somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেশভাগ কি আরও কম রক্তস্নাত হতে পারতো? # রামচন্দ্র গুহ

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭ রাত ৮:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘দেশভাগ কি এড়ানো যেত না?’ এটাই নিঃসন্দেহে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত ও সমাধানহীন প্রশ্ন। ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে সব রকমের ভারতীয়দের মধ্য থেকে এই প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয়েছে এবং এর সব রকমের উত্তরও দেয়া হয়েছে। আরও একটি গুরুত্ববহ প্রশ্ন যা এখনও কমবেশি উচ্চারিত হয় তা হলো ‘১৯৪৬ বা পরবর্তীকালে দেশভাগ যদি অমোচনীয়ই হয়ে থাকে তবে তা আরও কম প্রাণক্ষয়ের মধ্য দিয়ে হতে পারতো না?’
১৯৪৭ এর ফেব্র“য়ারিতে লন্ডনের লেবার সরকারে ঘোষণা দেয়, তারা ১৯৪৮ এর জুনের মধ্যে ভারত ছাড়বে। তিনমাস পর নতুন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন প্রায় নাটকীয় ভাবে ভারত ত্যাগের সময় সংপ্তি করে আগস্ট ১৯৪৭-এ এগিয়ে আনেন। তার দরবারি জীবনীকার ফিলিপ জিয়েগলার এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিক দিক তুলে ধরেছেন, ‘যখনই দেশভাগের নীতি গৃহীত হয়েছে, তখনই বোঝা গেছে সাম্প্রদায়িকতা এখন মুক্তভাবে ঘৃণার উদ্গীরণ ঘটাবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘকালীন অপেক্ষা সবচেয়ে খারাপ ঘটনাগুলোকেই উৎসাহিত করবে, উদ্বেগ ও হানাহানি বিস্তৃত হবে। আজ এটা পাঞ্জাবে, কাল বাংলা কিংবা হায়দরাবাদে অথবা উপমহাদেশের অগণন সমাজের যে কোনো স্থানে ঘটতে পারে। এটা ঘটতে পারে সেখানেই, যেখানে হিন্দু ও মুসলমানরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবস্থান করছে। দুই শত বা দুই হাজার মৃত্যু সেখানে দুই মিলিয়ন বা বিশ মিলিয়নে পরিণত হতে পারে।
১৯৮৫ সালে জিয়েগলার জীবনীটি লিখলেও বাস্তবতা হলো, দেশবিভাগের মূল্য হিসাবে এক মিলিয়ন মৃতদেহ গুনতে হয়েছিল। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে, এটা ছিল আরও বেশি। প্রায় দুই মিলিয়নের কাছাকাছি। যেভাবে পরিকল্পিত হয়েছিল, সেভাবে সেই জুন ১৯৪৮-এ ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করলে এই সংখ্যা কততে দাঁড়াতো? মাউন্টব্যাটেনের কাজের একটি আক্রমণাত্বক সমালোচনায় অ্যান্ড্রিউ রবার্টস তাকে নমনীয়তা ও দোদুল্যমানতার জন্য অভিযুক্ত করেছেনÑ
‘যখনই শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলার সময় এসেছে, তখনই মাউন্টব্যাটেন মেরুদণ্ডহীনের পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন’Ñ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কার্যকর হস্তক্ষেপ করার অনিচ্ছায়, আরও স্পষ্ট করে বললে পাঞ্জাব সীমান্ত বাহিনীকে কাজে না লাগিয়ে এবং একে বিমান বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট না করে। জিয়েগলারের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েও রবার্টস মনে করেন ‘তাড়াহুড়ার প্রত্যাহার’ তবু ‘কিছু কম প্রাণক্ষয় সম্ভব করে তুলেছে।
মাউন্টব্যাটেনের কর্মকর্তারা তাকে আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল, পাঞ্জাবই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সেখানে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হতে পারে। কিন্তু সময় যখন এলো তখন দাঙ্গা দমনে যথেষ্ট সৈন্য মোতায়েন করা হলো না। এর পেছনে ছিল একটাই কারণ, শাসক ব্রিটিশরা চলে যাচ্ছে এ ঘোষণা জনসম্মুখে প্রচারিত হলে তারা আক্রমণের শিকার হবে। এই ভয় তাদের মনে গেঁড়ে বসেছিল। এই ধারণাটি বহুলভাবে ব্রিটিশ কর্মকর্তা, জাজক, বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল। ১৯৪৬ এর গ্রীষ্মে একজন তরুণ ব্রিটিশ কর্মকর্তা তার পরিবারের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছিল সে কোন দৃষ্টিতে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগকে দেখছে, ‘ঘটনা শুরুর পূর্বে পুরো দেশটাই ভাবগতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে গেছে (যা আমাদের ছড়ানো-ছিটানো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীকে সবখান থেকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম)। কিন্তু যখন তা সত্যিই ঘটতে শুরু করবে তখন তা হিন্দু-মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতার বাইপ্রোডাক্টে পরিণত হবে।’
শেষ দিনগুলোতে শাসকের নীতিই ছিলÑ সর্বাগ্রে ব্রিটিশ জীবনের সুরা নিশ্চিত করা। ১৯৪৭ সালের ফেব্র“য়ারিতে বেঙ্গলের গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারোজ বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ মতা প্রত্যাহারের তারিখ ঘোষণার পর তার প্রথম পদক্ষেপ হবে...সেনাসদস্যদের সতর্ক রাখা এবং জনতা সহিংস হওয়ার আগেই যথাসম্ভব কম সময়ে ছড়ানো-ছিটানো ইউরোপীয়দের একত্রিত করা।’
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৯৪৭-এর গ্রীষ্মে একজন শ্বেতকায় নারী বা পুরুষই ছিল ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ লোক। তাদের হত্যা করে কারও কোনও ফায়দা হতো না। কিন্তু তাদের কল্পনাপ্রসূত নিরাপত্তাহীনতার কারণে অন্য স্থানে দাঙ্গা প্রতিরোধে নিয়োজিত না রেখে ইউরোপীয় আবাসগুলোর পাশে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল।
নিজেদের সুরার নীতি থেকে স্বাধীনতার তারিখ ঘোষণার পর পর্র্যন্ত পাঞ্জাব সীমান্ত চিহ্নিতকরণও বন্ধ রাখা হয়েছিল। পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার ইউয়ান্স জেনকিনস নিশ্চিত ছিলেন, নির্ধারিত হওয়ার পরই সীমান্ত সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়া হবেÑ এতে ডিস্ট্রিক্ট অফিসাররা ডমিনিয়নের পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে এবং ভারতীয়দের ভারতে রাখতে সম হবেন। অন্যদিকে সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে একত্রিত করা হচ্ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে। সীমান্তরেখা চিহ্নিতকরণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ ৯ আগস্টেই প্রস্তুত ছিলেন। তারপরও পনের আগস্টের পরই ঘোষণা দিতে চেয়েছেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভাইসরয়ের তরফে দেরির কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা ছিল অদ্ভূত, ‘প্রশ্নহীনভাবে বলা চলে, আগেই যদি এটা প্রকাশিত হতো তবে ব্রিটিশদেরকেই এ অপ্রতিরোধ্য ফলের দায় বহন করতে হতো।’ এতদসঙ্গে ‘ এর প্রকাশনা স্থগিত হওয়ায় ব্রিটিশদের ওপর কম বিক্ষোভ প্রদর্শিত হবে।’ অর্থাৎ স্থানীয় পুলিশের ওপরই দেশভাগ এবং স্বাধীনতা জনিত ভয়ংকর পরিস্থিতির দায় চাপাও।
রীতি অনুসারে, ইতিহাস সেভাবেই লেখা উচিত যেভাবে তা ঘটেছে, সেভাবে নয় যেভাবে ঘটা উচিত ছিল। আরও বর্ধিত সময়ের কলেবরে একবছর সময় হাতে নিয়ে যদি ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে দেশত্যাগের ঘোষণা দেয়া হতো তবে কি তা কম বেদনাদায়ক হতো? পাঞ্জাব সীমান্তে বেশি সংখ্যক সক্রিয় সেনা মোতায়েন করলে এবং র‌্যাডকিফের সীমান্ত রেখা চিহ্নিতকরণের ঘোষণা আগেভাগে দিলে কি পাঞ্জাবে কম রক্তপাত হতো? হয়তো, হয়তো নয়।
পাঞ্জাবের একজন কর্মকর্তা অক্সফোর্ডের এক সমাজকর্মীকে যা বলেছিলেন তা-ই হয়তো ব্রিটিশ রাজের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে মোক্ষম এপিটাফ, ‘তোমরা ব্রিটিশরা পরিচ্ছন্ন লেনদেনে বিশ্বাস করো। তোমরা ভারত ত্যাগ করেছিলে একে সেই গোলযোগপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছে দিয়ে ঠিক যে অবস্থায় একে পেয়েছিলে তোমরা।’
সূত্র : দি হিন্দু
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭ রাত ৮:৫৪
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×