somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার....

০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"সারা বিশ্বের বিস্ময়
তুমি আমার অহংকার"


মন ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারন দুটি পংক্তি!
'

বাংলাদেশকে মনে করে গভীর ভালোবাসা নিয়ে গেয়ে যাই এই গান। আমার দেশ সব সময়ই আমাদের ভালোবাসা, আমাদের অহংকার। আমাদের কাছে শ্রেষ্ঠতম। বাস্তবতার সাথে প্রথম পংক্তিটিকে মিলাতে গেলে কিছুটা ভাবিয়ে তুলে।

সত্যি কি বাংলাদেশের এমন কিছু আছে যা বিশ্বকে বিস্মিত করে এবং আমার অহংকার?

এই প্রশ্নের জবাব --- 'অবশ্যই আছে'। আমাদের এমন সম্পদ আছে যা যেকোন দেশের মানুষকে মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে সেই সাথে গর্বে ভরে উঠে আমাদের মন। আর তা হলো আমাদের ভাষা ইতিহাস। বিশ্বের আর কোন দেশ আর কোন ভাষার এমন গৌরবময় ইতিহাস আছে বলে জানা নেই।

পৃথিবীতে দেশের স্বাধীনতা, দেশের মাটির মুক্তির জন্য লড়াই, যুদ্ধ, প্রাণ বির্সজনের প্রচুর উদাহরন আছে। প্রতিটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ সে দেশের জন্য সমহিমায় গর্বের, অহংকারের। তবে, ভাষার জন্য, মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণ বিসর্জনের ঘটনা আর কোন দেশের নেই। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী সালাম, রফিক, বরকতের সেই আত্মত্যাগ বিশ্বের বুকে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছে অনন্য এক জাতি হিসেবে। যার স্বিকৃতী জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারীকে "বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে ঘোষনা করেছে।

নিজের দেশ, নিজের মাতৃভাষার এই গৌরবোজ্জল অবস্থান সুযোগ পেলে ভীনদেশীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই.. জেনে বিস্মীত হন তাঁরা... অথচ, নিজের দেশের কিছু মানুষের আচরন আহত এবং লজ্জিত করে।

একজন চাইনীজ বংশোদ্ভুত বান্ধবী এবং তাঁর স্বামী আমেরিকায় জন্মেছেন, তাঁদের আগের ২/৩ জেনারেশন এই দেশে প্রতিষ্ঠিত। ধনাঢ্য এই দম্পতির আছে বিলাসবহুল বাড়ি, বিভিন্ন স্টেটে জমি সহ অন্যান্য প্রপার্টি। এমন সম্পদ আর বিলাসিতার মাঝেও তাঁরা উদ্বিগ্ন! তাঁদের আশংকা এই মুহুর্তে চীন না গেলে হয়তো তাঁদের সন্তান নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি পর্যাপ্ত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে বড় হতে পারবেনা!!!! তাঁদের সন্তানের বয়স তিন বছর হতে চলেছে, মেয়েটিকে তাঁরা শুধুমাত্র চাইনীজ শিখিয়েছেন, নিজেদের সংস্কৃতিতে বড় করছেন। আমেরিকান যখন, ইংরেজীতো শিখবেই... স্কুল কলেজ, বন্ধু বান্ধব সবাই যে ভাষা বলে, সে ভাষা রপ্ত করতে কোন সমস্যা হবেনা, যেমন তাঁদের নিজেদের হয়নি। তবে, চাইনীজ.. তাঁদের প্রাণের ভাষা, তাঁদের অস্তিত্বের সংস্কৃতি থেকে মেয়েটি যেন সড়ে না আসে।

আমার পরিচিত এক সিনিয়র দম্পতি। ভদ্রলোকের স্ত্রী সন্তানরা(বাংলাদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা) বেশ কয়েক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে আসেন ২০০৬ এর শেষে। বড় মেয়েটির বয়স তখন নয়/দশ বছর এবং ছেলেটি সাত বছর। দেশ থেকে আসার পর পর ওদের সাথে পরিচয়, অত্যন্ত ভদ্র মার্জিত শিশু দুটিকে দেখে মুগ্ধ হতে হয়, পড়াশুনাতেও দুজন মেধাবী!

দুরত্বের কারনে দীর্ঘদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই, ৬/৭ মাস পর তাঁরা আসেন আমাদের এখানে বেড়াতে। চমকে গেলাম শিশু দুজনকে দেখে, বাংলা বলতে যেন তাদের কষ্ট হচ্ছে! যে ভাষায় এতো বছর কথা বলেছে, হঠাৎ করেই যেন সেই ভাষা প্রায় সম্পূর্ণ ভুলে বসেছে!!! সমবয়সী আত্মীয় সজনদের আশে পাশেই থাকে, তারা যেহেতু শুদ্ধ বাংলা বলেনা, হয়তো সেকারনেই এই পরিবর্তন!


সম্প্রতি দেখা হয়েছিলো ওদের সাথে। আমি মর্মাহত এবং শংকিত ওদের অবস্থা দেখে! এক বছরের কম সময়ে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ ভুলে বসে আছে তারা। সমান্য সাধারন কোন বাক্য বাংলায় বলতে বললে প্রচুর সময় লাগছে ভেবে ভেবে বাংলা অনুবাদ খুঁজতে!!!!

পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার কারনেই ওদের বুঝাতে চেষ্টা করলাম, শুদ্ধ করে যেকোন ভাষা জানা একটি গর্বের বিষয়, আর মাতৃভাষা শুদ্ধ করে বলতে এবং বুঝতে পারা একটি অবশ্যকর্তব্য। বাংলা ভাষার যে ইতিহাস শুনে বিদেশীরা মুগ্ধ হয়ে যায়, বিনয়ের সাথে তাদের মনে করিয়ে দিলাম সেই ইতিহাস....

সবচেয়ে বড় উপহাস যেন এই মুহুর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলো...! শিশু দুজনের বাবা আমাকে সমর্থন জানালেন আর সেই সাথে জানালেন তাঁর বাবা(শিশুদের দাদা) ভাষা সৈনিক ছিলেন!!!!!!!!!!!!!!!!!!! ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" এর দাবীতে মিছিল করেছিলেন... শুধু তাই নয়, সেই অপরাধে তিনি গ্রেফ্তার হন এবং প্রায় তিন মাস জেল খাটেন।


আমি স্তম্ভিত, শংকিত!!!!! ভাষা সৈনিকের নাতি-নাতনিরা আজ বাংলা ভাষা বর্জনে সচেষ্ট, তাদের কাছে বাংলাদেশ একটি 'পঁচা দেশ'!!!!



সত্যি প্রচন্ড মানসিক চাপ অনুভব করি যখন দেখি, এক বছরের কম সময় আগেও যারা চমৎকার স্পষ্ট বাংলা বলছিলো, আজ সেই ভাষা ইংরেজী টোনে বলতেও তাদের কষ্ট হচ্ছে!!!


আমি ব্যক্তিগত ভাবে যেকোন ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, এমনকি যে উর্দু ভাষা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিলো, সেই 'উর্দু' ভাষার প্রতি আমার কোন ঘৃণাবোধ নেই। ভালো লাগলে ইংরেজী, উর্দু, হিন্দী, গান আগ্রহ নিয়ে শুনি। পৃথিবীর কোন ভাষা নিয়ে আমর কোন প্রেজুডিজ নেই, যে কোন ভাষা অনর্গল বলতে এবং বুঝতে পারাকে কৃতিত্ব মনে করি। তবে, বাংলাদেশীদের জন্য 'বাংলা ভাষা" জানা একটি অবশ্য কর্তব্য মনে করি। আমার কাছে খাদ্য গ্রহন, শ্বাস প্রশ্বাস, ধর্মপালন যেমন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, তেমনি স্বাভাবিক প্রতিটি বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত মানুষের বাংলা জানা!!! অন্তত বলতে এবং বুঝতে পারা।।

প্রবাসে জন্ম থেকে যে শিশুটি বেড়ে উঠে, তার বাংলা ভাষায় কিছুটা ভীনদেশী টোন তেমন আপত্তিকর মনে হয়না.. তবে যথেষ্ট বড় হয়ে প্রবাসে গিয়ে অথবা বাংলাদেশে বসেই ইচ্ছাকৃত ভাবে ভাষা ভুলে যেতে চেষ্টা করা, বাংলা ভাষা বিকৃত করা..... মেনে নেয়া যায়না!!

কি হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের? প্রবাসে যারা নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে, তাদের বাবা মা যদি উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে না আসেন, তাহলে তারা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হবে আমাদের এই ভাষা!!! তাদের মধ্যে আমাদেরই গড়ে তুলতে হবে নিজের দেশ, নিজের ভাষা আর নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। হীনমন্যতাবোধ থেকেই মানুষ নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন হয়, এড়িয়ে যেতে চায় নিজেদের শিকড়ের অস্তিত্ব! আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে কোন ভাবে যেন এই হীনমন্যতাবোধ গড়ে না উঠে।


ইংল্যান্ডে জন্ম, আমেরিকায় বেড়ে উঠেছেন একজন বাংলাদেশী আমেরিকান, বিয়ে করেছেন আমেরিকান ভদ্রলোককে। এই দম্পতির বাসায় দেখা যায় ছোট্র শিশুটিকে বাংলা শিখানোর প্রচেষ্টা... !!! ঘর ভর্তি শিশুদের বাংলা শিখানোর বিভিন্ন খেলনা, বই, ক্যাসেট, সিডি... ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাংলা বর্ণমালা... প্রবাসে জন্ম আর বেড়ে উঠা একজন যদি পারেন, আমরা কেন পারবোনা!


প্রবাসে বাসকালে ভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে চলার মাঝে খারাপ কিছু নেই, যে দেশে বেড়ে উঠা সেই দেশের সংস্কৃতির মার্জিত দিকটি গ্রহন করা অন্যায় নয়। ভীনদেশী সংস্কৃতিকে আপন করার সাথে সাথে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকেও সযত্নে লালন করা যায়, শ্রদ্ধাভরে ধারন করা যায়....আমার যে অহংকার সারা বিশ্বকে বিস্মিত করে, আমরা একটু চেষ্টা করলে সেই "বাংলা ভাষা" কে সাদরে পরবর্তী প্রজন্মের প্রাণে তুলে দিতে পারি....



সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১০ ভোর ৪:২৭
৫৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×