somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মা আমার জলকন্যা

১১ ই মে, ২০১৪ রাত ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি গালে হাত দিয়ে শুনতে থাকি । চোখেমুখে আমার মনোযোগ স্পষ্ট। মা গল্পচ্ছলে বলে যান,

আমার মায়ের ধারনা তিনি মারা যাবেন কোনো এক অঝোরধারা বৃষ্টিদিনে। এলোপাথারী বৃষ্টিতে চারপাশ যখন সয়লাব, ঠিক তখন মা চলে যাবেন তাঁর শরীর খানা আমাদের কাছে রেখে। আত্মীয়স্বজনেরা আধভেজা হয়ে আসবেন একের পর এক আমার মাকে শেষ বারের মত দেখতে। ঘর ভর্তি মানুষ, পাকা মেঝে কাদায় মাখামাখি, সে এক হুলুস্থুল অবস্থা ! ওইদিকে গোঁড়খোদকের সে আরেক ঝামেলা, কোদাল এর আঁচরে মাটি যতই গভীর হয়, পাল্লা দিয়ে সেই গর্তে বাড়তে থাকে পানির উচ্চতা। এভাবে কি কবর খোদাই হয় ? তাও চলতে থাকবে শেষকৃত্তের কাজ।

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি , মৃত্যুর মতো একটা বিষয় নিয়ে মা কেমন সাবলীল ভাবে কথা বলে যাচ্ছেন ! ‘বুঝলা নিন, তারপরে কি হইব জানো ?’, মা একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছেন, গুরিগুরি বৃষ্টি মাথায় হবে শবযাত্রা । মজার ব্যাপার, দাফন করতে গিয়ে দেখা যাবে কবরখানা পানিতে টইটুম্বুর। ‘মা, কি শুরু করলা, please থামো!’, এমন কোনো কথাই আমি মাকে বললাম না, বরং চোখেমুখে বিশাল আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম,’ আচ্ছা মা, মৃত্যুর সাথে বৃষ্টির যোগসূত্রটা কই ?বুঝায় বলতো, মনে হইতাসে ব্যাপার টা Interesting!’ চশমার ফাঁক দিয়ে মা তাকান আমার দিকে,মেয়েটা রসিকতা করছে কিনা যাচাই করার চেষ্টা । আমি ঠায় বসে থাকি মুখে আগ্রহের ভাব ধরে । যেন পরের টুকু শোনার জন্য উদগ্রীব। এ কাজটা আমি বেশ ভাল পারি, সুতরাং মা নিশ্চিন্ত হয়ে আবার শুরু করেন একদম শুরু থেকে।

সে বছর বেশ বন্যা হলো । উঠোন ডিঙ্গালো, চৌকাঠ পেরুলো। পানির উচ্চতা তাও বেড়েই চলেছে। ঘরের চৌকিটাও তার ছয় পা নিয়ে পানির উপর দাঁড়িয়ে । এমনই জলভরা দিনে এক কিশোরী তার প্রসব ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে । কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া মেয়েটির কান্না জানান দেয়, হ্যাঁ... সময় এসে গেছে। এদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই । তবে কি পানি আরও বাড়বে ? এখন উপায় ? শেষে ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় ছৈওয়ালা নৌকা । গর্ভধারিণীকে নিয়ে ধাই ওঠে যান নৌকায় আর জলে ভাসতে ভাসতে কিশোরী মেয়েটি জন্ম দেন আমার মা কে ।
মা তার জন্মমুহূর্তের কাহিনী শুনেছে তার বু’র কাছ থেকে। (মা তাঁর দাদীকে বু বলে ডাকতেন)আমার নানীও নাকি এ গল্প শুনিয়েছেন অনেকবার । কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি অন্য কথা ভেবে । পুরো কাহিনী থেকে বেছে বেছে বৃষ্টি শব্দটাকেই কিভাবে যেন আলাদা করে ফেলেছেন আমার মা । তার বদ্ধমূল ধারনা , জন্ম থেকেই বৃষ্টির সাথে কোথাও একটা যোগসূত্র আছে তাঁর ।

এই মুহূর্তে আমি আমার মাকে দেখছি । মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে স্কুল পড়ুয়া ছোট্ট মেয়েটার মত কথা বলে যাচ্ছেন । মা তাঁর বিয়ের গল্প বলতে শুরু করেছেন । আমি এ ঘটনা আগেও অনেকবার শুনেছি । কিন্তু প্রতিবারের মত এবারো এত আগ্রহ ভাব মুখে ধরে রাখলাম যেন এই প্রথম শুনছি।

হ্যাঁ , বিয়ের দিনও বৃষ্টি ছিলো , সেকি উথালপাথাল বৃষ্টি! একসময় বৃষ্টি থামল কিন্তু সারা উঠোন যে কাদায় মাখামাখি । বরযাত্রী এসেছে, গ্রামসুদ্ধ মানুষ এসেছে। এরা বসবে কোথায়, খাবে কোথায় ? তখন ছিল সদ্য আঁশ ছাড়ানো সাদা পাটশোলার দিন ।সবাই মিলে পাটশোলা বিছিয়ে সারা উঠোন ঢেকে দিলো । কাদায় মাখা কালোমাটির উঠোন ঢাকা পরলো সাদা পাটশোলায় । আরে, সেকালে তো আর ডেকোরেটর ছিল না যে সাহেবী ধাঁচে চেয়ারটেবিলে বসে খাইদাই হবে । কলাপাতা সামনে রেখে সকলে লাইন ধরে বসে পরলো উঠোনে । বিয়ে হল ধূমধাম ।বৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠিক ঠিক মা চলে এলেন অচেনা মানুষের শহরে ।

কথা বলতে বলতে মা উদাস হন, আমি আড়চোখে তাকে তাকিয়ে দেখি । মেয়েটা বুড়িয়ে গেছে অনেক । চুলে পাক ধরেছে সেই কবে ।তবু মাকে আমার পুরনো মনে হয় না । মা যানে না , গোসল করার পর পর মাকে কি অপরুপ দেখতে লাগে । মায়ের মাথার লম্বা চুলগুলো তখন আর খোপার ভেতর হাঁসফাঁশ করে না , বটের ঝুড়ির মত নিচে নেমে আসে, বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে , এই মানুষটাকে আমি প্রচণ্ড ভালবাসি ।

একসময় মা-মেয়ের গল্প শেষ হয় । রুটিন মাফিক মা ঢোকেন রান্নাঘরে , হয়তো আমি ব্যস্ত হই ব্যাগ গোছাতে। লম্বা সময়ের জন্য বিদায় নিয়ে আবার ফিরে আসি ইটকাঠের প্রানহীন শহরে , স্বার্থপরের মত ব্যস্ত হয়ে পরি নিজেকে নিয়ে । আর মা আমার প্রতিক্ষায় থাকেন...কখনো আমার , কখনো বৃষ্টির...............
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×