ঢাকা শহরে অল্প কয়েক বছর ধরে থাকছি। এই অল্প সময়ের মধ্যে ২১ আগস্টের মতো বিকাল, রাত ও সন্ধ্যা খুব কমই দেখেছি। আরও এক ভয়ংকর দিন ও ভয়ংকর রাত দেখেছিলাম আরেক ২১,২২,২৩ আগস্ট। তখন আজকের কাগজে কাজ করি। ২০০৪ সাল। আমার বন্ধু শুভাশিস সিনহা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে নাটকের দল নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় মহিলা সমিতিতে তারা নাটক পরিবেশন করবে। দুপুরে ফোনে কথা বলে ঠিক করেছি নাটকের আগে দেখা হবেই হবে। গ্রেনেড হামলার খবর শুনলাম মীনা হাউজের নিচে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে। দেখলাম, অফিস থেকে সবাই নেমে আসছে। তাকিয়ে আছে পূর্বদিকে। যেন একটু চেষ্টা করে গলা বাড়ালেই দেখতে পাবে মানুষের ক্ষত-বিক্ষত চেহারা। দেখলাম, সবাই হতচকিত। ফোন করছে সবাই সবাইকে। খবর নিচ্ছে। খবর দিচ্ছে। আমরা দ্রুত অফিসে ঢুকে টিভির সামনে দাঁড়ালাম। বিশেষ বুলেটিন দেখানো হচ্ছে। মনে আছে, এনটিভির বুলেটিনে গ্রেনেড পড়ার ছবি দেখা যাচ্ছিল। একটার পর একটা খবর দেখে আবার নিচে নেমে এলাম। আলো কমে এসেছে। হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মতো করে পুরো ঢাকা শহর তার গাড়ি, বাসসহ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুভাশিস ফোন করলো। বললো, এখন কী হবে। তুই আসবি একটু। লোক হোক না হোক নাটকটা বাতিল করতে চাচ্ছে না আয়োজকরা। আমি একটা রিকশার চেষ্টা করতে থাকলাম। না কেউ যাবে না। হাতেপায়ে ধরে একজনকে রাজি করানো গেল। সামান্য কয়েকজন দর্শকের সামনে নাটক হলো। তারপর পুরো নাটকের দলটিকে আমরা কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে দিলাম। ঢাকা শহর তো আর নিরাপদ নয়। এবার বাড়ি ফেরার পালা। শুভাশিসের কাছে বিদায় নিয়ে অসম্ভব উৎকণ্ঠার মধ্যে কীভাবে বাড়ি ফিরেছিলাম আর মনে করতে পারি না।
আমি সে রাতে মানুষের মুখ দেখেছি অনেক। সে কী ভাবছে তা বোঝার চেষ্টা করেছি অনেক। দেখেছি, তালগোলপাকানো একেকটা মানুষ, শুধু ফিরতে চাইছে। তাড়াহুড়া করে শুধু ফিরতে চাইছে।
প্রথম আলোর ২১ আগস্ট নিয়ে আয়োজন পড়লাম আজ। ২১ আগস্ট কি ইতিহাস হয়ে গেছে? স্মৃতি হয়ে গেছে? নিশ্চিত হতে পারলাম না। এই তো সেদিনও কোনো ভীড়ের মধ্যে ঢুকলেই প্রচণ্ড ভয় হতো। মনে হতো এই ভীড়ের মধ্যে মৃত্যু ওঁৎ পেতে আছে। গ্রেনেড হাতে। এখন কি সেই গ্রেনেড হাতের মৃত্যুকে আমরা মেরে ফেলেছি। পেরেছি কি? আমাদের জানা নেই। একটাই শুধু কামনা, ওই অসম্ভব ভীতি, উৎকণ্ঠা নিয়ে আর সচকিত হয়ে চলতে চাই না।
একটা জিনিশ বিশেষভাবে মনে আছে, ২১ আগস্ট কেউ প্রতিবাদ করেনি। ভয়ে সবাই কোথাও ফিরতে চাচ্ছিল। যেখানে হয়তো নিরাপত্তা আছে।