somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্যাটেন্ট আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সম্পদঃ সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং নির্লিপ্ততা কার স্বার্থে?

০৭ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং কৃষিজ পণ্যের উপর একের পর এক মেধাস্বত্ব অধিকার তথা মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায় সম্প্রতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা থেকে রাজশাহীর ফজলি আমের মালিকানা স্বত্ব নিয়ে নিয়েছে ভারত। ফলে ভবিষ্যতে আমরা ফজলি আম খেতে চাইলে ভারতকে ট্যাক্স (রয়্যালিটি) দিয়ে খেতে হবে। এর আগে বাংলাদেশের জামদানি শাড়ির স্বত্বও নিয়ে নিয়েছে ভারত। ওষধি গাছ নিমের স্বত্ব নিয়ে গেছে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে ভারত। বাসমতির স্বত্ব নিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথাকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ভারত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কাছে এর মালিকানা স্বত্বও দাবি করে রেখেছে (সূত্রঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১০ আগস্ট, ২০১২)। এভাবে একের পর এক আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পণ্য, ওষধি গাছ এবং কৃষিজ শস্যের মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং এসব পণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অন্যায্য এবং অসম ট্রিপস (TRIPS) চুক্তি অনুযায়ী অন্য দেশের স্বত্ব নেয়া পণ্যগুলো ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন এবং আমদানি-রপ্তানি করতে হলে স্বত্ব পাওয়া দেশকে রয়্যালিটি দিতে হবে। মেধাস্বত্ব মালিকানা হারানোর ফলে ভবিষ্যতে ট্রিপস চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের জামদানি ও নকশিকাঁথার উৎপাদন ও বিপণন, হারিয়ে যাবে আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। এছাড়াও বাধাগ্রস্ত হবে আমাদের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা। হাতছাড়া হয়ে যাবে আমাদের লোকায়ত জ্ঞান। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক পণ্য পেটেন্ট আগ্রাসন তথা বায়োপাইরেসির শিকার। বায়োপাইরেসি হচ্ছে অন্যায্য পেটেন্টের মাধ্যমে অন্য দেশ ও লোকালয়ের জেনেটিক সম্পদ বিশেষ করে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজ সম্পদ আত্মসাৎকরণ। গত দুই দশক ধরেই পশ্চিমা বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেমন মনসেন্টো, ইউনিলিভার, ডুপন্ট তৃতীয় বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জ্ঞান, প্রাণ বৈচিত্র্য তথা জেনেটিক সম্পদকে অবৈধভাবে পেটেন্ট করে নিয়ে এসবের উপর তাদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ ধরনের পেটেন্ট আগ্রাসনের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারা যেখানে দুনিয়ার সব প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। ব্যাবসায়িকভাবে অবাধ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে এই মেধাস্বত্বের অধিকার। প্রাণ এবং জীবনের পেটেন্টকরণ শুধু অনৈতিক এবং অন্যায়ই নয়, তা জীববৈচিত্র্যের পণ্যকরণ ও বাণিজ্যকীকরণের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের স্থানীয় জনসাধারণের লোকায়ত জ্ঞানের উপর বহুজাতিক কর্পোরেশনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে ঐতিহ্যবাহী সম্পদের লুণ্ঠনের পথ প্রশস্ত করে দিবে।

আগামী শতাব্দী হবে জীববিজ্ঞানের শতাব্দী যেখানে মেটাল ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির জায়গা দখল করে নিবে বায়োলজিক্যাল পণ্য। তাই বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর বনভূমির ‘ জেনেটিক ফার্মেসী’ এবং কৃষিজাত শস্য বীজের উপর নিজস্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন বহুজাতিক এগ্রো-কেমিক্যাল কর্পোরেশন মনসেন্টো, ইউনিলিভার ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে শস্য বীজ সংগ্রহ করে গড়ে তোলে বিশাল শস্য বীজ ব্যাঙ্ক । এরপর উক্ত শস্যের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করে যে জিনটি শস্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী তা সনাক্ত করে। লোকায়ত কৃষকদের বীজের সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ক্রসিং (Natural combination) এর ফলে যে জিনের উদ্ভব তাকেই ল্যাবরেটরিতে সনাক্ত করে বহুজাতিক কোম্পানি তার মৌলিক উদ্ভাবনা বলে চালিয়ে দেয় এবং ঐ শস্য বীজের পেটেণ্ট করে নেয়। কোম্পানি পরবর্তীতে জেনেটিক রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সমস্ত উদ্ভিদ, বীজ ও উদ্ভিদজাত সব পণ্যের উপর তার মালিকানা নিয়ে নেয়। কৃষিজ উদ্ভিদের যে বৈচিত্র্য, বিভিন্ন জাতের ও বৈশিষ্ট্যের যে সমাহার তা কিন্তু কৃষকদের বীজের সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন ও নবায়নযোগ্য ব্যাবহারেরই ফল। কোম্পানি কৃষকদের পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতালব্ধ এই উৎপাদন প্রণালীকেই নিজস্ব উদ্ভাবন বলে দাবী করে শুধু মাত্র অর্থ ও প্রযুক্তির জোরে। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের কৃষক ও জনসাধারণের উৎপাদন প্রণালী উদ্ভূত বিভিন্ন শস্য বীজের জাত চলে যায় বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানায়। এভাবে প্রাণ ও উদ্ভিদের পেটেন্ট হচ্ছে হাজার বছরের উন্নয়নশীল দেশের জ্ঞানের নীরব চৌর্যবৃত্তি। উদাহরণস্বরূপ ১৯৯৫ সালে মার্কিন কৃষি বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশের ওষধি গাছ নিম হতে প্রাপ্ত ছত্রাক বিরোধী ওষুধের পেটেন্ট, মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি মনসেন্টো কর্তৃক ১৯৯৯ সালে ভারতের উচ্চ বেকিং ক্ষমতা সম্পন্ন ‘ন্যাপ হাল’ গমের মেধাস্বত্ব দাবী, ২০০০ সালে মেক্সিকোর উচ্চ লিপিড সম্পন্ন বিশেষ ভুট্রার উপর ডুপন্ট এর স্বত্ব দাবী, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাসমাতি চালের উপর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ রাইসটেক’ কোম্পানির মালিকানা দাবী এবং ‘টেকনোমতি’ নামে বাজারজাতকরণ ইত্যাদি। এছাড়াও গাছের বিশেষ উপাদান যেমন প্রোটিন বা লিপিড এবং এসব উপাদান সমৃদ্ধ সমস্ত জেনেটিক সম্পদ, হাইব্রিড ব্রিডিং প্রণালীর সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্ত বীজ ও উদ্ভিদ, টিস্যু কালচার প্রযুক্তির প্রয়োগে উদ্ভূত উদ্ভিদের জেনেটিক বস্তু, বাহ্যিক জিনকে (external gene) বিদ্যমান প্রজাতিতে প্রযুক্ত করে নতুন জিন বহনকারী সকল উদ্ভিদ এবং বীজকে নিজের বলে দাবি করে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ডুপন্ট এবং পাইওনিয়ার এসব জৈবিক সম্পদের উপর পেটেন্টের আবেদন করে রেখেছে। বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক এভাবে পেটেন্ট আগ্রাসনের ফলে পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন শুরু হলে আমাদের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। প্রথমত, বায়োপাইরেসির ফলে লোকায়ত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং জেনেটিক সম্পদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এসব উদ্ভিদ এবং শস্য বীজের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উৎপাদনের উপর বিধিনিষেধের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো খাদ্য শস্যের উপর গবেষণা করতে পারবে না এবং খাদ্য নিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট কর্পোরেশনের হাতে। স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্যবীজ, উদ্ভিদ এবং ওষধি গাছের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকদের নিজেদের জমিতে/খামারে বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যাবহার এবং বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত হবে পেটেন্ট আইনের কারনে। ফলে পেটেন্টেড শস্য বীজ ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ উৎপাদনের জন্য হয় বহুজাতিক কোম্পানিকে রয়্যালিটি দিতে হবে অথবা আমাদেরই উৎপাদন প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত এসব দ্রব্যাদি উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য করা হবে। ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে কৃষিজ পণ্য ও খাদ্য দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে, হুমকির মুখে পড়বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। আর এসব পেটেন্টেড পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা অর্জন করবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং হারবাল ওষুধ বিজ্ঞানকে বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্ট আগ্রাসন থেকে মুক্ত করতে হলে দরকার আমাদের লোকায়ত জ্ঞানের সংরক্ষন এবং রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য একদিকে সরকার এবং সচেতন মহলকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারা অনুযায়ী প্রাণ ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পেটেন্টকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে। বর্তমানে দক্ষিন আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ১১৮টি সংগঠন সব ধরনের প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্ট বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্টের বিপক্ষে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (মেক্সিকো, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া) কৃষক ও আদিবাসীদের বিভিন্ন ফেডারেশন যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে তার সাথে এদেশের কৃষক ও জনগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে। সরকারকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অন্যায্য মেধাস্বত্ব অধিকার আইন বাতিলের জন্য কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে হবে। অন্যদিকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ভৌগোলিক নির্দেশক আইন (জি আই এ) ১৯৯৯-এর ২২,২৩ ও ২৪ ধারা অনুযায়ী বিশ্বের প্রতিটি দেশের নিজেদের বিশেষ ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত পণ্য সংরক্ষণের অধিকার রয়েছে। এজন্য নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত পণ্যকে নিজস্ব জি,আই,এ আইনের অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এই আইনের ভিত্তিতেই ভারত ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ১১৭ টি পণ্যকে নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য দরখাস্ত করেছে এবং বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পণ্য জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা, ফজলি আমকেও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে এসব পণ্যের স্বত্ব দাবি করেছে। অথচ বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ ১২ বছর পরও এখনো পর্যন্ত ভৌগোলিক নির্দেশক আইন প্রণয়ন করে এদেশের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পণ্যসমূহ নিবন্ধনের মাধ্যমে পেটেন্ট করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। সূত্র মতে বাংলাদেশের বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্প মন্ত্রণালয় নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষে ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ, ২০০৮’ নামের একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করে এতে ১৪ টি কৃষিজাত পণ্য, ১২ টি ফল, ১১ টি প্রক্রিয়াজাত খাবার, ৮ টি শাকসবজি, ৩ টি মৎস্য পণ্যসহ মোট ৪৮ টি খাদ্যপণ্য এবং খাদ্য বাদে ১৮ টি পণ্য মিলিয়ে ৬৬ টি পণ্যকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২০১১ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় ‘ভৌগোলিক নির্দেশক আইন, ২০১১’ এর খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলেও এখনো পর্যন্ত এই খসড়া অধ্যাদেশ আইনে পরিণত না হওয়ায় বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন করতে পারছে না। জি,আই,এ আইন প্রণয়নে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কালক্ষেপণ দেশজ পণ্যের উপর আমাদের জাতীয় মালিকানা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করছে। অতিদ্রুত এই আইনটি প্রণয়ন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় দেশের ঐতিহ্যবাহী ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যসমূহ নিবন্ধন করে এসব পণ্যের উপর জাতীয় মালিকানা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে এদেশেরই ঐতিহ্যবাহী ভৌগোলিক পণ্য জামদানি শাড়ি ও ফজলি আমের মালিকানা স্বত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে উপর্যুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে ভারতের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া নিম, বাসমাতির চাল, হলুদ ইত্যাদির মেধাস্বত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বায়োপাইরেসির মাধ্যমে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ধংসের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এবং ভারতের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ সরকার। কেননা আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য সনদ (সি বি ডি, ১৯৯২) অনুযায়ি প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব জীববৈচিত্র্যের অন্তর্ভুক্ত জেনেটিক সম্পদ ও লোকায়ত জ্ঞানের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবে এবং এই চুক্তিতে বলা হয়েছে মেধাস্বত্ব অধিকার যেন জীববৈচিত্র্যের টেকসই ব্যাবহারকে বাধাগ্রস্ত না করে। মার্কিন কোম্পানি মনসেন্টো ভারতের বাজার দখলের জন্য ভারতীয় বেগুনের জেনেটিক্যাল পরিবর্তন করে নতুন জাত বের করে পুরো বেগুনের উপরই মেধাস্বত্ব দাবি করলে ভারত ২০১০ সালে বায়োপাইরেসির অভিযোগে এবং ভারতের জীববৈচিত্র্য আইন (BDA) ভঙ্গের দায়ে মনসেন্টোর বিপক্ষে মামলা ঠুকে দেয় এবং বর্তমানে ভারতীয় বেগুনের মালিকানা স্বত্ব ফিরে পায়। আমাদের জীববৈচিত্র্য ও লোকায়ত জ্ঞানের বায়োপাইরেসি রোধ করে এসবের সুরক্ষার জন্য ভারতের অনুকরণে তৈরি করতে হবে ট্র্যাডিশনাল নলেজ ডিজিটাল লাইব্রেরী (TKDLK) যেখানে এদেশের সমস্ত ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও স্থানীয় ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ওষধি ফর্মুলা এবং ঐতিহ্যবাহী সমস্ত উদ্ভিদ, শস্য ও ওষধি গাছের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। এই ডিজিটাল লাইব্রেরী বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পেটেন্ট অফিস যেমনঃ ইউরোপিয়ান পেটেন্ট অফিস (EPO), যুক্তরাজ্য ট্রেডমার্ক ও পেটেন্ট অফিস (UKPTO) এবং যুক্তরাষ্ট্র পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক অফিসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে যেন এদেশের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের উপর আগ্রাসন রোধ করা যায়। অধ্যাপক মাকসুদুল আলম এবং হাসিনা খানের নেতৃত্বে এদেশেরই একদল তরুণ বিজ্ঞানী বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল পাটের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করে প্রমাণ করেছেন সরকারি সহায়তা পেলে আমাদের গবেষকরাই এদেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী শস্য ও উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করতে সক্ষম। সরকারের উচিত অতিদ্রুত আমাদের পাটের মেধাস্বত্ব অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের কাজে লাগিয়ে আমাদের ঐতিহ্যবাহী উদ্ভিদ, শস্য ও ওষধি গাছের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করে এসব সম্পদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। পেটেন্ট আগ্রাসন রোধে একদিকে যেমন প্রাণ ও জীবনের উপর পেটেন্ট করার বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে তেমনি এই অন্যায্য আইন নিরসন না হলে আমাদের নিজস্ব সম্পদের পেটেন্ট নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপও আমাদেরই নিতে হবে। এই প্রেক্ষিতেই সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিদ্রুত জি,আই,এ আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে আমাদের নিজস্ব সম্পদের মেধাস্বত্ব সুনিশ্চিত করার দাবী জানাচ্ছি।
২০টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×