somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সামগ্রি (পল্লী সমাজ পর্ব ২)

২১ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




এই কুয়াপুরের বিষয়টা অর্জ্জিত হইবার একটু ইতিহাস আছে তাহা এইখানে বলা আবশ্যক । প্রায় শতবর্ষ পূর্ব্বে মহাকুলীন বলরাম মুখুয্যে তাহার মিতা বলরাম ঘোষালকে সঙ্গে করিয়া বিক্রমপুর হইতে এদেশে আসেন । মুখুয্যে শুধু কুলীন ছিলেন না বুদ্ধিমানও ছিলেন । বিবাহ করিয়া বর্ধমান রাজ সরকারের চাকরি করিয়া এবং আরও কি কি করিয়া এই বিষয়টুকু হস্তগত করেন । ঘোষালও এই দিকেই বিবাহ করেন । কিন্তু পিতৃঋণ শোধ করা ভিন্ন আর তাহার কোন ক্ষমতাই ছিল না । তাই দুঃখে কষ্টেই তাহার দিন কাটিতেছিল । এই বিবাহ উপলক্ষেই নাকি দুই মিতার মনোমালিন্য ঘটে । পরিশেষে তাহা এমন বিবাদে পরিণত হয় । যে এক গ্রামে বাস করিয়াও বিশ বৎসরের মধ্যে কেহ কাহারও মুখদর্শন করেন নাই । বলরাম মুখুয্যে যেদিন মারা গেলেন । সেদিনও ঘোষাল তাহার বাটীতে পা দিলেন না । কিন্তু তাহার মরণের পরদিন অতি আশ্চর্য কথা শুনা গেল । তিনি নিজেই সমস্ত বিষয় চুল চিরিয়া অর্ধেক ভাগ করিয়া নিজের পুত্র ও মিতার পুত্রগণকে দিয়া গিয়াছেন । সেই অবধি এই কুয়াপুরের বিষয় মুখুয্যে ও ঘোষালবংশ ভোগদখল করিয়া আসিতেছে। ইহারা নিজেরাও জমিদার বলিয়া অভিমান করিতেন । গ্রামের লোকও অস্বীকার করিত না । যখনকার কথা বলিতেছি তখন ঘোষালবংশও ভাগ হইয়াছিল । সেই বংশের ছোট তরফের তারিণী ঘোষাল মোকদ্দমা উপলক্ষে জেলায় গিয়া দিন ছয়েক পূর্বে হঠাৎ যেদিন আদালতে ছোট বড় পাঁচ সাতটা মুলতুবি মোকদ্দমার শেষফলের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া কোথাকার কোন্‌ অজানা আদালতের মহামান্য শমন মাথায় করিয়া নিঃশব্দে প্রস্থান করিলেন । আর তখন তাহাদের কুয়াপুর গ্রামের ভিতরে ও বাহিরে একটা হুলস্থূল পরিয়া গেল । বড় তরফের কর্তা বেণী ঘোষাল বুড়োর মৃত্যুতে গোপনে আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন এবং আরো গোপনে দল পাকাইতে লাগিলেন কি করিয়া খুড়োর আগামী শ্রাদ্ধের দিনটা পণ্ড করিয়া দিবেন । দশ বৎসর খুড়ো ভাইপোর মুখ দেখাদেখি ছিল না । বহু বৎসর পূর্বে তারিণীর গৃহ শূন্য হইয়াছিল । সেই অবধি পুত্র রমেশকে তাহার মামার বাড়ি পাঠাইয়া দিয়া তারিণী বাড়ির ভিতরে দাস দাসী এবং বাইরে মোকদ্দমা লইয়াই কাল কাটাইতেছিলেন । রমেশ রুড়কি কলেজে এই দুঃসংবাদ পাইয়া পিতার শেষকার্য সম্পন্ন করিতে সুদীর্ঘকাল পরে কাল অপরাহ্নে তাহার শূন্য গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল ।

কর্মবাড়ি মধ্যে শুধু দুটা দিন বাকি । বৃহস্পতিবার রমেশের পিতৃশ্রাদ্ধ । দুই একজন করিয়া ভিন্ন গ্রামের মরুব্বিরা উপস্থিত হইতেছেন । কিন্তু নিজেদের কুয়াপুরের কেন যে কেহ আসে না রমেশ তাহা বুঝিয়াছিল এবং হয়ত শেষ পর্যন্ত কেহ আসিবেই না তাহাও জানিত । শুধু ভৈরব আচার্য ও তাহার বাড়ির লোকেরা আসিয়া কাজ কর্মে যোগ দিয়াছিল । স্বগ্রামস্থ ব্রাহ্মণদিগের পদধূলির আশা না থাকিলেও উদ্যোগ আয়োজন রমেশ বড়লোকের মতই করিয়াছিল । আজ অনেকক্ষণ পর্যন্ত রমেশ বাড়ির ভিতরে কাজ কর্মে ব্যস্ত ছিল। কি জন্যে বাহিরে আসিতেই দেখিল ইতিমধ্যে জন দুই প্রাচীন ভদ্রলোক আসিয়া বৈঠকখানার বিছানায় সমাগত হইয়া ধূমপান করিতেছেন । সম্মুখে আসিয়া সবিনয়ে কিছু বলিবার পূর্বেই পিছনে শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল এক অতিবৃদ্ধ পাঁচ ছটি ছেলেমেয়ে লইয়া কাসিতে কাসিতে বাড়ি ঢুকিল । তাহার কাঁধে মলিন উত্তরীয় নাকের উপর একজোড়া ভাঁটার মত মস্ত চশমা পিছনে দড়ি দিয়া বাঁধা । সাদা চুল সাদা গোফ তামাকের ধুয়ায় তাম্রবর্ণ । অগ্রসর হইয়া আসিয়া সে সেই ভীষণ চশমার ভিতর দিয়া রমেশের মুখের দিকে মুহূর্তকাল চাহিয়া বিনা বাক্যব্যয়ে কাঁদিয়া ফেলিল । রমেশ চিনিল না ইনি কে কিন্তু যেই হোন ব্যস্ত হইয়া কাছে আসিয়া তাহার হাত ধরিতেই সে ভাঙ্গা গলায় বলিয়া উঠিল । না বাবা রমেশ তারিণী যে এমন করে ফাকি দিয়ে পালাবে তা স্বপ্নেও জানিনে কিন্তু আমারও এমন চাটুয্যেবংশে জন্ম নয় যে কারু ভয়ে মুখ দিয়ে মিথ্যা কথা বেরুবে । আসবাব সময় তোমার বেণী ঘোষালের মুখের সামনে বলে এলুম আমাদের রমেশ যেমন শ্রাদ্ধের আয়োজন করচে এমন করা চুলোয় যাক এ অঞ্চলে কেউ চোখেও দেখেনি । একটু থামিয়া বলিল আমার নামে অনেক শালা অনেক রকম করে তোমার কাছে লাগিয়ে যাবে বাবা কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো এই ধর্মদাস শুধু ধর্মেরই দাস আর কারো নয় । এই বলিয়া বৃদ্ধ সত্যভাষণের সমস্ত পৌরুষ আত্মসাৎ করিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলীর হাত হইতে হুকাটা ছিনাইয়া লইয়া তাহাতে এক টান দিয়াই প্রবলবেগে কাসিয়া ফেলিল । ধর্মদাস নিতান্ত অত্যুক্তি করেন নাই । উদ্যোগ আয়োজন যেরূপ হইতেছিল । এদিকে সেরূপ কেহ করে নাই । কলিকাতা হইতে ময়রা আসিয়াছিল । তাহারা প্রাঙ্গণের একধারে ভিয়ান চড়াইয়াছে সেদিকে পাড়ার কতকগুলো ছেলেমেয়ে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে কাঙ্গালীদের বস্ত্র দেওয়া হইবে চণ্ডীমণ্ডপের ও ধারের বারান্দায় অনুগত ভৈরব আচার্য থান ফাড়িয়া পাট করিয়া গাদা করিতেছিল সেদিকেও জনকয়েক লোক থাবা পাতিয়া বসিয়া এই অপব্যয়ের পরিমাণ হিসাব করিয়া মনে মনে রমেশের নির্বুদ্ধিতার জন্য তাহাকে গালি পাড়িতেছিল । গরীব দুঃখী সংবাদ পাইয়া অনেক দূরের পথ হইতেও আসিয়া জুটিতেছিল । লোকজন প্রজা পাঠক বাড়ি পরিপূর্ণ করিয়া কেহ কলহ করিতেছিল কেহ বা মিছিমিছি শুধু কোলাহল করিতেছিল । চারিদিকে চাহিয়া ব্যয়বাহুল্য দেখিয়া ধর্মদাসের কাসি আরও বাড়িয়া গেল ।
প্রত্যুত্তরে রমেশ সঙ্কুচিত হইয়া না না বলিয়া আরও কি বলিতে যাইতেছিল । কিন্তু ধর্মদাস হাত নাড়িয়া থামাইয়া দিয়া ঘড়ঘড় করিয়া কত কি বলিয়া ফেলিল । কিন্তু কাসির ধমকে তাহার একটি বর্ণও বুঝা গেল না ।

গোবিন্দ গাঙ্গুলী সর্বাগ্রে আসিয়াছিল। সুতরাং ধর্মদাস যাহা বলিয়াছিল তাহা বলিবার সুবিধা তাহারই সর্বাপেক্ষা অধিক থাকিয়াও নষ্ট হইয়াছে ভাবিয়া তাহার মনে মনে ভারি একটা ক্ষোভ জন্মিতেছিল । সে এ সুযোগ আর নষ্ট হইতে দিল না । ধর্মদাসকে উদ্দেশ করিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল কাল সকালে বুঝলে ধর্মদাসদা এখানে আসব বলে বেরিয়েও আসা হল না বেণীর ডাকাডাকি গোবিন্দখুড়ো তামাক খেয়ে যাও । একবার ভাবলুম কাজ নেই তারপর মনে হ'ল ভাবখানা বেণীর দেখেই যাই না । বেণী কি বললে জান বাবা রমেশ বললে খুড়ো বলি তোমরা ত রমেশের মুরুব্বি হয়ে দাড়িয়েচ কিন্তু জিজ্ঞেস করি লোকজন খাবে টাবে ত ?

আমিই বা ছাড়ি কেন । তুমি বড়লোক আছ না আছ আমার রমেশ কারো চেয়ে খাটো নয় । তোমার ঘরে ত এক মুঠো চিঁড়ের পিত্যেশ কারু নেই । বললুম বেণীবাবু এই ত পথ একবার কাঙ্গালী বিদায়টা দাড়িয়ে দেখো । কালকের ছেলে রমেশ কিন্তু বুকের পাটাও বলি একে এতটা বয়েস হল এমন আয়োজন কখনও চোখে দেখিনি । কিন্তু তাও বলি ধর্মদাসদা আমাদের সাধ্যিই বা কি যার কাজ তিনি উপর থেকে করাচ্চেন । তারিণীদা শাপভ্রষ্ট দিক্‌পাল ছিলেন বৈ ত নয় । ধর্মদাসের কিছুতেই কাসি থামে না সে কাসিতেই লাগিল । আর তাহার মুখের সামনে গাঙ্গুলীমশাই বেশ বেশ কথাগুলি অপরিপক্ক তরুণ জমিদারটিকে বলিয়া যাইতে লাগিল দেখিয়া ধর্মদাস আরও ভাল কিছু বলিবার চেষ্টায় যেন আকুলি বিকুলি করিতে লাগিল ।

গাঙ্গুলী বলিতে লাগিল তুমি ত আমার পর নও বাবা নিতান্ত আপনার । তোমার মা যে আমার একেবারে সাক্ষাৎ পিসতুতো বোনের খুড়তুতো ভগিনী । রাধানগরের বাড়ুয্যে বাড়ি সে সব তারিণীদা জানতেন। তাই যে কোন কাজ কর্মে মামলা মোকদ্দমা করতে সাক্ষী দিতে ডাক গোবিন্দকে । ধর্মদাস প্রাণপণ বলে কাসি থামাইয়া খিচাইয়া উঠিল কেন বাজে বকিস গোবিন্দ ? খক খক খক আমি আজকের নয় না জানি কি ? সে বছর সাক্ষী দেবার কথায় বললি আমার জুতো নেই খালি পায়ে যাই কি করে ? খক খক তারিণী অমনি আড়াই টাকা দিয়ে একজোড়া জুতো কিনে দিল । তুই সেই পায়ে দিয়ে বেণীর হয়ে সাক্ষী দিয়ে এলি । খকখকখক গোবিন্দ চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিল এলুম ? এলিনে ? দূর মিথ্যাবাদী । মিথ্যাবাদী তোর বাবা ।
গোবিন্দ তাহার ভাঙ্গা ছাতি হাতে করিয়া লাফাইয়া উঠিল তবে রে শালা ।ধর্ম্মদাস তাহার বাঁশের লাঠি উচাইয়া ধরিয়া হুঙ্কার দিয়াই প্রচণ্ডভাবে কাসিয়া ফেলিল । রমেশ শশব্যস্তে উভয়ের মাঝখানে আসিয়া পড়ীয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল । ধর্ম্মদাস লাঠি নামাইয়া কাসিতে কাসিতে বসিয়া পড়িয়া বলিল ও শালার সম্পর্কে আমি বড় ভাই হই কি না তাই শালার আক্কেল দেখ । ও শালা আমার বড় ভাই । বলিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলীও ছাতি গুটাইয়া বসিয়া পড়িল ।

সহরের ময়রারা ভিয়ান ছাড়িয়া চাহিয়া রহিল। চতুর্দ্দিকে যাহারা কাজকর্ম্মে নিযুক্ত ছিল । চেচামিচি শুনিয়া তাহারা তামাসা দেখিবার জন্য সুমুখে ছুটিয়া আসিল । ছেলেমেয়েরা খেলা ফেলিয়া হা করিয়া মজা দেখিতে লাগিল । এবং এই সমস্ত লোকের দৃষ্টির সম্মুখে রমেশ লজ্জায় বিস্ময়ে হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল । তাহার মুখ দিয়া একটাও কথা বাহিল হইল না । কি এ ? উভয়েই প্রাচীন ভদ্রলোক ব্রাহ্মণ সন্তান । এত সামান্য কারণে এমন ইতরের মত গালি গালাজ করিতে পারে ? বারান্দায় বসিয়া ভৈরব কাপড়ের থাক দিতে দিতে সমস্তই দেখিতেছিল শুনিতেছিল । এখন আসিয়া রমেশকে উদ্দেশ করিয়া কহিল প্রায় শ চারেক কাপড় ত হল আরও চাই কি ? রমেশের মুখ দিয়া হঠাৎ কথাই বাহির হইল না । ভৈরব রমেশের অভিভূতভাব লক্ষ্য করিয়া হাসিল । মৃদু অনুযোগের স্বরে কহিল ছিঃ গাঙ্গুলীমশাই । বাবু একেবারে অবাক হয়ে গেছেন । আপনি কিছু মনে করবেন না বাবু এমন ঢের হয় । বৃহৎ কাজ কর্মের বাড়িতে কত ঠেঙ্গাঠেঙ্গি রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়ে যায় আবার যে কে সেই হয় । নিন উঠুন চাটুয্যেমশাই দেখুন দেখি আরও থান ফাড়ব কি না ? ধর্মদাস জবাব দিবার পূর্বেই গোবিন্দ গাঙ্গুলী সোৎসাহে শিরশ্চালনপূর্বক খাড়া হইয়া বলিল হয়ই ত হয়ই ত ঢের হয় নইলে বিরদ কর্ম বলেচে কেন ? শাস্তরে আছে লক্ষ কথা না হলে বিয়েই হয় না যে সে বছর তোমার মনে আছে ভৈরব যদু মুখুয্যেমশায়ের কন্যা রমার গাছ পিতিষ্ঠের দিনে সিদে নিয়ে রাঘব ভটচায্যিতে হারাণ চাটুয্যেতে মাথা ফাটাফাটি হয়ে গেল ? কিন্তু আমি বলি ভৈরবভায়া বাবাজীর এ কাজটা ভাল হচ্ছে না । ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া আর ভস্মে ঘি ঢালা এক কথা । তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া আর ছেলেদের একখানা করে দিলেই নাম হ'ত। আমি বলি বাবাজী সেই যুক্তিই করুন । কি বল ধর্মদাসদা ? ধর্মদাস ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিল । গোবিন্দ মন্দ কথা বলেনি বাবাজী । ও ব্যাটাদের হাজার দিলেও নাম হবার জো নেই । নইলে আর ওদের ছোটলোক বলেচে কেন ? বুঝলে না বাবা রমেশ । এখন পর্যন্ত রমেশ নিঃশব্দে ছিল । এই বস্ত্র বিতরণের আলোচনায় সে একেবারে যেন মর্মাহত হইয়া পড়িল । ইহার সুযুক্তি কুযুক্তি সম্বন্ধে নহে এখন এইটাই তাহার সর্বাপেক্ষা অধিক বাজিল যে ইহারা যাহাদিগকে ছোটলোক বলিয়া ডাকে । তাহাদেরই সহস্র চক্ষুর সম্মুখে এইমাত্র যে এত বড় একটা লজ্জাকর কাণ্ড করিয়া বসিল । সেজন্য ইহাদের কাহারও মনে এতটুকু ক্ষোভ বা লজ্জার কণামাত্রও নাই । ভৈরব মুখপানে চাহিয়া আছে দেখিয়া রমেশ সংক্ষেপে কহিল আরও দু শ কাপড় ঠিক করে রাখুন । তা নইলে কি হয় ? ভৈরবভায়া চল আমিও যাই তুমি একা আর কত পারবে বল ? বলিয়া কাহারও সম্মতির অপেক্ষা না করিয়া গোবিন্দ উঠিয়া বস্ত্ররাশির নিকটে গিয়া বসিলেন । রমেশ বাটীর ভিতর যাইবার উপক্রম করিতেই ধর্মদাস তাহাকে একপাশে ডাকিয়া লইয়া চুপিচুপি অনেক কথা কহিলেন । রমেশ প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়া সম্মতিজ্ঞাপন করিয়া ভিতরে চলিয়া গেল । কাপড় গুছাইতে গুছাইতে গোবিন্দ গাঙ্গুলী আড়চোখে সব দেখিল । কৈ গো বাবাজী কোথায় গো ? বলিয়া একটি শীর্ণকায় মুণ্ডিতশ্মশ্রূ প্রাচীন ব্রাহ্মণ প্রবেশ করিল । ইহার সঙ্গেও গুটি তিনেক ছেলেমেয়ে। মেয়েটি সকলের বড় । তাহারই পরনে শুধু একখানি অতি জীর্ণ ডুরে কাপড় । বালক দুটি কোমরে এক একগাছি ঘুন্সি ব্যতীত একেবারে দিগম্বর । উপস্থিত সকলেই মুখ তুলিয়া চাহিল। গোবিন্দ অভ্যর্থনা করিল । এস দীনুদা বসো । বড় ভাগ্যি আমাদের যে আজ তোমার পায়ের ধুলো পড়ল । ছেলেটা একা সারা হয়ে যায় তা তোমরা ধর্মদাস গোবিন্দের প্রতি কটমট করিয়া চাহিল । সে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া কহিল তা তোমরা ত কেউ এদিক মাড়াবে না দাদা বলিয়া তাহার হাতে হুঁকাটা তুলিয়া দিল। দীনু ভটুচার্য আসন গ্রহণ করিয়া দগ্ধ হুঁকাটায় নিরর্থক গোটা দুই টান দিয়া বলিল আমি ত ছিলাম না ভায়া তোমার বৌঠাকরুনকে আনতে তার বাপের বাড়ি গিয়েছিলুম । বাবাজী কোথায় ? শুনচি নাকি ভারী আয়োজন হচ্চে ? পথে আসতে ও গাঁয়ের হাটে শুনে এলুম খাইয়ে দাইয়ে ছেলে বুড়োর হাতে ষোলখানা করে লুচি আর চার জোড়া করে সন্দেশ দেওয়া হবে । গোবিন্দ গলা খাটো করিয়া কহিল তা ছাড়া হয়ত একখানা করে কাপড়ও । এই যে রমেশ বাবাজী তাই দীনুদাকে বলছিলুম বাবাজী তোমাদের পাচজনের বাপ মায়ের আশীর্বাদে যোগাড় সোগাড় একরকম করা ত যাচ্ছে কিন্তু বেণী একেবারে উঠে পড়ে লেগেচে । এই আমার কাছেই দুবার লোক পাঠিয়েচে। তা আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলে রমেশের সঙ্গে আমার যেন নাড়ির টান রয়েচে কিন্তু এই যে দীনুদা ধর্মদাসদা এরাই কি বাবা তোমাকে ফেলতে পারবেন ? দীনুদা ত পথ থেকে শুনতে পেয়ে ছুটে আসচেন। ওরে ও ষষ্ঠিচরণ তামাক দে না রে । বাবা রমেশ একবার এদিকে এস দেখি একটা কথা বলে নিই । নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া গোবিন্দ ফিস্ফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল ভিতরে বুঝি ধর্মদাস গিন্নী এসেচে ? খবরদার খবরদার অমন কাজটি করো না বাবা । বিটলে বামুন যতই ফোসলাক ধর্মদাস গিন্নীর হাতে ভাড়ারের চাবি টাবি দিও না বাবা কিছুতে দিও না ঘি ময়দা তেল নুন অর্ধেক সরিয়ে ফেলবে । তোমার ভাবনা কি বাবা ? আমি গিয়ে তোমার মামীকে পাঠিয়ে দেব । সে এসে ভাড়ারের ভার নেবে তোমার একগাছি কুটো পর্যন্ত লোকসান হবে না । রমেশ ঘাড় নাড়িয়া যে আজ্ঞা বলিয়া মৌন হইয়া রহিল। তাহার বিস্ময়ের অবধি নাই । ধর্মদাস যে তাহার গৃহিণীকে ভাড়ারের ভার লইবার জন্য পাঠাইয়া দিবার কথা এত গোপনে কহিয়াছিল । গোবিন্দ ঠিক তাহাই আন্দাজ করিয়াছিল কিরূপে ? উলঙ্গ শিশু দুটা ছুটিয়া আসিয়া দীনুদার কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িল বাবা সন্দেশ খাব । দীনু একবার রমেশের প্রতি একবার গোবিন্দের প্রতি চাহিয়া কহিল সন্দেশ কোথায় পাব রে ?
কেন ওই যে হচ্চে বলিয়া তাহারা ওদিকের ময়রাদের দেখাইয়া দিল । আমরাও দাদামশাই বলিয়া নাকে কাদিতে কাদিতে আরও তিন চারটি ছেলেমেয়ে ছুটিয়া আসিয়া বৃদ্ধ ধর্মদাসকে ঘিরিয়া ধরিল । বেশ ত বেশ ত বলিয়া রমেশ ব্যস্ত হইয়া অগ্রসর হইয়া আসিল ও আচায্যিমশাই বিকেলবেলায় ছেলেরা সব বাড়ি থেকে বেরিয়েচে খেয়ে ত আসেনি ওহে ও কি নাম তোমার ? নিয়ে এস ত ওই থালাটা এদিকে । ময়রা সন্দেশের থালা লইয়া আসিবামাত্র ছেলেরা উপুড় হইয়া পড়িল । বাঁটিয়া দিবার অবকাশ দেয় না এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল । ছেলেদের খাওয়া দেখিতে দেখিতে দীননাথের শুষ্কদৃষ্টি সজল ও তীব্র হইয়া উঠিল ওরে ও খেঁদি খাচ্ছিস ত সন্দেশ হয়েচে কেমন বল দেখি ? বেশ বাবা বলিয়া খেদি চিবাইতে লাগিল । দীনু মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল হা তোদের আবার পছন্দ মিষ্টি হলেই হল । হা হে কারিগর এ কড়াটা কেমন নামালে কি বল গোবিন্দভায়া এখনও একটু রোদ আছে বলে মনে হচ্ছে না ? ময়রা কোন দিকে না চাহিয়াই তৎক্ষণাৎ কহিল আজ্ঞে আছে বৈ কি । এখনো ঢের বেলা আছে । এখনো সন্ধ্যে আহ্নিকের তবে কৈ দাও দেখি একটা গোবিন্দভায়াকে চেখে দেখুক কেমন কলকাতার কারিগর তোমরা । না না আমাকে আবার কেন ? তবে আধখানা আধখানার বেশী নয় । ওরে ষষ্ঠীচরণ একটু জল আন দিকি বাবা হাতটা ধুয়ে ফেলি রমেশ ডাকিয়া বলিয়া দিল । অমনি বাড়ির ভিতর থেকে গোটা চারেক থালাও নিয়ে আসিস ষষ্ঠীচরণ । প্রভুর আদেশ মত ভিতর হইতে গোটা তিনেক রেকাবি ও জলের গেলাস আসিল এবং দেখিতে দেখিতে এই বৃহৎ থালার অর্ধেক মিষ্টান্ন এই তিন প্রাচীন ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট সদ্ব্রাহ্মণের জলযোগে নিঃশেষিত হইয়া গেল। হাঁ কলকাতার কারিগর বটে । কি বল ধর্মদাসদা ? বলিয়া দীননাথ রুদ্ধনিশ্বাস ত্যাগ করিল । ধর্মদাসদার তখনও শেষ হয় নাই এবং যদিচ তাহার অব্যক্ত কণ্ঠস্বর সন্দেশের তাল ভেদ করিয়া সহজে মুখ দিয়া বাহির হইতে পারিল না । তথাপি বোঝা গেল এ বিষয়ে তাহার মতভেদ নাই । হা ওস্তাদি হাত বটে । বলিয়া গোবিন্দ সকলের শেষে হাত ধুইবার উপক্রম করিতেই ময়রা সবিনয়ে অনুরোধ করিল । যদি কষ্টই করলেন ঠাকুরমশাই তবে মিহিদানাটা একটু পরখ করে দিন । মিহিদানা ? কই আনো দেখি বাপু ? মিহিদানা আসিল এবং এতগুলি সন্দেশের পরে এই নূতন বস্তুটির সদ্ব্যবহার দেখিয়া রমেশ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল । দীননাথ মেয়ের প্রতি হস্ত প্রসারিত করিয়া কহিল ওরে ও খেঁদি ধর দিকি মা এই দুটো মিহিদানা । আমি আর খেতে পারব না বাবা । পারবি পারবি । এক ঢোক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নে দিকি মুখ মেরে গেছে বৈ ত নয় । না পারিস আঁচলে একটা গেরো দিয়ে রাখ কাল সকালে খাস হা বাপু খাওয়ালে বটে । যেন অমৃত । তা বেশ হয়েচে । মিষ্টি বুঝি দুরকম করলে বাবাজী । রমেশকে বলিতে হইল না । ময়রা সোৎসাহে কহিল আজ্ঞে না রসগোল্লা ক্ষীরমোহন ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৬
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×