somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্রে জীবন - ১৮

২২ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[গত পর্বে আপনাদের এই জাহাজটার গল্প বলেছিলাম]

[গত পর্ব, “সমুদ্রে জীবন - ১৭”-তে যে জাহাজটার গল্প বলতে শুরু করেছিলাম - এবারের পর্বটাও সেই জাহাজেরই অসমাপ্ত গল্পের ধারাবাহিক বর্ণনা। যারা গত পর্বটা পড়েন নি, তাদের প্রতি আন্তরিক অনুরোধ, এই পর্ব পড়ার আগে, কষ্ট করে গত পর্বটা পড়ে নেবেন, ইনশা’আল্লাহ্!( য়া এখানে রয়েছে: Click This Link ) ]


জাহাজে পা রেখে মনে হলো একটা মৃত নগরী - আমাদের এদিককার জাহাজগুলো বন্দরে আসলে দারুণ রকমের একটা প্রাণ-চাঞ্চল্য দেখা যায় - এখানে সেই প্রাণের স্পন্দনটা একেবারেই অনুপস্থিত মনে হলো। আমাদের সাথে ওদের জীবনযাত্রার পার্থক্য বোঝার পর্বের সূচনা হলো এভাবেই! আমাকে ঐ জাহাজে আমার ডিপার্টমেন্টের শীর্ষব্যক্তির অফিসে, তার কাছে, নিয়ে যাওয়া হলো - যার কাছ থেকে আমার জাহাজ takeover করার কথা। সাদা-চামড়া আমেরিকান ঐ ভদ্রলোকের নামের প্রথম অংশ ছিল Joe - যার সাথে পরবর্তী সময়ে হৃদ্যতার সূত্র ধরে আমি তাকে Joe-ই ডাকতাম - উনিও আমাকে আমার প্রথম নাম ধরে ডাকতেন - যা বিদেশীরা সাধারণত কোন formal relation-এ ডাকে না! Joe আমার চেয়ে ১২/১৩ বছরে বড় জার্মান বংশোদ্ভূত একজন আমেরিকান, তার স্ত্রীর দিকটা আইরিশ উৎসের বলে তিনি উল্লেখ করেছেন বলে মনে পড়ছে। বয়স কিছুটা ভারী হলেও, তার সুঠাম পেশীবহুল দেহ তার কর্মক্ষমতার স্বাক্ষর বহন করে - মুখভর্তি দাড়ি যেন তার নাবিক পরিচয়কে সত্যায়িত করছে বলে মনে হয়। আগামী দিনগুলোতে আমি যতদিন এই আমেরিকান ক্রুর সাথে sail করবো, ততদিন আমার বেশীরভাগ কাজকর্ম বা interaction হবে এই লোকটির সাথেই - এই লোকটির কাছ থেকেই আমি জাহাজ বুঝে নেব - সেজন্য লোকটি কেমন, তা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ!

একটা জাহাজ পোর্টে আসলে, বিশেষত হোম পোর্টে আসলে, যত বেশী সম্ভব - মেইন্টেনেন্স কাজগুলো সেরে নেয়া হয়। ঐ জাহাজটার হোমপোর্ট তথা "পোর্ট ফ রেজিস্ট্রি" ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার (কথিত Bay Area-য় অবস্থিত) Oakland, যদিও হেড অফিস ছিল ক্যালিফোর্নিয়ারই Walnut Creek-এ - এক কালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের হেড অফিস যেমন ঢাকায় ছিল, কিন্তু জাহাজগুলোর "পোর্ট আফ রেজিস্ট্রেশন" ছিল চট্রগ্রাম। যাহোক, আমি খেয়াল করলাম: সাধারণ মেইন্টেনেন্স কাজের জন্যও বাইরের ঠিকাদারদের লোক এসেছে জাহাজে - ব্যাপারটা আমাদের এই অঞ্চলে বেশ বিরল - খুব ক্ষীণ লোকবলের জাহাজ না হলে, সাধারণ মেইন্টেনেন্সের কাজগুলো জাহাজের ক্রুরাই করে থাকে। দেখলাম একজন ইঞ্জিনিয়ার সুপারিনটেন্ডেন্টও এসেছেন কাজগুলোর তদারকি করতে।

কিছু প্রাথমিক আলাপের পর আমাদের ঘরগুলো দেখিয়ে দেয়া হলো। আমাকে Joe-এর কেবিনের পাশেই একটা কেবিন দেখিয়ে দেয়া হলো - জাহাজের পরিভাষায় যেটাকে বলা হয় Owner's Cabin। কথাবার্তায় বুঝলাম জাহাজের প্রায় সকলেই (আসলে কেবল চীফ অফিসার ছাড়া বাকী সকলেই) ঐ জাহাজের স্থায়ী ক্রু - অর্থাৎ কেউ ৮ বছর কেউ ১০ বছর ধরে ঐ একই জাহাজে আছে; যখন কেউ ছুটিতে যায়, তখন ঐ জাহাজের জন্য নির্ধারিত "রিলিফ ক্রু" এসে তাদের জায়গায় কাজ করে। ছুটি শেষে তারা ফিরে এসে আবার স্বপদে যোগ দেন। ব্যাপারটার একঘেঁয়েমি আমি কল্পনাও করতে পারি না। এর পক্ষের যুক্তি হচ্ছে যে, এতদিন একটা জাহাজে থাকলে ঐ জাহাজের নাট-বল্টু সব মুখস্ত হয়ে যাবার কথা - কাজেই ব্যাপারটা জাহাজের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আমি কাজের আগ্রহই হারিয়ে ফেলতাম - নতুন নতুন (অর্থাৎ একাধিক বা বিভিন্ন) জাহাজে চাকুরী করতে গিয়ে যেমন অনেক ধরনের তথ্য বা প্রযুক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাড়ে, তেমনি কাজের আগ্রহটাও বজায় থাকে! কি জানি, আমার কাছে, ৮ বছর একটা জাহাজে থাকলে, জাহাজটাকে শতবার পড়া একটা খবরের কাগজের মত মনে হবে হয়তো। ঘরে আর কোন reading material না থাকলে আমরা হয়তো একটা পুরানো খবরের কাগজও কয়েকবার পড়তে/দেখতে পারি - কিন্তু তাতে আগ্রহ কতটুকু বজায় থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। বাইরে থেকে অস্থায়ী চুক্তিতে আসা চীফ অফিসার Allen ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম - তার বিদেশী ফ্ল্যাগের জাহাজে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, আর তাই সে ছিল বহুজাতিক ক্রুর সাথে কাজ করা একমাত্র ব্যক্তি - বাকীরা আজীবন কেবল আমেরিকান ক্রুর সাথেই কাজ করেছে। প্রসঙ্গত উল্রেখযোগ্য যে, বহুজাতিক ক্রুর সাথে কাজে করার অভিজ্ঞতাকে জাহাজী পেশায় সবসময় একটা বাড়তি যোগ্যতা বলে জ্ঞান করা হয়! আমার মনে আছে, একবার আমরা যুক্তরাষ্ট্রের Washington অঙ্গরাজ্যের Fort Vancouver-এ গিয়েছিলাম, যখন আমাদের জাহাজে ৮টি দেশের নাগরিকেরা কর্মরত ছিল। সেখানকার Seaman's mission থেকে কর্মকর্তারা এসেছিলেন আমাদের ক্রুর ছবি তুলতে - আমাদের জাহাজের লোকবলকে তারা "United Nations" আখ্যা দিয়েছিলেন।

আপনি যে সম্পূর্ণ অচেনা একটা পৃথিবীতে রয়েছেন - এই বার্তাটা বা বোধটা যে কয়টা বিষয় আপনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, তার অন্যতম একটি হচ্ছে খাবার-দাবার। জাহাজের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর সারতে হয। ঐ জাহাজে পদার্পণ করার অল্প সময়ের মাঝেই খাবার "নির্দিষ্ট সময়" এসে উপস্থিত হলো। আমরা "মেস রুম"-এ গেলাম। ওখানে অন্যান্য কিছু অফিসারদের সাথে পরিচিত হলাম - সাধারণভাবে, আমাদের প্রতি তাদের মনোভাব ও আচরণকে বেশ "ঠান্ডা" মনে হলো! "মেস রুম"-এ ঢুকে বুঝলাম: প্রায় কিছুই আমাদের খাবার যোগ্য নয়্ - অবস্থাটা, প্রথম পরিচিত হবার একটা পর্যায়ে বেশ অস্বস্তিকর। কোন খাবারটা শূকর থেকে তৈরী উপকরণ মুক্ত, তা নির্ণয় করা এক প্রকার অসম্ভব মনে হলো - আর তাছাড়া (অর্থাৎ শূকর ফ্যাক্টর ছাড়াও) মাংসের হালাল-হারাম বাছ-বিচার তো রয়েছেই। বিশালদেহী ন্যাড়ামাথা চীফ স্টুয়ার্ড হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো, কি সমস্যা জানতে। কত মুসলিমই ব্যাপারগুলো বোঝেন না, সেক্ষেত্রে আত্মমগ্ন ও নিজেদের "জগত"কেই পৃথিবী জ্ঞান করা (বা অন্তত that is all that matters জ্ঞান করা) আমেরিকান জাতির একজন কাফির নাগরিককে ব্যাপারগুলো বোঝানো তো আরো অনেক কঠিন। তাকে তবু মোটামুটি বললাম যে, মাছ বা সবজীর একটা আইটেম আর সাথে ভাত/রুটি থাকলেই আমাদের চলে যাবে। কথা বলতে বলতে pantryতে গিয়ে দেখলাম অনেক আইটেমের বেশ বড় একটা সালাদ বার রয়েছে - যেখানে বরফ দেয়া অনেক আইটেমের মাঝে "টুনা-সালাদ"ও ছিল। প্রথম বেলার খাওয়াটা সালাদ আর পাউরুটি দিয়ে সমাধা হলো [১]। পরবর্তী বেলা থেকে, আমাদের জন্য প্রায়ই কিছু না কিছু ব্যবস্থা থাকতো। অল্প সময়ের ভিতর আবিষ্কৃত হলো যে, "চীফ স্টুয়ার্ড"-এর অধীনে ইয়েমেনী বংশোদ্ভূত, "আলী" নামের একজন আমেরিকান নাগরিক রয়েছেন "মেস-বয়" হিসেবে। তিনি প্রায়ই আমাদের একটু বাড়তি যত্ন-আত্মি করার চেষ্টা করেছেন।

যাহোক, সিঙ্গাপুর থেকে আমরা যে "হোম ওয়ার্ক" করে এসেছিলাম, তার ভিত্তিতে Joe-কে কিছু প্রশ্ন করতে বুঝলাম ঐ সব বিষয়ে তার তেমন একটা জ্ঞান নেই। তিনি অবাক বিস্ময়ে আমার/আমাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন যে, তার জাহাজ সম্বন্ধে আমরা এত কিছু জানি কিভাবে! নানা কথাবার্তায় আমাদের দিন কেটে গেল। আমরাও কিছুটা সহজ হতে শুরু করলাম। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশের অস্বস্তিগুলো আস্তে আস্তে দূর হতে শুরু করলো। দিন শেষে সন্ধ্যার খাবারের পর খেয়াল করলাম যে, জাহাজখানি আক্ষরিক অর্থেই এক ভূতুড়ে মৃত নগরীতে পরিণত হলো। এখানেও পৃথিবীর দুই অংশের "জাহাজীয় সংস্কৃতিটা" ভিন্ন বলে মনে হলো। বুঝলাম আমাদের পৃথিবীর (অর্থাৎ এশিয়ান বা এমনকি ইউরোপীয়) দেশগুলোর নাবিকদের মত এরা খাবার পরে smoke room-এ আড্ডা মারতে আসে না - বরং প্রত্যেকের ঘরে যে টিভি রযেছে এবং ছায়া-ছবি দেখার যে সব যন্ত্রপাতি রয়েছে, সে সবের বদৌলতে ঘরে বসেই বিনোদন সামগ্রী গলাধঃকরণ করে থাকে। অথচ, আমাদের কোম্পানীতে নিজের ঘরে বসে সিনেমা-টিভি দেখাটা officiallyই নিরুৎসাহিত করা হতো social harmony-র concept থেকে - এমন কি ক্যাপ্টেন বা চীফ ইঞ্জিনিয়ারদের মত যাদের কেবিনে সচরাচর টিভি/ভিডিও থাকে, তাদেরও নিরুৎসাহিত করা হতো। অগত্যা ("সমুদ্রে জীবন - ১৭"-তে উল্লেখ করা) আমার সহকর্মী জামাল আর আমি, আমরা দু'জনই smoke room-এ বসে একটু গপ্প-সপ্প করে ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন জাহাজ Guam-এর উদ্দেশ্যে sail করলো। আগে কখনো আমি Guam য়াই নি। একজন seasoned sailor হয়েও, কখনো না যাওয়া একটা জগতে যাবো ভাবতে তখনো হঠাৎ করে বুকের পাঁজরে হৃদপিন্ডের গতির পরিবর্তনটা স্পষ্ট অনুভব করতাম। (এখন অবশ্য সেটা আর হবে না - কেন তা ব্যাখ্যা করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। সংক্ষেপে: যেদিন থেকে জেনেছি যে, "যরুরত" ছাড়া কাফির-দেশে বেড়াতে যাওয়াটা হারাম, সেদিন থেকে একটা নতুন "কাফির-মুলুক" দেখতে যাবার ভাবনাটা আমাকে আর পুলকিত করে না। [২])



[গুয়ামের ছবি]

জাহাজ sail করলে, নাবিকরা অনেক বকেয়া কাজে হাত দিতে পারে - তাদের অবসরও অনেক বেড়ে যায়। পরদিন থেকে শুরু হলো Joeকে সাথে করে জাহাজের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা আর নানা ব্যবস্থা (systems), ফাইলসমূহ, ITসামগ্রী, inventory ও যন্ত্রপাতির অবস্থা জানা ও বোঝা - আর একা থাকা সময়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন “ম্যানুয়েল” পড়া। এসব কর্মকান্ডের মাঝে Joe-এর সাথে আমার বেশ খাতির জমে উঠলো। বুঝলাম, পৃথিবীর প্রচলিত সংজ্ঞায়, তিনি একজন ভালো মানুষ - যদিও ইসলামী বিশ্বাস মতে "কুফর" হচ্ছে এমন একটা দোষ, যা পৃথিবীর সকল গুণকে ম্লান করে দেয় - অকেজো ও অর্থহীন করে দেয়; আর ঈমান হচ্ছে এমন একটা গুণ, যা পৃথিবীর সকল দোষকেই খাটো করে দেয়। ধীরে ধীরে অন্যদের সাথে সম্পর্কও সহজ হতে লাগলো - কারো কারো সাথে বেশ সখ্যতাও গড়ে উঠলো। অন্য কোম্পানী থেকে আসা চীফ অফিসার Allen-এর সাথেও বেশ খাতির হলো আমার। সে প্রায়ই "শ্বেত-হস্তী" পোষার মত করে, ঐ আমেরিকান কোম্পানী চালানোর সমালোচনা করতো, আর বলতো যে, ওখানে সবকিছু কাগুজে নিয়মের বেড়াজালে আটকে রয়েছে - তাছাড়া জনবল বাছাইয়ের ব্যাপারটা ইউনিয়নের পেশীশক্তির কাছে জিম্মী। Allen ছিল একজন ক্যাথলিক খৃষ্টান আর তার বউ ছিল পেরুভিয়ান। জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে গল্প করতে গিয়ে, সে প্রায়ই তার মতে যে, তৃতীয় বিশ্বের (যেমন ল্যাটিন আমেরিকার) লোকজন অধিকতর সুখী, সেই বোধটা প্রকাশ করতো এবং আমেরিকানদের মাঝে নিজেদের অহেতুকই বিশেষ কিছু মনে করার যে প্রবণতা দেখা যায়, সেটার সমালোচনা করতো । গল্পের মাঝে এক পর্যায়ে Allen বললো যে, আমরা জাহাজে আসার আগে ঐ জাহাজের অফিসাররা - কি করে আমাদের "সামাল" দেবে - সেই ব্যাপারে মিটিং করে আলোচনা করেছে । তারা অন্য জাতীয়তার নাবিকদের সাথে কখনো কাজ করে নি বলেই হয়তো তাদের কিছুটা বাড়তি উদ্বেগ ছিল - তাছাড়া যারা জাহাজ takeover করতে আসে, তাদের সাধারণত জাহাজের "অবস্থা" সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন থাকে, সেটার জন্যও handover কারীরা অনেক সময় "আসামী আসামী" বোধ করে বা বিব্রত বোধ করে - কিছুটা অবিশ্বাসও কাজ করে, কি জানি "কন্ডিশন রিপোর্ট" বা এ্যপ্রাইজালে কি লেখা হয় .. ইত্যদি। অল্প দিনের ভিতরই সংশয় কেটে গিয়ে অফিসারদের প্রায় সকলের সাথে বেশ চমৎকার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো।

[গুয়ামের টুনা মাছের ছবি]

আমরা যথাসময়ে Guam পৌঁছালাম - ঐ ধরনের আর দু'টো জায়গায় আমি ইতিপূর্বে গিয়েছিলাম: সেগুলো হচ্ছে পাপুয়া নিউ গিনির "ভ্যানিমো" আর হাওয়াইয়ের "হনুলুলু"। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত এই দ্বীপটিকে (অর্থাৎ Guamকে) যুক্তরাষ্ট্রের অধীন একটা অঞ্চল বলে ধরা হয়, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে আত্তীকরণ করা হয় নি। এখানে শক্তিশালী মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যাকে ঘিরে এখানকার প্রায় সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আবর্তিত হয়! Guam-এ পোর্ট-এর কাছে একটা ক্লাব মত রয়েছে। Guam-এ নিয়মিত আসা ঐ জাহাজের নাবিকেরা যেখানে পান ও আহার করতে যায়। Exxon Valdez নামক বিশাল আমেরিকান ট্যাঙ্কারের দুর্ঘটনার ফলশ্রুতিতে, আমেরিকান উপকূলে ইতিহাসের বৃহত্তম "oil spill" (বা "তৈল-নিঃসরণ") তথা "pollution"-এর (বা "পরিবেশ দূষণের") ঘটনা ঘটলে, ঘটনার তদন্তে দেখা যায় যে, জাহাজের ডিউটি অফিসার তখন "under the influence of alcohol" ছিলেন। এরপর থেকে আইন করে আমেরিকান জাহাজে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকানরা মদ, বা অন্তত বিয়ার খাবে না ব্যাপারটা অকল্পনীয়। কিন্তু বাস্তবেই দেখেছি, ঐ জাহাজখানা আক্ষরিক অর্থেই "শুকনো" ছিল। যাহোক, Joe আমাকে খুব আন্তরিকতার সাথে, তার সঙ্গে লাঞ্চ করতে ডাকলেন। “হারাম” এড়িয়ে যেতে আমি salmon steak জাতীয় একটা কিছু খেলাম। "যার যার তার তার" দর্শনে পরিচালিত বস্তুবাদী “কাফির জগতের” লোকেরা (অর্থাৎ ঐ জাহাজের লোকেরা) বেশ অবাক হলো - আর কাউকে নয়, বরং অল্প সময়ের পরিচিত একজন ভিনদেশীকে Joe তার সঙ্গে খেতে ডাকলেন। পরে বুঝেছি, নানা কারণে কিছুটা রাশভারী Joe প্রথম থেকেই আমাকে বেশ পছন্দ ও সমীহ করতেন - আর সে সব কারণের একটা হচ্ছে, আমার আল্লাহর ইচ্ছা মত চলার যথাসাধ্য চেষ্টা; তিনি নিজেও তার মত করে ধার্মিক ছিলেন - নিজেকে তিনি একজন মৌলবাদী (প্রটেস্ট্যান্ট) খৃষ্টান মনে করতেন। এছাড়াও "তৃতীয় বিশ্বের" পেশাজীবীদের সম্বন্ধে তার/তাদের মনে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল, তার নিরসনও একটা কারণ হয়ে থাকবে। সিঙ্গাপুরের "জাহাজ ব্যবস্থাপনা" অনেক দক্ষ বিধায়, আমাদের কাজের ধরণ ও গতি তাদের চেয়ে অনেক বেশী planned, fast ও productive এবং পার্থক্যটা যে কারো চোখে পড়ার মত। যাহোক, Guam-এ আমরা একদিনেরও কম সময় ছিলাম। ঐ সময়ে জেলেদের কাছ থেকে অফিসারদের নিজস্ব পয়সায় (চাঁদায়) একটা বিরাট টুনা কেনা হলো - আনুমানিক ৪০ কেজি ওজনের হবে - sail করার পর accommodation-এর পাশের খোলা deck-এ বারবিকিউ পার্টির জন্য।

এক পর্যায়ে Joe-এর সাথে "দ্বীন-ধর্ম" নিয়ে বেশ কথাবার্তা হতে শুর করলো। এর মাঝে একদিন তিনি আমাকে আমার "অবসর পরিকল্পনা" সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। আমি যখন তাকে বললাম যে, আমার আসলে একদমই কোন পরিকল্পনা বা স্কিম নেই - তিনি প্রশ্নমাখা অবিশ্বাস এবং বিস্ময়ের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তার জীবনের "অবসর পরিকল্পনা" সম্বন্ধে বললেন: চাকুরী শেষে তাদের অফিসার ইউনিয়নের মাধ্যমে করা ইনস্যুরেন্স পরিপক্ক হলে, তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করবেন - তা দিয়ে তিনি তার অবসর জীবনটা কিভাবে কাটাবেন এবং এমন কি নিজের শেষকৃত্যের জন্য কিভাবে পয়সা রেখে যাবেন তার বর্ণনা দিলেন। আমি তাকে বললাম যে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের এরকম কোন "অবসর পরিকল্পনা" থাকে না। বললাম: আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের জন্য জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করেন - বিসর্জন দেন - কিছু তুলে রাখেন না বা আমাদের বাদ রেখে "সাইড লাইনে" কিছু উপভোগ করেন না। তাঁদের জীবনের শুরু থেকেই শুরু হয় আমাদের জন্য তাঁদের ত্যাগ - এটাই সঠিক কিনা আমি জানি না, তবে, বলা যায় জীবন দিয়ে তাঁরা আমাদের জীবনকে গড়েন - জীবনী শক্তি দান করেন। সন্তান জন্ম দেবার পর নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা আরাম আয়েশের জন্য তাঁরা আমাদের পাশের রুমে "cot"-এ একাকী পরিত্যক্ত অবস্থায় শুইয়ে রাখেন না - বরং মায়ের উষ্ণতা ও স্পর্শ-গন্ধের নিরাপত্তার জন্মগত অধিকার নিশ্চিত করতে, রাতে নিজেদের মাঝখানে নিয়ে ঘুমান। আমাদের মায়েরা নিজেদের "বক্ষ সৌন্দর্য্য"-কে সন্তানের মাতৃ-দুগ্ধপানের প্রয়োজনীয়তা ও অধিকারের উপরে স্থান দেন না - বরং দেখা যায় যে, অতিরিক্ত যত্ন, উদ্বেগ আর ত্যাগের সাথে সংসার-ধর্ম পালন করতে গিয়ে সময়ের আগেই তাঁরা "ক্ষয়" হয়ে যান - নিঃশেষ হয়ে যান । এখনো, আমাদের সমাজের এমনকি নাগরিক জীবনেও, এমন অনেক বাবা-মা পাওয়া যাবে, যারা, নিজের সন্তানদের ছেড়ে কখনো একদিনের জন্যও, কোন রিসোর্ট বা অবকাশে যান নি - বরং কখনো সৌভাগ্য হলে সকলকে নিয়ে কোন সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যাবেন, এই দুরাশায় জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন - আর "বেবী-সিটার"-এর কাছে দুধের বাচ্চা রেখে পার্টিতে "মৌজ" করতে যাওয়া বা কোন অবকাশ যাপনের আয়োজনে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। এখনো, হাতেগোনা কিছু নাগরিক "নষ্ট-নীড়" ছাড়া, আমাদের সংসারগুলোতে দেখা যাবে যে, সকলের পাতে ভালো খাবারগুলো নিশ্চিত করার আগে, আমাদের মায়েরা খেতে বসেন না! সুতরাং এসব বাবা-মায়েদের তাঁদের সন্তানরা যেভাবে treat করবে, সেটা তোমাদের সভ্যতার ছেলেমেয়েরা তাদের মা-বাবাকে যেভাবে treat করে - তার চেয়ে আলাদা হবে বৈকি!! তাঁরা নিজেদের ইন্দ্রিয়-সুখের জন্য যেমন আমাদের ত্যাগ করেন না, আমরাও তেমনি তাদের হোমে পাঠাই না - অজান্তে হলেও, এটা স্বভাবজাত একটা "give and take" process হিসেবে কাজ করে! আমার বাবা যতদিন কাজ করেছেন, ততদিন পেছনে ফিরে তাকান নি - নিরাপত্তার কথা ভাবেন নি। তোমাদের জগত থেকে তাকিয়ে দেখলে মনে হবে যে, তিনি হয়তো ভবিষ্যত-কালেই বিশ্বাস করতেন না। তিনি রিটায়ার করলে কোথায় থাকবেন? - এই প্রশ্নটাই কখনো ওঠে নি বা কারো মাথায় আসে নি - আমাদের[৩] সাথেই যে থাকবেন, সেটাই অবধারিত ছিল। তাঁর যেমন কোন "অবসর পরিকল্পনা" ছিল না - আমারও নেই!! Joe অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে আমার কথাগুলো নীরবে শুনলেন - তারপর ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, আর্দ্র অথচ একধরনের শূন্য একটা দৃষ্টি নিয়ে তিনি বুঝিবা শতবর্ষ দূরে পেছনে ফেলে আসা একটা জীবনযাত্রার চেহারা দেখতে চাইলেন: একদিন খৃষ্ট-জগতেও এই মূল্যবোধগুলো ছিল - বাবা-মা-ভাই-বোন নিয়ে জীবন ছিল, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা সংসার ছিল, শালীনতা বোধ ছিল, বিয়ে ছিল, লজ্জা ছিল, চক্ষুলজ্জাও ছিল - সর্বোপরি ঈশ্বর ছিলেন - তাঁকে তখনো “অবসর” দেয়া হয় নি!



["সমুদ্রে জীবন - ১৭" ও "সমুদ্রে জীবন - ১৮"তে এই জাহাজটার গল্প বলা হয়েছে]

ফুটনোট:

[১] আমি তখনো জানতাম না যে, বিদেশের পাউরুটিগুলোর প্রায় সবই হারাম উপকরণযুক্ত হবার কথা (সেগুলোতে ব্যবহৃত emulsifier, monoglyceride, diglyceride ইত্যাদির মাধ্যমে হারামের অনুপ্রবেশ ঘটে) - আর, কেবল মাত্র মোড়কে লেখা ingredients দেখেই নিশ্চিত হবার উপায় নেই যে, কোন একটা খাবার "হালাল" না "হারাম"। যুক্তরাষ্ট্রের FDA-এর নিয়ম অনুযায়ী, একটা খাবারে কোন উপকরণ ২%-এর কম হলে, প্রস্তুতকারকের সেটা উল্লেখ করার কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে সদ্য বাড়তি পয়সা হাতে আসা জনগোষ্ঠীর প্রিয় খাবার "Pringles" চিপসে সাধারণভাবে হারাম উপকরণ রয়েছে (সৌদী আরবের মত রক্ষণশীল দেশগুলোতে বাজারজাত করা বিশেষভাবে প্রস্তুত কিছু পণ্য ছাড়া) - এছাড়াও অনেক জনপ্রিয় চকোলেট বা বিস্কুটে সাংকেতিক "E" নম্বরের আড়ালে অনেক "হারাম" বস্তুর পরিচয় ঢাকা পড়ে যাওয়াতে, সাধারণ মুসলিমেরা অকাতরে "হারাম" গ্রহণ করে চলেছেন। যে কোন সাধারণ মানুষের জন্য বিদেশী কোন খাবারের হালাল/হারাম মর্যাদা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া প্রায় অসম্ভব।

[২]দেখুন: http://www.islam-qa.com/en/ref/13342

[৩] আমাদের বলতে ভাই-বোন মিলে আমাদের যে বৃহত্তর পরিবার, তার সাথেই থাকবেন - যদিও এটা হতেই পারে যে, ভাইবোনদের একজন বা দুইজনের সাথে তিনি বসতবাড়ীতে রইলেন - অন্যরা হয়তো জীবিকার তাগিদে অন্য কোন শহরে থাকছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ১০:১৩
১৯টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×