somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমিশদের কিছু কথা...

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অনেক বছর আগে নায়াগ্রা ফলস্ এ বেড়াতে গিয়ে বিভিন্ন বর্ন, জাতির হাজারো পর্যটকের ভীড়ে কয়েকজন নারী পুরুষের ছোট্ট একটি দল দৃষ্টি আকর্ষন করে। পুরুষদের দেখে প্রথম ঝলকে মনে হয়েছিলো ইহুদী র‌্যাবাই, কিছুক্ষন পর মহিলা সঙ্গীনিদের দেখে ভুল ভাঙ্গে। কোন রকম প্রসাধন নেই, বর্ণহীণ সাদা কালো লম্বা পোশাক আর মাথার টুপি দেখে মনে হয়েছে বিশেষ কোন উপলক্ষ্য বা উৎসবে তাঁরা সেকেলে সাজে সেজেছেন। পরে জানতে পারি এই অতি সাদা মাটা পোশাকের সহজ সরল চেহারার নারী পুরুষের দলটি 'আমিশ' সমাজের একটি অংশ। এক সময় আমিশ অধ্যুসিত এলাকার কাছাকাছি বেশ কিছুদিন বাস করেছি।


বিজ্ঞানের নতুন নতুন উদ্ভাবন, প্রগতি, প্রযুক্তি, যান্ত্রিকতা আর আধুনিকতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে সম্পূর্ণ অকৃত্রিম নির্মল এক জীবন যাপন করে চলেছে আমিশ সমাজ।


অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমিশদের আগমন ঘটে। প্রগতিশীল ও নিত্ত পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্ভুলভাবে নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষায় বিশ্বাসী সুইজারল্যান্ডের "জ্যাকব আম্মান" এর নাম থেকে 'আমিশ' নামকরন।ওহাইও স্টেটের হোমস কাউন্টিতে আমিশদের সবচেয়ে বড় গ্রুপটি বাস করে।প্রধানত পেনসিলিভিনিয়া, ওহাইও, ইলিনয়, আইওয়া, নিউ ইয়র্ক, মিজৌরি স্টেটে তাদের দেখা গেলেও, অন্যান্য স্টেটে কম বেশি ছড়িয়ে আছেন। কানাডার ওন্টারিওতেও আছে আমিশদর ছোট্ট একটি অংশ।


আমিশদের নির্লোভ আর অহিংস স্বভাব। বর্ণহীন সাদা, কালো আর ধূসর পোশাক, বাইরের জগতের আধুনিকতেকে সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলা...লোভ আর উচ্চাশা যেন তাদের স্পর্শ না করে। সমাজে প্রায় সব নারী একই বর্ণ এবং ডিজাইনের পোশাক, পুরুষদের জন্য নির্ধারিত পোশাক। শৈশব থেকে এভাবেই তারা বেড়ে উঠে।


বিদ্যুতের আলো নয়, কেরোসিন হারিকেন বা গ্যাসের বাতি আঁধারে আলো জালে। কাঠ অথবা কয়লার আগুনে রান্না এবং শীতকালে ঘর গরমের ব্যবস্থা করা হয়।তাঁরা নিজেদের হাতে গড়া আসবাবপত্র, রান্নার তৈজস ব্যবহার করেন। কারো নতুন সংসার শুরু হলে, পুরো আমিশ কম্যুনিটির পুরুষরা এসে সাহায্য করে গৃহ নির্মানে। কারো বাড়িতে কোন উৎসব বা অনুষ্ঠানের প্রায় পুরো সমাজ এসে পাশে দাঁড়ায় সাহায্যে।

উপাসনালয়ের পুরোহিতকে সবাই খুব মেনে চলে। খুব সাদামাটা, সাধারনত এক কক্ষের স্কুল ঘর নিজেদের এলাকাতেই অবস্থিত। বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঘোড়া টানা গাড়ি যা "বাগ্গি" নামে পরিচিত। "বাগ্গি" আমিশদের প্রতিক বললেও ভুল হবেনা। আমিশ পল্লীতে চোখে পরার মতো আরেকটি জিনিস "উইন্ড মিল"। গৃহস্থালী সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় পানি পাম্প করে তোলা হয় উইন্ডমিলের সাহায্যে। যেসব পল্লীতে গ্যাস আছে তারা পানি পাম্প সহ বিভিন্ন কাজে গ্যাস ব্যবহার করেন।


আমিশদের তৈরী আসবাবপত্র আমিশ সমাজের বাইরে বেশ সমাদৃত তবে সহজলভ্য নয়।মিনেসোটার মিনিয়াপলিস শহরে অবস্থিত "মল অফ আমেরিকা"য় আমিশদের ফার্নিচারের দোকানে খুব সাধারন একটি কাঠের টেবিলের অস্বাভাবিক চড়া দাম দৃষ্টি আকর্ষন করে! নিতান্তই সাদামাটা টেবিলের এককোনে এঁটে দেয়া কাগজে লেখা, " এই টেবিলটি একজন আমিশ তরুনের নিজে হাতে গড়া। টেবিল বিক্রীর অর্থে সে তার ভবিষ্যত শিক্ষা এবং জীবন গড়ে তুলতে চায়"



শক্ত পারিবারিক বন্ধনে বিশ্বাসি আমিশ সমাজ অত্যন্ত রক্ষনশীল। পোশাক পরিধান, নারী পুরুষের মেলামেশা- কোন কিছুতেই নেই আধুনিকতার ছোঁয়া। মেয়েদের জন্য লম্বা হাতা সহ প্রায় আপদমস্তক ঢাকা ধূসর, কালো আর সাদা পোশাক, সাথে মাথার চুল ঢাকা টুপি। পুরুষদের পোষাকের বর্ণ একই রকম, ফুল প্যান্ট, ফুল হাতা সার্ট, জ্যাকেট বা স্যুট। কম বেশি পুরুষরা দাড়ি রাখে। আমিশদের পোশাক, জীবনযাত্রায় নেই তেমন রঙের খেলা, নেই কোন বিলাসিতা আর ফ্যাশনের প্রতিযোগিতা।সেকেলেই বলতে হয় তবে নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধা জাগাবার মতো। হরেক রঙের ফুলে সাজানো বাগান যেন সেই বর্ণহীণতার শূণ্যস্থান পূরণ করে।


আমিশরা অত্যন্ত সহজ সরল। আধুনিকতা, প্রযুক্তির ছোঁয়া বাঁচানোর সাথে সাথে তারা যেন সকল পংকিলতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলেছেন। তাই তাদের প্রতি (!!)সভ্য সমাজের মানুষের রূঢ়তা তাদের যতোখানি আহত করে তার চেয়ে হতবাক করে অনেক বেশি।

শান্তি প্রিয় আমিশ সমাজ যেমনই হোক বাইরের জগতের পংকিলতা, নৃশংসতা মাঝে মাঝে হামলে পরে তাদের উপর। ২০০৭ সালে পেনসিলভিনিয়ার এক মানসিক ভারসাম্যহীন নিজের পাপ আর বিকৃতির দংশনে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয়। আপাতঃ স্বাভাবিক এই অর্ধ উন্মাদ সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃরাশ শেষে পুত্রদের স্কুলে দিয়ে আসে খুব স্বাভাবিক ভাবে, তার পর কোন কারন ছাড়া সম্পূর্ণ নিরীহ আমিশ পল্লীতে গিয়ে হিংস্র মূর্তি ধারন করে। নির্বিচারে গুলি বর্ষন করে স্কুলের ছোট ছোট শিশুদের উপর। পাঁচ জন শিশু সেখানেই মৃত্যুবরন করে আহত হয় অনেকে। পাশবিক হত্যা কান্ডটি ঘটিয়ে খুনি আত্মহত্যা করে।

ঘটনার সময় শিশুদের সাথে নারীরা উপস্থিত থাকলেও রক্ষনশীল আমিশ সমাজের মহিলারা মিডিয়ার সামনে আসতে চাইছিলেননা। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান এড়িয়ে চলা আমিশ সমাজে এমন অতর্কিত হামলা পরবর্তী অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে বেশ কিছু নতুন সমস্যার সন্মূখীন হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আমিশরা যেহেতু শহর থেকে দূরে, প্রায় সভ্যতার রেশহীন এলাকা বেছে নেয় নিজেদের সমাজ গড়ে তোলার জন্য, আহত শিশুদের জরূরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়। আধুনিকতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা শিশুদের বাবা মা হেলিকপ্টারে চড়তে অসন্মতি জানান, তারা কেবল তাঁদের নিজস্ব বাহনে( ঘোড়া টানা গাড়ি- বাগ্গিতে) যেতে রাজী। খুব সম্ভবত অনেক বুঝানোর পর শেষ পর্যন্ত কয়েকজন আধুনিক গাড়ি ব্যবহারে সন্মত হন, কারন বাগ্গিতে করে গেলে কয়েক ঘন্টার পথ যেতে কয়েকদিন সময় নিবে।।


স্বামীর এমন আচরনে হত্যাকারীর শোকাহত স্ত্রী একই সাথে লজ্জিত, বিব্রত হতভম্ব! নির্বিরোধি সহজ সরল আমিশ জীবনে এমন অতর্কিত হামলায় তীব্র নিন্দা এবং ঘৃণা জানায় সমগ্র দেশের মানুষ।
ঘটনাপরবর্তি যে বিষয়টি সবচেয়ে অবাক করে, মুগ্ধ করে সবাইকে....আমিশ পল্লীতে যে সময় সন্তান হারানোর শোক, আরো কয়েকজন মুমূর্ষ শিশু ছটফট করছে হাসপাতালে, এমতাবস্থায় আমিশ সমাজের শোকাহত নারীরা দেখা করে স্বান্তনা দিতে যান হত্যাকারীর স্ত্রীকে! তাদের এই মানবিকতা, এই সৌজন্যে মুগ্ধ হয় অগুনিত মানুষ।আমিশদের এই উদারতা মন ছুঁয়ে যায় আমাদের।

(ব্লগার ৃৃমম এর পোস্ট পড়ে যাঁরা আমিশদের সম্পর্কে কৌতুহলি হয়েছেন, তাঁদের সন্মানে আমিশ সম্পর্কে জানা কিছু কথা শেয়ার করে এই পোস্ট)

ছবি: আমিশ পল্লী/ খামার বাড়ি
ছবি উৎস: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ৩:৩৪
৩৫টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×