somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈচিত্র্যের উৎসব # উইলিয়াম ডালরিমপেল

০৯ ই অক্টোবর, ২০০৭ দুপুর ১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একুশ বছর আগে ভারতে আমার প্রথম সফরের সময় এক শুত্রক্রবার ফতেপুর সিক্রির মসজিদে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেবার মসজিদের উঁচু খিলান বিশিষ্ট প্রবেশ পথের ওপর আমি আরবি ক্যালিগ্রাফিতে একটি বিশেষ বাণী খোদিত দেখি। তাতে লেখা, ‘মেরির (তার ওপর রহমত বর্ষিত হোক) পুত্র যীশু বলেছেন দুনিয়া একটি সেতু। একে অতিক্রম করে যাও, কিন্তু এর ওপর কোন গৃহ তৈরি করো না। যে একটি দিনের জন্য আশা করতে পারে, হয়তো সে আশা করতে পারে অনন্তেরও, কিন্তু দুনিয়া তো নিঃশেষ হয়ে যাবে এক লহমায়। অদেখা অনন্ত সময়টার অপেক্ষার এই সময়টুকু প্রার্থনায় ব্যয় করো।’
কথাটি পুরোটাই অপরিচিত। পড়ে মনে হয়, যিশুই এটি বলেছেন। কিন্তু সত্যই কি তিনি বলেছেন পৃথিবী একটি সেতুর তুল্য? এবং কেনই বা একজন মুসলিম শাসক তার রাজধানী শহরের প্রধান মসজিদের প্রবেশ পথে এমন একটি খৃষ্টীয় বাণী খোদাই করলেন?
ষোড়শ শতকের মোগল সম্রাট আকবর এই শহর ও মসজিদ দুটোই তৈরি করেছেন। তিনি ছিলেন খুবই কৌতুহল উদ্দীপক চরিত্র। তিনি শুধু তার দাদা এবং বাবার কাছে থেকে উত্তারধিকার সূত্রে পাওয়া অবিন্যস্ত সাম্র্রাজ্যকে সুবিন্যস্তই করেননি, তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পরসিক, দার্শনিক, ধর্মগুলোর সহনশীল মতাদর্শের সমঝদার। তার শাসনকাল যুদ্ধের চেয়ে বেশি কৌশল ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছিল। ধর্মগুলোর পারস্পারিক সংঘর্ষ দেখে এবং বাস্তব রাজনৈতিক বিচার বোধ থেকে তিনি এই রীতি উদ্ভাবন করেন, যা মোগল শাসনকে সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অমুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে স্বতোপ্রণোদিতভাবে গ্রহণযোগ্য করতে পারে। নতুন রাজধানী শহরের কাজ শুরুর পর আকবর সার্বিক সহনশীলতার উপযোগী একটি বিধান জারি করেন। জোরপূর্বক মুসলিম ধর্মান্তর নিষিদ্ধ করেন। সংস্কৃত ক্লাসিকগুলোকে ফার্সি ভাষায় অনুবাদের নির্দেশ দেন। রাজকার্যের উচ্চ পদগুলোতে হিন্দুদের নিয়োগ করেন। এমনকি তার পূর্বশত্রু রাজা মান সিংহকে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দেন।
এ কথাগুলো আবার মনে পড়ল নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নতুন প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘ দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’-এ আকবরের প্রসঙ্গ পড়ে।
অমর্ত্য সেন আকবরকে আধুনিক ভারতীয় ধর্মনিরপেতা এবং গণতন্ত্রের অন্যতম পথিকৃতের সন্মান দিয়েছেন। তিনি তর্ক শুরু করেছেন একটি সাধারণ সূত্র থেকে যে, পাশ্চাত্য হলো ধর্মীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সূতিকাগার; আবার প্রাচ্যের একটি উজ্জ্বল ঐতিহ্য আছে নীতি নির্ধারণে জনমতের গুরুত্ব বিবেচনার ক্ষেত্রে। হোক সেটা সরকার বিষয়ে কি ধর্মীয় সহনশীলতা বিষয়ে। অন্যদিকে, আকবরের সময়কালের ক্যাথলিক ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা ছিল নিষেধাজ্ঞার অধীন। সে সময় ইতালীয় দার্শনিক জিওদার্নো ব্রুনোকে রোমে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। অথচ আকবর বলেছেন, ‘কোন মানুষকেই ধর্মীয় কারণ দর্শিয়ে দোষারোপ করা যাবে না। যে কারও স্বাধীনতা আছে সে যে ধর্ম সে পছন্দ করে তা গ্রহণ করার।’
আকবর ফতেপুর সিক্রি তৈরি করেছিলেন তার আধ্যাত্মিক ধারণাকে পাথরের ভাষায় অনুবাদ করতে। তিনি সচেতনভাবে হিন্দু ও মুসলিম উপাদান এবং রীতিগুলোর মিশ্রন ঘটিয়েছিলেন এবং এগুলোকে পরিণত করেছিলেন আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের দার্শনিক পরীক্ষাগার হিসাবে। সারা ভারতের বিভিন্ন ধর্মের সন্মানীত ব্যক্তিদের এই শহরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বক্তব্য দেওয়ার জন্য। এদের মধ্যে ছিল গোয়ার পর্তুগিজ জেসুইট ফাদারদের একটি দল এবং হিন্দু নিরীশ্বরবাদীরাও। এই উপায়ে আকবর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম বহুধর্মীয় আলোচনা দল। এর মাধ্যমে হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, জৈন, ইহুদী, পার্সিরা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন এবং আলোচনা করতে পেরেছিলেন কেন ও কীভাবে তারা পরস্পরের থেকে আলাদা এবং কীভাবে তারা একই সাথে বসবাস করতে পারেন।
যে দরবারে এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতো সেই দিওয়ান-ই-খাস, এখনও অক্ষত আছে। এর কেন্দ্রে আছে চারিধারে পাটাতন বেষ্টিত একটি অলংকৃত স্তম্ভ। এখান থেকে চারটি পথ বের হয়ে ভবনের চার কোনায় চলে গেছে। চারটি কোনাতেই রয়েছে চারটি পাটাতন। আকবর কেন্দ্রে রেশমশোভিত কুশনে বসতেন আর বিভিন্ন বিশ্বাসের বুজুর্গ ব্যক্তিরা বসতেন চারটি কেন্দ্রে।
কেন আমরা আজ খবর নেব একজন মোগল বাদশা ৪৫০ বছর আগে কী ভেবেছিলেন?
উপর থেকে দেখলে, এশিয়া একটি সম্ভাবনাময় এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পরিণত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরও অনেক দিক থেকে এই অঞ্চলটি রয়ে গেছে আদিম, যাকে পূর্বতন বিভাজন ও অন্ধ বিশ্বাস তাড়া করে ফেরে। পারমাণবিক শক্তিধর উত্তর কোরিয়া পরিষ্কারভাবে একটি হুমকিতে পরিণত হয়েছে। চীন জাপানের জাতীয়তাবাদীরা প্রস্তুত একটি ঠাণ্ডা যুদ্ধের জন্য। দক্ষিণ থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ও মুসলমানরা অস্ত্র ধারণ করেছে, যেমনটা করছে মিয়ানমার এবং লাওসের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। দক্ষিণ এশিয়ার চাঁই ভারত ও পাকিস্তান হয়তো সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করার উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু একগুঁয়ে ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসা কখনওই অগ্নুৎপাতের সম্ভাবনা নাকচ করে দেয় না। এই পুরো অঞ্চলটিতে ছোট ছোট কিন্তু ভয়ংকর ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী ছড়িয়ে রয়েছে। যারা কুরআনকে মানে না তাদের ওপর এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো হামলে পড়তে পারে কুরআনের সংকীর্ণ ও বিকৃত ব্যাখা দিয়ে।
এই সার্বিক পরিস্থিতিই বলছে, আকবরের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বাণীকে যে কোন সময়ের থেকে অনেক গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার সময় এসেছে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রাচ্য হোক কি পাশ্চাত্য, মাদের ঐতিহ্যে মধ্যেই প্রোথিত আছে সহনশীলতা এবং জনবিতর্কের রীতি। এশিয়ার ইতিহাসের বর্তমান সময়ে, আশাহত হবার মতো অনেক ঘটনা থাকলেও এখনও অনেক কিছুই অর্জন করার আছে। এটাই অন্তর্গত শিক্ষা। একে কখনওই ভোলা যাবে না।
উইলিয়ম ডারলিমপেল হোয়াইট মোগল: লাভ এন্ড বিট্রেয়াল ইন এইটিন সেঞ্চুরি ইন্ডিয়া, দি লাস্ট মোগল গ্রন্থের লেখক। ইতিহাসবিদ।

২০০৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। ডেট মনে নেই।
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ

১৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×