somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুন্দরবনের উপর জাহাজডুবির প্রভাব

০৩ রা মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় জলজ ও প্রাণিজ সম্পদের প্রায় একশ’ কোটি টাকার ক্ষতি হবে বলে আশংকা করছে বন বিভাগ। বস্তুত এই ক্ষতি টাকায় পরিমাপ করা সম্ভব নয়। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক কার্তিক চন্দ্র সরকার ঘটনাস্থলে থেকে জানান, যে এলাকায় ট্যাংকারটি ডুবে গেছে সেটি ডলফিনের অভয়ারণ্য। এতে ডলফিন, কুমিরসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণি ও গাছপালার যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এই ঘটনার ফলে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের পরিবেশ তথা এর নদীসমূহ, উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল, বাস্তুসংস্থান ও স্থানীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
সমগ্র সুন্দরবনের জালের মত ছড়িয়ে আছে অসংখ্য খাল ভারানী ও নদী-নালা। স্বভাবতই জাহাজডুবির ফলে নদীর পানি দূষিত হয়েছে। আর এর ফলে সুন্দরবনের পানিতে থাকা জলজ উদ্ভিদ ও মৎস্য সম্পদ এখন হুমকির মুখে। তেল নদীর তলদেশে গিয়ে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। যা মাটিকে দূষিত করার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে নদীর খাদ্যচক্রে প্রভাব ফেলবে।
তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সুন্দরবনে কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে বছরব্যাপী একটি গবেষণা শুরু হয়েছে। এই গবেষণার আওতায় ১১ ডিসেম্বর থেকে বনের ১৫টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রতি লিটার পানিতে ২০ থেকে ৩০টি উদ্ভিদকণা এবং এক থেকে দুটি প্রাণিকণা পাওয়া গেছে। যেখানে দুর্ঘটনার পূর্বে বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবন এলাকায় প্রতি লিটার পানিতে ৩০০ থেকে ৪০০টি উদ্ভিদকণা এবং ২০ থেকে ৩০টি প্রাণিকণা থাকে।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক অবস্থায় মাডস্কিপার বা চিংড়ি প্রতি বর্গমিটারে পাওয়া যায় তিন থেকে সাতটি। তেল ছড়ানোর পর একটিও দেখা যায়নি। মাডস্কিপার মূলত পাখি, ভোঁদড় ও সাপের খাদ্য। সুন্দরবন এলাকায় চার প্রজাতির কাঁকড়া দেখা যায়। প্রতি বর্গমিটারে সুন্দরবনের স্বাভাবিক অবস্থায় কাঁকড়া দেখা যায় তিন থেকে সাতটি। তবে গবেষণা এলাকায় কোনো জীবিত কাঁকড়া দেখা যায়নি। অসংখ্য মরা কাঁকড়া দেখা গেছে। কাঁকড়া হলো পাখি ও কুমিরের খাদ্য। সুন্দরবন এলাকায় ১০ প্রজাতির শামুক রয়েছে। প্রতি বর্গমিটারে ৯ থেকে ১৭টি শামুক দেখা যায়। তবে গবেষণা এলাকায় কোনো জীবিত শামুক দেখা যায়নি। শামুক মাছ, পাখি ও কুমিরের খাদ্য। আক্রান্ত অঞ্চলে দুই ধরনের শৈবালের উপস্থিতি দেখা যেত। এর মধ্যে লোহিত বা লাল শৈবাল হিসেবে পরিচিত উদ্ভিদের তিনটি প্রজাতি গাছের শেকড় ও শাসমূলের সঙ্গে লেগে থাকত। এরা বিভিন্ন জলজপ্রাণীর খাদ্য ও পুষ্টির জোগানদাতা হিসেবে কাজ করে থাকে। এছাড়া আক্রান্ত অঞ্চলে লাল শৈবালের ৯৫ শতাংশই মারা গেছে। এছাড়া বাদামি শৈবালের দুটি প্রজাতি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে উজাড় হয়ে গেছে। বাদামি শৈবাল সাধারণত ছোট ছোট খালের পাশে জন্মায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এমএ বাশার বলেন, জোয়ার-ভাটায় তেল ছড়িয়ে পড়ায় ম্যানগ্রোভ বন নষ্ট হবে। নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় জলজ ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানির গতির সঙ্গে চলমান ক্ষুদ্র জীবগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৮০ ভাগ মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না বলে ক্ষয়ক্ষতি বুঝা যাচ্ছে না। ক্ষুদ্র জীবগুলোই জলজপ্রাণীর প্রথম ধাপের খাবার। এসব নষ্টের কারণে ওই এলাকায় খাবার সংকট দেখা দেবে।
প্রাণিবিদ্যার খাদ্যশৃঙ্খল অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান বা খাদ্যচক্রের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা। বনের সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রাণী ছোট মাছ, কাঁকড়া ও শামুক এই কণাগুলো খেয়ে বেঁচে থাকে। ছোট মাছ আবার মাঝারি ও বড় মাছ এবং পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর প্রধান খাবার। পাখি আর হরিণ হচ্ছে শক্তিশালী প্রাণী বাঘের খাবার। ফলে উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা মারা গেলে সর্বস্তরের প্রাণীদের খাদ্য জোগান বন্ধ হয়ে যাবে।
সুন্দরবনের নদী ও জলরাশির সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের এক বিরাট আধার। সমগ্র সুন্দরবনে ২১০ প্রজাতির মাছ ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৭ প্রজাতির চিংড়ি ও ৪২ প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক পাওয়া যায়। প্রতিবছর কেবল মাত্র সুন্দরবন থেকেই ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিকটন মাছ, ৩ হাজার মেট্রিকটন চিংড়ি ও কাঁকড়া এবং ৭৫০ মেট্রিকটন ইলিশ আহরিত হয়ে থাকে। বিপুল পরিমাণ এ মৎস্য সম্পদ দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়ে আসছে। সুন্দরবন থেকে মৎস্য আহরণে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় দেড় লাখ লোক নিযুক্ত রয়েছে।
সুন্দরবনে জাহাজডুবির পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে গবেষণায় দেখা গেছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে খরশোলা ও পারসে মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম শুরু হয়েছে। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, তেলের কারণে এ অঞ্চলের পানিতে কোনো ডিম ও রেণু পোনা শ্যালা নদী ও আশপাশের তেল আক্রান্ত অঞ্চলে ৩১ থেকে ৪৩ ধরনের মাছ পাওয়া যেত। তেল ছড়ানোর পর এ অঞ্চলের ওপর গবেষণায় পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১৪ ধরনের মাছ।
সুন্দরবনে প্রায় ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুন্দরী, কেওড়া, পশুর, ধুন্দল, আমুর, গরান, গর্জন, খোলশী, বলা, হেতাল, গোলপাতা, টাইগার ফার্ন, হারগোজা ইত্যাদি।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে ড. হামিদা খানম বলেন, আপাতত গাছ-পালার ক্ষয়ক্ষতি তাৎক্ষণিক চোখে দেখা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে। নদীর দুই তীরবর্তী ১০০ থেকে ২০০ গজ পর্যন্ত এলাকার গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাটি থেকে পানি, পুষ্টি, মিনারেল, খনিজ টেনে নেয় গাছ-পালা। তেলের কারণে স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন এর মতে, শ্বাসমূলীয় বনের শ্বাসমূলে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে, যা দিয়ে তারা নিঃশ্বাস নেয়। তেলের কারণে তারা ধীরে ধীরে মারা যেতে পারে।
সুন্দরবনে জাহাজডুবির পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে গবেষণায় দেখা গেছে, তেলের প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরী গাছের বংশ বিস্তারে ব্যাপক ক্ষতি হবে। কারণ তেল আক্রান্ত অঞ্চলে সুন্দরী গাছের ফল নষ্ট হয়ে গেছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বর্গমিটারে সুন্দরী গাছের ফল ৯ থেকে ১৪টি পাওয়া গেছে। তেল আক্রান্ত অঞ্চলের সুন্দরী ফলের ৯৫ শতাংশের ভ্রূণই নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া প্রতি বর্গমিটারের ৯৫ ভাগ শাসমূলীয় উদ্ভিদের গায়ে তেলের কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। ফলে এ ধরনের উদ্ভিদের শ্বসন ও শারীরিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লবণ পানির ওয়াটারলিলি এক জলজ উদ্ভিদ যা জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী স্থানে জন্মে থাকে। তেল নিঃসরণের আগে এ অঞ্চলে ও তেল যেখানে যায়নি সুন্দরবনের পশ্চিম অঞ্চলে- এই জলজ উদ্ভিদ প্রতি বর্গমিটারে ১০ থেকে ১৪টি দেখা যেত। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর উদ্ভিদটি গোড়া পচে সবগুলোই মারা গেছে।
১৯৮৬ সালে পানামার বাহিয়া লাস মিনাস অয়েল স্পিলের ঘটনাকে গবেষকরা মহাবিপর্যয়কর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ঘটনার পাঁচ বছর পর গবেষকরা বনে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত শ্বাসমূলের অস্তিত্ব দেখতে পান। ১৯৮৪ সালে পানামায় ট্রপিকস স্পিল নামের একটি পরীক্ষামূলক তেল নিঃসরণ ঘটানো হয়। ঘটনার সাত মাস পর গবেষকরা দেখতে পান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের মৃত্যুর হার ১৭ শতাংশ। ১০ বছর পর দেখা যায়, আক্রান্ত এলাকার অর্ধেক গাছই মারা গেছে। এ অবস্থা যদি আমাদের সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও ঘটে তবে দুর্ঘটনা অঞ্চলের অর্ধেক গাছ মারা যাবে।
এক পরিসংখ্যান মতে সুন্দরবনে বর্তমানে প্রায় সাড়ে চারশ’ ডোরাকাটা বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ত্রিশ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণের বসবাস। এ ছাড়া মায়া হরিণ, বন্য শূকর, বানর, গুঁইসাপ, ভোঁদড়, ডলফিন, লোনাপানির কুমির, কিং কোবরা, বেঙ্গল কোবরা, অজগর ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে সুন্দরবনে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে শ্বাসমূলীয় বন এবং সুন্দরবন নিয়ে ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন এমন গবেষক জুনায়েদ কে চৌধুরী বলেন, বিশ্বে যত ধরনের বন আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল হচ্ছে শ্বাসমূলীয় বা ম্যানগ্রোভ বন। তেল ছড়িয়ে পড়ায় এমন অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে, তা হয়তো আগামী দু-এক মাস তো নয়ই, দু-তিন বছরেও বোঝা যাবে না। হয়তো ১০-২০ বছর পর আমরা দেখতে পাব, বনের কোনো একটি প্রাণীকে আর দেখা যাচ্ছে না।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন এর মতে, বিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র অনুযায়ী পূর্ব সুন্দরবনের তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকায় প্রাণীদের একটা বড় অংশ মারা যাবে বা ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাবে।
সুন্দরবনে জাহাজডুবির পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে গবেষণায় দেখা গেছে , যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় এ স্থানের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় তিন থেকে ছয়টি কুমির দেখা যায়। সেখানে দুর্ঘটনার পর গবেষণার সময় তেলমাখা মাত্র দুটি কুমির দেখা গেছে। এছাড়া আক্রান্ত অঞ্চলে দুটি মৃত ভোঁদড় দেখা গেছে। এ ছাড়া তেল গায়ে মাত্র একটি ভোঁদড় জীবিত দেখা গেছে। প্রাণীটি আইইউসিএনের তালিকা অনুযায়ী মহাসংকটাপন্ন। গবেষণার সময় কোনো ডলফিন গবেষকরা দেখেননি। অথচ স্বাভাবিকভাবে প্রতি ঘণ্টায় ৫ থেকে ১০টি ডলফিনকে পানির ওপর উঠতে দেখা যায়। দুর্ঘটনা কবলিত অঞ্চলে কোনো হরিণের দেখা মেলেনি। এমনকি এসব অঞ্চলে হরিণের সাম্প্রতিক কোনো পায়ের ছাপও দেখা যায়নি। সুন্দরবন অঞ্চলে তিন প্রজাতির গুইসাপ রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১ থেকে ২৭টি গুইসাপ দেখা গেলেও তেল আক্রান্ত অঞ্চলে দুটি গুইসাপ দেখা গেছে, যা আবার তেলের প্রলেপ রয়েছে গায়ে। আর একটি গুইসাপ পাওয়া গেছে মৃত। একই অবস্থা বনমোরগের। আক্রান্ত অঞ্চলে কোনো বনমোরগ দেখা যায়নি। কোনো বন্য শুকুরও দেখা যায়নি। যদিও এ অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থায় শুকুর, বনমোরগের অভাব ছিল না।
এমনিতেই অস্তিত্ব সংকটে বাংলাদেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাংলাদেশে সুন্দরবনই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শেষ আশ্রয়স্থল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করে বাঘ। যে বনে জীববৈচিত্র্য বেশি সেখানে বাঘের সংখ্যাও বেশি থাকে। এই দুর্ঘটনার পর নিঃসন্দেহে বাঘের পরিমাণ আরও কমে যাবে।
এই দুর্ঘটনায় বিলুপ্ত হতে পারে ইরাবতী ডলফিন, ভোঁদড় ও কুমির। ইতিমধ্যে অযত্নে অবহেলায় সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ২ প্রজাতির পাখি, ৫ প্রজাতির মাছ এবং ৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। আর বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি ও ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
স্থানীয় ও পরিযায়ী মিলে সুন্দরবনে প্রায় ২৭০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে বড় সাদা বক, সি ঈগল, বাজ, মাস্ক ফিঙ্কফুট, বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, ফিঙে, সুঁইচোরা, কাঠঠোকরা, বন মোরগ উল্লেখযোগ্য।
সুন্দরবনে দুর্ঘটনার দুই দিন পরে উপপ্রধান বন সংরক্ষণ জাহিদুল কবির জানান, সাদা বক, শিকারি পাখি ওসপ্রে এবং কাইটের শরীরে তেলের ক্ষতিকর নেতিবাচক প্রভাবও তারা লক্ষ্য করেছেন। এই পাখিগুলো মরে না গেলেও তাদের খাবার সংগ্রহ এবং জীবনযাপনে নির্জীব হয়ে পড়ার বিষয়টি তারা লক্ষ্য করেছেন।
সুন্দরবনে জাহাজডুবির পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে গবেষণার পর জানান, একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের হাঁসজাতীয় পাখি মাস্ক ফিনপুট কদাচিৎ দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে এর সংখ্যা মাত্র দুই হাজার। আর সুন্দরবনে রয়েছে ২০০-এর মতো। তেল নিঃসরণের আগে ২০টি মাস্ক ফিনপুট পাখি দেখা গেছে এ অঞ্চলে। কিন্তু তেল ছড়িয়ে পড়ার পর গবেষণা অঞ্চলের কোথাও এ পাখিটি দেখা যায়নি। এছাড়া মাছরাঙা, বকসহ ৫৭ ধরনের পাখি তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে এ অঞ্চলে দেখা যেত। এখন কোনো মাছরাঙা দেখতে পাননি গবেষকরা। গবেষণাকালে এ অঞ্চলে ১৭টি বক দেখা গেছে তেল মাখা অবস্থায়। শীতে এ অঞ্চলে পরিযায়ী বা অতিথি পাখির ঢল নামে। তবে তেল আক্রান্ত হওয়ার পর কোনো পরিযায়ী পাখি দেখা যায়নি।
সুন্দরবনের জনসংখ্যা ৪ মিলিয়নের বেশি কিন্তু এর বেশির ভাগই স্থায়ী জনসংখ্যা নয়। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়াও কাঠ, জ্বালানী ও মন্ডের মত প্রথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক। জাহাজডুবির ফলে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
সুন্দরবনে দুর্ঘটনার পর ওই রুটে সাময়িক জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকলেও এক মাস পার হওয়ার আগেই ৭ই জানুয়ারী ২০১৫ থেকে আবার চালু করা হয়েছে তেলবাহী ব্যতীত সকল জাহাজ। চালু হওয়ার দিনই চলাচল করে প্রায় চারশ জাহাজ। এতে দুর্ঘটনা কবলিত অঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুধু ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারটিই নয় এমন বহু জাহাজ আছে যেগুলোর বৈধ কাগজপত্র নেই। ২০১১ সালে ত্রুটিপূর্ণ এসব নৌযান চলাচল বন্ধ করতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় । নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তখন জানিয়েছিল ২০১৪ সালের মধ্যে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সকল প্রকার নৌযান চলাচল বন্ধ করা হবে। কিন্তু আদতে চার বছর পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে উদাসীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
অতিদ্রুত জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে না পারলে এ ধরণের দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। এজন্য অবিলম্বে ঘষিয়াখালী-মংলা আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেল চালু করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী। প্রয়োজনে মংলা সমুদ্র বন্দরের জন্য সুন্দরবন ব্যতীত নৌ রুট তৈরি করা যেতে পারে।
সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। শত আঘাতে জরাজীর্ণ এই বন সাইক্লোন-হারিকেনের মত বিপদে আমাদের রক্ষা করে যাচ্ছে। বড় বড় বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এই বন; বিলুপ্ত হচ্ছে জীব তবু আবার নিজেকে বিকশিত করছে সুন্দরবন । হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এ বন যুগের পর যুগ টিকে থাকুক স্বমহিমায়।
তথ্যসূত্র: দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক কালের কণ্ঠ
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×