somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাসাহিত্যিক নাজিব ওয়াদুদের সাক্ষাৎকার

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আশির দশকের সুচনা হতেই আমি তার লেখালিখির সাথে পরিচিত। তার লেখা পড়লেই বুঝা যেতো তিনি পড়াশুনা করেন এবং সবচেয়ে বড় কথা হল তিনি চিন্তা করেন।আমাদের দেশে চিন্তাশীল লেখকের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে।চিন্তা না থাকলে নতুন লেখা তৈরি হয় না।নতুন লেখা তৈরি না হলে নতুন বই হয় না।নতুন বই না হলে নবতরঙ্গ সৃষ্টি হয় না।
নাজিব চিন্তাশীল লেখক এবং তার কল্পনা কাব্যের সামন্তরাল। এ ধরণের লেখককে পৃষ্টপোষকতা দেয়া পাঠকদের উচিত ও কর্তব্য বলে আমি মনে করি। নাজিব দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখক নন।তিনি প্রতিভাবান ও পরাক্রমশালী লেখক। তার গ্রন্থাদি অপেক্ষাকৃত কম হলেও আমার মতো প্রায়ান্ধ লেখকও খুঁজে পেতে তার বই পড়ার প্রয়াস করে থাকে।

- আল মাহমুদ

লেখক নাজিব ওয়াদুদ এর উথান ৮০ এর দশকে।এবং এ পর্যন্ত নিরলস সাহিত্যসাধনায় নিয়োজিত আছেন।তিনি একজন সব্যসাচী লেখক (কথাকার,অনুবাদক, ছড়াকার,প্রাবন্ধিক,নাট্যকার)হলেও প্রথমত ও প্রধানত কথাশিল্পী।কাক ও কারফিউ (১৯৯৮), নষ্ট কাল অথবা হৃদয়ের অসুখ (২০০৮), কমরেড ও কিরিচ (২০১০) এবং পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা (২০১১), তার ছোটগল্প গ্রন্থ।এ পর্যন্ত উপন্যাস দুটি।দ্বিতীয় হৃদয় (২০০৬) ও বিয়ের ফুল (২০০৮)।সৃজনশীল রচনার পাশাপাশি তিনি অনুবাদেও ইতিমধ্যে বিদগ্ধ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।নোবেলবিজয়ী অরহ্যান পামুক (২০০৮), আনাড়ী রসিকজন (বালজাকের উপন্যাস, ২০১১),তার উল্লেখযোগ্য অনুবাদগ্রন্থ।পাশাপাশি ছড়াও লিখেছেন।ছড়াগ্রন্থ ফুলকুড়–নি ধানকুড়–নি (২০০৯)।এছাড়াও লিটল ম্যাগাজিন ‘পরিলেখ’ ও ‘নন্দন’ সম্পাদনা করেন।প্রিয় সামহোয়্যারইন ব্লগে তাকে এবং তার সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে জানানোর উদ্দেশ্যে লেখক মাসউদ আহমাদকে দেয়া তার সাক্ষাতকারটি (আংশিক)উপস্থাপন করা হল।মূলত যেসব প্রশ্নে তার সাহিত্যিক মতামত /দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে কেবলমাত্র সে সব অংশ উপস্থাপন করা হল।

মাসউদ -আপনি কিছু বলবেন বলেই লেখেন, না ভালো লাগে বলে ?

নাজিব - কিছু বলার জন্যই মূলত লিখি।তবে ভাল লাগে বলেও কিছু কিছু লিখি বৈকি।

মাসউদ - আপনি সাহিত্যচর্চা করেন কেন?শিল্পের জন্য শিল্প নাকি দায়বদ্ধতা থেকে?

নাজিব- এরকম কিছু ভেবে সাহিত্যচর্চা শুরু করিনি।তারপর একবার যখন শুরু করেছি তখন হয়তো একেক সময় একেক দৃষ্টিভঙ্গি এর পেছনে সক্রিয় থেকেছে, কিন্তু সেটাই একমাত্র উদ্দেশ্য এমন ও নয়।যাই হোক,আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন যে কোন সাহিত্যকর্মী যখন কাজ শুরু করে, তখন তার পেছনে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য-লক্ষ্য-প্রথমে সক্রিয় থাকে না।কারণ তখন তার যে বয়স তাতে জীবন ও শিল্পকে বোঝার মত পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে না।আসলে জীবন ও শিল্প আলাদা কিছু নয়।জীবন ছাড়া শিল্প হয় না,শিল্প ছাড়া জীবন অর্থহীন।দুটি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে মিলেমিশে থাকে যে তাকে পৃথকভাবে অনুভব করা মুশকিল।কিন্তু প্রি - অকুপায়েড হয়ে ভাবলে বা দেখলে তাকে কারো চোখে জীবনধর্মী,কারো চোখে শিল্পময় দেখায়। তবে হ্যা,তারপরও যদি জানার জন্য পীড়াপিড়ি করেন তাহলে বলব জীবন আগে,শিল্পের চিন্তা পরে।একটা গল্প যখন লিখি তখন প্রথমত ও প্রধানত জীবনের ছবিই আঁকি,কিন্তু তাকে জীবনের সৌকর্যে সাজাতেই হয়।তা নাহলে তা সাহিত্য হবে না । সুতরাং দায়বদ্ধতা জীবনের প্রতি যেমন শিল্পের প্রতিও তেমনই।

মাসউদ- আপনার লেখার পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু বলুন। যেদিন লেখেন সেদিনটা কিভাবে কাটে?

নাজিব - আমার লেখার নিদিষ্ট কোন পদ্ধতি নেই।লেখার ধরাবাধা কোন রুটিন আমি গড়ে তুলতে পারিনি।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি থেকে কিছু একটা লিখতে বসি।আমি লেখাকে তার নিজের মত করে চলতে দিতে চাই।লেখা এগিয়ে চলে নিজের মত করে।কখনো বেধে গেলে রেখে দেই।একটা সময় ছিল যেদিন লিখতাম সেদিন নেশাগ্রস্থের মত বুঁদ হয়ে থাকতাম।এখন ঠিক সে রকম হয় না।কারণ একইসাথে নানারকম লেখা নিয়ে কাজ করতে হয়,অন্য কাজেও ব্যস্ত থাকতে হয়।

মাসউদ - গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে উপাদান সংগ্রহের জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে আপনি কতটুকু গুরুত্ব দেন?

নাজিব - যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকি।অভিজ্ঞতা হচ্ছে উপাদান যার সাহায্যে নানা রকম কাঠামো গড়া যায়।কিন্তু তাকে সাহিত্য বা শিল্প করে তুলতে তাকে অবয়ব দিতে হয়, তার উপর নানান রুপ ও রঙ চড়াতে হয়।

মাসউদ - এ প্রসঙ্গটি এ কারণে টানছি যে,বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি ও মানুষ এবং তাদের প্রাত্যহিক জীবনাচরণ - ভাষা আপনার গল্পে এসেছে শিল্পিতভাবে,প্রায়ই লেখকের কণ্ঠস্বর যেন তাদের নিজস্ব অস্তিত্বের ছবি আঁকে।এমন বৈশিষ্ট্য হাসানের রাঢবঙ্গের লেখায় দেখা যায় ............

নাজিব - হ্যা,হাসানের গ্রাম হচ্ছে রাঢবঙ্গের অর্থাৎ বর্ধমান -বীরভূমের গ্রাম। তারাশঙ্কর, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ও তাই।আমার ত মনে হয় হাসানের গ্রামদর্শনে তারাশঙ্করের কিছু প্রভাব আছে।আমাদের গ্রামগুলি বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশেষ করে রাজশাহী আর চাপাইনবাবঙ্গঞ্জের।আরেকজন শক্তিশালী গল্পকারের কথা এখানে বলা উচিত।তিনি হলেন আবু বকর সিদ্দিক।তিনি এই দুই অঞ্চল নিয়েই ,লিখেছেন।কিন্তু আমার মনে হয়, আমিসহ এই চারজনের মধ্যে একটাই হয়তো মিল,সেটা হলো আমাদের সকলেরই গপের পটভূমি গ্রাম,চরিতগুলো গ্রামের মানুষ,বিশেষত কৃষক- মজুর।আর কোন মিল নেই - না জীবনদৃষ্টির,না ভাষার।

মাসউদ - লেখালিখির ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আপনি কিভাবে বিচার করেন ?

নাজিব - বাস্তব অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম।তাই বলে বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে লেখা যাবে না এমন নয়।

মাসউদ - আচ্ছা আপনার গ্রামীণ পটভূমির গল্পে হাসান আজিজুল হকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন প্রভাব আছে বলে ধরা যায়?

নাজিব - তার ব্যক্তিসংসর্গ ও গল্পের ভাষা আমাকে প্রথমদিকে অভিভূত করেছিল।কিন্তু আমার মনে হয় তার প্রভাব আমার উপর পড়েনি।আসলে প্রত্যেক লেখকের সাহিত্যরুচি গড়ে উঠে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে।সেদিক থেকে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আমার দূরত্ব বেশ ব্যাপক।তারপরেও বলব,হাসানের গ্রামভিত্তিক রচনাগুলোই তার শ্রেষ্ঠ রচনা, যদিও তার মধ্যে এক ধরণের কৃত্রিমতাও আছে।তবু আমি সেসব গল্পের ভক্ত পাঠক।

মাসউদ - আপনার সাহিত্যে মানবিক বিশ্লেষণ মনে হয় একটু রহস্যময়,কিন্তু গভীরতাকে স্পর্শ করে। রহস্য সৃষ্টির কারণ একটু ব্যাখ্যা করবেন ?

নাজিব - বাংলা সাহিত্য প্রধানত রিয়েলিস্টিক।আবার অপ্রধান হলেও অত্যন্ত শক্তিশালী হচ্ছে মনোবিশ্লেষণ ধারাটি।তৃতীয় আরেকটি ধারা রয়েছে যার মধ্যে এ দুটো ধারার সম্মিলন ঘটেছে।
যাই হোক,আপনারা হয়তো খেয়াল করে থাকবেন যে,আমার গল্পচর্চা বাংলা গল্পসাহিত্যের এই তৃতীয় ধারার মধ্যে পড়ে।সমকালের নবীন-প্রবীণ অধিকাংশ গল্পকারই এই ধারার অন্তর্ভুক্ত।তবে আমার কিছু গল্প আছে একেবারেই রিয়েলিস্টিক,আবার কিছু গল্প আছে মনোবিশ্লেষণাত্মক এবং নিরীক্ষাধর্মী।যে ধারার গল্পই হোক আমি গল্পে প্রত্যেকটি চরিত্রের মানবিক দিকটাকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এমনকি আমি যে কয়টি বক্তব্যপ্রধান গল্প লিখেছি সেগুলাতেও এই বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে।আর রহস্যময়তার কথা বলছেন?আমি মনে করি ছোটগল্পের এটি একটি অপরিহার্য কৌশল।এ কৌশলে যে যতটা পারঙ্গম তার গল্প ততটাই উৎকর্ষগামী এবং আকর্ষণীয় বটে।আর এই রহস্যময়তার ভেতর দিয়ে গল্পকার চরিত্রের বা বিষয়ের গভীরতাকে স্থান দিতে চান,কিন্তু এই স্পর্শ যে শারীরিক অনুভূতি সৃষ্টি না করে মানসিক(সাইকোলজিক্যাল) বোধ ও চেতনার উম্মেষ ঘটায় সেটা সম্ভব হয় এই রহস্যময়তার কারণেই।

মাসউদ - ছোটগল্প যুগ যন্ত্রণার ফসল- এই কথাটি আপনি কিভাবে বিবেচনা করেন?

নাজিব - কথাটা একটু বদলে বলা দরকার।সেটা হল - যুগ চেতনা।একটা গল্পের সফলতাও অনেকাংশে নির্ভর করে সেটি যুগের প্রবণতা ও চেতনাকে কতটা ধারণ করতে পারল তার উপর। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে,প্রকৃত শিল্পীকে কালাতিক্রমী হতে হয়।কিন্তু সেটা হতে হয় সমকালকে ধারণ করেই।
মাসউদ - আপনি ত প্রচুর অনুবাদ করেছেন।অনুবাদ কি আপনার মৌলিক সাহিত্যচর্চাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে না ?
নাজিব-হ্যা , প্রচুর অনুবাদ করেছি। এখনও করছি।অনুবাদের প্ত্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় বিশ্বসাহিত্য পড়তে গিয়ে।কোনও কোনও লেখা পড়তে গিয়ে মনে হত এই কারণে এই লেখাটি বাংলাভাষী পাঠকের সামনে হাজির করা দরকার।আর একটা জিনিস মনের ভেতর উদয় হয়।সেটা হলো আমি মনে করলাম একটা গল্প,প্রবন্ধ বা উপন্যাস অনুবাদ করতে গেলে সেই লেখাটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া হয়।তার প্রত্যেকটি শব্দ প্রত্যেকটি বাক্য উপমা-উৎপ্রেক্ষা - রুপক - প্রতীক বাগভঙ্গিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা সুযোগ ঘটে।এই অভিজ্ঞতা হয়তো আমার নিজের লেখার সময় কাজে লাগবে।মূলত এই কারণে নব্বই দশকের প্রথম ভাগে অনুবাদের কাজ শুরু করেছিলাম।সম্পাদক - পাঠকদের চাহিদার কারণে সেটা বহুমাত্রিক আর বহুলপ্রজ হয়ে উঠে।
হ্যা , বেশি বেশি অনুবাদ সৃজনশীল লেখকের নিজের লেখার ক্ষতি করে বলেই আমার মনে হয়।প্রথমত, নিজের লেখার সময় কমে যায়। অনুবাদ করতে করতে সেই ভাষাভঙ্গির প্রভাব নিজের ভাষাভঙ্গির উপর পড়তে পারে।২০০৭- ২০০৮ সালে আমি যখন অত্যাধিক অনুবাদ করেছি তখন আমাকে এই বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

মাসউদ -বিশ্বসাহিত্যের সাথে তুলনা করলে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থান কোন পর্যায়ে?বাংলা সাহিত্য চর্চায় ঢাকা না কলকাতা এগিয়ে?

নাজিব -এই বিষয়টা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে।এখানে সে সুযোগ নেই।আমি সংক্ষেপে যেটা বলতে চাই সেটা হচ্ছে,সাহিত্য একটি নির্দিষ্ট ভাষা এবং সেই ভাষাভাষী মানুষের জীবনবোধ ও জীবনচর্চাকে অবলম্বন করে সৃষ্টি হয়।তাই আঙ্গিক এক রকম হলেও লেখা শেষ পর্যন্ত এক রকম হয় না।
বাংলা সাহিত্যের কথা যদি বলি তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে,আমাদের সাহিত্যে আধুনিকতা মূলত ইউরোপ হতে আমদানী করা এবংসাহিত্যের বিচারপদ্ধতি ও ইউরোপীয় বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত।ইউরোপ যে মানদণ্ড বেধে দিয়েছে তার ভিত্তিতেই বিশ্বসাহিত্য যাচাই বাছাই করা হয়।
অথচ প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব সাহিত্যকে তার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারাই পরীক্ষা করা উচিত।অবশ্য তার মানে এই নয় যে সার্বজনীনতা থাকবে না।যাই হোক,যে সাহিত্য ইউরোপীয় সাহিত্যের মত নয়,তাকে বিশ্ব দরবারে ঠাই না দেবার তৎপরতা এখনো শক্তিশালী।এটা উপনিবেশকতার কুফল।উপনিবেশিক কারণে ইউরোপের বাইরের যে সব সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে,সেসব সাহিত্যকে বিশ্বমানের মর্যাদা 'দেওয়া' হয়েছে।বাংলা ভাষা আজতক সেই 'সুবিধা'আজতক 'অর্জন' করতে পারেনি।তা নাহলে, আমি মনে করি বাংলা সাহিত্য বিশ্বের যে কোন সাহিত্যের সাথে তুলনীয়।বিশেষ করে কবিতা ও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ।তবে হ্যা,একটা কথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে আমাদের সাহিত্যের গড়পড়তা মান আশানুরূপ নয়।উচ্চমানসম্পন্ন রচনাও প্রচুর নয়।আজকাল বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে উপন্যাসের জয়জয়কার।কথাসাহিত্য দিয়েই আজকাল সাহিত্যের গুণ মান বিচার করা হচ্ছে।এই ক্ষেত্রে আমরা তুলনামূলকভাবে দুর্বল।
বাংলাদেশ আর পশ্চিমবাংলার সাহিত্যের মধ্যে সাধারণভাবে তুলনা করলে আমি বলব কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই।তবে উৎকর্ষ এবং পরিমাণ একই সাথে বিবেচনায় নিলে বলব আমরা কবিতা ও প্রবন্ধে অগ্রগামী,ওরা এগিয়ে কথাসাহিত্যে।

মাসউদ - আমাদের কথাসাহিত্য এগুচ্ছে না কেন?

নাজিব - এগুচ্ছে না কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়।বলা ভাল কাঙ্ক্ষিত গতিতে,কাঙ্ক্ষিত প্রাচুর্যে হচ্ছে না।এর অনেক কারণ আছে। একটা বড় ব্যাপার ঐতিহাসিক।বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ একই ভাষাভাষী হলেও ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে এদের শিক্ষা,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটেছে ভিন্ন পথে ভিন্ন ভাবে।এই কারণে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা(মূলত হিন্দু)যত দ্রুত ও যত সহজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের নিজস্ব ধারাবাহিকতাকে যত দ্রুত ও যত সহজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের নিজস্ব ধারাবাহিক্তাকে অনুসরণ এবং ইউরোপীয় ধারাকে আত্মস্থ করতে পেরেছে,বাংলাদেশের বাঙালি( মূলত মুসলিম) জনগোষ্ঠী তা পারেনি।তারপরেও কবিতা ও প্রবন্ধের অগ্রসরতা অতুলনীয়।কিন্তু সেতা কথাসাহিত্যে ঘটতে পারেনি। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের দিগভ্রান্তিও একটা বড় কারণ।চল্লিশের দশক হতেই এর শুরু,এবং সেটা আজো চলছে।আমরাবাংলাদেশের গল্প -উপন্যাস না লিখে ইউরোপীয় গল্প - উপন্যাস লেখার দিকে ঝুকে পড়েছি।আমরা বিষয় -আঙ্গিক- জীবনবোধের নিজস্বতাকে আবিস্কার করার পরিবর্তে ইউরোপ আমেরিকার অন্ধ অনুসরণ,এমনকি অন্ধ অনুকরণ করার চেষ্টা করেছি।কিন্তু সেটাও সফলতার সাথে করতে পারিনি।কারণ, আমরা আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং বাঙ্গালিত্বকে বিসর্জন দিতে ও সক্ষম হইনি।

মাসউদ - তাহলে বাংলাদেশের একজন সাহিত্যিকের সামনে মূল সমস্যাগুলো কী?একটু বিস্তারিতভাবে বলুন।

নাজিব- সমকালে লেখক হিসেবে আমরা প্রধানতঃদুটি সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছি।একটা হলো,বিশবপ্রগতির,আসলে ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে আমাদের পশ্চাঁদপদতার বিশাল ফারাক সৃষ্টি হয়েছে।বাংলা কথাসাহিত্যের জন্মই অনুকরণ আর অনুসরণ দিয়ে।মাঝখানে তা দ্রুত নিজস্ব চরিত্র অর্জন করে।কিন্তু এখন আমরা আবার সেদিকে ছুটে চলেছি।তার কারণ ঐ ফারাক।আমাদের জীবন এখন উপনিবেশ-কালের চেয়েও ব্যাপক ও গভীরতর অর্থে পাশ্চাত্য-নির্ভর।আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক,সাংস্কৃতিক ও নৈতিকভাবে পশ্চিমের বিশ্বস্ত দাসে পরিণত হয়েছি।পশ্চিম যা করছে আমতা তা-ই করতে চাই।আমরা আমাদের মাঠে ঘাটে ইউক্যালিপটাস লাগাই। হাইব্রিড ফসলের চাষ করি।পারলে যমুনার চরে টুইন টাওয়ার লাগাতে চাই।আমার গল্পের পটভূমি পদ্মার চর,যেখানে বিদ্যুৎ নেই,রাস্তা নেই,স্কুল নেই,হাসপাতাল নেই,কিন্তু আমার মগজের ভেতরে আছে নিউইয়র্ক,লন্ডন,প্যারিস।আমার চরিত্র ফুলবানু, আব্দুল হালিমরা লেখাপড়া জানে না,সারাদিন কাজ করে,অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটায়,আল্লাহ-বিল্লাহ করে,কিন্তু আমার মগজে মাক্সবাদ,যৌনতত্ত্ব,মনোবিকলনতত্ত্ব,আধুনিকতাবাদ,,আধুনিকতাবাদ,উত্তরআধুনিকতাবাদ,উপনিবেশবাদ,উত্তর উপনিবেশবাদ,ইত্যাদির জটলা। কথা না বাড়িয়ে বলি,আমার মগজের চিন্তা আর আমার দেশ - কাল মানুষের বাস্তবতাকে আমি মেলাতে পারি না।পটভূমি ও চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গেলে মগজের চিন্তাকে কাজে লাগানো যায় না,বা মগজের চিন্তাকে যেহেতু আমি কাজে লাগাতে চাই (দাসত্ববোধ আমাকে প্রলুব্ধ ও বাধ্য করে)সে কারণে এই পটভূমি ও চরিত্রের উপর নির্ভর করা চলে না। আমি যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দাস,সেজন্য আমাকে আমার পটভূমি ও চরিত্রের সাথে প্রতারণা করতে হয়। সে কারণেই আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার লেখকরা যা পেরেছে আমরা তা পারিনি।যদিও উপনিবেশ তাদের কাছে এমনকি ধর্মও ভাষাও কেড়ে নিয়েছে।এই মেলাতে না - পারার ব্যর্থতা ঢাকতে আমরা বোধ হয় বিষয় হিসেবে শ্লোগান (রাজনীতি নয়),কামুকতা (যৌনতা)নয়,ঐতিহ্যবিরোধিতা(প্রগতি নয়) প্রভৃতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।আর তার সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছি পশ্চিমা সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি,ও চিন্তার দাসত্ব। আর একটি সমস্যা হলো ভাষার ধুম্রজাল।একপাতা- আধপাতা পড়ার পরই যদি পাঠককে ক্লান্ত ও বিরক্ত হতে হয়, সে ভাষা শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের শত্রুতে পরিণত হয়, যদিও তার লক্ষ্য সাহিত্যের উৎকর্ষই।অনুবাদ আর ইংরেজির মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্য পাঠ করে আমার ধারণা হয়েছে, কোনও বড় লেখক,একেবারেই হাতে গোনা দু'একজন ব্যতিত,ভাষাকে দুর্বোধ্য করেন না।গল্পের মাঝে প্রবন্ধের স্বাদ নিতেও পাঠক প্রস্তুত বলে মনে হয় না।

মাসউদ -কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ এবং ব্যক্তি নাজিব ওয়াদুদ কে আপনার সবচেয়ে বেশি প্রিয়?

নাজিব- ব্যক্তি নাজিব ওয়াদুদ ভেবে বিস্মিত হয় কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ আমার তুলনায় কতই না সৃজনশীল,মননশীল,আর কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ ব্যক্তি নাজিব ওয়াদুদের বড়ত্বের কাছে সব সময় মস্তক অবনত করেই রাখে। এই দুইজন পরস্পরের প্রতি বেশ একটা সমীহ ভাব পোষণ করে।


নাজিব ওয়াদুদ সম্পর্কিত কিছু লিঙ্ক
নাজিব ওয়াদুদের গল্প মাটিমাখা মানুষের ঘ্রাণ
গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক (অনুবাদঃ নাজিব ওয়াদুদ)
কবিতার ব্যক্তিকতা ও সর্বজনীনতা মাহমুদ দারবিশ অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ
মাহমুদুল হক উন্মূল ব্যক্তিজীবনের শব্দভাস্কর নাজিব ওয়াদুদ
পদ্মাপাড়ের বউ -নাজিব ওয়াদুদ
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ২:৪০
২৯টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×