somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের টুকরো গল্প : ৩ একটি কুকুরের মরন পণ অভিমান

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি কুকুরের মরনপণ অভিমান ও আমার পরাজয়ের কথা-
(সত্য ঘটনা)

১৯৯২ এর কথা আমি তখন থাকি আবুধাবীর 'লিওয়া' নামক এলাকার "হাওয়াইতিন" নামক স্থানে। আমার রুমমেট জাফর ভাই-বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া থানার আমজর হাট গ্রামে। তার চাচাত ভাই এর পুত্র আক্তার হোসেনকে আমি কোন এক প্রসঙ্গে ঠাট্টাচ্ছলে শশুর বলে ডাকি। তিনিও আমাকে জামাই বলে ডাকেন। তিনি থাকেন আমাদের থেকে আরো ৬৫ কি:মি: দূরে। হামীম নামক স্থানে। দুরত্বের ব্যবধান ওখানে কোন বিষয় নয়। তিনি নিজে একটা টয়োটা ল্যান্ড ক্রোজার চালান। মাঝে মাঝেই আসেন গল্প করেন-আবার চলে যান।

আরব দেশে যারা বাইরে কাজ করতে হয় তাদের একটা অলিখিত আইন হলো : সকাল ৬টা থেকে ডিউটি শুরু করে দুপুর ১২ টায় ছুটি। দুই/তিন ঘন্টা বিশ্রাম- আবার সন্ধা পর্যন্ত কাজ। যাক- একদিন দুপুর ১টার দিকে আমি ডিউটি হতে ফেরত এসে দেখলাম আমাদের ঘরের সামনে আমার তথাকথিত শশুরের গাড়ি। আর গাড়ির পেছনের খোলা স্থানে শেকল দিয়ে বাঁধা এক কুকুর। উনারা দুইজন চাচা ভাতিজা ভেতরে আলোচনায় ব্যাস্ত। আমি আমাদের বাগানের সীমানায় আসতেই কুকুরটির সেকি বিকট চিৎকার- ভয়ে গা শিউরে উঠে।
যেহেতু কুকুরটি শেকল দিয়ে বাঁধা ভয়ে ভয়ে আমি কোন রকমে ঘরে ঢুকে শশুর মিয়াকে (?) প্রশ্ন করি - কি ব্যপার ? শশুর মিয়া নতুন উৎপাতের আমদানী? আরব দেশে তো কখনও এরূপ কুকুর দেখি নাই? এটা কোথায় পেলেন? আর এখানেই বা কেন?
আমার অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরে উনি যা জবাব দিলেন তার সারমর্ম হলো: উনি উনার মালিককে বলে কয়ে উনার বুড়ো বাবাকে ভিসা দিয়ে এদেশে এনেছিলেন। উদ্যেশ্য হলো নিজের টাকা কামাই করে হজ্ব করে দেশে চলে যাবেন। মালিক তাকে কোন শক্ত কাজে না দিয়ে বাগানে পানি দেওয়া ও এই কুকুরটির দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়। ইতিমধ্যে এই মাদী কুকুরটিকে শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহ্ইয়ানের কুকুর দ্বারা প্রজনন ঘটানোয় কয়েকটা বাচ্চা প্রসব করে। বাদশার কুকুরের বীজ হতে আগত বাচ্চা পেয়ে তিনি তো মহা খুশী.... অতএব এই জঞ্জালটা (?) ফেলে দাও। আর এই ফেলে দেওয়ার উদ্যেশ্যে এই যাত্রা।
অবশেষে তিনি আমাকে বললেন: জামাই... কুকুরটা ভাল এবং ভদ্র, এটা রেখে দাও।
আমি বিরক্তি সহকারে বল্লাম : ফালতু ঝামেলায় আমি নেই।

অনেক পীড়াপীড়িতে জাফর ভাই রাজী আর আমি নিমরাজী- এ অবস্থায় গোসল করতে গিয়ে পানির পাইপ দিয়ে গর্ত করে কাঠের খুঁটি গেড়ে সাথে সাখেই খেজুর পাতার ঘর নির্মান করা হলো। আমরা খাবার খেলাম। আমাদের উচ্ছিষ্ট খাবার কুকুরটিকেও দিলাম। শুশুর মিয়া চলে গেলেন। কুকুরটি আমাদের বাগানের গেটের পাশে আশ্রিত।

বেশ কয়েক মাস সে আমাদের কাছে ছিল এর মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য স্বভাবগুলো ছিল এর রকম:
1. আমরা খাবার দিলেও সে আমাদের সামনে খাবে না। আমাদের প্রস্থানের পর সে আস্তে আস্তে খাবে। আমরা দরজা সামান্য ফাঁক করে তার কান্ড দেখি।
2. তার থেকে দুরে থেকেও যদি আমরা একে অন্যের সাথে জোড়ে কথা বলি-? আর রক্ষা নেই... সে বিকট চিৎকারে শেকল ছিড়ে ফেলতে চাইবে।
3. আমরা একজন আর একজনের হাতে ধরলেও একই কান্ড- বিকট চিৎকার... ।
4. অবশেষে কিছুদিন পর তার ক্ষমতা আরো বাড়ল: আমরা সন্ধায় অন্য কোন বাঙ্গালী ভাই/বন্ধুর কাছে গেলে ফিরে এসে দেখি সে নেই। সকাল হলে ঠিকই সে তার জায়গায় উপস্থিত। গবেষনা করে আবিস্কার করলাম- গলা থেকে ফিতা আলাদা করার জন্য সে উল্টা ভাবে হেঁচকা টান দেয় এবং চলে যায়।
5. এইরূপ আরো অনেক কাহিনী... যা একটি কুকুর তার ভালবাসা প্রকাশে করে থাকে।

আসল কথায় আসি...
একদিন জাফর ভাই আর আমি সন্ধায় গেলাম অপর এক বাঙ্গালী ভাই এর বাগানে। প্রায় ১ কি: মি: দূরে। রাত ১২ টার পরে আসার সময় দেখি সেও আমাদের সাথে। নিতান্তই স্বাভাবিক বিষয়।
আসল ঘটনা হলো: পরদিন সকাল বেলায় আমাদের গত রাত্রে ভ্রমনকৃত বাঙ্গালী ভাইয়ের মালিক (আরবী) গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। জাফর ভাইকে ডেকে বলে: তোমার কুকুর আমার মুরগী মেরে ফেলেছে- সুতরাং আমি তোমাদের বিরোদ্ধে শুরতা (পুলিশ) ডাকব।
আমি ডিউটি থেকে এসে দেখি জাফর ভাইর মন খারাপ: বিবরন জেনে বল্লাম ওটাকে আর রাখা যায়না। সিদ্ধান্ত হলো ফেলে দিব।
বিকাল বেলা আমরা দুজনের অনেক কসরতের পর ওকে গাড়ীতে উঠালাম। যাবার সময় সেকি করুন চাহনী! মনে হলে আজও কষ্ট হয়।
জাফর ভাই নিজে গাড়ী চালিয়ে ১৫ কি:মি: দূরে মুজিরা বাজারে ফেলে আসে।
সন্ধায় আমরা কুকুরকে গাড়ী থেকে নামানোর বিষয় এবং তার আমাদের সহচর্যের সময়ের পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করে কাঁদি।
মরুভুমির জীবন জীবিকার তাগিদ, আর সময়ের ব্যবধানে আমাদের কুকুর বিষয়ক আবেগ ধামাচাপা পড়ে। আমরা তাকে ভুলে যাই।

একমাস পর আমাদের বাগানে খাবার পানি দিতে আসে এক মাড়োয়ারী ড্রাইভার (ইন্ডিয়ার কেরালার অধিবাসীদের মাড়োয়ারী বলা হয়)। তার ট্রান্কার হতে আমাদের ট্রান্কিতে পাইপ লাগিয়ে অলস মহর্তে হঠাত সে আমাদের ঐ কুকুরের ঘরটি দেখিয়ে প্রশ্ন করে: এই ঘরটি কিসের? আমরা কুকুরের কাহিনী বর্ননা করি। সে হঠাত উত্তেজিত হওয়ার মত হয়ে জিজ্ঞাস করে: ওটাকে কোথায় ফেলেছ?
জাফর ভাই উত্তর দেয়: মুজিরা..... ঐ দোকানটির পাশে।
সে- (ড্রাইভার) আবারো প্রশ্ন করে ওটার রং কি? কতদিন আগে ফেলেছ? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন....। ... আমরা একে এক জবাব দেই।
অত:পর সে করুন ভাষায় আমাদের যা জানায় তা নিম্নরূপ:
জাফর ভাই ওকে ফেলে দেওয়ার পর সে সেই জায়গাতেই মাটিতে অল্প একটু গর্ত করে এবং নত মুখে বসে যায়। এভাবে সে করুন মুখে তাকিয়ে থাকে পথের পানে। কেউ কোন খাবার দিলেও সে খায়না। অনুসন্ধিৎসু লোকেরা তাকে খাওয়াতে চেষ্টা করে বিফল। তার পাশে খাবারের স্তুপ। এভাবেই কাটে প্রায় ২৮/৩০ দিন। অবশেষে একদিন সকাল বেলায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা তাকে মাটিচাপা দেয়।

মাড়োয়ারী ড্রাইভারের বিবরন শুনে আমরা নিশ্চিত হই সেই আমাদের ফেলে দেওয়া কুকুর।
আমি নীরবে তার কথা শুনি, আমাদের খাবার পানির ট্রান্কি পুর্ন হলেও মনের অজান্তে চোখ থেকে পানি চলে আসে। বুকে অনেক কষ্ট অনুভব করি। এখনও যখন নীরবে ভাবি...। মনে মনে বলি: সৃষ্টির এক নিকৃষ্ট প্রানী... সে তার মরনপন অভিমান ভরা কাহিনী রেখে গিয়ে আমাদের উপর প্রতিশোধ নিয়েছে।

আমরা দুজন যতদিন বেঁচে থাকব- আমাদের প্রতি তার অভিমান করে না খেয়ে মরনের কষ্টকেই মনে করে আজীবন কষ্ট পাব।

আমরা যেন তার অভিমানের কাছে এই জীবনের জন্য পরাজিতই হলাম।

(সত্য ঘটনা)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:২০
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×