somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জেগে ওঠো মানিব্যাগ

২৫ শে অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৯:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আব্বুর কাছে আব্দারটা কি দুরাগ্রহের মত শোনাবে ? চিন্তাটা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে , কিন্তু চিরাচরিত স্বভাব বদলে শখের কথাটা আব্বুকে বলা হল না । বলা হলো না আমার মানিব্যাগের শখের কথা , যেটা পেলে আমার জীবনের রংটাই বদলে যেত ।

বয়সটা তখন বড়জোর ৭ । মানিব্যাগের শখ মাথাচাড়া দিলেও , মানিব্যাগ ভরার মত মাল-মসল্লার যথেষ্ট অভাব ছিল। আব্বু নিজে থেকে মাঝে মাঝে যে টাকা দিত , মানিব্যাগে ঢুকার অবকাশ পাবার আগেই চুইংগাম বা ললিপপের ফরমায়েশ দিতে গিয়ে, সে টাকার জীবনাবসান হয়ে যাবার কথা হলফ করে বলতে পারি । তাই বলে টাকার শ্রাদ্ধ কখনো করিনি , নিজে থেকে টাকা চাওয়ার সেই ইতস্তত ভাবটাও পরবর্তীতে আর কখনোই কাটেনি ।


মাঝে অনেকগুলো দিন গড়িয়ে গেছে , বুকে চেপে থাকা মানিব্যাগ শখের শেলটা তখনও বোল হয়ে ফোটেনি । ৯৫ সালের কোন একদিন আমার চাচা সিংগাপুর থেকে ফিরলেন । অন্যের লাগেজ তন্ন তন্ন করে দেখার আগ্রহ পাইনি কখনো , কিন্তু লাগেজের ফাঁক গলে মানিব্যাগটা যখন মেঝেতে পড়ে গেল , চোখ আমার না এড়িয়ে পারলো না।

এমন আহামরি কিছু না , রেক্সিনের তৈরি সাধাসিধে একটা মানিব্যাগ । কিন্তু প্রেমিকের চোখে সাধারণ অসাধারণ হয়ে ধরা দেয় , এক দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেলাম ।১২ বছরের মুখচোরা স্বভাবটা মিনিট খানেকের জন্য সমাহিত করলাম ,ভালো লাগার কথাটা গোলায় ভরে মুখের ট্রিগার চাপলাম । মিসফায়ারটা আমায় যেন দু'হাত ভরে দিলো
হাসিমুখে চাচা মানিব্যাগটা আমায় দিয়ে দিলেন ।


মানিব্যাগ পেলেও মানিব্যাগ আবাদ করার মত পর্যাপ্ত নোট আর কয়েন আমার ছিলনা । তারপরও আড়ালে আবডালে মানিব্যাগ ব্যবহারের কসরত চলছিল পুরোদমে।আমার দৈনিক মজুরি তখন ২০ টাকা , রামপুরা টু মতিঝিল স্কুলে যাওয়া আসায় যার একটি টাকাও অবশিষ্ট থাকে না । ভোরবেলায় ২০ টাকায় বুনে দেয়া মানিব্যাগ , সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়ার আগেই শুন্যতায় খাঁ খাঁ করত।

একে তো শূন্য মানিব্যাগের হাহাকার , তার উপর এই বয়সে মানিব্যাগ ব্যবহার পাকনামো কিনা , এমন সাত পাঁচ ভেবে মানিব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করে দিলাম । সেই থেকে বছর খানেক মানিব্যাগের অস্থায়ী আবাস হলো আমার বুকশেলফের উপরের তাকে ।


বছরখানেক পরের ঘটনা , একদিন সন্ধ্যায় টেবিলে খুব সুন্দর একটা ভিজিটিং কার্ডের দেখা পেলাম । শখ জন্ম হতে কতক্ষণ , আমারও শখ হল ভিজিটিং কার্ডের । সে রাতেই উপায়ও বের করে ফেললাম ।

মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের দেয়া ওষুধের গুণাগুণ সম্বলিত প্রসপেক্টাসের শক্ত কাগজ থেকে ব্লেড দিয়ে মাপমত কেটে নিলাম ।ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার সুযোগ সময় খুব বেশি মিলতো না।আগের বছর বৃত্তি পরীক্ষায় ভালো করায় কোথায় যেন আমার নামসহ ছবি ছাপা হয়েছিল ।দুই কপির মাঝে একটি সংগোপনে সরিয়ে নিয়ে , সাবধানে আমার ছবি আর নাম কেটে নিলাম । ছোট কার্ডের উপর গাম দিয়ে সেটা সেঁটে নিলাম । তারপর মানিব্যাগের ট্রান্সপারেন্ট চেম্বারে সেটা ঢুকিয়ে রাখলাম । সেই আমার প্রথম ছাপার
হরফে লেখা ভিজিটিং কার্ড , দুর্লভ পেনি ব্ল্যাক স্ট্যাম্পের মতই যার একটা মাত্র কপিই ধরাধামে ছিল।


৯৭ সালে চিটাগাং বেড়াতে যাবার প্রাক্কালে অবশেষে মানিব্যাগটা কাজে আসলো । দু'মাস ধরে রিক্সা ভাড়া থেকে প্রতিদিন ২/১ টাকা জমিয়ে মানিব্যাগে রাখতাম । একসময় ৭২ টাকার বিরাট সম্বলসহ মানিব্যাগটা আমার সাইড পকেটে করে চিটাগাংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো । ঢাকায় পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে সবসময় মন খুঁতখুঁত করত , সেটা কাটলো চিটাগাং গিয়ে । আমার ছোটভাই আর তার সমবয়সী কাজিনকে,আগ্রাবাদে খালার বাসার পেছনের হোটেলে পরোটা স্পন্সর শেষে বীরদর্পে মানিব্যাগ খুলে বিল শোধ করলাম ।এসএসসির আগে পর্যন্ত আর্থিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি বিধায় "চিটাগাং মিশন" এর পর মানিব্যাগটা আবার শেলফ নির্বাসনে ফিরে গেল ।


তারও ৩/৪ বছর পরের কথা ,আমি তখন কলেজ স্টুডেন্ট । শেলফে যত্নে রাখা মানিব্যাগটা তখনও ঝকঝকে রয়ে গেছে ।কলেজজীবনে নরমাল কাপড়ের প্যান্ট পড়তে শুরু করলাম , মানিব্যাগ ঢুকালে কেমন যেন টিউমার টিউমার একটা ভাব চলে আসে , এই অজুহাতে মানিব্যাগটা শেলফ থেকে নেমেও আবার স্বস্থানে ফিরে গেল ।


ভার্সিটিতে উঠার পর আবার পুরোদমে জিন্সের প্যান্ট পড়া শুরু করলাম । জিন্সের প্যান্টের পকেটে হাঁসফাঁস করা মানিব্যাগের চাপে আমার নিজেরই ভীষণ অস্বস্তি লাগতো । মানিব্যাগ ব্যবহার করা এক সময় বাদ দিলাম ।

আমার টাকা রাখার কায়দাটা সে সময় থেকেই বেশ অদ্ভূত । মানিব্যাগ ব্যবহার করি না বলেই হয়তো , কখনও আমার কাছে থাকা টাকার সঠিক পরিমাণ বলার সাধ্য আমার নেই , কেউ জানতে চাইলে কাছাকাছি একটা ধারণা দিতে পারি ।
জিন্সের প্যান্টের আঁটসাঁট পকেট থেকে টাকা বের করতে আমাকে বেশ কসরত করতে হয় । যখন বেশি টাকা দরকার হয় , মাইকেল মধুসুদনীয় কায়দায় পকেটে খাবলা দিয়ে এক মুঠো টাকা বের করি , দশ-পঞ্চাশ-একশ টাকার নোটগুলো দলা পাকিয়ে একসাথে বের হয়ে আসে । অল্প টাকা দরকার হলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে স্পর্শানুভূতি কাজে লাগিয়ে টাকা সনাক্ত করার চেষ্টা করি । এমন করতে গিয়ে মলিন পাতলা অনেক দু'টাকার নোট বেঘোরে প্রাণ হারায় , কখনো বা দু'টাকা বের করতে গিয়ে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ১০০ টাকার নোট অনাহুত হয়ে হাতের সাথে সেঁটে গিয়ে বের হয়ে পড়ে ।১০০ টাকার নোটটা যখন হাতের তালুতে লেগে বের হয় , তখন সেটা হয় বিব্রতকর , আর হাতের উল্টো পিঠে লেগে বের হলে সেটা হয় বিপর্যয় । আম্মুর বারংবার মনে করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও টাকা হারিয়ে ফেলার বিপর্যয় এড়াতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ।


চাকরিতে ঢুকার অফিস থেকে আমাকে কয়েকটি বক্স ভরে ভিজিটিং কার্ড দেয়া হল , কিন্তু মানিব্যাগ সাথে থাকে না বলে সে কার্ডের আর হাত বদল হয় না ।৭ মাস পর চাকরিটা ছেড়ে দিই , আমার দু'শতাধিক বিজনেস কার্ড আকস্মিকভাবে পিতৃহারা হয়ে পড়ে ।চাকরি করে পকেটে কিঞ্চিত মুদ্রাস্ফীতিও অনুভব করি । পকেট মাঝের টাকার দলায় ১০/৫০ টাকার সাথে ইদানিং ৫০০ টাকাও এসে যোগ দেয় । হাতে খানিক বড় আর আর পায়ে একধরণের মচমচে অনুভূতি, ৫০০ টাকা সনাক্ত করার প্রয়োজনে নিজেই সূত্র বানিয়ে নিই ।


ট্র্যাফিক জ্যাম এড়াতে অফিস শেষে ইদানিং বাসায় খানিক দেরী করে ফিরি । পরশুদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি । ৮:৩০ এ অফিস থেকে বের হওয়ার পর গুলশান-১ এ এক দেখা এক বন্ধুর সাথে ,দু'মাস আগেও এরিকসনে যার সাথে একসাথে কাজ করে এসেছি । পায়ে মচমচে অনুভূতির জোরে তাকে একরকম জোর করেই রেস্টুরেন্টে টেনে নিয়ে যাই । খাওয়া দাওয়া শেষে বিলটা বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠে । পকেটে হাত দিতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে ,৫০০ মচমচে অনুভূতির বদলে বিশাল শূন্যতায় ০০০০ অনুভূতি হয়। দরদর করে ঘামি ,বন্ধুর ফেরার তাড়া বলে ,তাড়াহুড়া করে তোতলামো মেশানো ফর্মালিটি করে বন্ধুকে একরকম জোর করেই বিদায় করি ।

সময় কম ,গুলশানের অফিসপাড়া খালি হয়ে গেছে । কুইক ব্রেনস্টর্মিং করি ।খালি হাতে অফিসে এসেছি,ডেবিট কার্ড ব্যাগে।অফিস থেকে বের হয়ে আসার সময় আমার বন্ধুকে একা দেখে এসেছি । রাত ৯ টায় তাকে পাবো না জেনেও ফোন দিই , ফোন যায় না । ব্যালেন্স চেক করে ২ পয়সার সন্ধান মেলে । হুড়োহুড়ি করে ফ্লেক্সিলোডের খোঁজ করি , দোকানের লোকেরা জানায় আশপাশে ফ্লেক্সিলোড করার কোন সুযোগ নেই ।ল্যান্ডফোন ব্যবহার করার সুযোগ দিয়ে একটা উপায় অবশ্য তারা করে দেন । অবিশ্বাস্যভাবে বন্ধুকে অফিসে পেয়ে যাই , মাত্র নাকি সে বেরিয়েছে । টাকাসহ বন্ধুকে নাভানা টাওয়ারের সামনে আসতে বলি ।

টাকা আনতে দোকান থেকে বের হবো , ক্যাশে বসা নিরীহদর্শন লোকটি ষন্ডামার্কা মুখভঙ্গি করে মোবাইল সেটটা জমা দিয়ে যেতে বলেন । সামান্য কটা টাকার জন্যও তারা আমাকে বিশ্বাস করতে রাজি না , তাদের দোষ দেই না , প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় দশবার প্রতারণার শিকার তারাও হয়তো হয়েছেন ।

প্রায় ১৫ মিনিট পর ঘামে জবজবে হয়ে ক্যাশ কাউন্টারে টাকা শোধ করে মোবাইল ফেরত নিই । ষন্ডামার্কা লোকটা টাকা পেয়ে নিজের নিরীহদর্শন ফিরিয়ে আনেন , আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ ইংরেজিতে বলে উঠেন ...
"হ্যাভ অ্যা মানিব্যাগ , হ্যাভ ইউর মানি ব্যাক "


যত্নে ঘুমিয়ে থাকা শেলফের মানিব্যাগটা বোধহয় এবার সত্যিই জাগবে
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০০৮ দুপুর ২:৩৫
৭৫টি মন্তব্য ৭২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×