‘মানুষের মাংস মিষ্টি। যে বাঘ একবার এর স্বাদ পেয়েছে সে সারাক্ষণ মানুষের ধ্যানেই থাকে। ১৯৯০ এর দশকে একটি বাঘের ক্ষপ্পরে ৮৪জন মানুষ নিহত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা বাঘটিকে মেরেছিলাম।’ বলেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের এই ম্যাংগ্রোভ বনভূমিতে কর্মরত বন বিভাগের এক কর্মকর্তা। জঙ্গল ও হাজারো ক্রমবর্ধমান চিংড়ি খামারের মধ্যে চাপা পড়া এক লাখ গ্রামবাসী বাঘের ভয়ের মধ্যেই মাছ ধরে, কাঠ কাটে, মধু সংগ্রহ করে। ত্রিশ বছর ধরে মধু সংগ্রহের পেশায় জড়িত মোহাব্বত আলী বলেন, ‘আমাদের অন্য কোনো উপায় নেই। আমরা গরীব মানুষ। বেঁচে থাকার জন্যই জঙ্গলের উপর আমদের নির্ভর করতেই হয়।’
সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম উপকূলবর্তী ম্যাংগ্রোভ বনাঞ্চল। ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে এটি ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনে বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া সুনামি আর মুহুর্মুহু সাইক্লোন থেকে ভূমিকে রক্ষা করে এ বন। গ্রামের অনেক অধিবাসী সংরক্ষিত এই বনে প্রবেশ করে : গাছ কাটে, নৌকা বানায়। সে কাঠ ফ্যক্টরিতে সরবারহ করে আসবাব বা বিল্ডিং তৈরি করতে। জেলেরা কাঁকড়া, চিংড়ি ও সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে।
সবচেয়ে কষ্টকর কাজ করে মধু শিকারীরা। মৌমাছির চাক এত ঘন জঙ্গলে থাকে যে অনেক সময় হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়। নৌকা ভাড়া করে বিস্তৃত, পতিত, কর্দমাক্ত ও লবণাক্ত পানির নদী বা জলখাত বেয়ে বনের হাজারো দ্বীপে পাড়ি জমাতে হয় তাদের। নিজেদের নৌকা না থাকায় নৌকা ভাড়া করতে প্রতি বৎসরে প্রচুর টাকা দেনা হয় তাদের। ঘর ছাড়তে হয় নৌকায় তিনমাসের খাবার নিয়ে। বনে বিভাগের কর্মকর্তাদের খাইও মেটাতে হয়। মধু শিকারীদের সবকিছু ধার-দেনায় চলে। এমনকি তাদের জীবনও বনদস্যু, বন্য শ্বাপদদের কাছ থেকে ধার নেওয়া। আছে পাইথন, গোখরা, কুমীর, রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তবু তরল সোনার প্রলোভন এতটাই শক্তিশালী যে সব ভয়ের চেয়ে সেই প্রলোভন বড় হয়ে ওঠে।
আব্দুল গফুর গাজী মধু সংগ্রহের সময় বাঘের আকস্মিক আক্রমণের শিকার হন। তার পিঠে থাবা দিয়ে তাকে কুপোকাত করে ফেলে বাঘটি। তিনি সেখানেই মারা যান। তার বিধবা স্ত্রী জাহানারা আক্তার বকুল বলেন, ‘ আমি তাকে গভীর বনে যেতে মানা করেছিলাম। খুব ভয়ংকর কাজ এটা। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছে।’ এখন তাদের সংসার চলে ১০ থেকে আঠার বছরের তিন সন্তানের আয়ে। তারা মাছ ধরে। তারা দিনে ৫০-৬০ টাকা আয় করে। মৃত স্বামী এর দ্বিগুণ আয় করতেন মধু সংগ্রহ ও বনের অন্য কাজ করে।
সুন্দরবনের বন্য মধু সুপারমার্কেটের স্যান্ড উইচে শোভা পায় না। এর রঙ দেখতে ঘন বাদামী হলুদ। সূর্যালোকে ছড়ায় উজ্জ্বল সোনালি বর্ণ। বরফমিশ্রিত ওয়াইনের মতো এর ঘন। ছড়ায় ল্যাবেন্ডার আর ওকের মিলিত সৌরভ। অন্য মূল্যবান পণ্যের মতোই এর অধিকাংশটাই স্থানীয় বাজারে ওজন করে বিক্রি হয়। গাবুরার মধু ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান এক কিলো মধু মাত্র দুই ডলারে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, তার কিছু ক্রেতা এই মধু নিয়ে যায় সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগরীয় নানা দেশে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, নবজাতকের মুখে এক ফোঁটা বন্য মধু দিলে কয়েক বছর সে সুস্থ থাকে। বাংলাদেশের মাত্র কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি সুন্দরবনের মধু কফের সিরাপ তৈরির কাজে ব্যবহার করে। অনায়াত্ত এই যাদুতরলকে বোতলজাত করার চেষ্টাও সামান্য।
সহনীয় লবণাক্ততার সামুদ্রিক জলে শেকড় গেঁথে ম্যাংগ্রোভ প্রজাতির গাছগুলো ৭০ ফুট বা তারও বেশি বাড়ে। দ্বীপের মাটিতে বালু ও ধূসর কাদার স্তর জমে হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর স্রোতের মাধ্যমে।
মৌমাছি খুঁজতে বাঘ ছাড়া অন্য যে সমস্যার মুখে পড়তে হয় তা হলোÑগাছের শামিয়ানা। খালি হাতে গাছের পাতা জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছড়াতে হয়। যাতে চাক থেকে দূরে সরে যায় রাগান্বিত মৌমাছিরা। এই সুযোগে চাক কেটে মধু নেয়া যায়। এই কাজে দরকার ধৈর্য আর ঐতিহ্যলালিত জ্ঞান। প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা এই মৌমাছি এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ প্রজাতির। পশ্চিমা মৌমাছির মতো কুঠুরি তৈরি করে না এরা। পাথর বা গাছের ডালে খোলা চাক তৈরি করে। যা কয়েক কয়েক ফুট লম্বা। চাক রক্ষা করতে মৌমাছিরা প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করে। খুব কম মৌয়ালীই এদের হুল থেকে বাঁচতে পারে।
‘খুব ব্যথা করে। যদি খুব গভীরভাবে হুল গোঁথে যায় তবে প্রচণ্ড জ্বর আসে, বমি হয়। এদের হুলে বিষ থাকে। ফোটানো হুল বের করতে গেলে সাথে রক্ত বেরিয়ে আসে। একটি মৌমাছি হুল বেঁধাতে পারলে সেটি অন্য সব মৌমাছিকেও ডেকে আনে। সবাই এক সঙ্গে হামলা করে হুল বেঁধায়।’ এতে হয়তো মৃত্যু হয় না কিন্তু একজন মধু শিকারীর দিনটা মাটি করার জন্য এটাই যথেষ্ট। বলেন মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ১৯ সদস্যের সংসার চালান স্রেফ মধু সংগ্রহ করে।
মালি নামের এক বয়োবৃদ্ধের সব দাঁতই পড়ে গেছে। ইনি চার আত্মীয়কে হারিয়েছেন বাঘের আত্রক্রমণে। তারপরও মধুসংগ্রহের কাজ ছাড়তে চান না। আকাশের দিকে হাত তুলে মালি বলেন, আল্লার নাম নিয়ে আমরা প্রত্যেকবার জঙ্গলে ঢুকি। গাবুরার মতোই হাজার বদ্বীপ তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠে। তারপরও মালির মতো লোকেরা জঙ্গলে তাদের জীবন বাজি রাখছেন। কারণ কৃষিজমি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
গত ২০ বছর যাবত চিড়িং রফতানিকারকরা হাজার হাজার ধান ক্ষেত এবং জমি লবণাক্ত পানি প্লাবিত করে নষ্ট করছে ঘের তৈরির কাজে। এটা এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি পণ্য। বিক্রি হয় প্রধানত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। আয় হয় বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এই শিল্পে কাজ করে প্রায় ৬ লাখ মানুষ। এদের অধিকাংশই প্যাকিং, ফ্রিজিং ও শিপিং-এর কাজে জড়িত। অধিকাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রই পঞ্চাশ মাইল দূরের খুলনায় অথবা ১০০ মাইল দূরের চট্টগ্রাম শহরে। গ্রামবাসীদের মতে, এসব কাজে জড়ালে ঘর ধ্বংস হয়ে যাবে। পাবিবারিক বন্ধন থাকবে না। তাই এই মানুষগুলোর সামনে অরণ্যনির্ভর কাজের বিকল্প নেই। স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুল হক বলেন, ‘চিড়িং ব্যবসায়ীদের কাছে জমি লিজ দিয়ে আমরাই পরিণত হয়েছি এর সবচেয়ে খারাপ শিকারে। তাদের দেয়া টাকা দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জমিটিতে আর কখনোই গাছ বা সব্জি জন্মায় না। এটা ঠিক, মানুষ জঙ্গলে যেতে চায় না। কিন্তু ক্ষুধা তাদের বাধ্য করে।’
কিন্তু মধু সংগ্রাহকদের কঠিন পরিশ্রমের মূল্য জোটে সামান্যই। মালি ও তার গ্রুপ ৩০০০ পাউন্ড মধু সংগ্রহ করে স্থানীয় এক দালালের কাছে মাত্র ১৭০০ ডলারে বিক্রি করেছে। বনবিভাগের বখরা ও অন্যান্য খরচ মেটানোর পর টাকা নয় সদস্যের গ্রুপে ভাগ-বণ্টন করা হয়। মোট টাকার এক দশমাংস চলে যায় নৌকা ও খাবার জোগানদাতার পকেটে। মালির কাছে থাকে একটি কষ্টকর মাসের আয় হিসাবে মাত্র নব্বই ডলার। এই টাকায় তাকে বৎসরšপর্যন্তø চলতে হয়। অন্যদিকে চিংড়ি কারখানায় কাজ করে একজন শ্রমিক মাসে আয় করে ৩০ ডলার।
মিজানুর রহমান এ অঞ্চলের মধু ব্যবসার বড় মধ্যস্বত্ব ভোগী। তিনি ১৫টি দলের কাছ থেকে বখরা পান। গতবছর এই খাত থেকে তার লাভ হয়েছে ৩ হাজার ডলার। ইনি সারা বছর টেবিল-চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে এই আয় করেন। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো অপরাধবোধ নেই। তার মতে, ‘ মৌয়ালীদের টাকা ধার দেয়ার রিস্ক মেলা। নৌকা ডাকাতের কবলে পড়ে, চার পাঁচটা নৌকার কোনো আয়ই হয় না। বাঘেও অনেককে খেয়ে ফেলে। আমার টাকা নিয়ে ছয়সাত জন বাঘের পেটে চলে গেছে।’
১৯ ডিসেম্বর ২০০৫ এর লস এ্যাঞ্জেলস টাইমস থেকে।
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৬:৫০