somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্যুটকেস চুরির প্রধান প্রধান বিপত্তি এবং ... পরিত্রাণ

০৭ ই এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দাবিটা মিতুল জোরাল করে ফেলেছিল ওর নিজের একখানা ছবি পাঠিয়ে দিয়ে। ফলে আমার ছবি একখানা না পাঠাবার আর বিশেষ কোনো উসিলা আবিষ্কার করা কঠিন ছিল। আর সত্যি কথা যদি বলি তাহলে, আমার যে ছবি পাঠাতে একটুও অনিচ্ছা কাজ করছিল তা নয়। বরং একদম উল্টো। খুঁজে-পেতে যে ছবিটাতে সবচেয়ে ভাল দেখায় আমাকে, অন্ততঃ আমার চোখে, সেটা কম্পিউটারের পেটে ভরে অনলাইনে উত্তেজিতভাবেই বসেছি। সরাসরি নিজে পাঠালে খুব আদিখ্যেতা হয়ে যায় এই ভয়ে আমাদের দু’জনের সেতুবন্ধ শিউলিকেই দায়িত্ব দিয়ে পাশে অধীর হয়ে অপেমান আছি। সেকেন্ডগুলো যায়। মিতুল আমার ছবি দেখে মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠায় --
"এ তো স্যুটকেস চোরের মতো দেখায়।"
"বলিস কী!"
শিউলি হতভম্ব হয়ে পাল্টা বার্তা পাঠায়। আড় চোখে ও আমাকে দেখে আমি খেয়াল করেছি কিনা। আমার চোখ গোলগোল হয়ে তখন ওর কম্পিউটারের মেসেঞ্জারের বাক্সে সেঁটে আছে। শিউলি পরিত্রাণের পথ পায় না। মিতুল ভাবে ওর ভেঙেই বলতে হবে। মেসেঞ্জারে আবার বার্তা আসে --
"আহা ট্রেইন-স্টেশনে, লঞ্চঘাটে স্যুটকেস চোর থাকে না? দেখতে একদম ওদের মতো।"
শিউলিকে দিশেহারা দেখায়। আমাকে হাড়ে-মাংশে চেনে বলে ও বিচলিত বোধ করে। ও বোধহয় ভাবে আমি এক্ষুনি স্যুটকেস-চোরদের সামাজিক অস্তিত্ব বিষয়ে মাঠমারা বক্তৃতা শুরু করব। কিংবা ও চিন্তায় পড়ে যায় ওর কাছ থেকে আমি চেহারা-ছবির অবধারিত্ব বিষয়ে ক্রিটিক্যাল মন্তব্য আশা করছি কিনা। কী-বোর্ডে ওর হাত-চালানো দেখে ওর ভ্যাবাচ্যাকা-ভাব বোঝা যায়। আমিও পাশে বসে বিশেষ সুবিধায় নেই। দূরবর্তী পাঠিকার এই সাদর সম্ভাষণে মুখের হাসিটা আঠার মতো শক্ত হয়ে গালে লেগে আছে। এরপরের কয়েক সেকেন্ড ধরে শিউলি একটা উপায় বের করে। তারপর একমুখ হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে "কী বদ দেখেছো! বলে স্যুটকেস চোর!" আঠার মতো লেগে থাকা আমার হাসিটাকে আমি বিশেষ বদলাতে পারি না। কিন্তু শেষ সুযোগ যাচ্ছে দেখে আমিও মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে থাকি "তোমার বন্ধুর যাই হোক সাহস আছে। হা হা হা। আমি ইমপ্রেসড। হা হা হা। ..."

আইডিয়াটা এক হিসেবে আমার। ফলে এর দায়দায়িত্ব, ঘটনাপ্রবাহ মায় ফলাফলের জন্য কাউকেই দোষারোপ করার সুযোগ আমার নেই। নার্সিসিস্টিক ধরনের সমস্যা। ওই যে সঞ্জীব চাটুজ্জে বলেছিলেন না নিজের সম্পর্কে আমাদের নিজেদের ধারণা! 'একটাই পিস্, কেউ জানল না, কেউ চিনল না।' তো আমার রচিত গল্প-গুজব সম্পর্কে স্বীয় মূল্যায়নও এমনধারাই। গল্প আমি অতিশয় ভাল লিখি, অথচ তা নিয়ে যথেষ্ট গুজব এখনো তৈরি হলো না চারধারে -- এই বেদনায় মূহ্যমান থাকতে থাকতে আমি নতুন লেখা লিখতে বসি। এবং ইদানীং রচনা শেষ করতে না করতেই কোজ-সার্কিট একটা ইলেকট্রনিক বান্ধব-মহলে পাঠিয়ে দিই। এতে বিশেষ ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। এইসব গ্রাহকের পক্ষে এরকম উপায়ে পাওয়া এক রচনা বিষয়ে প্রশংসামুখর না হয়ে বিশেষ উপায় থাকে না। ফলে নব-উদ্ঘাটিত পদ্ধতিতে আমার সাহিত্যিক-ইমেজের, খণ্ডিত এবং সীমিত হলেও, চর্চা সম্ভব হচ্ছে। তবে কেবল এই অবধি আমার বাসনা সীমিত থাকলেও কথা ছিল না। অত্যুৎসাহী হয়ে আরো পরে আমি বিরল এসব গ্রাহকদের তাগাদা দিতে থাকি যেন তাঁরাও তাঁদের বান্ধব-মহলে গুরুতর আমার সাহিত্যকর্ম পৌঁছে দিতে থাকেন। মিতুল এইভাবে অবতীর্ণ হয় আমাতে। অনলাইন হয়। আমিও।

মিতুলকে ইমেইল করি। বেশ ক’দিন ভেবেচিন্তে। আমার গল্পের নিরুপায় ওর প্রশংসাটুকুকে সৌধ বানিয়ে লালন করতে আমি আবার সেই প্রশংসাই শুনতে চাই। এ দফা সরাসরি। ফলে মিতুলকে সংপ্তি একটা ইমেইল করি। সাব্জেক্টের ঘরে লিখি: নতুন পাঠককে বার্তা। রোমান হরফে এরপর:
প্রিয় মিতুল, আমার গল্প পড়ে আপনার যে ভাল লেগেছে সেটা আমার বিরাট আনন্দের ব্যাপার। ধন্যবাদ। আপনার আগ্রহ থাকলে আমি এরপর থেকে সরাসরি আপনার ঠিকানাতেই নতুন লেখা পাঠাতে পারি। চিয়ার্স ...
মিতুল লেখে:
আপনি বোধহয় মনখারাপ করেছেন আমার কমেন্ট শুনে। কিন্তু আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি।

আমি পরেরবার মন-শক্ত করে লিখি:
আরে কী যে বলেন! আমিও সরাসরি কথা শুনতে পছন্দ করি। আপনি যা ফিল করেন তা বলতে পারা একটা বিরাট গুণ। আমার গল্প নিয়ে আপনার কমেন্ট যদি আমি শুনতে পারি, তাহলে চেহারা নিয়েও পারা উচিত।

মিতুল লেখে পরেরবার:
বিলিভ মী! দ্যাট ওয়াজ মাই ওনেস্ট ওপিনিয়ন সীইং ইয়োর ফোটো।

দেখি আমার সাহিত্যকর্মের ব্যাপারে কিছুই বলে না। এরপরও আবার কথা চালানো কঠিন। ফলে তখনকার মতো ছেড়ে দিতেই হয় কিছুদিনের জন্য। দু’মাস পরে যখন টরন্টোতে একটা বোকাসোকা কনফারেন্সে যাবার ব্যবস্থা পাকা হয় তখন হুমড়ি খেয়ে বসি আবার ইমেইলে। তবে লিখি যথাসম্ভব গম্ভীর স্বরে:
আগামী মাসের ১০-১২ তে কি অনেক ব্যস্ত থাকবেন?

মিতুল ত্বরিৎ উত্তর করে:
কেন বলেন তো?

আমাদের যোগাযোগ চলতে থাকে:
না, ভাবছিলাম দেখা হওয়া সম্ভব কিনা। মানে আমি ০৯ তারিখে টরন্টো আসছি। টরন্টো ইউনিভার্সিটির একটা সেমিনারে।

ইন্টারেস্টিং! উঠছেন কোথায়? ওয়েল আপনি চাইলে আমি এয়ারপোর্টে আসতে পারি। বাট আই ডোন্ট রিয়েলি থিংক দ্যাট উড বি নেসেসারি।
আমার দ্বিতীয় সুযোগও, দেখা যায়, যথাসম্ভব পাকিয়ে ফেলি আমি। ফলে লিখতেই হয়:
আমি সেটা মীন করিনি। না না এয়ারপোর্টে আসার কথা আমি একেবারেই ভাবিনি। আর ওঠার ব্যবস্থা একটা ওরাই করেছে। আপনার আগ্রহ বা সময় না থাকলে দেখা করবারও কিছু নেই।

ওয়েল। আই ক্যান সী দ্যাট ইউ ডোন্ট হ্যাভ এ গুড সেন্স অফ কনভার্সেশন। আসলে আমার দেখা করার আইডিয়াটা ইন্টারেস্টিংই লাগছে। ফাইন। ১০ বা ১১ কোনদিন আসব বলেন। এ্যাড্রেস দেন। সমস্যা না থাকলে আমার বাসায় ডিনার করেন।
আমি ঠিকানা দিই কনফারেন্স স্থানের। আর মিতুলের কাছে হৃত আমার স্মার্টনেসের কিছুটা ফিরে পেতে লিখি:
১১ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা। কিন্তু বাসা পর্যন্ত স্যুটকেস চোর নিয়ে যাবেন? চুরির ভয় নেই? আর প্রসঙ্গতঃ স্যুটকেস চোরদের নিয়ে আমার কোনো স্ট্রং প্রিজুডিস নেই।

মিতুল লেখে:
আমারও কোনো প্রিজুডিস নেই। আর কাজটা একেবারেই সোজা না যদি আপনি ভেবে থাকেন। এ্যান্ড বাই দ্য ওয়ে, স্যুটকেস ইজ হার্ডলি এ্যাভেইলব্ল হিয়ার দিজ ডেজ।
আমি লিখে বসলাম:
ঠিক আছে অন্য জিনিস নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে চুরির জন্য।

ফলে মিতুলের এই বার্তা এল:
হাহ্! ইউ মীন হোয়াট? মী? এইসব বস্তাপচা আইডিয়া ... প্লিজ ডোন্ট ডাম্প দিজ আইডিয়াজ টু ইয়োর স্টরিজ।

আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। এরপর বার তিনেক একটা ইমেইলের ড্রাফট করলাম যাতে আমি ব্যাখ্যা করেছি যে আসলে আমি কোনো একটা বস্তুই বোঝাতে চেয়েছিলাম চুরির জন্য। কিন্তু সেই লেখা একবারও আমার নিজেরই পড়তে আরাম লাগেনি। ফলে পাঠানোও হয়নি।

কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে গাড়ি পার্কিং-এর কাছে গেলাম। নীল রঙের একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মিতুল।

ছয়তলা এক বিল্ডিং-এর একতলায় মিতুলের এ্যাপার্টমেন্ট। দুই ঘরের। ছোট কিন্তু পরিপাটি। ঢুকেই বামহাতে রান্নাঘরের দরজাটা খোলা। দরজার গায়ে বন জোভি’র একটা সাদাকালো পোস্টার। ডানদিকের দরজাটা অনুমান করা যায় বাথরুমের। আমাকে নিয়ে ও ঢুকল নাক বরাবর দরজায়। বাম হাতে আরো একটা দরজা খোলা দেখা গেল। একনজর টেবিল চেয়ার দেখলে মনে হয় ওর পড়বার ঘর ওটা। কিন্তু যে ঘরে আমরা ঢুকলাম হিসেব অনুযায়ী সেটাই ওর শোবার ঘর। আমাকে বসতে বলে সিডি প্লেয়ারের দিকে দেখিয়ে বলল 'যেটা ইচ্ছা শোনেন। ফ্রেশ হতে চান?' আমি মাথা নাড়ি। মিতুল বলে 'আমার একটু গোসল দিতে হবে। ড্রিংকস চলবে একটা?'
'হ্যাঁ জ্যুস।'
ডান ভুরু কপালে তুলে ও বলল 'জ্যুস? আচ্ছা!' তারপর রান্নাঘর থেকে এক গেলাস আঙুর শরবৎ এনে দিয়ে গোসলে ঢুকে পড়ল।

মিতুলের ম্যাজেন্টা রঙের বিছানায় বসে বেগুনি পর্দার দিকে তাকিয়ে খানিকণের জন্য মনে হয় স্টুডিওতে বসে আছি। ইংরেজি সিডির সংগ্রহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম। কারণ বাংলাগুলো এমন বারোভাজা যে বেশিক্ষণ আগ্রহ নিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো না। ইংরেজিতে জ্যাজ, ব্লুজ থেকে বীটলস্, ৭০ দশকের আরো সব পপ, হালের নির্ভানা। আমার নিজের দৌড় যেহেতু বেশি না, চট করে একটা কিছু খামকাই প্লেয়ারে চালিয়ে দিলাম। ওর সাজগোছের আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখলাম। চুলগুলোতে হাত চালালাম। বাথরুমের দরজার দিকে চোখ গেল। কিন্তু মিতুল বের হবার তেমন কোনো লক্ষণ নেই। ওর শিস শোনা যায়, আর পানি পড়ার শব্দ।

দ্বিতীয়বার আয়নায় তাকাতেই হলদেটে রঙের স্যুটকেসটা চোখে পড়ল। এবারে ঘাড় ঘুরিয়ে কোসেটের পাশে খাড়া করে রাখা ছোটখাট একটা স্যুটকেস দেখতে পেলাম। একেবারে অন্যমনস্কভাবে সেটা ধরলাম, তারপর বিছানার উপরে তুললাম। সুন্দর চামড়ার একটা চকচকে স্যুটকেস। কোনায় ঘন বাদামি রঙের চামড়ার কাজ। এটাতে অলঙ্কার রাখবার কথা। কিন্তু ওজনে সেটা মনে হয় না। স্যুটকেসটা খোলার একটা উসখুশে বাসনা দেখা দিচ্ছে মাথায়। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। জ্যুসের গেলাসে বড় একটা চুমুক দিয়ে আমি সিডির আওয়াজ খানিকটা বাড়িয়ে দিলাম।

গোসল থেকে বেরিয়েই মিতুল প্রায় চেঁচিয়ে বলতে শুরু করল --
"দেখেন আমি টরন্টোতে থাকি। এখানকার সিস্টেমে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনার খুব সমস্যা হলে আমি একাই ড্রিংক নেব।"
"আহা হা, ... সমস্যার কথা কে বলল?" আমি গলা খাঁকারি দিয়ে দুই ধাক্কায় কথা বলি।
"ফাইন! কী খাবেন? ভোদকা, জিন, হুইস্কি? এক্ষুনি নিশ্চয় ভাত খাবেন না।"
"ভোদকা।"
"ওয়াও। এইঘরে আসতে পারেন। ফোরে বসতে পারেন তাইলে।"

আমি জ্যুসের গ্লাসটা রান্নাঘরের দেয়াল ঘেঁষে-থাকা খাবার টেবিলটাতে রেখে প্রথমবারের মতো ওর পড়ার ঘরে ঢুকি। সারা ঘরময় ওর কাগজ, বই-পত্র ছড়ানো। টেবিলের উপর স্তূপ করে বই রাখা। দেখলেই মনে হয় পড়ে অনেক, সাজায় কম।
"আপনার বাবা-মা’র ছবি?" টেবিলের উপর ঝোলানো বড় মাপের একটা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি।
"কোনটা, এইটা?" কয়েক সেকেন্ড পরে ঘরে গেলাস হাতে ঢুকে ও জানতে চায়।
"আমি নিশ্চয়ই নোরা জোন্স-এর পোস্টার দেখিয়ে আপনার বাবা-মা কিনা জানতে চাচ্ছি না।"
ঢুকেই বাঁ-হাতে একটা পোস্টার রাখা ছিল।
"না, না ঐ ঘরে আমাদের ভাইবোনদের একটা গ্রুপ-ফোটো ছিল।"
"হ্যাঁ, সেখানেও কাউকেই আমার আপনার বাবা-মা বলে মনে হয়নি।"

এতক্ষণে মিতুলকে ঝলমল করে হাসতে শোনা গেল। এতই যে ওর হাতের গেলাস ছলকে পড়ে যায় প্রায়। আমি তাড়াতাড়ি আমারটা নিয়ে নিলাম। মিতুল যে আদৌ হাসতে পারে, এই এতদিনের যোগাযোগে আমার একবারও মনে হয়নি। আমার এই নতুন উপলব্ধি নিয়ে সেও বোধহয় বিশেষ সতর্ক হয়ে গেল। কারণ, এরপর ওকে আর হাসতে দেখা গেল না।

রাত এগারোটার দিকে অন্ততঃ চলে আসতে চাওয়াটা আমার নিছকই কর্তব্য মনে হলো। আরো আড্ডা দিলে ভাল দেখায় না। মাঝখানে আলাপ বলতে সবই প্রাসঙ্গিক ধরনের। কী চিন্তা করে কানাডায় পাকাপাকি থাকতে চাইল, কেমন লাগে থাকতে, চাকরি করতে। এইসব। মিতুল কেমন একটা কড়া কড়া গলায় চোখের দিকে তাকিয়ে বলে যাচ্ছে। আর মিতুল জানতে চাইল আমি বাইরে থাকবার পরিকল্পনা করছি কিনা, আমার বন্ধু-বান্ধব কারা। এর বাইরে নানারকম খাপছাড়া শৈশবের স্মৃতি এবং অতি অবশ্যই মার্কিন পলিসি ও মুসলমান প্রসঙ্গ। ও কিন্তু একই রকম কাটা কাটা গলায়, চোখের দিকে তাকিয়ে এইসব আলাপ চালাচ্ছে। আসলে ঠিক চোখের দিকেও না। ও চোখের দিকে তাকায়, আবার সেটা আমি ভালমতো বুঝে ফেলতেই ও তখন ভুরুর দিকে তাকায়, আবার গালের দিকে। মানে চোখের আশপাশেই থাকে। কিন্তু ওর এই কড়া গলা আর নিমেষে চোখের দৃষ্টিপাতের বদল -- ভীষণ চাপ লাগতে থাকতে পারে কারো। কিন্তু একবার ছাড়া, আর দুটো শব্দ ছাড়া আমার গল্প নিয়ে আর কিছুই বলল না।

ওর রান্নার যথাসম্ভব তারিফ করে আমি যখন চলে আসতে চাইলাম, ও একবারেই দাঁড়িয়ে পড়ল। মাঝখানে অ্যলকোহলিক যে ঝিমানিতে দুজনেই পা বিছিয়ে এলিয়ে পড়েছিলাম, সেটা কাটাতে ও এক সেকেন্ডও সময় নিল না। এবং ওর আচরণে মনে হলো আমার অন্ততঃ ঘণ্টাখানেক আগেই বলা উচিত ছিল যাবার কথা। কী করা! কিন্তু ওর গাড়ি নিয়ে বের হবার প্ল্যান আমি গোড়াতেই খারিজ করে দিলাম।
"না না, আমি ভাবছি খানিকণ হাঁটাহাঁটি করব। তারপর একটা বাস ধরে হোটেল ফিরব। আপনি বরং আমাকে বাসের নম্বর বলে দিন।"
"ফাইন! কিন্তু হাঁটাহাঁটি করবার জন্য বোধহয় এটা পারফেক্ট সময় না।"
"উহুঁ, আমি একাই ফিরতে চাই।"
কিছুতেই আমি ওর সঙ্গে বের হতে চাই না। এবার মিতুল আসলেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। বেশ অনেকটা সময়।
"শিওর?"
"একদম।"
"ফাইন! এই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটলে একই বাস। যত স্টপ পরেই ওঠেন। ..."
"তাহলে আমি বের হই। আপনার বের হবার দরকার নেই।" আমি প্রায় ওর মতো খসখসে গলাতেই বলি।
"ওকে। কাল তো আপনি ৪টার পর থেকেই হোটেলে আছেন। আমি একবার দেখা করতে চলে আসব।"
"সো নাইস অব ইউ।"
মিতুল কোনো উত্তর করল না। কেবল এক ভুরু তুলে কাঁধ নাচাল একটু। ওর ঘরের দরজার পাল্লা ধরে মাথাটা বামে খানিক কাৎ করে ঠোঁটের বাম কোণায় আলতো একটা হাসি সমেত ঘর থেকেই বিদায় দিল ও আমাকে।

বাইরে বের হয়ে মিতুলের বাড়ির জায়গাটুকু ডিঙিয়েই বাসের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ি আমি।

আমি ভেবেছিলাম রাতে মিতুল একটা ফোন করবে। কিন্তু করল না। টেলিভিশন দেখতে দেখতে, বই পড়তে পড়তে আমি রাত গভীর করতেই থাকলাম, সেটারও মূল কারণ ফোনের অপো। কিন্তু রাত ৪টার সময়ও ফোন এল না, ওই সময় আসবার কথাও না। আমার আর তখন সজাগ থাকার উপায় নেই। না পেরে আমি ঘুমিয়ে যাই। তখনো ভাবছি, আশ্চর্য! মিতুল ফোন করল না।

পরদিন। কনফারেন্সের সমাপনী পর্বের হাততালিমুখর একটা পোস্ট-লাঞ্চ চা পর্ব সেরে হোটেলে ফিরেছি ৪টার আগে। নতুন পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে নানারকম যোগাযোগ, টুকটাক স্যুভেনির। অনেক কিছু নিয়েই কম্পিউটারে অনলাইনে কাটিয়ে দেয়া যায়। না-পড়া পেপারগুলো তো আছেই। কিন্তু কোনো কাজেই বিশেষ মন বসানো গেল না। ৫টা বাজলে হাঁসফাঁস করতে করতে কাবার্ড খুলে স্যুটকেসটা বের করি। হলদেটে রঙের ছোট্ট একটা স্যুটকেস। কালকে মিতুল যখন গোসল করছিল তখন বেগুনি পর্দা সরিয়ে আমি বাইরের জানালাটা খুলে দেখে নিয়েছিলাম। তারপর শেষবার খাবার পর ও যখন আবার একবার রিফ্রেশ রুমে গেছে, আমি চট করে স্যুটকেসটা জানালার ধার ঘেঁষে বাসার বাইরে রেখে দিই। আমার পে তাই ওর বাসা থেকেই বিদায় নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

হোটেলের জবরজং বিছানার চাদরের উপর এই স্যুটকেস রেখে আমি বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকি। মিতুল কথা না তুললে কীভাবে এটা নিয়ে আগানো যায় তাই ভাবতে থাকি। স্যুটকেসটা খুলতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কিছুতেই কেমন জানি পুরো সাহস করে উঠতে পারি না। ছ’টায় বন্ধ স্যুটকেসের পাশে বসে ফোন করে ফেলি --
"কেমন আছেন মিতুল?"
"হ্যাঁ, ভাল আছি। কেন?"
"না না এমনি ভাবলাম। আসলেন না যে।"
"আরে আমি তো কেবলই অফিস থেকে ফিরলাম। আসব তো। কোথাও বের হচ্ছেন নাকি?"
"ও হ্যাঁ অফিস ...। না, না, কোত্থাও না। হ্যা হ্যা আমি ভুলেই গেছিলাম। না না আমি হোটেলেই।"
"আমি তো ভাবলাম সময় নিয়ে আসব। কোথাও একটা কফি ট্যুরে যাওয়া যায়। সমস্যা থাকলে ..."
"না না। ইয়ে ... হ্যা হ্যা এতো খুব ভাল। সময় নিয়ে আসেন।"
"ডু ইউ ওয়ান্ট টু সে সামথিং?"
"কে আমি? না না। এমনি ফোন করলাম। আচ্ছা দেখা হবে।"

ফোনটা কোনোমতে রেখে আমি পানি খাই। সিগারেট ধরাই। তারপর গোলগোল চোখে বন্ধ স্যুটকেসটার দিকে তাকিয়ে থাকি। সিগারেট শেষ হতেই মাথাটা একটু সাফ হয়। আবার ফোন লাগাই। এবার একটু চৌকষ গলায় শুরু করি --
"আচ্ছা মিতুল কিছু চুরি যায়নি আপনার?"
"ইউ মীন হোয়াট?"
"আরে না না। আমি একদম ম্যাটেরিয়ালি মীন করছি। কোনোকিছু?"
"লাইক?"
"এই ধরুন স্যুটকেস।"
"কবে?"
আমি এত জোরে ঢোঁক গিলি যে টেলিফোনের ওধারে কোঁৎ ধরনের একটা শব্দ শোনা যায়। সেটা ঢাকতে তড়িঘড়ি সামনের জগ থেকে আমি আবারো পানি খাই। টেলিফোন কানে ধরেই। পানি নাকে ঢুকে পড়ে। সেই শব্দে মিতুল জিজ্ঞেস করে --
"কী হলো?"
"হ্যা হ্যা পানি খেলাম একটু। গলা শুকিয়ে গেছিল, না না মানে ইয়ে পিপাসা পেয়েছিল।"
"আপনি বলছেন আমার কখনো স্যুটকেস চুরি গেছে কিনা?"
"হ্যাঁ মানে না ... মানে গতকাল চুরি যায়নি?"
"হোয়াট আর ইউ ট্রায়িং টু সে?"
"আপনার গতরাতে একটা স্যুটকেস চুরি গেছে।" অনেকখানি দম নিয়ে আমি একদমে বললাম।
"ইউ মীন ইউ ডিড ইট!"
"হ্যাঁ।"
"হাউ ক্যান আই বী শিওর?"
"আরে এ কি? এ তো দেখি উল্টো। আপনার খাটের পাশে রাখা হলুদ ..."
"সিন্স ইউ ইনসিস্টেড দ্যাট ইউ হ্যাড দ্য স্কিল, এটা তো অন্য কারোও হতে পারে। সেমিনারে তো কত লোকই এসেছে।"
"আরে আপনার খাটের পাশে রাখা হলুদ ছোট ..."
"কী আছে ভিতরে?"
"সে তো জানি না। মানে দেখিনি তো খুলে ..."
"ওয়াও! কাল রাতে চুরি করে এখন পর্যন্ত দেখেননি! আমি লাইনে আছি। দেখে বলেন।"
"দেখে বললে হবে? আচ্ছা!"
আমি টেলিফোনটা কোনোরকমে রেখে বিছানায় রাখা স্যুটকেসটা খুলি।

খুলেই ... লাল নীল বেগুনি ম্যাজেন্টা ... এলোমেলো, না-সাজানো। এতবড় ধাক্কার জন্য আমি একদমই তৈরি ছিলাম না।

আমি ধুপ করে ডালাটা বন্ধ করে দিই। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর টেলিফোনের দিকে খেয়াল পড়তেই এক লাফে টেলিফোনটা ধরি --
"হ্যাঁ মানে ইয়ে ..."
"কী আছে স্যুটকেসে?"
"না না আমি খুলিনি তো।"
"এতক্ষণ কী করলেন?"
"খুলব কিনা ভাবছিলাম।" মরিয়া হয়ে আমি বলি।
"খুলতেই তো বললাম।"
"হ্যাঁ ... ইয়ে কিন্তু আপনার স্যুটকেস আপনি ছাড়া কীভাবে খুলি?"
"আচ্ছা চোর তো! বাট আই টোল্ড ইউ আই কান্ট বী শিওর।" ওর গলা এতটুকু টসকায় না এতক্ষণ পর্যন্ত।
"এখন কী করব?"
"ওয়েল ইট'স ইয়োর ডিপার্টমেন্ট। ওকে লেট'স হ্যাভ চেক ফার্স্ট। ফোনেই যদি সময় ..."
"না না আপনি আসেন তাড়াতাড়ি। হ্যাঁ বাই।"

ফোন রেখে স্যুটকেসটার দিকেই তাকিয়ে থাকি। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আবার ওটাকে কাবার্ডের ভেতরে চালান দিই। সিগারেট ধরিয়ে, আমি হঠাৎ টের পাই, কাবার্ডটার দিকেই আমি তাকিয়ে।

মিতুল এসে হোটেলে পৌঁছাল প্রায় ন'টায়। এসেই বলল "স্যরি। আপনার ফোন রাখার পরই একটা ফোন আসল। আমার আর্জেন্ট একটা কাজ পড়ে গেছিল।" আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর বিশেষ ভাবান্তর নেই। কিন্তু আমার মনে হলো এই সময়টাও আমাকে ভোগান্তির মধ্যে রাখতে চেয়েছে ও। ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই আমি টেবিলে আনিয়ে-রাখা খাবার বাড়তে শুরু করি। মিতুল আবারো বলে "ও ডিনার এখানেই। আমি তো ভাবলাম বাইরে করব। আপনি কি টায়ার্ড নাকি?"
"না না একদম পার্ফেক্ট।"
"ঠিক আছে। তাইলে কফি খেতেই যাওয়া যাবে।"

খাওয়া পর্ব হলো আমার তরফে প্রায় কোনোরকম আওয়াজ ছাড়াই। মিতুলই জিজ্ঞেস করল "কবে আসবেন আবার?"
"তার কি ঠিক আছে? এরকম কনফারেন্স না থাকলে তো ..."
"ফান্ড পান কীভাবে?"...
এইসব কথাবার্তা। কিন্তু আমি তালকানার মতো হু হা করে যেতে থাকি। টয়লেট থেকে বেরিয়ে দেখি মিতুলের ভঙ্গিতে বাইরে যাবার স্পষ্ট আয়োজন। কী বিপদ! স্যুটকেসের কথা আবারো তো আমাকেই তুলতে হয়।
"... কিন্তু স্যুটকেস!"
"হ্যাঁ আপনার স্যুটকেস।" ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে মিতুল বলে।
"আহা হা আমার কেন হবে? আপনার স্যুটকেস। হলুদ মতো ছোট ..."
"হোয়ের'স দ্যাট?"
আমি লাফ দিয়ে কাবার্ড খুলি। তড়িঘড়ি করে স্যুটকেসটা বের করে চেয়ারে-বসে-থাকা ওর সামনে বিছানায় রাখি।
"এই দেখেন। হলুদ পাশে বাদামী তালি ..."
"ইট ক্যান বী এনিবডি'স।"
"আরে বলেন কী? আপনার খাটের পাশ থেকে ... এই যে হলুদ মতো ছোট ..."
"দ্যাট'স নট ইনাফ। এট লিস্ট ইউ শ্যুড হ্যাভ লুকড ইনটু ইট। লেট'স।"
মিতুল হাতে করে স্যুটকেসটা ধরতেই আমি আরেক লাফ দিয়ে ওপরের ডালাটা চেপে ধরি --
"না না তার দরকার নেই। এটা আপনার স্যুটকেস, ভিতরের মানে ইয়ে সবই আপনার।"
"ডিড ইউ হ্যাভ আ লুক?"
"না না মানে স্যুটকেসটা যখন আপনার, তখন জিনিসপাতিও আপনার।"
"আই -- কান্ট -- বী -- শিওর।" মিতুল আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থেমে থেমে প্রত্যেকটা কথা আলাদা করে বলল।
"কিন্তু স্যুটকেসটা আমি আপনার ঘর থেকেই এনেছি। এখন ফেরৎ দিতে চাই।" এর থেকে কাতর হয়ে আমার পে বলা সম্ভব ছিল না।
"আপনি দেখতে দিচ্ছেন না কেন?"
"মিতুল।" আমার মুখ থমথম করে, টের পাই। দুই হাত জড়ো করে চোখ বুঁজে আমি মনোসংযোগ করি, আবার বলি -- "লেট'স বী ক্লিয়ার। এর ভেতরে আন্ডারগার্মেন্টস আছে। মানে ... মেয়েদের।"
"দেন ইউ হ্যাড সীন ইট।" নিস্পৃহ গলায় মিতুল বলে।
"না না কাল দেখিনি। আপনি ফোনে বলার পর ... মানে আরো পরে ..."
"বাট আয়াম নট দ্য ওনলি উয়োম্যান..." গম্ভীর মুখে মিতুল বলে।
"এখন আমি কী করব?" পূর্ববৎ কাতর হয়েই আমি বলি।
"কফি খেতে বের হই ..."
"স্যুটকেসটা প্লিজ নেন।"
"লুক। এটাও তো হতে পারে যে আপনি এই স্যুটকেসের মধ্যে সেনসিটিভ পার্সোনাল আইটেম প্রেজেন্ট করবার চেষ্টা করছেন।"
"বলেন কী এসব?" আমি মিতুলের গলা শুনতে শুনতে এতণে নার্ভাস হতে শুরু করেছি।
"দেয়ার আর প্লেনটি অব মেইলস হু হ্যাভ দিস স্ট্রেঞ্জ কাইন্ড অব এটিট্যুডস।"
মিতুল আমার চোখের দিকে তাকিয়েই থাকল। আমার চেহারার অবস্থা দেখে, কিংবা ভেবেচিন্তেই, এরপর অন্যদিকে তাকিয়ে একদম ক্যাসুয়াল গলায় টেনে টেনে বলল --
"অর দেয়ার ক্যান বী এনাদার ওয়ে ..."
"প্লিজ ..." আমার আর সহ্য হয় না।
"আমি প’রে আপনাকে দেখাতে পারি। ইফ ইউ থিঙ্ক দোজ আর নাইস অন মী, আই মাইট থিঙ্ক ওভার আকসেপ্টিং দোজ, এন্ড দ্য স্যুটকেস টু।"
আমি একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের আর কোনো রাস্তাই আমার সামনে খোলা নেই। মিতুল আমাকে মজাদার এক সাব্জেক্ট বানিয়ে চেখে চেখে দেখছে। তাকিয়ে থাকে সেও, তবে আমাদের দু’জনের তাকানোতে সামান্য কোনো মিলও নেই।
"হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক?" মিতুলই এই নৈঃশব্দ ভাঙে।
"চলেন কফি খেতে বের হই।" দু'বার গলা খাকারি দিয়ে চলনসই একটা আওয়াজ বের করি আমি।

যেন হোটেলে কিছুই হয়নি, মিতুল গাড়িতে কিংবা কফি খেতে খেতে বলতে থাকল কী পড়তে ওর ভাল লাগে, কাদের সঙ্গে মেশে। পরের বার আমি সময় নিয়ে আসলে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। আমি কোনোমতে ওর সঙ্গে ঝুলে থাকি। রাত্রে হোটেলে নামিয়ে দেবার সময় বার বার ও জিজ্ঞেস করে ভোররাতে গাড়ি করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে হবে কিনা। সেটার দরকার ছিল না। আমি হোটেলে আগেই বলে রেখেছিলাম ক্যাবের জন্য।

সতর্কতার চোটে আমি বেশ আগেই কাউন্টারে চলে এসেছিলাম। আমার মতো আরো দু’চারজন। কাউন্টারের মহিলা তখনো বোর্ডিং পাস দিতে শুরু করেনি। পায়ের কাছে রাখা আমার ব্যাগটা বস্তার মতো ঠাসা হয়ে পড়ে আছে। কাঁধের ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট আর টিকেট বের করি আমি। মহিলাটি ততণে ডাক ছেড়েছে। আমার সামনে পাঁচজন। আমি মনে মনে বিভীষিকাময় চেক-ইন পর্ব ভেবে কাতর হয়ে দাঁড়িয়ে।

শিখে-ফেলা হাসি সমেত আমি বাম হাতে আমার পাসপোর্ট আর ইলেকট্রনিক টিকেট এগিয়ে দিই তার দিকে। ভুরু কুঁচকে সে আমার পাসপোর্টের ছবি দেখল। তারপর টিকেটটা দেখল। কম্পিউটারে দু’চারটা বোতাম টিপল। তারপর সেও মাপা হাসিতে টিকেট আর পাসপোর্ট আমাকে ফেরত দিয়ে দেয় --
"সরি স্যার। ইয়োর বুকিং ইজ নট ফর টুডেজ।"
আমি তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে --
"হাউ ক্যান ইউ সে দ্যাট? আই বট টুডে’স টিকেট।"
"ওয়েল আই ক্যান চেক ইট এগেইন।" তাজ্জব হয় সেও। কিন্তু মাপা-হাসিটা ছাড়ে না।
আমি কাউন্টারে অনিচ্ছাকৃত টোকা দিতে থাকি। সে আবার কম্পিউটারে হাত চালায় --
"ওকে। আই ক্যান সী ইউ হ্যাড আ বুকিং বাট ইউ চেঞ্জড ইট ফর টুয়েন্টি থার্ড।"
"আই কান্ট বিলিভ ইট।"
"সরি স্যার। উড ইউ প্লিজ লুক এট ইওর টিকেট?" মহিলাটি রাস্তা পায়।
আমিও আমার টিকেটের দিকে তাকাই। কাগজটাকে এতক্ষণে আমার বেশ অচেনাই লাগে। পরিষ্কার দেখতে পাই যে লেখা আছে ২৩ তারিখে আমার যাবার কথা। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের দিকে হতভম্ব হয়ে আমি তাকাই।
"দিস ইজ .. আই মীন দিজ ওয়াজ আ ফিক্সড টিকেট।"
"ইয়েস স্যার। বাট ইউ ক্যান চেঞ্জ ইট উইদ আ পেনাল্টি। এন্ড ইউ ডিড ইট।"
"মী? আয়াম সরি ... বাট ইউ নো ... আয়াম জাস্ট লস্ট।"
"দ্যাট আই ক্যান সী স্যার।"
"নো নো আই মীন আই জাস্ট ডোন্ট নো হাউ দিস কুড হ্যাপেন।"
"দিস হ্যাপেনস সামটাইম।"

মহিলাটি হাসিমুখেই তাকিয়ে থাকে। সে আমাকে সরবার জন্য বলতে চায় বোধহয়। আমিও বুঝতে পারি এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এই রহস্যজনক ঘটনার তদন্ত করা দরকার। হঠাৎ প্রায় মেঝে-ফুঁড়ে মিতুলকে কথা বলতে শোনা গেল। সে উল্টো দিকের কোনো লাইন ধরে চলে এসেছে কাউন্টারের সামনে --
"সরি ম্যা'ম। দেয়ার ওয়াজ আ সিরিয়াস মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং।"
"আই ক্যান সী দ্যাট।"
"হেল্থ গ্রাউন্ডে তো টিকেট বদলানোই যায়, তাই না?" আমার দিকে তাকিয়ে হাসিহীন একটা নিচু গলায় মিতুল বলে।
"বাট হোয়াট হ্যাপেন্ড টু মী?" আমি বাংলাতে বলার কথাও ভুলে গেলাম।
"হাই ব্লাড প্রেশার।" কাউন্টারের মহিলার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে মিতুল ঘাড় খানিক ঝাঁকিয়ে বলল। আশ্চর্য হাসল ও!
"আই নেভার এভার হ্যাড হাইপ্রেশার।" হতভম্ব আমি খেয়ালও করি না যে গলা চড়ে যাচ্ছে।
"আর ইউ শিওর?" মিতুল চট করে এগিয়ে এসে আমার ইঞ্চিখানেক দূরে দাঁড়ায়। ইঞ্চিখানেকই সম্ভবতঃ। সাথে সাথেই আমার বাঁ হাতের পাল্স দেখে। হাতটাকে ওর ডানহাতে ধরে আমাদের দু'জনের মাঝখানের ওই ইঞ্চিখানেক জায়গায় তোলে -- "আই ডোন্ট থিঙ্ক ইউ আর রাইট।" তারপর আমাকে প্রায় ঠেলে দু'কদম সরায় যাতে পরের যাত্রী কাউন্টারে যেতে পারে। জনা আষ্টেক লোকের দিকে ততক্ষণে তাকানো হলো আমার। তাদের কারো মুখ দেখেই মনে হলো না আমার জন্য দেরি হওয়াতে অখুশি। বয়স্ক এক লোক, পিপার মতো গোল, রীতিমত হাসিমুখ করে তাকিয়ে আছে। তার চোখগুলো প্রায় বোঁজা। মিতুল আমাকে সরানোতে যে লোকটা আগালো তারও চোখ আমাদের দিকে, কাউন্টারে নয়। কাউন্টারের মহিলার দিকে মিতুল বলল -- "থ্যাঙ্ক্যু ম্যা'ম।"
"ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। আই উইশ আ ভেরি হেপি ডে টু ইউ।"
"আয়াম সরি।" আমার সম্ভাব্য সহযাত্রীদের দিকে কিছু-বুঝতে-না-পেরে বললাম। ততক্ষণে মিতুল আমার পাল্স দ্বিতীয়বার নিরীক্ষণ করতে শুরু করেছে। সহযাত্রীরা প্রায় সকলেই স্মিত। বয়স্ক লোকটা তো হাত নেড়েই ফেলল। মিতুল প্রায় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলছে --
"ডোন্ট ইউ থিঙ্ক ইয়োর লাগেজ উড বী টু প্রোভোকেটিভ ফর দ্য কাস্টমস?"
আমার মুখে কোনো আওয়াজ নেই তখন। ফলে মিতুলই আবার বলে --
"ডোন্ট ইউ থিঙ্ক ইউ শুড ড্রপ দ্যাট স্যুটকেস হিয়ার ইন টরন্টো? হা? আই গেইভ ইউ দ্য বেস্ট অপশন।"

আমি বাধ্য বাছুরের মতো মিতুলের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বাইরে আসি। ওর কাঁধে আমার লাগেজ। বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাই। কিছু একটা না বলতে পারলে আমার অস্তিত্বই থাকে না সেটা আমি দিব্যি বুঝতে পারি --
"আমার তো কাজও থাকতে পারত।"
"আপনি বলেছিলেন লেখা ছাড়া বিশেষ কাজ নেই।"
"ও। বাট হাউ কুড ইউ ম্যানেজ দ্য টিকেট?"
"রিফ্রেশ রুমে শুধু আমি যাইনি। আপনিও গেছিলেন।"
"আপনি আমার টিকেট বের করে নিয়েছিলেন?"
"একচুয়েলি ইয়োর পাসপোর্ট অলসো। কিন্তু শুধু টিকেট নাম্বারটা থাকলেই কাজ চালানো যেত।"
"কিন্তু আমার পাসপোর্ট টিকেট তো ঠিক জায়গাতেই ছিল।"
"ছিল। তবে সেটা পরদিন। মানে হোটেলে।"
"ও।" আমার সিগারেট পুড়তে থাকে। আমি মিতুলের দিকে ভালমতো তাকানোর চেষ্টা করি --
"তো আমার কী করণীয় এখন?"
"কাল পরশু আমার উইক-এন্ড। তারপর ৫দিন অফিস। তারপর আবার দু'দিন উইক-এন্ড। আপনি আমার বাসায় বসে আপনার হোমওয়ার্ক করবেন। আর আমরা দু'জন মিলে ওয়ার্ক আউট করতে পারি আপনার স্যুটকেসের বিষয়ে।"

মিতুলের গলা কিছুমাত্র বদলায় না। একই রকম করে তাকায় ও আমার দিকে। একই রকম কাটা-কাটা ওর স্বর।
"সাউন্ডস কুল।" আমি বলি।
"নো ওয়ে! আই গেইস হট। ভেরি হট। আস্ক ইয়োর পাল্স।"

ডানচোখে ছোট্ট একটা টিপ মেরে মিতুল বলে।


---
(৬ই জুন ২০০৫ -- ১৪ই জুন ২০০৫। হিগাশি-হিরোশিমা)
প্রকাশ: সম্ম্ভবত মোফাজ্জল করিম নিলু সম্পাদিত ওয়েব ভিত্তিক একটা পত্রিকায় প্রকাশিত ছিল।
৩২টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×