শহীদ জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র জনাব তারেক রহমান ১৯৯১ থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে পুত্র তার পিতার রাজনীতি এবং রাজনৈতিক আদর্শকে পালন করবে এটাই স্বাভাবিক।
২০০৭ এর ১১ জানুয়ারী বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের পর একটি বিষয় ব্যাপক আলোচনায় আসে। বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসেছিল। এই পরিবারতন্ত্র থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করা না গেলে দেশের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। এক যুক্তিতে বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমানের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। যারা এসব কূটতর্ক করেছে, তারা উপমহাদেশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার নামে তারা একটি কূটতর্কের সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তারা কি জানেন না, ভারতীয় রাজনীতিতে মতিলাল নেহেরু, তার পুত্র জওহরলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধী, রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং রাজীব ও সোনিয়ার পুত্র রাহুলের ভূমিকার কথা।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো, তার কন্যা বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তানী রাজনীতিতে ভূমিকা সবারই জানা। বেনজিরের জ্যেষ্ঠ পুত্র অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে রাজনীতিতে সক্রিয় হবে এটাও জানা কথা। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অং সান সুকি, মিয়ানমারের প্রয়াত জাতীয় নেতা আং সান-এর কন্যা। তাহলে তারেক রহমান রাজনীতিতে এসে কী দোষ করলেন? শেখ কামাল বেঁচে থাকলে কি আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব দিতেন না? শেখ হাসিনা কি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের ঐতিহ্য বহন করছেন না?
১৯৯১ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির রাজনীতিতে প্রায় নেপথ্যে থেকে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তারেক রহমান। বিএনপির রাজনীতিতে সাংগঠনিকভাবে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল যেমন: সংগঠনের জন্য একটি ডাটাবেজ প্রতিষ্ঠা করা, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নেতৃস্থানীয়দের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ ও নথিভুক্ত করা, জাতীয় রাজনীতির উত্থান-পতন সম্পর্কে জরিপ চালানো প্রভৃতি কাজগুলো তারেক রহমান সুনিপুণভাবে করে যাচ্ছিলেন। ২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপি যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে তার অবকাঠামো সৃষ্টিতে তারেকের অবদান অনস্বীকার্য। তার মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দলটির রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিত্তি সুদৃঢ় করার কাজে অবদান রেখে যাচ্ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুষ্পদল সংগ্রহ করেছেন, আর তারেক সেই পুষ্পদলের মালা গাঁথার চেষ্টা করেছেন। কখনও তিনি সফল হয়েছেন, আবার কখনও তিনি সফল হননি। কিন্তু তার এই প্রয়াসকে কখনো তুচ্ছ করা সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিন দলের রাজনীততে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেপথ্যচারীর ভূমিকা পালন করলেও সরাসরি কোন দলীয় পদে তারেক আসেননি। অবশেষে ২০০২ সালে তিনি বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান। দলকে প্রাণবন্ত করে তোলায় তার যে ভূমিকা সেই তুলনায় তার এই প্রাপ্তি খুব বড় কিছু ছিল না। তিনি হয়তো নিছক উত্তরাধিকারের সূত্রেই এই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। বেশ কিছু মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার মাধ্যমেই তিনি তার কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন মাত্র।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিস্পেষণের স্টীম রোলার নেমে আসে। সেই সময়কার শাসকগোষ্ঠী এই নির্যাতনকেই যৌক্তিকতা দিতে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের আশ্রয় নিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, ১১ জানুয়ারীর কুশীলবরা সত্যিই কী দুর্নীতি উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন? তাহলে পরবর্তীকালে কেন তাদেরই বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলো? আসলে তারা এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য দুর্নীতির ধূয়া তুলেছিল। তাদের এই লক্ষ্যটি ছিল বাংলাদেশকে শেষ বিচারে একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করা। সে জন্যই দিল্লি থেকে ছয় ঘোড়া উপহার এনে দিল্লির অশ্বমেধযজ্ঞ সমাপন করা হয়। একটি দেশের প্রধান সেনাপতি যখন মীর জাফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন ‘বণিকের’ মানদণ্ড দেখা দেয় রাজদন্ড রূপে। পোহালে শর্বরী। বাংলাদেশ আজ সেই কানাগলিতে আবর্তিত হচ্ছে।
তারেক রহমান গ্রেফতার হলেন ২০০৭ সালের ৭ মার্চ। তার কয়েক মাস পর গ্রেফতার হলেন তার মা। উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রাজনীতিকে কবর দেয়া। রিমাণ্ডে নিয়ে তারেক রহমানের ওপর চললো চরম নির্যাতন। তারেক রহমান পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হলেন। কোন সভ্য দেশে এ ধরনের নির্যাতন কল্পনা করা যায় না। যার পিতা স্বাধীনতার ঘোষক, একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা, যিনি বাংলাদেশকে স্বাধীনপথে চলার দিশা যুগিয়েছেন, তার সন্তানকে তারই দেশে এমন মানবতা বিরোধী নির্যাতনের শিকার হতে হলো। সব শাসকগোষ্ঠীরই সংকট একদিন না একদিন দেখা দেয়। ১১ জানুয়ারির কুশীলবদের সামরিক শাসনের চাইতেও নির্মম শাসন দু’ বছর না গড়াতেই সঙ্কটের মুখোমুখি হলো। সেই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা নিরাপদ প্রস্থানের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারা বাধ্য হলো দুই নেত্রীকে মুক্তি দিতে। বাধ্য হলো বেগম খালেদা জিয়ার দুই সন্তানকেও মুক্তি দিতে। আজ তারেক রহমান বিদেশের মাটিতে চিকিত্সাধীন। সপ্তাহে দু’ দিন তাকে হাসপাতালে গিয়ে চিকিত্সা নিতে হয়। ভরদন্ড ছাড়া তারেক রহমান চলাফেরা করতে পারেন না। সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত জাতীয় জীবনে তিনি সক্রিয় কোন ভূমিকা রাখতে পারবেন না। জিয়া পরিবার এই মুহূর্তে শাসকগোষ্ঠীর টার্গেট। তারা খুব ভালো করেই জানে জিয়া পরিবারকে পর্যুদস্ত করতে পারলে তাদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারবে। কারণ একটি আন্দোলন নস্যাত্ করার জন্য তার নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে হয়। সেই পথই তারা বেছে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। নির্যাতন-নিপীড়ন এবং ভয়াবহ সব মামলার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে গেলে দেশে ব্যপক গণআন্দোলনের প্রয়োজন হবে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরে বিশাল গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হওয়ার ফলেই শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে রেহাই পেতে পেরেছিলেন, তারেক রহমানের ক্ষেত্রেও এটি কম সত্য নয়। ভবিষ্যতই বলে দেবে ইতিহাস কোন পথে এগুবে।
তারেক রহমান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে গভীর সেতুবন্ধন নির্মাণ করতে তৃণমূল সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এসব সম্মেলনে কর্মীরা দলীয় রাজনীতি ও সংগঠন সম্পর্কে মন খুলে কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে একটি সুসংঘবদ্ধ বিএনপি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আজ তারেক রহমান অনেক দূরে। তার পক্ষে তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্য এই পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক।
তারেক রহমান ইতিমধ্যে বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কারা নির্যাতন তাকে নিশ্চয়ই অনেক শিক্ষা দিয়েছে। কারা বন্ধু, কারা শত্রু সেসব নিশ্চয়ই তিনি এতোদিনে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিংবা কোথায় কোথায় ভুলত্রুটি হয়েছিল, সেগুলোও নির্জন প্রবাসে খতিয়ে দেখার সুযোগ তিনি পাচ্ছেন। যারা স্তাবক এবং সুযোগ সন্ধানী তাদেরকে সযত্নে এড়িয়ে চলার কাজটি তিনি যত সুনিপুণভাবে করতে সক্ষম হবেন, ততোই তার সাফল্য নিশ্চিত হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখন অত্যন্ত জটিল। এই জটিল রাজনীতির অলিগলিগুলো চেনার জন্য গভীর অধ্যয়নের কোন বিকল্প নেই। তিনি যদি প্রবাসের দিনগুলোকে অসুস্থতা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে এই অধ্যয়নের কাজে ব্যয় করেন তাহলে তার সুফল তিনি একদিন না একদিন পাবেন নিশ্চিত। বিগত জাতীয় সম্মেলনে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ নির্বাচনে কোনো ভিন্নমত ছিল না। এতগুলো মানুষের আকাঙ্ক্ষার মূল্য তিনি নিশ্চয়ই পূরণ করবেন। এটাই সকলের প্রত্যাশা। প্রবাস জীবন রাজনীতিকদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী কোন ঘটনা নয়। আমরা সেই শুভ দিনের অপেক্ষা করবো যেদিন তিনি বিজয়ীর বেশে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাকে সুস্থতা অর্জনের তৌফিক দিন, এই কামনাই করছি।
সুত্র- Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



