somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জন্মদিনের পিঠা

২৪ শে জানুয়ারি, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রুহানের একটি ছোট্ট পুতুলের মত কন্যা জন্মিয়াছে। তাহা লইয়া তাহাদের পরিবারে আনন্দের শেষ নাই। শিশুটির একমাত্র জ্যাঠা থাকেন মার্কিনীদের দেশে আর একমাত্র মামা থাকেন ক্যাঙ্গারুদের দেশে। তাহার দাদু এখনও চাকুরীতে বহাল, বাবাও ভাল চাকুরী করিতেছেন। যাহাকে বলে একেবারে সোনায় সোহাগা। মেয়ের মুখে ভাতে হইয়াছে সোনার চামুচে। শিশুটির এক বছরের পুর্তির সময়টাতে মার্কিন মুলুক হইতে তাহার জ্যাঠা এবং জ্যাঠিমা আসিয়া হাজির। ঠিক করা হইল মেয়ের জন্মদিন করা হইবে ধুমধাম করিয়া, বাদ্য বাজাইয়া, পটকা ফুটাইয়া।

এই অনুষ্ঠান লইয়া তাহাদের পরিবারে আনন্দের শেষ নাই। কেহ কেহ নিজে দায়িত্ব লইয়া জন্মদিন পালনের জন্য চৈনিক রেস্তোরাতে ঠিক করিতে যান। কেহ কেহ জন্ম্যদিনে বিশেষ পিঠার আকার, আকৃতি, স্বাদ, চেহারা উহাতে কি লেখা হইবে তাহা লইয়া গবেষনায় মাতিয়া উঠেন। কেহ কেহ জন্মদিনের দাওয়াতপত্রের চেহার কিমত হইবে, তাহাতে কি ধরনের ছড়া লিখা যাইবে তাহা লইয়া বিস্তর ঝগড়া ঝাটিতে মাতিয়া উঠেন। অনুষ্ঠানে আগত শিশুদের কিছু উপহার দেয়া হোক - একজন মত দিলেন, এক দল ব্যাস্ত হইয়া পড়িলেন কি উপহার দেয়া যায় তাহার গবেষনায়। অনুষ্ঠানে সাজাইবার জন্য উপকরন কেনাকাটা, শিশুর চিত্র ছাপাইয়া নিয়া আসার একটা ছোটখাট প্রতিযোগীতাই হইয়া গেল।

শিশুটির জ্যাঠা মার্কিন মুলুক হইতে আসিয়া জিহবার সংযম হারাইয়া ফেলিয়াছে। হইবেইতো একে তো কাফের, নাসারাদের দেশে বাস করে তদুপরী রোজা রাখার মত গর্হিত অপরাধ সেই ব্যাক্তি জীবনেও করে নাই। মাকিনর্ী কালোদের আচার আচরন রপ্ত করিয়া ঠান্ডার মধ্যে আধখানা প্যান্টালুন পরিয়া ঘুরিতেছে। অসম্ভব জুতার দাম দেখিয়া জ্যাঠামশাই নাকি দুবছর ধরিয়া জুতা কেনে নাই। অনুষ্ঠানের পূর্বে তিনি প্রতিদিন একটি করিয়া জুতা খরিদ করিয়া আনিতে লাগিলেন এবং পরিয়া পরিয়া সবাইকে দেখাইতে লাগিলেন।

যে সমস্ত মুরগী ডিম পাড়ে, কিংবা কয়েকটি বাচ্চার গর্বিত মা তাহারা একরকম ঘাড়ের পালক ফুলাইয়াই চলাফেরা করে। কুটকুট করিয়া চাল খায়, মাঝে মাঝে করর করর করিতে থাকে। শিশুর জেঠিমার অবস্থা তদ্রুপ। শিশুটির দাদু তাই হাসিয়া তাহাকে মোরগা বউ বলিয়া ডাকেন।

না, সৈয়দ মুজতবা আলী হইবার কোন সাধ আমার নাই। থাকিলে শিশুটির দাদুকে আমি পন্ডিতমশাইয়ের রূপ দিতে চেষ্টা করিতাম। কিন্তু দাদুভাই সেরকমটি নন। তিনি তাহার মোরগা বউ এবং আরেক বউ অর্থাৎ শিশুটির মাকে যথেষ্ট আদর করেন। তাই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে তাহাদের উভয়কেই তিনি শাড়ি কিনিয়া দিলেন, যাহার প্রতিটির দাম পড়িল বঙ্গদেশীয় অর্থে ছয় হাজার মুদ্রা। শিশুর দিদিমাও বাদ গেলেন না।

অনুষ্ঠানের দিন সকাল হইতেই ব্যস্ততা। কেউ চৈনিক রেস্তোরাতে দৌড়াইতেছে সব ঠিক আছে কিনা দেখিতে, কেউ ছুটিতেছে সাজিবার জায়গায়, কেউ চৈনিক রেস্তোরাটিকে সাজাইবার জন্য দৌড়াইতেছে, কেউ কেউ জন্মদিনের পিঠা নিয়া আসিতে গিয়াছে, কেউ গিয়াছে গাড়ি ভাড়া করিতে - পরিবারের সকলে যাতে ঠিক মতো যাইতে পারে, কেউ কেউ গিয়াছে ভিডিও চিত্র করিবার লোকেদের ভাড়া করিতে। সে দেখিবার মতো এক হইচই বটে।

এরমাঝে মোরগা বউ, থুক্কু শিশুটির জ্যাঠিমা কোন এক সাজিবার স্থান হইতে প্যাঁচানো কেশ সোজা করিয়া আসিয়া অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের মাঝে ঘুরিতে লাগিলেন। সকলে তাহার সাজ-পোশাক দেখিয়া আহা উহু করিতে লাগিলেন। তাহা শুনিয়া তাহার করর করর আওয়াজ যেন আরও একটু বাড়িয়া গেল। শিশুর জ্যাঠাও তাহার বহুমূল্য জুতাখানা পরিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখাইতে লাগিলেন।

মুহর্ুমুহু ছবি, হাসি-ঠাট্টা, শিশুদের চিল চিৎকার, কান্না কাটির মাঝখানে জন্মদিনের পিঠা কাটা সমাপ্ত হইল। আগত অতিথিদের প্রথম দল খাওয়া দাওয়া করিয়া চলিয়া গেলে, দ্্বিতীয় দলের সাথে শিশুর নিকটাত্মীয়রা বসিলেন খাইতে। হাসি ঠাট্টার এক পর্যায়ে এক বেয়ারা আসিয়া জ্যাঠিমাকে বলিল, 'মা ঠাকুরুন, আমি একটা ব্যাগ পাইয়াছিলাম। তাহা আমি কার ব্যাগ জানিতাম না বিধায় আমি জিজ্ঞাসা করি। অনুষ্ঠানে আগত একজন তরুনী তাহার ব্যাগ দাবী করিয়া উহা নিয়া গিয়াছে।' এক্ষনে জ্যাঠিমার টনক নড়িল, সত্যইতো তাহার ব্যাগটাতো তাহার কাছে নাই। ব্যাগের মধ্যে আর কিছু নাই - কেবল একটি বহনযোগ্য কথা বলিবার যন্ত্র ছাড়া।

খাওয়া দাওয়া শেষ না হইতেই শুরু হইল তাহার অস্থিরতা। বহু চেষ্টা করিয়াও সেই কথা বলিবার যন্ত্রে যোগাযোগ স্থাপন করা গেল না। বোঝা গেল যিনি উহা নিয়াছেন তিনি বুঝিয়া শুনিয়াই নিয়াছেন। ইহার মধ্যে শিশুটির মেজ মাসী বুদ্ধি দিলেন যে বেয়ারাদের ভেতরের কেউই সেটা সুযোগ বুঝিয়া হাতাইয়াছে, মালিককে চাপ দিলেই কাজ হইতে পারে। ডাকা হইল মালিককে। আলোচনার এক পর্যায়ে পুরুষদের শৌচনাগার হইতে ব্যাগটিও পাওয়া গেল, অথচ তাহাতে যোগাযোগকারী যন্ত্রটি নাই। সন্দেহ আরও ঘনীভূত হইল। তদুপরী ঐ বেয়ারটিরই বা কি দায় পড়িয়াছিল যে ব্যাগ কুড়াইয়া 'কার কার' বলিয়া চেচাইবে, আর যাহার ব্যাগ সে যদি তাহা লইয়াই গিয়া থাকে তাহলে আবার আসিয়া জানাইবারই দরকার কি?

মালিক শেষ পর্যন্ত নিজের লোকদের যাচাই করিয়া দেখিতে রাজি হইলেন। দু একজনকে খুঁজিয়া দেখার পর, যোগাযোগকারী যন্ত্রটি মিলিল সেই বেয়ারার পায়ের মোজার ভিতর হইতে। মালিক তাহা দেখিয়া উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। আরও দু একজন তাহার সাথে তাল মিলাইয়া সেই বেয়ারাটিকে পিঠাইতে শুরু করিলেন। শিশুটির আত্মীয় স্বজন তাহাদের ঠেকাইয়া পারিয়া উঠিতেছিল না। এক পর্যায়ে মালিকটি কোমল পানীয়ের কাচের বোতল দিয়া আঘাত করিয়া তাহার মাথা ফাটাইয়া ফেলিলেন। দরদর করিয়া রক্ত পড়িতে দেখিয়া সকলে একটু থতমতই খাইয়া গেলেন।

শিশুটির দাদু এবং অন্যান্যরা মিলিয়া বেয়ারাটিকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করিয়া, বাকি পাওনা মিটাইয়া, বাঁচিয়া যাওয়া খাবার এবং পিঠা না নিয়াই যখন রেস্তোরা হইতে বাহির হইলেন তখন শহরে বিদু্যত চলিয়া গিয়াছে। রাস্তার পাশে অন্ধকারে দাঁড়াইয়া যখন তাহার গাড়ি আসিবার অপেক্ষা করিতেছেন তখন শিশুটির দাদুভাই জ্যাঠিমাকে জিজ্ঞেস করিলেন, 'জননী একটি অংক কষতো দেখি। তোমার বারো হাত শাড়ীর মূল্য যদি ছয় হাজার মুদ্রা হয় আর এই বেয়ারাটির বেতন যদি দু হাজার মুদ্রা হয় তাহলে তাহার পরিবার তোমার কয় হাত শাড়ীর সমান?'

না, আমি সৈয়দ মুজতবা আলী হইতে চাহি না, আমি পন্ডিতমশাই লিখিতেও বসি নাই। চোরের শাস্তি হইয়াছে আমি তাহাতেও ব্যথিত না, কেবল অন্ধকারে শিশুটির কিংকর্তব্যবিমূঢ় জ্যাঠিমা কান্নায় ভাসিয়া যাইতেছেন সেই কষ্টটাই আমাকে বার বার ছুঁইয়া যাইতেছে। এই দেশে আর কতবার প্রর্দশিত হইবে সেই একই নাটক?



(একটি সত্য ঘটনার অতিরঞ্জিন)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:১৬
২৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×