somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির দৌড় , দৌড়ের স্মৃতি : গল্পে , অনুভবে (১৯৮৮-১৯৯৪)

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ৯:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কৃতজ্ঞতার , বাবার ভালবাসার :
দৌড়ুনোর প্রথম স্মৃতি .... স্মৃতির ক্যালেন্ডারে ৮৮ সালের মার্চের এক সকাল , সকালের সৌম্য ভেঙে শহরের আকাশ জুড়ে এক ঝাঁক ইরাকী
বোমারু বিমান । শহরের নাম কেরমানশাহ ,আমরা সে শহরে অতিথি ,
ইরান থেকে দেশে বেড়াতে আসার জন্য আমাদের যাত্রা , সে যাত্রাপথে
সেই সকালেই কেরমানশাহে আমাদের প্রবেশ । কেরমানশাহে তখনও গাড়ি থেকে নামার ফুসরত মেলেনা আমাদের , হঠাৎ গগনবিদারী
সাইরেন , পরক্ষণেই সব এলোমেলো , কি করে গাড়ি থেকে নেমে আসি
বাবার কোলে , অতটুকুন ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতি ।

রাস্তাজুড়ে এলোমেলো গাড়ি , সব গাড়ির দরজা খোলা ,দরজা খুলে নেমে
আসা মানুষের স্রোত , সে স্রোতের একজন আমার বাবা , বাবার কোলে এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখা আমি , অন্য হাতে মায়ের হাত , মায়ের চোখে অঝোর জল , মায়ের কোলে আধো বোলে আমার
ছোট ভাই । দু'ধারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের ঝাঁক , চোখে মুখে আতঙ্ক , গাড়ির হর্ণ , সাইরেন .... , প্রাণপণে রুদ্ধশ্বাসে সবার ছুটে চলা । খানিক দূরে ডানে বামে কনক্রীটের আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকার , বেঁচে থাকার আশ্রয় । ছু'টে চলা স্রোতগুলো সেগুলো সেখানে মিশে
যেতে দেখি ।

সেই আমার প্রথম, প্রথম ভীষণ গতি , ছু'টে চলার প্রথম স্মৃতি । বাবার পায়ে আমার প্রথম দৌড় , ছুটে চলার নকশায় প্রথম ফোঁড় । কি নাম সে স্মৃতির ? পিতৃত্বের , ভালবাসার নাকি কৃতজ্ঞতার ।

ছোট জীবনের , জীবনের মায়ার:
তারপর .... জীবন হাতে নিয়ে নিজের ছোট পায়ে দৌড়ুনোর স্মৃতিটা
খোদাই হতে বড়জোড় আর একবছর লাগে । রোজ বিকেলের খেলার সাথীটির নাম ইদ্রিস । এক বিকেলে কি খেয়ালে নিজের পোষা বদরাগী কুকুরটি আমার পেছনে লেলিয়ে দেয় । সে বয়সে , এতটুকুনই যেন আমার কাছে মৃত্যুর হাতছানি । রুদ্ধশ্বাসে আমি ছুটে চলি , পেছনে ছুটে আসে ইদ্রিসের কুকুর । বাসা পর্যন্ত পথটা অসীম দূরত্বের মনে হয় , এতদিনেও সে অনুভূতি আজও ফিকে হয়ে যায়না । আমার প্রাণশক্তি যেন ফুরিয়ে আসে , শেষ বিন্দুটুকু ঢেলে দিয়ে বাসার দ্বারে
পৌছে যাই , কিন্তু ঘরে ঢোকা হয়না । স্টিলের চৌকাঠে আমার ছোট কাঁধ আটকে যায় । পুরো বাসা কাঁপিয়ে দ্বারের সামনে আমি নিথর হয়ে
ছিটকে পড়ি । আচমকা ঘটনায় কুকুরটাকে ঘাবড়ে গিয়ে পালিয়ে যেতে
দেখি ।

উড়ে চলার:
দৌড়ের মাঝে উড়ে চলার স্বপ্নের স্থপতির নাম ইকারুস । স্কুলে যেতাম না বলে , ঘরে বসেই ইকারুসের গল্প পড়ে , গ্লাইডারে ভর করে আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখি ।আমাদের হসপিটাল কম্পাউন্ড ঘেঁষেই একটা গাঁ , সে গাঁয়ে মাত্র কয়েকটা ঘর , ঘর পেরুলেই হেলানো পাহাড় । বসন্তে লাল সাদা হলুদ অজানা নামের ফুলে , আর নাম জানা টিউলিপ ফুলে সে পাহাড় রঙিন কার্পেট জড়িয়ে নেয় । বিকেলে বন্ধুদের সাথে সে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে , দু'হাত দুপাশে আদিগন্ত ছড়িয়ে দিতাম , পাগুলো শিথিল করে ঢাল বেয়ে শুরু হত আমার দৌড় । বাতাসে ভেসে , উড়ে চলার স্বপ্নে রঙ মেখে পৌছে যেতাম পাহাড়ের পাদদেশে ।

পাশের শহরের হসপিটালের ডাক্তার আংকেলরা মাঝে মাঝে বেড়াতে
আসেন । তাদের ছোট ছেলেমেয়েগুলির বেশ ক'জনা আমার সমবয়েসী । তাদেরই একজন জুনায়েদ । এক উপলক্ষে জুনায়েদরা বেড়াতে
আসলে আমি ঐ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওকে উড়তে শেখাই । উড়ে চলার সে দৌড় জুনায়েদও ভালবেসে ফেলে ।

তারপর একদিন গাঁয়ে বড় বড় বুলডোজার আসে । পাহাড়ের ঠিক মাঝ চীরে তৈরি হয় রাস্তা । পাহাড় বেয়ে আমার ছুটে নেমে আসার গল্পও ফুরিয়ে যায় ।

লজ্জার:
জুনায়েদরা আবার আসে , পাহাড়ের চূড়াতেও ওঠে । কিন্তু ভুলে যায় সে রাস্তার কথা । হেলানো বলে , পাহাড়ের চূড়া থেকে পুরো পাহাড় দেখার জো নেই , সে না দেখাই কাল হয়ে দাঁড়ায় , কিছু বুঝে উঠার আগেই ও নিচের দিকে ছুটে যায় । ঢাল বেয়ে নিচে দৌড়ে গিয়ে দেখি , রাস্তার উপর অসহায় ভাবে ও পড়ে আছে । সে যাত্রায় খুব বড় ক্ষতি হয় না , ওর হাঁটু আর হাতে বেশ ক'জায়গায় ছলে যায় , ঘরে ফিরে সবার সামনে বলে আর কখনও আমাদের বাসায় আসবে না । কি ভেবেছিল সেদিন সবাই ? সবাই কি জানত কি হয়েছিল ? নাকি আমার দোষ ভেবে নিয়েছিল সবাই ?

শেষ পরিচ্ছদটা আজও অজানা.... কিন্তু সে দৌড় নিয়ে আমার লজ্জার রেশটা বেঁচে রইবে চিরকাল ।

রক্তের :
পরের গল্পটার দিনক্ষণ অজানা । আমার প্রিয় ইরানী বন্ধুটির নাম নাসের , সেই নাসেরই মাঝে মাঝে ক্রোধে অন্যরকম হয়ে ওঠে । ইরানের রুক্ষ মাটিতে ছড়িয়ে থাকা কোটি পাথর টুকরো আমাদের খেলার নিত্য সঙ্গী । একদিন পাথর নিয়ে খেলতে খেলতে আমার হাত ছিটকে একটু টুকরো গিয়ে নাসেরের পায়ে আঘাত করে বসে । কিছু হয়নি বলে খেলা থামে না , বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই নাসেরের সজোরে ছুঁড়ে দেয়াএকটা পাথরের টুকরো আমার চোখের ঠিক নিচে এসে লাগে । হঠাৎ করেই পৃথিবীটা যেন অন্ধকার দেখি , বাসার দিকে দৌড়াতে শুরু করি । ছুটে চলার ফাঁকে টপটপ করে পড়া রক্তের ফোঁটায় আমার সাদা কেডস লাল হয়ে যেতে দেখি । আয়নার সামনে দাঁড়ালে চোখের নিচে সেই ক্ষতের রয়ে যাওয়া খানিক দাগ আজও রক্ত ঝরানো ছুটে চলার স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে।

গর্বের , অহঙ্কারের :
ইরান ছেড়ে শেষ যেবার দেশে ফিরি , তার দিন কয়েক পরেই দক্ষিণ এশিয়া জয় করে নেয় বাংলাদেশের এক তরুণ । দৌড়ে উপমহাদেশ জয় করা সে তরুণের নাম বিমল চন্দ্র তরফদার , টিভি স্ক্রিনে দেখা সে দৌড়ের রেশ না কাটতেই , স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় । পরীক্ষা শেষে চেহারা মনে থাকা , নাম না জানা বুড়ো এক শিক্ষক বিশাল হলরুম ভর্তি ছেলে মেয়েকে এসে জিজ্ঞেস করেন দ্রুততম মানবের কথা । হয়ত ইতস্তত হওয়ার বোধ থেকে বা না জানার ভয় থেকে কারও হাত ওঠেনা । দোটনার মাঝে আমার হাতটা উঠে যায় । বিমলের কথা বলতেই স্যার এসে আমার চুল নেড়ে দেন , আজ প্রথমবার স্বীকার করে নিই সেদিন আমার ভীষণ গর্ব হওয়ার কথা। বিমলের সে দৌড় অহঙ্কারের ভাগীদার হয়ে গর্বের যে অনুভূতি আজও হয় , সে দৌড়ের স্মৃতি কি কোনদিন মলিন হবে ?

.
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১১:০৪
২৬টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×