কিছু কিছু চোখ, কিছু কিছু দৃষ্টি, কিছু ভালোবাসা মানুষকে সারা জীবন তাড়া করে ফিরে।
দীর্ঘ দিন আগের কথা।
বাইরে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি। মা বাবা কেউ বাসায় নেই। দুপুর অথচ চার পাশটা কেমন অন্ধকার করে এসেছে।
এমন সময় সাহায্যকারী ছোট্ট মেয়েটা এসে খবর দিলো, দারোয়ান কাউকে নিয়ে এসেছে, আমাকে দেখাতে চাইছে। দরজার কাছে ছোট খাটো জটলা! হঠাৎ বাগানের এক কোণে কেমন অস্বাভাবিক এক নড়াচড়া দেখে দারোয়ান কাছে গিয়ে ওকে আবিস্কার করে।
বিভিন্ন পশুপাখি প্রেমী এক পরিবারে আমার জন্ম। শৈশব থেকে নিজের বাসায় গৃহপালিত পশু পাখি থেকে শুরু করে এক্সোটিক পশু পাখি দেখে আসা আমি পোষা প্রানীর ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাসক্ত! আর কুকুর বিড়াল জাতীয় প্রাণীর কাছ থেকে দশ হাত দুরে থাকি। ক্ষিপ্র চিতা বাঘকে এক হাতের চেয়েই কম দূরত্ব থেকে দেখেছি, অথচ কোন বিড়ালের সাথে এক কামরায় নিজেকে চিন্তা করতেই শিউরে উঠি!
সেদিন তার মাঝে কি যেনো একটা ছিলো। দারোয়ানের হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যখন সে থর থর করে কাঁপছিলো, কেমন এক অণুনয় ঝরে পড়ছিলো তার চোখে! ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে জব জবে অসহায় ভীরু সেই দৃষ্টি নিমেষেই আমাকে সন্মোহিত করে। বাসার ছেলেটাকে বলি ওকে ভালো করে গোসল করিয়ে মুছে দিতে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ওকে এক বাটি দুধ এনে দিতেই কেমন ক্ষুধার্তের মতো খেতে থাকে।
সে বাসাতেই থাকে তবে আমার ঘরে নয়। সারা বাড়ি, বাগান আপন মনে ঘুরে বেড়ায়। কিছু দিনের মধ্যেই একটু বড় ও বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠে। আমি আদর করে ও নাম দিয়েছিলাম পিংকু। ধবধবে সাদা এই বিড়াল ছানার গলায় স্যাটিনের একটা ফিতা বাঁধা, তাতে সাদা সুতোয় সেলাই করে লিখেছিলাম "PINKU"।
তাকে দেখেই পাড়া প্রতিবেশিরা জানতো, এটা মানবীর বিড়াল।
আমার ঘরে তার প্রবেশ নিষেধ হলেও সে কেমন করে যেনো জানতো এই বাড়িতে তার গার্জিয়ান কে! আমার বাইরে যাওয়া আর আসার সময় কোথা থেকে ছুটে গেটের কাছে যেতো। এক সময় বাইরে থেকে ফেরার সময় পিংকু কে গেটের কাছে এক্সপেক্ট করতে শুরু করি।
সেদিন ক্লাস ছিলোনা। প্রতিদিন আমি নিয়মিত যেসময় বের হয়ে যাই, তেমন সময় আমার মা অফিসের উদ্দেশে্য বের হয়ে যাবার প্রায় সাথে সাথেই বাইরে একটু হৈ চৈ শুনি।
* * * * * * * * * *
একটু পর বাসার লোকজনের ছোট একটি দল আমার কাছে আসে, ছেলেটা হাতে পিংকু কে ধরে আছে। পিংকু কেমন ভাবে যেনো ওর হাতে শুয়ে আছে আর চোখে এক ধরনের হেরে যাওয়া, অসহায় কাতর দৃষ্টি!
ছোট মেয়েটা প্রায় এক নিঃশ্বাসে হরবর করে যা বললো, আমার মা অফিস যাবার সময়( সাধারনত এসময় আমি ক্লাসে যাই, সেদিন ক্লাস ছিলোনা) ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই দারোয়ান পিংকুকে আবিস্কার করে, গাড়ির চাকার নীচে পিষ্ট!!!
অদ্ভুত ব্যাপার ওর গায়ে কোন রক্ত নেই। এটা দেখে আমি একটু পজিটিভ হতেই ছেলেটা কি যেনো বর্ণনা করতে চাইছিলো, পিছন দিকে কোন এক ইনজুরির কথা। আমার বাঁধা পেয়ে আর শেষ করতে পারেনি। কোন পশু হঅসপাতাল, পশু চিকিৎসকের নাম, ঠিকানা কিছুই জানা নেই। কখনও দেখেছি বলেই মনে পড়েনা।
যে দেশে মানুষ বিনা চিকিৎসায় অহরহ মারা যায় সেখানে এমন চিকিৎসক সহজলোভ্য হওয়া শুধু বিলাসিতা নয় প্রায় অসম্ভব!
পিংকুর অসহায় দৃষ্টি টা সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিলোনা। ওদের বললাম, ওদিকে তোমরা চেষ্টা করে দেখো। আমাকে কিছু যেনো না জানায় তা বিশেষ ভাবে অনুরোধ করলাম(ছোট মেয়েটা কোন কিছু এক্সাইটিং দেখলেই ছুতে এসে আমাকে জানায়)!
বাসায় গ্রাম থেকে আসা সম্পর্কে আত্মীয় ছিলেন, ওনার পরামর্শে দুধ হলুদ টাইপ কিছু চিকিৎসা চলেছিলো মনে হয় তবে পিংকু খুব বেশিক্ষণ কষ্ট পায়নি। আল্প সময় পরেই ইহলোক ত্যাগ করে।
কোন আপন কাউকে সেই প্রথম চিরতরে হারানো। মৃত্যুর শীতল স্পর্শ কেমন নির্মম ও কঠিন, সেই প্রথম অনুভব করি।
মনে আছে সেদিন বাসার থমথমে পরিবেশ। বাবা মা কাজ থেকে ফিরে সব শুনে আমায় নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। শুধু কান্নাকাটি নয়, আমি তার পর বেশ কিছুদিন কোন খাবার খেতে পারিনি।
ধীরে ধীরে এক সময় সব স্বাভাবিক হয়ে আসে..... শুধু পিংকুর সেই অসহায় কাতর দৃষ্টি আমাকে ছেড়ে যায়না।
কারো চোখের অনুনয়, কোন আকুতি ভরা দৃষ্টি সারা জীবন মানুষকে তাড়া করে ফিরে, সেই আমার প্রথম পরিচয়।
*দীর্ঘদিন ধরে পিংকুর কথা লিখতে ইচ্ছে করছে, চেষ্টাও করেছি অনেকবার। খুব প্রিয় আর আপন কারো কথা লিখে রাখা না তাড়া করে ফেরা দৃষ্টিটা থেকে রেহাই পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা জানা নেই!!!!*
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:০২