somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পল সেজাঁ

২৭ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফরাসী রূপবাদ বা উত্তর রূপবাদ থেকে কিউবিজমে উত্তরনের ক্রান্তিকালে যে দু'জন প্রভাবক ও নির্ণায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন তার একজন আঁরি মাতিস আর অন্যজন পল সেজাঁ। বিশেষতঃ সেজাঁই কিউবিস্টদের প্রভাবিত করেছিলেন সবচে' বেশি। ১৮৫০এর পর কিছু চিত্রকর আর তুলনামূলক বেশি সংখ্যক লেখক মধ্যবিত্ত বিশ্বদর্শন কে অভিযুক্ত করলেন জ্ঞান আর মননের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী রেখায়। নতুন বুর্জয়া অর্থিনীতির বিকাশের ফলে সৃষ্ট শ্রমশিল্পনির্ভর সমাজের যেসব নতুন ব্যর্থতা হতাশা বোধি দ্যোতনা নাগরিক নিরাষক্তি ইত্যাকার সবকিছু যা তাদের পূর্বসুরিরা বেমালুম অস্বিকার করে গেছেন তার প্রতি তাদের অনুরক্তি প্রকাশ করলেন তারা


কিন্তু শুরুতেই এক সমস্যা, তাদের বক্তব্য নয় , তাদের শ্রোতা-পাঠক-দর্শকেরাই সে সমস্যার মূলে। তারা যা বলছেন তা কাদের প্রতি বলছেন, বক্তব্যের মর্ম মূলে পৌছাবার যোগ্যতা তাদের আছে কিনা সে প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিল। অষ্টাদশ শতক থেকে শ্রোতা-পাঠক-দর্শকেরা ছিল মূলতঃ একটি ক্ষুদ্র অভিজাত উচ্চশিক্ষিত গোষ্ঠি- ; এরা ছিল ওসব সুকুমারকলার সমঝদার ও পৃষ্টপোষক। রেমব্রান্ট-রুবেন্স-ভেলাস্কেথের ছবি দেখার বা উপভোগ করার সামর্থ সুযোগ বা ক্ষমতা কোনটাই ছিলনা একজন আমনাগরিক বা গ্রামীন চাষীর,তারা রাজসভার চিত্রকর, কেউকেউ রাজদূত বা মন্ত্রি। গ্যোতে বায়রন ভলত্যর টেনিসন বা দেভি দ্যলাক্রয়া আঁজে-রা ছিল সামন্ত সমাজের ওপরতলার মানুষ, কেউ রাজকবি, কেউ ব্যরন, কেউ ফরাসী বিপ্লবের পর গুরুত্বপুর্ণ নাগরিক বা সম্রাটের ধামাধরা, তাঁদের কাছে জনগন নিকটবর্তি হলেও তাঁরা জনগন থেকে দূরবর্তি। কিন্তু শ্রমশিল্পনির্ভর সমাজে অক্ষরজ্ঞানের বিস্তার হল প্রচন্ড দ্রুততায়, ১৮৫০ এ যেখানে ইউরোপের অর্ধেক লোক ছিল অশিক্ষিত সেখানে পরবর্তি কয়েক দশকে অবস্থার হল নাটকিয় পরিবর্তন, এবং ১৯০০ নাগাদ ইউরোপের ৮৫ শতাংশ লোকের মাঝে অক্ষর জ্ঞান বিস্তার হল। এই নতুন শ্রমশিল্পনির্ভর সমাজের অধিক সংখায় অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন জনগোষ্ঠি প্রয়োজন ছিল স্বাভাবিক কারণেই। পুঁজিবিকশিত রাষ্ট্রগুলো নিজস্ব অর্থায়নে বিনামুল্যে প্রথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করল যার উদ্যেশ্য এই শ্রমশিল্পনির্ভর সমাজের তীব্র গতীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারা,শহর কেন্দ্রিক নাগরিকতাবোধ আর রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি যা রাষ্ট্রকে দেবে আভ্যন্তরিন (প্রলেতারিয়া আর শ্রমিক থেকে) ও বাহ্যিক(অর্থনৈতিক সামরিক প্রতিদ্বন্ধি দেশ থেকে) নিরাপত্বা আর সেই সাথে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষকে দেবে শক্তি। এ নতুন শিক্ষিত জনগষ্ঠির সাংস্কৃতিক চাহিদা অনস্বিকার্য, তাই শ্রমশিল্পনির্ভর পুঁজিবিকশিত দেশগুলোতে তৈরি হল সংবাদপত্রপাঠক মধ্যবিত্ত শ্রেনীর। এই নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উচ্চমার্গিয় সংগীত দর্শন শিল্পকলা অনুধাবন করার যোগ্যতা ছিল না পুঁজির পেছনে দৌড়াতে থাকায় সুজোগও ছিলনা । এ কারনে ওই পুঁজিবাদী প্রকাশকেরা নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনির চাহিদা আগ্রহ আর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারেই সবকিছু ছাপাতেন প্রচার করতেন, আক্ষরিক অর্থেই 'জনগনের সংসদ' হয়ে ওঠেন তারা এবং এ ধারা এখনো বিদ্যমান। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাংস্কৃতিক চাহিদা মেটাতেই তারা করতেন সুঁরসুরি-সাংবাদিকতা, লিখতেন মশলাদার কলাম আর সহজপাঠ্য ধারাবাহিক। দূঃখজনক হলেও সত্য এই সাংস্কৃতিক মানের সদস্যরাই নতুন লেখক-শিল্পকলাকারগনের উদ্দিষ্ট।


এসব সহজ পাঠ্য ধারাবাহিকে সৃষ্টি হল নতুন এক জাতের কলম সৈনিক, তারা নানা রকম রোমাঞ্চকাহিনী যেমন মঙ্গল গ্রহবাসীর আক্রমন,৮০ দিনে দুনিয়া ভ্রমন নানা গোয়েন্দাকাহিনী লিখে বেশ নাম কুড়াতে থাকেন।এরা নব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেনীর কল্পনাবিলাসী প্রবণতাকে উসকে দিতে থাকেন, অপররিণত মানসের ফ্যন্টাসিকে কাহিনীতে পরিণত করে তারা হয়ে উঠেন প্রবল জনপ্রিয় -যে জনপ্রিয়তা এখনো অক্ষুন্ন আছে। আর তাদের চিত্রকলার পিপাসা মেটাতে থাকে 'পাঞ্চ' ম্যাগাজিন সুলভ কার্টুন, নব্যাবিষ্কৃত ফটোগ্রাফি প্রভৃতি। এ সবই নবজন্মপ্রাপ্ত অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মধ্যবিত্ত দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ।

এমনি অবস্থা চিত্রকর লেখক দের সাধারণ মামুলি ইতর অমার্জিত স্থূল বিষয়ী রুচি থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করল। শিল্পের উদ্দেশ্য দালালি বা ভাবপ্রবনতা সৃষ্টি করা নয় জনগনকে নৈতিকতার বুলি শেখান বা শুভবুদ্ধি উদ্রেককেরী ক্লান্তিকর ধর্মোপদেশ দেয়া নয়। এই নতুন প্রজন্মের কলাকারগনের দর্শন হল একজন একটি কবিতা পড়বে ভাল মন্দ পৃথক করার জন্য নয় বরং সত্য-শিব-সুন্দরের আকাঙ্ক্ষায়, একটি সৃষ্টি প্রশংসিত হবে এটার নিজের গুনের কারনেই। সে নিজে সুন্দর তাই সে প্রশংসনীয় তার আর কোন হীতকরী গুন নেই এটাই হবে একটি ছবি বা কবিতার একমাত্র যোগ্যতাঃ আমি আছি তাই আমি সুন্দর,আমি সুন্দর তাই আমি আছি । এই নতন প্রজন্মের কলাকারগনের বিপুল সংখ্যক শ্রোতা-পাঠক-দর্শক লাভের কোন ইচ্ছা ছিলনা সহৃদয়হৃদয়সংবাদি গুটিকয় সমঝদার শ্রোতা-পাঠক-দর্শক ছিল তাদের লক্ষ্য,মুলতঃ তারা নিজেদের বা নিজেদের ক্ষুদ্র সমাজকে উদ্দেশ্য করেই লিখত বা আঁকত। তাই দেখি মনে মানে দেগা এই তিন সমসাময়িক পরষ্পরের বিপুল পরিমানে ছবি এঁকেছেন ,গখ-গগাঁর ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য, সমারসেট মম গঁগার জীবন নিয়ে লিখেছেন 'মুনলাইট এন্ড সিক্স পেন্স', মনে এঁকেছেন মালার্মের ছবি, মালার্মের অনুদিত পো'র "ল্য করব্যু" গ্রন্থে ছবি এঁকে দিয়েছেন মানে। অর্থাৎ তারা স্থুল সাধারণ জগৎ ছেড়ে তাদের ছোট গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে বাইরের রূঢ় বাস্তব জগতের ছবি আঁকতে লাগলেন।

১৮৫০ এ একজন শিক্ষিত লোক সহজেই বুঝতে পারতেন চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস বা অনরে দুমিয়ের ছবি, এই বোধগম্যতার ফলে তারা ঐক্যমত পোষন করতে পারতেন লেখক বা চিত্রকরের ভাবজগতের সাথে,লেখক-চিত্রকরের চোখ আর মন নিয়ে তার সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে ঘটনা অনুধাবন করতে পারতেন। এসব উপন্যাস বা ছবি ১৮৫০ এর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্যে প্রবল ভাবে প্রভাব বিস্তার কারি এবং তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু বেশ সহজ বোধ্য। এরা মনের উপর ফেলে তীব্র আলো বা নিকষ অন্ধকার,হাসায়, কাঁদায় আপ্লুত করে ,সাদা মাটা ভাষায় সুন্দর তুলির আঁচড়ে আবিষ্ট করে রাখে।এঁরা তখনও পাঠক বা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যে উদ্বিঘ্ন।বৈয়াকরন কঠোর বিদ্রুপে অভিধানের কাছে পাঠায় না বা নৈয়ায়িকের শীতল উপেক্ষায় দর্শন চর্চা করতে উপদেশ দেয় না। কিন্তু ১৯০০ তে সাধারন এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ল, তারা এই নতুন শিল্পকলা বুঝে উঠতেই পারলনা, পছন্দ করা-না করা তো বহু দূরের কথা,তার মনে হল লেখক-চিত্রকর তারচেয়ে অনেক দুরবর্তি অগ্রসর কোন সত্বা তাঁর কাছে যাবার যোগ্যতা তার নেই। একজন কারনিক সেজাঁর ছবি বা ভালেরির কবিতা বুঝতেই পারেনা, সেটা সে পছন্দ করবে কিভাবে! পশ্চিমা সংস্কৃতি ভাগ হয়ে গেল দুটি শিবিরে,একটি শিল্পকলাকারগনের অপরটি সাধারণ জনতার।এই দুটি বিভাগের সম্পর্ক বৈরিতা বৈশিষ্ট আলোচনার জায়গা অন্যত্র,আগ্রহীরা হোসে অর্তেগা-ই-গাসেৎ লিখিত "রিভল্ট অব মেসেস","ডিহিউমেনাইজেশন অফ আর্ট" পড়ে দেখতে পারেন। বাঙলায় দ্বিতীয়টির ভাবানুবাদ করেছেন হুমায়ুন আজাদ সাহেব। গাসেৎ লিখেছেন, "modern art is anti-popular rather than unpopular", আধুনিক শিল্পকলা অজনপ্রিয় নয় জনপ্রিয়তাবৈরী।

কলাকার ও কলারসিকের এই নৈকট্যের দিন ঘুঁচে গেল ১৮৭০এই। পারষ্পরিক নির্ভরশীলতার ঐতিহ্য ছেড়েদেবার প্রথম স্পষ্ট ঘোষণা চিত্রকলায় দিলেন রূপবাদীরা (Impressionist), ফ্রান্সকেন্দ্রিক তরুণ এ সমধর্মি শিল্পিগোষ্ঠির সদস্যগন এ নামেই নিজেদের পরিচয় দিতেন। ধ্রুপদি ঐতিহ্যকাতর, রক্ষনশীল মনোভাবাপন্ন 'রয়াল আকাদ্যমি দ্য ফ্রঁসেস' এর সাংবাৎসরিক প্রদর্শনিটিকে তারা অস্বিকার করলেন, বাহ্যিক ভাবে উন্নাসিক ও বিদ্রুপাত্মক অনিহাও দেখালেন। তথাপি, আমাদের এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে তরুন শিল্পিগোষ্ঠির সাঁল্যতে স্বিকৃতি পাবার আকাঙ্ক্ষা ছিল,তাদের প্রতিষ্ঠা এনে দিতে পারত সাঁল্য। তাঁরাও চেষ্টা করেছিলেন আকাদ্যমিকে নতুন দিনের চিত্রকলা বোঝাতে,কিন্তু তারা ব্যার্থ হয়েছিলেন বৃদ্ধ আকাদ্যমির প্রাচিনপন্থি মনে তারুন্য জাগাতে, সাল্যতে তাদের ছবি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়, তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা হয় বিপুল উদ্যমে। অধুনা বিশ্ববিশ্রুত 'অলিম্পিয়া' বা 'ইম্প্রেশনঃ সান্‌রাইস' চরম নিন্দিত হয়েছিল সাঁল্যতে, বাস্তবিকই আমরা নবীন বিপ্লবিদের আস্তাকুঁড়ে পাঠাই আর প্রবীনদের উপাসনা করি! যাহোক এই অভিমানী তরুনেরা বর্জন করেছিল প্রথাসিদ্ধ পথ ও ঐতিহ্যবিলাসী সাঁল্যর প্রদর্শনি ( এর বদলে তাঁরা নিজেদের স্টুডিওতেই আয়জন করতেন প্রদর্শনির যার নাম তারা দিয়েছিলেন 'পোর্ত উভের্ত' মানে উম্মুক্ত দুয়ার, রসিকজনের জন্য তাদের দরজা খোলা) আর নিজেদের গোষ্ঠির মধ্যে থেকেই কাজ করতে থাকলেন । অর্থাৎ কবিরা লিখতেন সমমনা কবিদের জন্যে, চিত্রকরেরাও আঁকতেন নিজেদের জীবন, সমমনাদের জীবন যে কথা পুর্বেও উল্লেখ করেছি।

কী ছিল তাদের ছবিতে যা তাদের এমন বিতর্কিত এত বিচ্ছিন্ন এত পতিত করেছে- এ প্রশ্নের জবাব নিহিত আছে তাদের প্রতিষ্ঠিত শিল্পান্দোলনটির নামে। তাদের কাজের একান্ত বৈশিষ্ট এবং কর্মিগণের ব্যক্তিত্ব নির্ভুলভাবে প্রকাশ পায় এ শব্দে। রূপবাদীগণ কোন একটি বস্তু আঁকার সময় ঐ বস্তুটির বাহ্য রূপ না এঁকে তার ইম্প্রেশনটি আঁকতেন, কোন বিষদ বিবরণে (details) না গিয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে ওটি মনে যে রূপ বা ধারণা বা ইম্প্রেশন তৈরী করে তাই তারা ক্যানভাসে তুলতেন। এক অর্থে তাদের বাস্তববাদী বলা যায়- তারা তাই আঁকতেন যা তারা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখতেনঃ কিন্তু তারা বাস্তববাদী নন, রূপবাদী তাদের অংকনপদ্ধতি ছিল বাস্তববাদী শৈলী থেকে ভিন্ন। রূপবাদীগণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষন করতেন প্রকৃতিকে, এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনের প্রতিভাস ছিল তাদের অংকনপদ্ধতিতেও। একটি দৃশ্যের বা বস্তুর
তাৎক্ষনিক অনুভুতি তারা কোন রকম ডিটেইলস্‌ ছাড়া এঁকে ফেলতেন, দর্শকের মন আর মনন তার সামর্থ অনুযায়ী সেগুলো বুঝে নেবে বা কল্পনা করে নেবে, এমনটাই ছিল তাদের চাওয়া। যেমন হয়তো একটি ছবিতে আপনি দেখলেন মাঝ গাঙে নৌকা, অস্পষ্ট ভাবে মাঝিকে আর আরোহিকে দেখা যাচ্ছে, তাদের ফিগার হয়ত রঙের কয়েকটি পোঁচ চেহারার কোন মূর্তরূপ নেই। আপনি কল্পনা করে নিন না- আরোহি একজন সুদর্শনা, সুর্য্যাস্তের রংমাখা নদীর মাঝদিয়ে সে চলে যাচ্ছে- কি জানি কোথায়? এই হল ইম্প্রেশনিজমের বৈশিষ্ট, দর্শকের উপর দ্বায়িত্ব পরে আপন অনুভুতির চর্চা করার, অনুভুতি তে রঙ চড়িয়ে নেবার। আপনাকে সব কথা শিল্পি বলে দেবেন না, আপনি যদি অনুভুতিশিল হন তবেই আপনার কানে জলের মতন ঘুরেঘুরে ধ্বনিত হতে থাকবে তার কথা। শিল্পির কল্পনার চমৎকারিত্ব আপনার কল্পনার সাথে মিশে সৃষ্টি হবে মহৎ চিত্রকলার। এরা দর্শক কে অলস না রেখে মিথষ্ক্রিয় (interactive) করে তোলে। আপনি যদি এই প্রক্রিয়ায় অংশ না করেন, তবে এধরনের চিত্রকলা প্রাথমিকভাবে আপনার কাছে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ জগাখিচুড়ি, অবাস্তব মনে হবে। আপনি দেখতে পাবেন ছবির ফিগারগুলি বিকৃত, চারদিকে ছোপ-ছোপ রঙ ছড়ান অর্থহীন ভাবে, কোন ঐক্য নেই,সংহতি নেই যেন চিত্রকরের স্বেচ্ছাচারিতার চরম দৃষ্টান্ত একটি ক্যানভাস- ইচ্ছেমত সে যাখুশি তাই করে গেছে। চারদিকের চরম বিশৃঙ্খলা আপনাকে করবে বিরক্ত বিব্রত, নিজেকে আপনার মনে হবে প্রতারিত, আপনি সুরসিকজন, একটি ভাল ছবি দেখতে এসেছেন, খামখেয়ালি দেখতে নন। শান্ত হোন, এই ভুলটিই করেছিলেন সাল্যঁর পন্ডিতেরা, আপনার দীর্ঘ্য দিনের অচর্চিত মেধা আর বুদ্ধির কলটিতে একটু তেল দিন, তারপর আবার তাকান ক্যানভাসটির দিকে, দেখবেন আপনার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে এক অনাবিল সৌন্দর্য। দর্শককে মিথষ্ক্রিয় করার এ উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণ করতে রূপবাদী চিত্রকরেরা আরেকটি আধারগত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এর মাঝেই নিউটন আবিষ্কার করে ফেলেছেন মৌলিক রঙ তিনটি এই তিনের সমন্বয়েই বাকি সব রঙের উৎপত্তি, যেমন লাল আর সবুজ মিলে হবে হলুদ।অর্থাৎ হলুদ হল অসংখ্য লাল আর সবুজ রঙের দানার সমষ্টি, এই মিশ্রন আমাদের কাছে হলুদ বলে প্রতিভাত হয়। রূপবাদিরা মিশ্রিত রঙ ব্যবহার না করে মৌলিক রঙগুলি পাশাপাশি ব্যাবহার করতেন। যেমন একটি সবুজ গাছ আঁকার জন্যে তারা বিশুদ্ধ নীল আর বিশুদ্ধ হলুদ রঙের অসংখ্য ফুটকি পাশাপাশি এঁকে যাবেন, আপনার চোখই সেগুলো মিশ্রিত করে নেবে। আপনি যখন একটি গাছ দেখেন তখন কি তার প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন? না, দেখেন না। এসব ডিটেইলস আপনি দেখেন না, আপনার কাছে সমগ্র গাছটির একটি ইম্প্রেশন আসে। ইম্প্রেশনিস্টরা এ জিনিশটিই এঁকে ফেলেন সব ডিটেইলস বর্জন করে আর বিশুদ্ধ রঙ ব্যবহার করে।ক্লদ মনে এই নতুন পন্থার ল্যান্ডস্কেপ অংকনশৈলীর প্রধান ব্যখ্যাদাতা,এবং সম্ভবত সেরা জন।প্রচলিত অর্থে তার ছবিতে নকশা পরিকল্পনা গাঠনিক বিন্যাস সামান্যই আছে। তার বদলে আছে গাছ পাহাড় নদী বা প্রন্তরের প্রতিভাস অথবা মোটামুটি খসড়া দেহরেখা। প্রচন্ড সচেতন চিলেন তিনি আলছায়ার নানা সমস্যা বিষয়ে।সকালে সুর্য উথতেই তিনি কিছু ক্যনভাস নিয়ে বের হয়েজেতেন, স্রা দিন নানা রকন আলয় কয়েক গন্ডা 'তাৎক্ষনিক রূপ' এঁকে ফিরতেন। একটা ছবি সম্পর্কে তিনি একবার বিলেছিলেন 'আলোই এর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র'। আরকজন এলুয়ার মানে, রূপবাদীদের প্রধান পুরোহিত, যিনি বলতেন প্রকৃতিতে কোন রেখা নেই, তার এই ঘোষণা বিপুল প্রভাবিত করেছিল রূপবাদী দের। প্রচলিত অংকনরীতিসুলভ দেহরেখা আঁকা তারা ছেড়ে দেন। ব্যাপারটি এমন, একটি শিশুকে যদি বলি একটি আম আঁকো দেখি বাছা,তবে সে আগে একটি আউটলাইন আঁকবে, তারপর তার ভেতর রঙ ঢেলে দেবে, হয়ে গেল আম। আর রূপবাদীরা আমটি সরাসরি এঁকে ফেলবেন তুলির ভাঙ্গা-ভাঙ্গা আঘাতে (broken stroke of brush), পূর্ববর্তি চিত্রকরদের মত বালসুলভভাবে নয়, পরিণত চিত্রকরদের মত। ছিলেন বৈচিত্রময় এডগার দেগা, যিনি ইম্প্রেশনিস্ট, এ-অভিধা গ্রহন করতে অনিচ্ছুক ছিলেন- এটি যেন তাকে সিমাবদ্ধ করে ফেলে একটি গন্ডির মধ্যে। কলাকৌশলগত দক্ষতায় তিনি ছিলেন নিখুঁত, স্বকিয়তায় উজ্জ্বল, আধেয়গত উপাদানে বৈচিত্রময়। নিজে যতই অস্বিকার করুন না কেন, মনে-মানের এ ঘনিষ্ট বন্ধু যে অন্তরাত্মায় রূপবাদী ছিলেন আমরা তার কাজ দেখলেই বুঝতে পারব। এ ছাড়াও ছিলেন পিয়ের আগুস্ত রেনোয়া, কামিল পিসারো, আলফ্রেদ সিস্‌লি আর মানের ছাত্র, বার্থ মরিসো। ফ্রান্সের এই চিত্রান্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ইউরোপে, কিন্তু কেবল ইংল্যান্ডেই এধারার কয়েকজন সার্থক চিত্রকর দেখি, জন সিঙ্গার সার্জেন্ট, জেমস হুইস্‌লার আর ওয়াল্টার সিকার্ট।এদের সবার বিস্তৃত বর্ণনা ভিন্ন কোন অনুচ্ছেদের জন্যে বকেয়া রইল।

যাহোক, কলাকৌশলগত বিষয় থেকে এবার সমাজতাত্বিক দৃষ্টিকোণে ফিরে যাই। সেসময় সমাজের বিপুল পরিমান অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্তের সামর্থ ছিল না যে তারা আয়াসসাধ্য উপায়ে কলারস আস্বাদন করবে। অবধারিত ফলাফলঃ কলাকারগণের কুখ্যাতি (অজনপ্রিয়তা নয়), এতে স্বাভাবিক ভাবেই তারা হয়ে গেলেন সমাজ বিচ্ছিন্ন। যেহেতু তৎকালীন দর্শকেরা শিল্পির দৃষ্টিকোণ থেকে ছবি দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, যথেষ্ট অনুভুতিশীলতা ও শিল্পির সমকক্ষ মেধাও ছিলেন না সেহেতু সে সময় এসব শিল্পকর্মের কোন বাস্তব, ব্যাবহারিক ও অর্থনৈতিক মূল্যও ছিল না। এ অবস্থা তাকে বাধ্য করল শিল্পবস্তুর মূল্য নতুন করে নিরুপণে। এ নতুন মুল্যমানের নামই কলাকৈবল্যবাদ। একটি চিত্র বা কবিতার মূল্য ও গুরুত্ব হল এটি একটি চিত্র বা কবিতা,তার আর কোন ব্যবহারিক প্রয়োজনিয়তা নেই, সত্য প্রচারের আকাঙ্ক্ষা নেই। কেবল বিশুদ্ধ সৌন্দর্যই তার কারণ। সে নিজে সুন্দর, সে একটি কলাবস্তু এটিই তার একমাত্র বৌশিষ্ট,অনুপম গুন। সৌন্দর্যসৃষ্টিই কলাসৃষ্টির একবমদ্বিতীয়ম লক্ষ্য। রূপবাদীগন প্রবর্তিত-বর্ণিত পুরন প্রথা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা অনেক নবীন চিত্রকরকে নতুন পথ আর পন্থা অন্বেষনে অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা খুঁজতে লাগলেন তাদের ভিন্ন পথ, স্বকীয় পথ। মানব চরিত্রের স্বাভাবিক প্রবণতার একটি হল অপরিচিতের প্রতি সন্দেহ, নিরাসক্তি ও বিদ্বেষপ্রবণতা। রূপবাদ উদ্দিষ্ট নতুন মাত্রার চিত্রকলা প্রথম দর্শনে কদাকার, কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক- এটি প্রথমিকভাবে ছিল বিপর্যয়কর। কিন্তু এর তত্ত্বিয় কাঠামো যেহেতু সত্যের উপর অবলম্বিত, যে কাঠামো নির্মিত হয়েছে মূর্ত বা বিমূর্ত উভয় রূপেই, সেহেতু দর্শকের কাছে এর সৌন্দর্য দ্রুতই পরিফুষ্ট হল, এবং বোধগম্যতা বৃদ্ধির স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবে প্রতিকূল সংস্কার হ্রাস পেল। উজ্জল, নৈসর্গিক ও স্বাভাবিক রূপের চিত্রকলা রূপবাদী আন্দলনের মাধ্যমে তার চরম উৎকর্ষে উঠে এল, আর নতুন কিছু যেন দেবার নেই এটির। মানে আর দেগার প্রকৃতির স্বাভাবিকতা আর বাস্তবতার সাথে চমৎকার বোঝাপরা সেই সাথে জমিদারের জরিপকারীসুলভ চরম উদ্যোগের পর আর কিছু করার থাকে না। বাস্তবিকপক্ষেই তারা যা খুশি এঁকেছেন, যা দেখেছেন তাই এঁকেছেন। মনে মৌলিক রঙ নিয়ে যে কাজ শুরু করেছিলেন সৌরা তাকে চরম শিখরে নিয়ে গেলেন, তার নাম পয়েন্টিসম- ভাঙ্গা ভাঙ্গা মৌলিক রঙের ছোপ থেকে একেবারে বিন্দুতে পর্যবাসিত হল রঙের কারুকাজ। শুধু তাই নয় সৌরা আরেক ধাপ এগিএ গেলেন, রূপবাদী চিত্রকলায় অনুপস্থিত স্থাপত্য কাঠামো,কাঠিন্যের যে অভাব ছিল তা নিয়ে কাজ করতে লাগলেন। তার এ প্রয়াস রূপবাদউত্তর কলান্দোলনের কায়া গঠনের প্রথম ধাপ। ইম্প্রেশনিস্ট আন্দলনের উত্তরসুরিরা দুটি ধারায় বিভক্ত, এক্সপ্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট, রজার ফ্রাই নামক এক ইংরেজ সমালোচক এ নামকরণ করেন।পূর্ববর্ণিত সামাজিক অবস্থার প্রভাব ফলাফল প্রতিক্রিয়া এদের ওপরেও বিরাজমান। শিল্প বিষয়ক প্রতিটি আন্দোলনই অতিরঞ্জিত অর্থাৎ অতিশয়ন দোষে দুষ্ট, অন্যথায় তারা শিল্পান্দোলন হয়ে উঠার বা মনোযোগ আকর্ষনের জন্য প্রয়োজনিয় প্রেরনা আর আবেগ অর্জন করেনি, ঐ ত্রুটিই তার ক্ষমতা, তার শক্তির উৎস ,তার সামনে এগিয়ে চলার ভরবেগ। সংকির্ন মানসিক ধারণার কুপমুন্ডুক আদর্শের বিরুদ্ধে যন্ত্রনাময় দ্রোহের বিষ্ফোরন থেকেই উদিত হয় একটি নতুন শিল্পান্দোলন, চেষ্টা করে শিল্পরীতিকে প্রমিত করার, নিখুঁত আদর্শিক ভিত্তিতে প্রোথিত করার। পূর্বসুরীগণের ত্রুটিগুলো শোধরাবার আকাঙ্ক্ষা কলাজগতে একটি তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে অতঃপর আবার স্থিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনে। এ স্থিতাবস্থা শিল্পরীতিকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করে,নতুন মুল্যমান নির্দেশ করে। কিন্তু এই একতরফা বিরুদ্ধবিলাসীতা ভুল সংশোধন করলেও সম্মুখগতীর জন্য সুফলদায়ক নয়। আর্শিতে কেবল দোষগুলোই দেখা যায়, উত্তরনের পথ পাওয়া যায় না, নতুন সৃষ্টির পথ হয়ে যায় রুদ্ধ। নবীন দ্রোহীদের মধ্যে কোন প্রবল সৃজনশীল নেতৃত্বই কেবল পারে এই বন্ধ্যাত্বকে অতিক্রম করতে। এই সৃজনশীল নেতৃত্বের অভাবে কত মহৎ, উচ্চাভিলাষী আন্দোলন কালের ভাগাড়ে হারিয়ে গেল! মনে করতে পারি প্রথম মহাযুদ্ধান্তে অচিরস্থায়ী দাদাবাদের কথা, মাত্র তিন বছর স্থায়ী ছিল এ শিল্পান্দোলন টি। সৃজনশীল নেতৃত্ব যদিও সহজ লভ্য নয়, কারো কারো এটি থাকে দৈবক্রমে সহজাতভাবে, কেউ অর্জন করে।

পূর্ণাঙ্গ নৈতিক নন্দনতাত্বিক বিশুদ্ধতার জন্য নিরন্তর প্রয়াসি আর নিরবিচ্ছিন্ন নিরিক্ষাধর্মি পল সেজাঁর সে পৌরহিত্য সাধনের ক্ষমতা ছিল। অভিব্যক্তিবাদের প্রতিপাদ্য হল একটি ছবিতে অবশ্যি চিত্রকরের নির্দিষ্ট ও বিশেষ মেধার প্রকাশ থাকতে হবে, শুধু এঁকে ফেললেই হল না, চিত্রকর স্বেচ্ছাচারীরসুলভ চারদিক থেকে দৃশ্য পটে তুলতে পারেন না, তাকে হতে হবে বিবেচক, সচেতন, প্রাজ্ঞ। এভাবেই তারা জনগন সমাজ থেকে আরও কয়েক কদম দূরে সরে এলেন। অভিব্যক্তিবাদীরা ঘোষণা করলেন, তাদের পূর্বসুরীগণ ছবিতে প্রকৃতিক প্রতিক্রিয়া আর স্বাভাবিকতা আনতে গিয়ে কাঠামোকে জলাঞ্জলী দিয়েছেন, তারা আলো নিয়ে অনর্থক জটিলতা বাড়িয়েছেন। তারা প্রকৃতিবাদ, স্বাভাবিকতা, রূপবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বাতিল করে দেনঃ চিত্রকলা প্রকৃতি নয়, চিত্রকলা হল প্রকৃতির উপর চিত্রকর আরোপিত কাঠামোর প্যাটার্ন, ছন্দ ও সৌন্দর্য। যথেচ্ছ প্রকৃতির প্রতিলিপি তৈরী চিত্রকলা হতে পারে না, সেটি ক্যমেরার কাজ, চিত্রকরের স্থান তারও ওপরে। মহৎ এই অহম জাগরণের কাল মোটামুটি উনবিংশ শতকের শেষ আর বিংশ শতকের প্রথম দশক। ভাসঁ ভান গখ (১৮৫৩-১৮৯০) আর পল গগাঁদের(১৮৪৮-১৯০৩) কথা স্মরণ রেখেও বলছি, উত্তরকালে সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তারকারী পল সেজাঁ। কারন পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট ওই যুগল তাদের জীবনদশায় তাদের মতের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেন নি। ১৯১০ সালে লন্ডনের গ্রাফটন গ্যালারিতে তাদের আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রদর্শনির পরই জগত এই দুই মহৎ বিদ্রোহীকে চিনে উঠতে পেরেছে। তাই সেজাঁর প্রভাব ছিল সে সময় দিগন্ত বিস্তৃত। এমনকি সেজাঁর যত ব্যার্থতা যত ত্রুটি সবই ছিল পরবর্তি প্রজন্মের শিল্পির জন্যে প্রথম ধাপ, সেগুলো শুধরাবার আত্যান্তিক প্রচেষ্টাই সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে চিত্রকলাকে। তার বহু অসমাপ্ত পরীক্ষামূলক কাজ উত্তরসধক কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অন্বেষনে সচেষ্ট করেছে। কিন্তু বেশিরভাগই তার অন্তরাত্মার ধ্বণি উপলব্ধিতে ছিলেন অপারগ, তার চিন্তা চেতনার কাছাকাছি যেতে পেরেছেন খুব কম জন- তিনি সদা সর্বদা রূপবাদ অতিক্রান্ত , তার সন্ধিৎসা ছিল কাব্যিক, আত্মিক, অতিন্দ্রিয় এক কলাপ্রকৌশল । সেজাঁ পরিণত বয়সে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন, তার স্মৃতিশক্তি দূর্বল ছিল, তাই তিনি কোন তাৎক্ষনিক ইম্প্রেশন দীর্ঘক্ষন মনে রেখে ক্যানভাসস্থ করতে পারতেন না; একারনে তিনি মডেল নিয়েও ছবি আঁকতে পারতেন না। এ প্রতিবন্ধ অতিক্রমের প্রতিচিকির্ষা তাকে প্রতিদিষ্ট করল নতুন প্রত্যাদেশে, তিনি নিজের জন্য স্থির করলেন ভিন্ন দুরূহ লক্ষ্য। পুস্যাঁ অন্বিষ্ট কাঠামোগত সংবদ্ধতার সাথে রূপবাদী আদর্শের মিলন - তথা - আলো আর রঙের কারুকাজের সাথে স্থাপত্যিক বিন্যাসের আধারগত সমন্বয়। রূপবাদী ক্যানভাসের উপর ভাসে থাকা ল্যন্ডস্কেপ, জলছাপ সুলভ দৃশ্যের প্রতিভাস বা রৈখিক বহিরাবরণ তার মানসভূম অধিকারের আগেই বিদায় নিল, তার বদলে ঠাঁই পেল জ্যামিতিক আকৃতি- সবরকম গড়ন আকার ভংগী তার কাছে বেলনাকার শাঙ্কব বা বর্তুল, তার তুলির আঁচর কৌনিক । প্রকৃতিক গড়নগুলো সে প্রততুলনিয় জ্যামিতিক গড়ন দিয়ে প্রতিস্থাপন করলেন, যতক্ষন না স্বাভাবিকভাবে বিমুর্ততা অর্জিত হচ্ছে ততক্ষন প্রতিটি বস্তুর গড়নকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে থাকলেন জ্যামিতিক নিয়মতান্ত্রিকতায়। আর তিনি আঁকার বিষয়সমুহ বিন্যস্ত করতেন কতগুলো ধারাবাহিক স্তরে ফলে ত্রিমাত্রিক কাঠামো অর্জন করত তার প্রতিটি ছবি। প্রতিটি স্তর পৃথক করা যায় তাদের রঙের বিভিন্নতার মাধ্যমে।
অতঃপর তিনিই কিউবিজমের অন্তরালের পুরুষ যে কিউবিজমের কায়া গঠন ১৯০৮ এর আগে হয়নি।তিনি মনে করতেন সুচিবায়ুগ্রস্থসুলভ খুঁতখুতে স্বভাবের ডাচ চিত্রকরদের মত বস্তুর আদর্শ বিন্যাস সৃষ্টির চেয়ে একটি সৌন্দর্য সৃষ্টিই মহত্তম।অর্থাৎ বুদ্ধিমত্তাপুর্ণ শ্রেয়বোধের চেয়ে সৌন্দর্য শ্রেয়-মনে করিয়ে দেয় ডি.এইচ. লরেন্সের সেই উক্তি, being wiser than the intellect, ১৯১৩ তে লরেন্স তার কোন এক বন্ধুকে বলেছিলেন এ কথা। প্রজ্ঞাই সৌন্দর্যের জননী বুদ্ধি নয় ঔচিত্যবোধ নয়, সৌন্দর্য বিশুদ্ধ, জ্ঞানীর চেতনার অমৃতালোকে প্রতিভার স্ফুরন হলেই জন্ম নেয় সৌন্দর্য, এই সে যুগের সার। তাঁর কোন বার্তা প্রচারের অভিপ্সা ছিল না ,প্রয়াস ছিল চিত্রকরের বিশেষ কোন ব্যাক্তিগত প্রতিভার প্রকাশ থাকবে তাঁর চিত্রে। এভাবে শিল্পকলা আরও এক ধাপ সরে আসল জনগনের কাছথেকে, হয়ে উঠল আরো একান্ত, ব্যাক্তিগত।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ১২:২২
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×