somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ১লা রমজান বড়াল নদীর আড়ানি রেল ব্রীজ অপারেশনের স্মৃতি কথা

৩১ শে জুলাই, ২০১০ দুপুর ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ১লা রমজান বড়াল নদীর আড়ানি রেল ব্রীজ অপারেশনের স্মৃতি কথা

পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে সরাসরি মুখোমুখি যুদ্ধ। ১লা রমজান, ১৯৭১ শুক্রবার আড়ানি বড়াল রেল ব্রীজ অপারেশন। ছাত্র ও বিডিআর (সেকালের ইপিআর) সব মিলিয়ে ত্রিশ জনের একটি চৌকষ মুক্তিযোদ্ধা দল ভারতের কাজিপাড়া মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প থেকে রাতেই রওনা দিয়ে বর্ষা মৌসুমের তরঙ্গায়িত উন্মত্ত পদ্মা নদী নৌকায় পাড়ি দিয়ে পৌঁছি সোনার বাংলার কোমল মাটির বুকে। রাতেই সম্পূর্ণ বিশ্বস্ততার উপর নির্ভর করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেই।

নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার পর পরই রাতেই রেকি (অনুসন্ধান) কাজ সুসম্পন্ন করি। রেকি কাজে নিয়োজিত ছিল মুক্তিসেনা থানা পাড়াস্থ শফিক (বর্তমানে মৃত ইন্না....)। অর্থাৎ পুরোপুরি অনুসন্ধানের কাজটি তন্ন তন্ন করে সুসম্পন্ন করে নেই রাতেই। এভাবে শত্রূর অবস্থানের খুঁটিনাটি বিষয় অবগত হই। রেল ব্রীজে শত্রূদের প্রতিষ্ঠিত ক্যাম্পে ২৩ জন সৈন এবং ওদের সাথে ৬০ উর্দ্ধ রাজাকার অবস্থান করতো। সব কিছু বিস্তারিত জেনে পরের দিনই সূর্যালোকে অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং দিনে এ্যাকশনে যাওয়াটাই উত্তম হবে বলে সকলে মনে করি। এ সিদ্ধান্ত সকল সাথি মুক্তিযোদ্ধা ভাইদেরকে অবগত করাই।

পাঠকবৃন্দ বুঝতেই পারছেন যে, সে সময়ে যখন আমাদের বয়স ২৩ বা ২৪ এবং কারো কারো ২৯-৩০ বৎসর তখন কার রক্তরাঙা যৌবন রশ্মিতে দেশ স্বাধীন করার প্রবল তৃষ্ণা বা তীক্ষ্ণ নেশার চরম ও পরম খোরাক পরের দিনই রণাঙ্গনে সূর্যালোকে শত্রূসেনার সাথে সামনা সামনি যুদ্ধে লড়বো। শত্রূকে সমূলে নিঃশ্বেষ করে বড়াল নদীর রেল ব্রীজ অপারেশনে সফলতা আনতে হবে। অর্থাৎ রেল ব্রীজের গার্ডার কেটে ব্রীজকে ক্ষণকালের জন্য অকেজ করতে হবে। এভাবে কয়েকটি জেলায় শত্রূদের যাওয়া আসার পথ বন্ধ করাই ছিল এ অপারেশনের মূল লক্ষ্য।

সত্য কথা বলতে কি, ঐ সময়ে যেন সম্মুখ সমরের জন্য মনে-প্রাণে খুশীর তুফাণ বা বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। কখনও কখনও আমার স্ত্রী আলেয়ার মুখের হাসিমাখা স্মৃতি বিজড়িত হৃদয় কাড়া সুন্দর নয়ন ও এরই সাথেই আড়াই বছরের প্রথমা কন্যা লাকীর নিষ্পাপ সুমধুর মুখ, অবুঝ মন ও চোখের চাহুনি হৃদয়ে বরং যুদ্ধের দোলা আরো প্রাণবন্তভাবে জাগিয়ে দিচ্ছিল।

যাক সে সব কথা, রাত পোহালে সুর্য উদিত হলে দিনের বেলায় বড়াল নদীর রেল ব্রীজ অপারেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ১০:০০ ঘটিকায় রণাঙ্গনে রওনা দিয়ে পৌঁছি বেলা ১২:৪৫ মিনিটে। তৎক্ষনাতই শত্রূকে তীক্ষ্ণভাবে তাক করে ফায়ার ওপেন করি। শত্রূরাও ফায়ারের যথাযথ জবাব দেয়। ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হয়। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আমাদের অতর্কিত আক্রমণে শত্রূরা এক ভ্যাবাচ্যাকার রাজ্যে নিপতিত হয়। শত্রূরা দিকপিস না পেয়ে অনেকটাই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তারা বিচলিত হয়ে উঠে। সে কারনে মুক্তিযুদ্ধ জীবনে ১লা রমজান, ১৯৭১ ছিল শত্রূপক্ষের জন্য এক রক্তঝরা করুণ অধ্যায়। আমরাও অগ্নিশিখা রুপে উদ্বীপ্ত হয়ে ধীর-স্থির চিত্তে ক্ষিপ্রতা নিয়ে যুদ্ধে এগিয়েছিলাম। শত্রূকে পরাজিত করাই ছিল ক্ষ্যাপা যৌবনের যেন মহা অহংকার।

এমতবস্থায়, এক পর্যায়ে যখন শত্রূর অতি কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছিলাম, তখন একজন হানাদার উর্দূতে জিজ্ঞেস করে, “তোম কোন হ্যায়”। উত্তর দেই, তেরে বাপ মুক্তিফৌজ। অস্ত্রের গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে শত্রূকে আরো জানাই, জীবন আমাদের থাকতেরে তুই পাবিনা নিস্তার। চিহ্ন তোদের রাখবো না এ ভূবনে এবার। মনের গহীন গগনে আরো গুঞ্জরণ তুলেছিল, প্রতিক্ষাতে ছিলেম তোদের, রক্ষা পাবিনা অস্ত্র হাতে থাকতে মুক্তিযোদ্ধাদের। বীর বাঙালির হাতে তুই পড়েছিস এবার। সম্মুখ যুদ্ধ কারে বলে, তোরা দেখ এবার। ইতোমধ্যেই শত্রূপক্ষের অনেকেই চিরতরে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছে।

আমাদের হাতে অস্ত্র ছিল - এলএমজি, এসএমজি, এসএলআর, হ্যান্ড গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ। যুদ্ধ শুরু থেকে মুহুর মুহুর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো সদর্পে গর্জে উঠছিলো। প্রকৃত কথা বলতে কি, এ সম্মুখ সমরে মৃত্যুকে হাতে নিয়েই প্রাণপণ লড়াই করতে হয়। কারণ শত্রূর আক্রমণও ছিল প্রচন্ড। যুদ্ধের সময় মনে হয়েছে মানুষের মৃত্যুতো একবারই হয়। মৃত্যু হলে বীরের মতই হবে। মৃত্যু যদি হয়ই, শহীদ আত্মার মর্যাদার অমর মৃত্যুইতো হবে। এছাড়া রণাঙ্গনে রণে জয়ের প্রবল তৃষ্ণা মনে কাজ করছিল তীব্রতর রুপে।

আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এ যুদ্ধে দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে প্রবল আক্রমণ শুরু করি। পশ্চিম দিকে ছিল বড়াল নদী। রেল ব্রীজের অবস্থান আমাদের থেকে পশ্চিম দিকে ছিল। শত্রূপক্ষ দু’টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাজাকাররা ছিল বড়াল রেল ব্রীজের পশ্চিম প্রান্তে। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ হচ্ছিল নদীর পূর্ব প্রান্তে। পূর্ব প্রান্তেই ছিল পশ্চিমাদের অবস্থান। এদের স্থায়ী ক্যাম্পও ছিল ব্রীজের পূর্ব প্রান্তেই। সত্যি কথা বলতে কি, শত্রূকে তীব্র বেগে আঘাত হানতে আমাদেরকে যথারীতি বেগ পেতে হয়।

যুদ্ধ শুরুর অনতি পরেই এক মুহূর্তে দেখি জনাব আমজাদ (তদানিন্তন ইপিআর) বিডিআর দাঁড়িয়ে “ইয়া আলী এবং আল্লাহু আকবার” রবে গর্জে ওঠে হাঁটতে হাঁটতে এলএমজির গুলি বর্ষণ করতে করতে সামনে এগুচ্ছে। চিৎকার দিয়ে বলেন, শাফী ভাই, দ্রূত এগিয়ে আসুন। পাশে আমিও আমার ছাত্র গ্রুপের আমার অনতি নিচে দ্বিতীয় দলপতি - অন্যান্য সঙ্গীরা এসএমজি-এসএলআর ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে করতে সামনে ধাবমান হই। শত্রূদেরকে আমরা দুই দিক থেকে একেবারে কর্ণার করে ফেলি এবং সত্যি কথা বলতে কি, এক্কেবারে অক্টোপাশের ন্যায় আষ্টেপিষ্টে একরুপ ওদেরকে বেঁধে ফেলি বা বলা যায় ফাঁদে পুরি। ফলে ওরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং রণক্ষেত্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারায়।

যুদ্ধ চলাকালে অস্ত্রের জবাবে শত্রূকে জানাই যে, নিপীড়ন ও চরম উৎপীড়নে তোরা জ্বালিয়েছিস এবং জ্বালাচ্ছিস আমাদেরকে। এবার জানবি ভালমত - বিপদে-আপদে মহান আল্লাহ্ আমাদের সহায় আছেন। আরো বলি, তোদের নেই উপায়। গোলাবারুদের গর্জনের উত্তর যখন দিয়েছিস এবার ঠেলা সামাল দিবি তখন। মৃত্যু পথের যাত্রী মুক্তিযোদ্ধা আমরা। বিশ্ববাসী জানুক তোদের হিংস্রতা-পশুত্বতা। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সুনিশ্চিত জয় করবই। পেয়েছি তোদেরকে এবার সুযোগ মত। জাতির মান রাখবো সমুন্নত। দেশ স্বাধীন করবো এটাই নিয়েছি অগ্নিশিখা রুপে ব্রত। এ মুহূর্তে পালাবার উদ্দেশ্যে যে ব্যাক্তি ট্রেন্স থেকে উঠে পালাতে উদ্যত হয় তখনই আমাদরে গুলিতে সে নিহত হয়। শত্রূ পক্ষের গুলির শব্দ থেমে যায় এবং অটল স্তব্ধতা নেমে আসে। শেষ অবধি ওরা যখন একে একে সকলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, তখন আমরা নির্বিগ্নে বড়াল নদীর রেল ব্রীজ গার্ডারে এক্সপ্লোসিভ (ডিনামাইড) ফিট করি এবং ঠিক বেলা ২:৩০ মিনিটে বিকট শব্দে গার্ডার কেটে পড়ে।

এ মুহূর্তে যতটুকু মনে পড়ে সঙ্গে ছিলেন ছাত্রদের মধ্যে আমার চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলী হোসেন, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর (মৃত ইন্না..।) দলের দ্বিতীয় ম্যান (দ্বিতীয় দলপতি) সে বন্ধু। সে মারা যায় বছর তিনেক আগে। আরো যাঁরা ছিলেন-মোহাম্মদ আজিজুল হক, মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এবং মোহাম্মদ ফজলুল হক (মোহাম্মদ আজিজুল হক, মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এবং মোহাম্মদ ফজলুল হক) এই তিন জন আপন ভাই। এছাড়া আরো যাঁরা ছিলেন তাঁরা - মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, মোহম্মদ ইইয়ূব, মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম, মোহাম্মদ রুস্তম আলী, মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, রবি, হোসেন মন্ডল (মৃত ইন্না..। ) আরো অনেকে।


সফল অপারেশন। হিট এন্ড রান থিওরিতে যোদ্ধাদের বলি আর বিলম্ব নয়, এবার দৌড় সকলে দৌড়। গন্তব্য স্থানে চলো। নিরাপদে ফিরে যেতে সমর্থ হই ক্যাম্পে। এ সময়ে যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মনের মধ্যে আকাশের সমস্ত আলো যেন ঠিকরে পড়েছিল । মহান আল্লাহ্তা’য়ালার কাছে জানাই কোটি কোটি শুকরানা যে আমাদের সাথের সোনার টুকরা মুক্তিযোদ্ধা এ ভয়াবহ যুদ্ধে আহত বা নিহত হয় নাই ।




৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×