somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতীয় স্বার্থ বিরোধী টিকফা চুক্তি সই করা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি’ (টিকফা) সই হওয়ার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে বলে পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ। বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্য অংশীদার হওয়ায় গত এক দশক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য। এই চুক্তির ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় ২০০২ সালে এবং ২০০৫ সালে ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। প্রথম দিকে চুক্তির নাম ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত চুক্তি (TIFA) থাকলেও চুক্তির ব্যাপারে এদেশের সচেতন মহল থেকে প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে সমালোচনা বন্ধ করার প্রয়াসে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে Trade and Investment Co-operation Framework Agreement বা ‘টিকফা’ (TICFA) হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। দুর্নীতি, মেধাস্বত্ব ও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে দুদেশের মাঝে মতানৈক্য থাকায় বিভিন্ন সময় চুক্তি নিয়ে আলোচনা থেমে গিয়েছিল। এ চুক্তি সম্পাদনে যুক্তরাষ্ট্র শর্ত দিয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুর্নীতির আশ্রয় না নেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে বিষয়টি চুক্তিভুক্ত করতে হবে। অত্যন্ত অমর্যাদাকর শর্তের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে বলে বাংলাদেশ আপত্তি জানায়। খবরে প্রকাশ বর্তমানে সরকারের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক ও নোবেল বিজয়ী ডক্টর ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল ইত্যাদি কারণে চাপে পড়ায় বাংলাদেশ সরকারকে আবারো টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা গত ২৮ জুলাই আবারো এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “টিকফা চুক্তি সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে না।“ টিকফা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষিকে ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় উল্লেখ করে তিনি জানতে চান, “এতে খারাপ কী আছে? আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না।” কিন্তু এই চুক্তিতে উদার বাণিজ্য নীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং মেধাসত্ব আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে আমাদের পণ্য রফতানিও। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রফতানির যথাক্রমে ২১ এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করলেও তারা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানিতে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫.৩% শুল্ক দিতে হয় অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩% । তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন টিফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রফতানি করতে পারছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে কিন্তু টিকফা এগ্রিমেন্টে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ চুক্তির ১৪ নং প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অশুল্ক বাধা খুব সামান্যই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কেন এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এতটা আগ্রহী। অনেক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞের মতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাইরে স্বল্পোন্নত দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আমেরিকা সহযোগিতামূলক উদ্যোগের ছদ্মাবরণে টিফা বা টিকফার মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছে। যদি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় তবে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ফোরাম ডব্লিউ,টি,ও এ আমেরিকা তার আধিপত্যবাদী বাণিজ্য নীতি বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই লক্ষ্যেই পাকিস্তান,সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ বিশ্বের ৩০ টিরও বেশি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই টিফা চুক্তি সাক্ষর করেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য এসব ফোরামে বাংলাদেশ যাতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারে সেজন্য বাংলাদেশকেও টিকফা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র কেননা টিকফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার প্রশ্নে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করে গণচীনের অব্যাহত উন্নয়ন ও পরাশক্তি হিসেবে চীনের অভাবনীয় অগ্রগতি ঠেকাতে এবং দক্ষিন এশিয়ার বিশাল বাজারের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারতমহাসাগরে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখতে হবে। আর বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আঞ্চলিক পার্টনার বানাতে আগ্রহী। ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকার কাছ থেকে অধিকতর সহযোগিতার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাচ্ছে কেননা এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।

এই চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায় এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতসমূহে বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। চুক্তির ৫ এবং ১৯ নং প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে। প্রস্তাবনা ৮ এ প্রাইভেট খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত “ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন” প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ সরবরাহ করবে। অনুচ্ছেদ ১ এ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত রাখা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে, তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোনো পণ্য এ দেশে উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান শুল্ক এবং অশুল্ক বাধাসমুহ দূর করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশকে দেশীয় শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষন নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত “দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি” অনুযায়ী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। ফলে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে দেশের সেবাখাতসমূহ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এতে করে দেশীয় কোম্পানিগুলোর স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। অবাধ মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো সেবা ও পণ্যের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি করবে। টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতির ব্যবহার মূল্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিবিধ নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে। সেবাখাতে বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে সেবা দানের যেসব কর্মসূচী নিয়ে থাকে তা সঙ্কুচিত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে গরিব এবং সাধারণ মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। চুক্তির ১৮ নং প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে সুকৌশলে বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করে অনুন্নত দেশকে বাণিজ্য সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থাকছে। দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষিতে ৫% এর বেশি ভর্তুকি দিতে পারছে না, অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯% এর বেশি ভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা। আমেরিকা ঠিকই বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিয়েছে তবে তাতে ঐসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার রপ্তানির পরিমান খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করছে অথচ আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য উদারনীতি গ্রহণে নানা চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করছে।

টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাসত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। এই আইনটি উন্নত দেশগুলোর মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করবে যাতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে অবাধে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের আইনি বৈধতা পাওয়া যায়। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতির অধিকারী হবার পর তারা এই জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্ব প্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পেটেন্ট আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের অনুপস্থিতির কারণে বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানির অবাধ বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টিফা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মেধাস্বত্ব আইন মানতে বাধ্য করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে ২০১৬ সালের আগেই মেধাস্বত্ব আইন মেনে চলতে হবে কেননা চুক্তির ১৫ নং প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার (TRIPS) এবং অন্যান্য প্রচলিত মেধাস্বত্ব আইনের যথাযথ এবং কার্যকরী রক্ষণাবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে । দোহা ঘোষণা ২০০০ অনুযায়ী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাণিজ্যবিষয়ক মেধাসম্পদ স্বত্ব চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এবং ২০১৬ পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পেয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রফতানি করতে পারছে। এমনকি প্রয়োজন হলে এই সময়সীমা আরো বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু টিকফা এ সে ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যার সহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে অভূতপূর্ব লোকসানের কবলে পড়বে। ফলে বিভিন্ন পণ্য এবং প্রযুক্তির দাম অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতেই দেশকে সফটওয়্যার লাইসেন্স ফি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। মেধাস্বত্ত্ব আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না, আমাদেরকে কয়েকগুন বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে । বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি সম্ভাবনা হারাবে। দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। আমাদের জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প ধংস হয়ে যাবে। তা ছাড়া ওষুধের পেটেন্ট আগে দেওয়া হতো সাত বছরের জন্য, এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস আইনে তা আরও বাড়িয়ে ২০ বছর করা হয়েছে। অর্থাৎ আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা লুট করবে। পেটেন্ট আইন বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। পেটেন্ট এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ গাছড়ার উপরও বিস্তৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইনে বলা আছে, “কোন কিছুর পেটেন্টের বেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অলিখিত উৎসের অনুসন্ধানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই”। এর মানে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশের প্রচলিত উৎপাদন প্রনালী, জীববৈচিত্র্য, কৃষকদের নিজস্ব শস্যবীজ ইত্যাদি শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং অর্থের জোরে পেটেন্ট করে নিতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশের নিজস্ব জীববৈচিত্রের অনেক জীব-অণুজীব এবং উদ্ভিদ প্রজাতি এখন বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্টের দখলে। ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছগাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। নিম, হলুদ,মশলা, থানকুনি,চিরতার রস, ট্রাইফোলিয়েট অরেঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ফলজ এবং ওষধি গাছ যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কোম্পানির পেটেন্ট আগ্রাসনের শিকার হতে চলেছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের উন্নত জেনেটিক টেকনোলজির মাধ্যমে ডি এন এ ফিংগার প্রিন্ট নির্ণয় করে অন্য দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিজ সম্পদকে নিজের বলে পেটেন্ট করিয়ে নিচ্ছে। কৃষিতে পেটেন্ট বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের শস্য বীজ উৎপাদন, সংরক্ষন, পুনরুৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। মেধাস্বত্ব আইন অনুযায়ী রয়ালিটি পাবে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর ধ্বংস হবে দেশী প্রজাতি, পরিবেশ এবং কৃষি উৎপাদন কাঠামো। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম অনেকগুন বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন- ট্যারিফ বাধা হিসেবে ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ এবং নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে বিনিময়ে লাভের পরিমাণ হবে সামান্যই। তাই জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি এই ধরণের চুক্তি স্বাক্ষর থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। দেশপ্রেমিক জনগণকে সাথে নিয়ে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×