এ লেখাটা একজন 'অপ্রকৃতিস্থ' মানুষের নিজস্ব চিন্তার চালচিত্র। কেউ এ লেখাটা পড়ে আনন্দ-দুঃখ-বেদনা-ভালবাসা-প্রেম-প্রীতি ইত্যাদি যাই-ই অনুভব করেন না কেন এজন্য এ লেখাটির লেখক ছাড়া অন্য সবাই দায়ী।
যারা পুরান ব্লগার, যারা নতুন ব্লগার, যারা ব্লগার হবেন কিংবা যারা ব্লগার হবেন না--তাদের সবাইকে এ লেখা পড়ার পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে। ইচ্ছে হলে পড়তে পারেন। ইচ্ছে না হলেও পড়তে পারেন।
এ ধরনের একটা লেখা অনেক আগে থেকেই লিখব বলে চিন্তা করছিলাম। কিন্তু কেন জানি হয়ে উঠছিল না। শেষ পর্যন্ত লিখেই ফেললাম।
ব্লগিং জিনিসটা কি- এটা খায় না পড়ে- নাকি মাথায় দেয়- এসব কিছুই আমি জানতাম না। আমার কাছে ব্লগ শব্দটা পরিচিত ছিল শুধুমাত্র প্রথম আলোর জন্য। তারা কোন একবার পেপারে প্রথম আলো ব্লগ বা এধরনের কিছু একটা লিখেছিল। তখনই আমি ব্লগ শব্দটার সাথে প্রথম বারের মতো পরিচিত হই।
আমি কি জন্য বা কিভাবে এ ব্লগে ঢুকে গেলাম সেটা নাই বলি। বলতে গেলে একটা ইতিহাস হয়ে যাবে। কোন একটা কারণ এ ব্লগের বিশিষ্ট কিছু ব্লগারের বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ে লেখা বিশেষ কিছু ফিচার আমি পড়তে বাধ্য হই। এরকম ব্লগারদের একজন রাগ ইমন। আরেকজন পি মুন্সী। আরো একজন হল দিনমজুর। তাদের লেখা বিশেষ করে রাগ ইমনের লেখা পড়ে আমি হঠাৎ করে ব্লগিং এর প্রতি উৎসাহিত হই।
যাই হোক, ব্যাপার সেটা না। অবশেষে অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমি সামুতে ব্লগার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই। আর তখনই শুরু হয় আশা ভঙ্গের বেদনা।
রাগ ইমন, দিনমজুর কিংবা পি মুন্সীর লেখাগুলো পড়ে আমার ধারণা ছিল নিশ্চয়ই ব্লগে সবাই এইরকম জ্ঞানী জ্ঞানী লেখা লিখে। ব্লগে একাউন্ট খোলার আগে আমি কয়েকজনের ব্লগে গল্প কবিতা ইত্যাদিও দেখেছি এবং আগ্রহের সাথে পড়েছি (এদের মধ্যে শায়মা, হাসান মাহবুব উল্লেখযোগ্য)। সামুতে যেদিন প্রথম ঢুকি বিশেষ লেখাগুলো পড়ার জন্য, সেদিন সামুর উপরের ছবিটা দেখে আবেগে আমার দুচোখে পানি চলে এসেছিল। কারণ এত সুন্দর করে প্রতিবাদী- ভাবমূর্তিমূলক ছবি যারা দিতে পারেন তারা কত যে অসাধারণ তার কি আর কোন দ্বিধা আছে? (পরে অবশ্য তাদের অসাধারণত্ব সম্পর্কে আমি চরম সব প্রমাণ পেয়েছি)!
কাজের কথায় আসা যাক। যেদিন একাউন্ট খোলার পর একজন 'সামু ব্লগার' হিসেবে আমি প্রথমবারের মতো লগ ইন করতে যাচ্ছিলাম সেদিন উত্তেজনা এবং সৃষ্টির আনন্দে (যদিও বুঝতে পারছিলাম না এখানে সৃষ্টির আনন্দটা কোথায়) আমার বুক দুরু দুরু করছিল। নিজের লগ ইন নেইম আর পাসওয়ার্ডটা (আমার পাসওয়ার্ড হল ******) টাইপ করে আমি গভীর আবেগে তাকিয়ে আছি আমার ল্যাপটপের স্ক্রীনের দিকে। মনের মাঝে তখন আনন্দের ঢেউ- আবেগের ঝড়- আত্মবিশ্বাসের জলোচ্ছ্বাস। ধীরে ধীরে সামুর হোম পেইজটা আসল। প্রথমেই আমার চোখ চলে গেল সেই প্রতিবাদী ছবিটার দিকে। যেখানে লেখা "বাঁধ ভাঙার আওয়াজ।" চোখটা জুড়িয়ে গেল আরেকবারের মতো। আনন্দে আত্মহারা আমি তখন।
সংকলিত ট্যাবের প্রথম লেখাটার দিকে তাকালাম। ওটার শিরোনামটা মোটামুটি এইরকম ছিল- "কিছু ১৮+ কৌতুক এবং অন্যান্য"।
আমি শিরোনামটা দুইবার পড়লাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তম্ভিত হয়ে থাকলাম। তারপর নিচের লেখাটার দিকে তাকালাম। ঐটার শিরোনাম ছিল- "আর কত বোকা হতে পারে আস্তিকেরা!"
এবার আরো একটু স্তম্ভিত হলাম।
পরের লেখাটার শিরোনাম- "একটা নতুন ডিজিটাল ক্যামেরা কিনব- একটু হেল্পান প্লিজ"।
এতে খুব বেশি অবাক হলাম না। ব্লগারেরা একে অপরের থেকে সাহায্য চাইতেই পারে।
কিন্তু পরের লেখাটার শিরোনাম- "ঐ ছাগু, পারলে আমারে বল"।
এবার আবারো স্তম্ভিত হওয়ার পালা।
পুরো পেজটা কয়েকবার দেখলাম। যতদূর মনে পড়ে সেখানে ৪-৫টা ১৮+, ২টা সাহায্য, ১টা ছাগু, ২-৩টা নাস্তিকতা- আস্তিকতা, ১টা প্রেম- ভালবাসা, ১টা ছবি- এরকম কিছু অদ্ভূত বিষয়ক ব্লগ ছিল। (কয়েকটা গল্প-কবিতা ছিল সম্ভবত তবে সেগুলোর মান সম্পর্কে আর নাই বা বললাম) আমি তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কোথায় আমার সেই জ্ঞানের লেখা? কোথায়?
যাই হোক, আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে এভাবেই আমার সামুতে পথ চলা শুরু। এখন পথ চলছি। তবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সম্ভবত পথ হারিয়ে বিলীন হয়ে যাব এক সময়।
আমার কিছু প্রশ্ন ব্লগারদের কাছে।
১। ব্লগ জিনিসটা কি একটি মাধ্যম না? (যা মোটামুটি পত্র পত্রিকার সমতুল্য)
২। সামুর ছবিটাতে লেখা "বাঁধ ভাঙার আওয়াজ"। ভুরি ভুরি ১৮+, নাস্তিক আস্তিক বিতর্ক, ছাগু কাগু আলাপন --এসব দিয়ে কোন ধরনের বাঁধ ভাঙা যায়?
২। সামুতে একাউন্ট খোলার সময় কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে বলা হয়েছিল। প্রশ্ন হল- ব্লগের কয়জন এসব নীতিমালা মানেন?
৩। সামু ব্লগ হল একটা আলাদা সমাজ। আলাদা কমিউনিটি। আমরা যার ব্লগার- তারা সবাই এই কমিউনিটির সদস্য। বলা যায় একটা পরিবারের মতো। কিন্তু আমার প্রশ্ন- ব্লগে এত 'কোক খাওয়া' ব্লগার কোত্থেকে আসল?
৪। সামুর অবশ্যই মডারেটর আছে। সব ব্লগেরই মডারেটর থাকে। আমার প্রশ্ন- সামুর মডুরা কি পরিমাণ মস্তিষ্ক নিজেদের করোটির ভেতর ধারণ করে জীবন যাপন করেন?
৫। সামুতে ডাঃ জাকির নায়েক এবং জেনুইন ডাঃ জাকির নায়েক নামে দুইজন ব্লগার আছে। যাদের কাজ হল মোটামুটি ইসলামকে পচানো। আমার প্রশ্ন- সামুর নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী এটা কতটুকু সমর্থনযোগ্য? কিংবা এ ধরনের নিক সামুতে এক্সেস পায় কিভাবে?
৬। দেশের সর্বত্র বিভিন্ন চিপা চাপায় অসংখ্য চটি বই পাওয়া যায়। যাতে ১৮+ জোকসের কোন অভাব নেই। সামুতে এসব দেওয়ার কি দরকার? আর দিলেও এত বেশি পরিমাণে সেগুলো কেন প্রকাশিত হতে দেওয়া হবে?
৭। সামুতে ব্লগিং শুরুর দুই সপ্তাহের মাথায় "কিছু সুন্দরী মাইয়াগো ফোটুক দেইখা যান" শিরোনামের একটি পোস্ট দেখি। আমার প্রশ্ন হল- যে ব্লগে ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে লেখালেখি হয় সে ব্লগে এ ধরনের পোস্ট আসে কিভাবে? (বলে রাখি, ঐ পোস্টটা যিনি দিয়েছিলেন তিনি ছবিগুলোতে নাম্বারিং করে দিয়েছিলেন যাতে সবাই নাম্বার লিখে জানাতে পারে কার 'কোনটাকে' বেশি সুন্দর লেগেছে)।
আরো কিছু প্রশ্ন ছিল। আর করলাম না। ভালো লাগছে না।
কিছু আশার কথা লিখি।
সামুতে আমার খুব খুব প্রিয় কিছু ব্লগার আছেন। যাদের লেখা কিংবা মতামতের সাথে আমি একমত এবং অনেক সময় দ্বিমত পোষণ করেছি। এরকম কয়েকজনের নাম লিখলাম।
* হাসান মাহবুব (তার গল্প আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে প্রতীকি লেখার মাধ্যমে অনেক বড় কিছু তুলে ধরা যায়। তার প্রতি আমি আমার ব্লগ জীবনে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব কারণ আমার ব্লগিং এর ক্ষেত্রে আমি তার দ্বারা সবচে বেশি উৎসাহিত হয়েছি)।
* রাগ ইমন (তিনি অসাধারণ। তার লেখার মধ্যে আমি সত্যিকার অর্থে ব্লগিং এর স্বাদ পেয়েছি। লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার নিয়ে লেখা তার চার পর্বের ধারাবাহিক আমাকে চরম মাত্রার মুগ্ধ করেছিল।
* দিনমজুর (তার মতামতের সাথে আমার মতামতের অনেক পার্থক্য। কিন্তু তাকে তারপরও আমার অনেক ভালো লাগে কারণ তিনি অনেক জানেন এবং অন্যকেও জানান)।
* পি মুন্সী (একই ব্যাপার তার ক্ষেত্রও)।
* শায়মা (আমি কবিতা টবিতাকে মোটামুটি অপছন্দ করি। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন তার কবিতাগুলো আমি পড়ে ফেলি)।
* আইরিন সুলতানা (তার লেখাও অসাধারণ। এবং ভিন্ন ধরনের।)
* ফারজান মাহবুব
* রাজসোহান
* নাফিস ইফতেখার
* আলিম আল রাজি
* মাহমুদহাসান
* নুশেরা (তার চিন্তা আর লেখনীর ধরন পুরোপুরি অন্যরকম।)
* পগলা জগাই
* লেখাজোকা শামীম
আরো কয়েকজনের নাম মনে আসছে না।
ছোট্ট ব্লগ জীবনে দুইজনের কাছ থেকে ব্লক খেয়ে বসে আছি। একজন একটা ছেলে। ছবি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল আমার ছোট। নামটা মনে নেই। সে একটা কবিতা লিখেছিল। কবিতাটাকে হৃদয় খানের লিরিক্স বলেছিলাম। এজন্য ব্লকড।
আরেকজন অদ্বিতীয়া সিমু নামের এক ব্লগার। দুর্গাপূজার ছবি নিয়ে তিনি একটা ছবি ব্লগ দিয়েছিলেন। ছবির কোয়ালিটি ভাল ছিল না। এজন্য মাইনাস দিয়েছিলাম। তাই ব্লকড।
নির্মল আনন্দ পেয়েছি md jakaria থেকে। এজন্য তাকে ধন্যবাদ। আরেকজন হলেন প্রিন্স (নাভানার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার)। তাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
যাই হোক। অনেক কথা বলে ফেললাম। ব্লগিং করছি। করব। যেদিন ইচ্ছে করবে না, চলে যাব। আবার ইচ্ছে করলে নতুন করে শুরু করব। আমার মনে হয়, সামু ব্লগে ঘুণ ধরছে। ঘুণের পরিমাণ হয়তো কম। কিন্তু এটা ভয়ানক। কারণ ঘুণ ধরে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য। একে নির্মূল করা প্রয়োজন।
যারা লেখাটা পড়ে ফেললেন তাদের ধন্যবাদ। যার পড়লেন না তাদেরও ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৩৯