somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(পর্বভিত্তিক বড় গল্প) জীবনের এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন - পর্ব ১-৪ :( :(

১৫ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব - ০১

বাড়ি থেকে যখন পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে এলো আমি তখন ভালো করে জামাটাও পড়ার টাইম পাইনি । নাইট ড্রেসটা পড়ে ছিলাম, একটু পরই ঘুমাবো বলে । এর আগে ব্যস্তভাবে ডিনারটা সেরে নিচ্ছিলাম । আমার স্ত্রী নূপুর আমার সাথেই বসে খাচ্ছিল । সারাদিন ব্যস্ততা শেষে এই ডিনার টাইমেই দুইজন একসাথে বসে খাবার টাইমটুকু পাই । অবশ্য ডিনার করতে করতে কখনও ১২ টা আবার কখনও ১টা বেজে যায় । পাগলিটা কেমন যেন, আমাকে ছেড়ে কখনই রাতের সময়টাতে খায় না । অনেক বলেছি ওকে কিন্তু কথাই শোনে না । তাই তো রাতে যদি কখনও খেয়েও আসি তবুও ওর সাথে বসে হালকা হলেও খেতে চেষ্ঠা করি । অবশ্য এই সময়ে এসে কখনই বাচ্চাগুলোকে জাগ্রত অবস্থায় পাই না ।

যাই হোক, ঘড়িতে ঠিক তখন ১২টা বেজে ১৯ মিনিট, দরজায় নক । এত রাতে প্রতিবেশী যে এসে নক করবে না, এটাই স্বাভাবিক, এটাই সামাজিকতা । যাই হোক, একটু পর নকের তীব্রতা বাড়তে লাগলো । আমি ধৈর্য্যহারা হয়ে গেলাম । রাগ তখন চরমে । দরজা খুললাম, কিন্তু খুলেই পুলিশ দেখেই রাগ আমার কনফিউশনে পরিণত হলো । এত রাতে পুলিশ !!! কিন্তু পুলিশই কেন !!!

মিঃ কালাম, আপনাকে আমাদের সাথে একটু পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে । আমরা আপনার এরেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি । আপনি দ্রুত ড্রেসটা চেঞ্জ করে নিন । This night will be so long for you । পুলিশের মধ্যে যে এতক্ষণ আমার মধ্যে কথা বলছিল সে যে উচ্চশিক্ষিত, বুঝতে পারলাম । আমি কথার প্রতত্ত্যুরে কিছুই বললাম না । নীরবেই ড্রেসটা চেঞ্জ করে পুলিশের সাথে চললাম । নূপুর এতক্ষণ ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে ছিল । শুধু যাবার সময় বললো, আমি আসবো ? আমি শুধু বললাম, না থাক, বাচ্চারা তো ঘুমাচ্ছে । হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ওরা তোমাকে খুঁজতে পারে । তুমি বরং সালামকে বলে কাল সকালে একবার আসতে পারো ওখানে । আগে বলে নিই, সালাম আমার ছোট ভাই । নূপুর আর কিছু না বলেই আমার কথা মেনে নিলো । আর আমি চললাম পুলিশের সাথে ।

পুলিশ স্টেশনে বসে আছি আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে । আমাকে একটি ছোটখাট বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছে তারা । আবার বেঞ্চের হাতলের সাথে আমার হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো । এর মধ্যে আর আমার সাথে কেউ কথা বলছে না । এমনকি আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছেও না । মনে হচ্ছে আমি অদৃশ্য কেউ একজন । তাই আমি বাধ্য হলাম চোখ বুলানোর জন্য । বেঞ্চে আমি একা না, আরও দুইজন বসে আছে । এদের মধ্যে একজন মহিলা আর একজন পুরুষ । মহিলাটি আমার পাশে আর পুরুষটি আরেক কোনায় । ঐ পুরুষটিকেও আমার মত হ্যান্ডকাফ দিয়ে হাত আটকিয়ে রেখেছে বেঞ্চের হাতলের সাথে । মহিলাটির মুখে অতিরিক্ত মেক-আপ । বুঝলাম, রাস্তা থেকে ধরে এনেছে, হয়তো টাকা নিয়ে বনিবনা হয়নি । পুরুষটিকে দেখে মনে হচ্ছে টাল হয়ে আছে । যে কোন মুহূর্তে বেঞ্চ থেকে পড়ে যেতে পারে । আবার রুমটির এক কোনায় একটি বাচ্চা অবিরত কেঁদেই চলেছে । কিন্তু সবাই যে রকম ভাবে ছোটাছুটি করছে, মনে হচ্ছে কেউ এই বাচ্চাটির কান্না শুনতেই পাচ্ছে না । আমি আশেপাশে তাকিয়ে বাচাটির মা কিংবা অভিভাবককে খুঁজার চেষ্ঠা করলাম কিন্তু না, কেউই নেই আশেপাশে । আবার সেখানে বসেই শুনতে পেলাম পুলিশ পেট্রলের গাড়িগুলো একটা স্টেশন ছাড়ছে তো আরেকটা এসে ভিরছে । তাই একটু পর পর সাইরেনের আওয়াজ একবার বাড়ছিল আবার একবার কমছিল ।

পর্ব - ০২

হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম । ঘড়িতে যখন প্রায় ৩ টা বেজে ৪০ মিনিট, তখন পুলিশেরই একজন এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো । "আপনাকে স্যার ডাকছে, চলুন ।" হঠাৎ কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে আমি একটু অস্বস্তিতে ভুগছি । আর তাছাড়া বসে বসে ঘুমানোর অভ্যাস নেই বলেও হয়তো এই অস্বস্তিটা আসতে পারে । তবু ঘুম ঘুম অবস্থাতেই চোখ কচলাতে কচলাতে আমি শুধু এই কথাটি বললাম, একটু পানি হবে ? পুলিশের ঐ লোকটি মনে হয় ভালোই । আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়ে আমার হাতে একটি পানির জগ এনে দিলো । আমি চোখেমুখে পানি ছিটালাম আবার কিছুটা খেলামও । ঐ পুলিশটি এরপর আমাকে তার স্যারের কাছে নিয়ে গেলো । আমি স্যারের কাছে পৌঁছেই সরাসরি তার নেমপ্লেটের দিকে খেয়াল করলাম । জনাব বদরুল । লোকটির মুখ পানে লাল । সামনে ছোটখাট একটি পানবাটা । মনে হচ্ছে একটির পর আরেকটি পান খাওয়া অভ্যাস তার । "স্যার, আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে ?" আমি আর অপেক্ষা না করেই জিজ্ঞেস করে বসলাম । জনাব বদরুল এতক্ষণ কোন একটি ফাইলের দিকে মনোনিবেশ করে ছিলেন, আমার প্রশ্ন শুনে মুখ উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন । কিছুক্ষণ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন, এই সময়টুকুতে পান চিবানোর কথাও ভুলে গেছেন যেন । আমি আবারও বললাম, "স্যার, আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে ?", এই ভেবে যে উনি হয়তো শুনতে পাননি । লোকটির ভ্রূ ধীরে ধীরে কুঞ্চিত হলো । লোকটি এরপর রেগে গিয়ে বলে উঠলো, "কেন, এক রাত আমাদের সাথে থাকলে কি আপনার জাত যাবে ? আমরা কি মানুষ না আপনাদের কাছে ?" বুঝলাম, লোকটি ভিতরে ভিতরে অনেক ক্ষোভ পুষিয়ে রেখেছে । আমি আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলাম । একটু পর জনাব বদরুলের নির্দেশে আমাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো ।

হাজতে আমার প্রথম রাত্রি । জীবনে যে কতরকম অভিজ্ঞতা হলো, তবে এরকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা, এই মুহূর্তে তা মনে করতে পারছি না । তবে সত্য হলো, জীবনে এরকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো সহজে ভোলা সম্ভব না । হাজতে অবশ্য আমি একা না । দেখলাম আরও অনেকেই আছে । হাজতে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটি হচ্ছে, খাওয়া আর টয়লেটের জায়গা কাছাকাছি । ঐ গন্ধের মধ্যে বসেই খাওয়া, ঘুম সব । আমি ভাবছি আমাকে কেন গ্রেফতার করে আনা হয়েছে । আমি ভেবে কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না । আবার মনের এক কোনায় এই ভাবনাও আসছে যে আমি হয়তো এই হাজত থেকে আর কোনদিন ছাড়া পাবো না । আর কোনদিন নূপুরের মায়াবী মুখটা দেখতে পাবো না । দুই ছেলে-মেয়ে আফনান আর জারিনকেও মিস করবো । হয়তো এখানেই আমার মৃত্যু হবে ।

আশেপাশের লোকগুলোর চোখের দিকে তাকানো যায় না । সবার চোখেমুখে এক ধরনের আতংক । একজনের সাথে কথা বলে বুঝলাম, লোকটিকে ধরে আনা হয়েছে ছিনতাই এর কথা বলে । অথচ লোকটি নাকি ছিনতাই-এর ঐ ঘটনার সময় নিজের বাসায় ঘুমাচ্ছিল । সন্দেহবশত ধরে আনা হয়েছে আরও চারদিন আগে । বাসার লোকজন প্রতিদিন ধরনা দিলেও মোটা অংকের টাকা চাওয়া হয়েছে ঘুষ হিসেবে । সেই টাকা জোগাড় করতে বিলম্বিত হচ্ছে বলেই লোকটি এখনও হাজতেই আছে । আমার ক্ষেত্রেও কি এমন কিছু হবে ? নূপুর বেশি চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পরবে না তো ? এত রাতে আবার সালামকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বসবে না তো ? বাচ্চাগুলোকে দেখবে কে ? আমার চিন্তাগুলো ক্রমশ বাড়ছে । চিন্তা বাড়ার সাথে সাথে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ক্রমশ চিন চিন করে ব্যাথা শুরু হয়েছে । মনে হলো, প্রেশার বাড়ছে ।

আমি হাজতের শিক ধরে এক কোণার দিকে বসে ছিলাম । হাজতে কেউ কারও বন্ধু হয় না । তবে শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই থাকে । যদি আপনার কোন আত্মীয় এক প্যাকেট সিগারেট ধরিয়ে দিতে পারে আপনার আশেপাশের হাজতিদের, তাহলে তো আর কোন কথাই নেই... আপনি তখন তাদের কাছে বস । আপনার আদেশ তাদের ক্ষেত্রে শিরোধার্য । আপনার হাত-পা টিপে দেবে তারা । আপনার মাথাও টিপে দেবে আর হাত দিয়ে ডলে শরীর মালিশ করা তো আছেই । আমি বসে বসে দেখছিলাম এমন একজনকে তিন-চারজন ঘিরে সেবা করছে । পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, "ঐ লোকটি কে ?" সে উত্তর করলো, "আপনি তাকে চেনেন না ? ধুর, মিয়া, আপনি তো তাইলে এই শহরে থাকেনই না !!! ও হইলো কালা মজিদ । প্রতি মাসের দুই-তিনদিন হাজতে এসে হাজতবাসীদের খোঁজখবর নিয়ে যায় । শহরে বিরাট ত্রাস ওর । আমি তো এমনও শুনেছি, মাসে একটা মার্ডার না করলে নাকি ওর ভাব আসে না......" । আমি আর ভাব আনার তালে থাকলাম না । এই কথা শুনে আরও জড়সড় হয়ে বসলাম । কালা মজিদ মনে হয় আমার পাশে বসে থাকা লোকটির মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে পেয়েছে আর আমাকেও খেয়াল করেছে । কালা মজিদ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি কেস ? ছিনতাই ? নাকি মার্ডার ? নাকি দুই নম্বরি ? কোনটা ?" আমি একটু ভয়ে ভয়েই উত্তর করলাম, "একটাও না । আমার মনে হয় এরা ভুল করেছে । আমাকে অন্য কারও সাথে গুলিয়ে ফেলেছে ।" কালা মজিদ মনে হয় আমার উত্তরে খুশি হলো না । আবার বেশ রাগও হয়েছে । রাগের ব্যাপারটা আমি বুঝলাম, এর পরপরই তার কথা শুনে । "ভুল করে মানে ? ঐ মিয়া, মশকরা করেন ? এখানে কেউ কাউকে ভুল করে আনে নাকি ? জলদি জলদি হাছা কথা কইয়া ফালান । নাইলে কিন্তু হাছা কথা বলানোর অনেক উপায় আমার জানা আছে ।" কালা মজিদের মুখে এই কথা শুনে আমি ঢোক গিললাম । ভালো বিপদে পড়েছি, মনে হচ্ছে ।

পর্ব - ০৩

আমাকে হুমকি দেওয়ার পর কালা মজিদের সাগরেদদের তার গা মালিশ করার গতি অনেকাংশে বেড়ে গেলো । বুঝলাম না, সে কি তাহলে ঝি কে মেরে বউকে শেখালো ? একটু পর দেখি কালা মজিদ বসা অবস্থা থেকে আবার শুয়ে পড়লো । আরামে তার চোখ বুজে আসছে । মনে হয় সে ঘুমিয়ে পড়বে । আমার কথা এখন আর তার মাথায় নেই । একটু পরই বলা যায় মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরই তার নাক ডাকার আওয়াজ আসতে লাগলো । তার ঘুমের ভাব দেখে আমি বেশ অবাক হলাম । এরকম প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, গন্ধের মধ্যে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই ঘুমিয়ে গেলো !!! অথচ আমাদের ঘুম প্রচণ্ড গতির ফ্যান কিংবা এসি ছাড়া তো হয়ই না । হায় রে মানুষ, কতটা আরামপ্রিয় !! এবার প্রকৃত অর্থে প্রমাণ পেলাম, শরীরের নাম আসলেই মহাসয়, যত সহানো হবে ততই সইবে । আমি এবার এই চিন্তা থেকে সরে এসে আবার বাড়ির লোকদের চিন্তায় মশগুল হলাম । এখন বাড়ির কি অবস্থা কে জানে !! নূপুর যে এখন কি করে !! ঘুমায় নাকি জেগে আছে ? নাকি কাঁদছে অবিরত ? আবার আমাকে ভুল বুঝবে না তো ? আমি তো সত্যি অপরাধী নয় ।

আসলে আমার কাপড়ের ব্যবসা । জেলার মেইন শহরে যেখানে বড় বাজারটি বসে, সেটির রাস্তার ধার ধরে আমার মোট চারটি দোকান । আব্বা মারা যাওয়ার আগেই আমার ভাগে এই চারটি দোকানই পড়ে । এর মধ্যে তিনটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছি আর একটিতে নিজেই ব্যবসা করি । আসলে দোকানটি মূলত পাইকারি বা হোলসেলের । ঢাকা থেকে লট এনে পরিচিতদের সাথেই মূলত আমার ব্যবসা । আমার আব্বাও এই কাপড়ের ব্যবসা করতেন । ছোট ভাইটিও অবশ্য ব্যবসা করে কিন্তু ও কাপড়ের ব্যবসায় আসেনি । ও জুতার ব্যবসা করে । আমি বেশ কয়েকটি নামকরা কোম্পানির লোকাল ডিলার আর তাছাড়া ঢাকার কয়েকটি নামকরা গার্মেন্টসের সাথেও আমার যোগাযোগ আছে । ওদের রিজেক্টেড মালগুলো মূলত আমার কাছেই আসে, সেগুলো আবার আমার সাথে কন্ট্রাক্ট থাকা লোকাল পাইকারি দোকানগুলো নিয়ে যায় । আমার ব্যবসা আল্লাহ্‌ দিলে মাশাল্লাহ্‌ । দোকানে কর্মচারির সংখ্যা অনেক । ম্যানেজার আছে একজন আর ঘুরে ঘুরে অর্ডার নেওয়ার জন্য আছে পাঁচ জন আর দোকানের ভিতরে আছে আটজন । এতজনের মধ্যে আমার দেশী মানুষই আছে প্রায় দশ জনের মত । বুঝতে পারছি যে ঘাপলা যা হইছে তা দোকানেরই কোন কর্মচারি করেছে কিন্তু কাকে অবিশ্বাস করবো ? এর দায়ভার যে আমার ঘাড়ে আসবে, এতে আর সন্দেহ কিসের ? আচ্ছা, এই ব্যাপারটির তদন্ত হবে তো ? নাকি বিনা দোষেই শাস্তি পেয়ে যাবো ?

ভাবতেই ভাবতেই কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি । একটু পর হঠাৎ-ই চোখ খুলে গেলো, হয়তো পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনে । ভোর হয়ে গেছে অনেক আগেই, প্রকৃতিও যেন ঘুম থেকে আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠছে । পাখিগুলো তো পাল্লা দিয়ে একজন আরেকজনের চেয়ে জোরে ডেকে চলেছে । এতক্ষণ পুলিশ স্টেশনে কোন চাঞ্চল্য ছিল না । সবাই যে যার মত হয় ঢুলছিল, না হয় বসে বসে ঝিমাচ্ছিল আবার কারও কারও তো নাক ডাকারও আওয়াজ আসছিল । এখন পুলিশ স্টেশনও জেগে উঠেছে । ছোটাছুটি আরম্ভ হয়ে গেছে । আমি যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে খুব কষ্ট করে স্টেশনের ঘড়িটা দেখা যায় । আমি চেষ্ঠা করলাম, কয়টা বাজে এটা দেখার জন্য । ঠিক ৮ টা বেজে ১৩ মিনিট । তার মানে ভালোই সকাল হয়ে গেছে । হঠাৎ খেয়াল করলাম, পিছন থেকে কালা মজিদ আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে । সে জেগে উঠায় হাজতের মধ্যে নিরবতা এসেছে । কারণ তার নাক ডাকার শব্দটা থেমে গেছে । সেই নিরবতার কারণেই মনে হলো অনেকেই এক সাথে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে । ঠিক যেন কোন ঘরের শব্দ করে ঘুড়া ফ্যানের মত । ফ্যানটি যখন শব্দ করে ঘুরতে শুরু করে, প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও এক সময় ঘুম কিন্তু চলেই আসে । তখন ফ্যানের ঐ অবিরত শব্দের সাথে মানিয়ে নিয়ে ঘুমও ধীরে ধীরে গভীর হয় । কিন্তু কারেন্ট চলে যাওয়া বা অন্য কোন কারণে যদি ফ্যানটি থেমে যায়, তাহলে আবার ঘুম ভেঙ্গে যায় । কালা মজিদের ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে ঠিক এমনটাই হয়েছে হাজতে । এত কষ্টের মাঝেও এটা দেখে আমার হাসি পেয়ে গেলো । আমি অনেক কষ্ট করে হাসি চাপার চেষ্ঠা করলাম কিন্তু কালা মজিদের চোখে সেটি এড়ালো না । সে দেখি আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আবার তার ভ্রূও বেশ কুঞ্চিত । আমি আবার জড়সড় হয়ে বসলাম ।

পর্ব - ০৪

তবে এ যাত্রায় আর কালা মজিদ আমাকে ঘাঁটলো না, নিজের আশেপাশে থাকা দুই সাগরেদকে পাশে ডেকে আবার হাত-পা মালিশ করতে বললো । কেন জানি মনে হচ্ছে, এই লোকটার শরীরে সবসময় এক ধরনের জড়তা লেগেই থাকে । যখনই বসে আছে তখনই কাউকে না কাউকে দিয়ে নিজের শরীরের জড়তা ভাঙ্গানোর কাজে লাগিয়ে রেখেছে । যাই হোক, কালা মজিদের কর্মকাণ্ড দেখে বাকি সময়টুকু কাটানোর ইচ্ছা নেই আমার । হাজতে পুরো একটা রাত কাটিয়ে ফেললাম আমি । কি সাংঘাতিক ব্যাপার !! আমার বাপ-দাদা চৌদ্দ-গুষ্ঠির মধ্যে কেউ কোনদিন পুলিশের হাতে ধরা খায়নি । আমিই এক প্রকার রেকর্ড করে ফেললাম । তবে এটা এমনই একটা রেকর্ড, যা নিয়ে গর্ব করা যায় না । আমারও গর্ব করতে ইচ্ছা করছে না মোটেও । যদিও আমি অপরাধী নই, তবুও নিজেকে কেন জানি খুব ছোট মনে হচ্ছে । কেন জানি মনে হচ্ছে দুনিয়ার চোখে সেই আগের সম্মানটুকু আর দেখতে পাবো না । লোকে আমাকে দেখে মশকরা করবে । বলবে ঐ দেখ সন্ত্রাসী কালাম যাইতেছে । আমার কাপড়ের ব্যবসায় লালবাতি জ্বলবে । নাকি ইতিমধ্যেই জ্বলে গেছে, কে জানে । আমার ছেলেটার স্কুলে ওর বন্ধু-বান্ধবীর অভিভাবকরাও এটা নিয়ে বলতে ছাড়বে না, আমি জানি । মেয়েটাকে তো এখনও স্কুলেই দেইনি, যদি দিতাম, তাহলে হয়তো ওর সাথেও...... থাক, আমার ভাবনাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে । আমি নিজেকে হারাচ্ছি খুবই ধীরে ধীরে । এটাই কি আসল আমি ?

একটু পর দেখতে পেলাম নূপুর প্রায় হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকলো । আমার হাজত থেকে আমি ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি । সাথে সালাম । ওরা দুইজনই জনাব বদরুলের সাথে কি যেন বললো, একটু পর ওরা দুইজনই আমার কাছে আসলো । নূপুর বেচারীর চোখ দুটোর নিচে হালকা কালি পড়েছে, ঠিক যেমনটা এক রাত না ঘুমালে কারও চোখে পড়ে । বুঝলাম, চিন্তায় ঘুমাইনি বেচারী । বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে প্রথমে সালামই কথা শুরু করলো । "কি হয়েছে ভাইয়া ? তোমাকে এখানে ধরে এনেছে কেন, বলতে পারো ?" আমি উত্তরে বললাম, "মনে হয় গত মাসে যে তিনটা লট এসেছে সেখানে কোন ঘাপলা থাকতে পারে । আমাকে ম্যানেজার সাহেব রিপোর্ট করেছিলেন যে তিনি হিসাব মেলাতে পারছিলেন না । আমি অবশ্য আরেকটি কন্ট্রাক্টে ব্যস্ত ছিলাম, তাই ঐ ঝামেলায় মন দিতে পারিনি । কিন্তু ম্যানেজার সাহেবের তো ঐ সমস্যা সমাধান করে ফেলার কথা... আমি তো উনাকেই এই দায়িত্ব দিয়েছিলাম । আচ্ছা, দোকানের কেউ জানে আমার থানায় থাকার কথা ?" সালাম আবার বললো, "হ্যাঁ, জানে, জানবে না কেন !! তবে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে আজকে সকালেই ম্যানেজার সাহেব ফোনে জানিয়েছেন তোমার দোকানের দুইজন কর্মচারী নাকি আচমকা ছুটি নিয়ে বাড়ির দিকে গেছে আর যাবার সময় বলে গেছে, ফিরতে দেরিও হতে পারে ।" আমার দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগলো না । তবে আমি সালামকে আর কিছুই বললাম না এই ব্যাপারে ।

"আচ্ছা, তুমি কি গো ? এত বড় ঝামেলাকে এভাবে কেউ ছোট করে দেখে !! এখন এখানে বড় কোন ঝামেলা হলে আমার কি হবে, একবার ভেবেছো ?" নূপুর আহ্লাদী ছোট মেয়ের মত আমার কাছে একটার পর একটা নালিশ করতে লাগলো । এই মেয়েটার সাথে বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় আট বছর হলো । গ্রামের মেয়ে, বেশি উচ্চশিক্ষিতও না, মাত্র এইট পাশ । দেখতে মুখশ্রী সুন্দর, ফর্সা, গোলগাল চেহারা, স্লিম দেহের গঠন । মেয়েটার সাথে থাকার এই আট বছরে প্রতিটি দিন আমি নতুনভাবে প্রায় প্রতিদিনই ওর প্রেমে পড়েছি । অথচ এরেঞ্জ মেরেজ, আব্বা যখন প্রথম ওর ছবি দেখান, তার আগেই নাকি তিনি মেয়ের বাড়িতে হ্যাঁ করে দিয়ে এসেছিলেন । আমাকে ছবি দেখানো ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা । আমি রাগ করে ছবিটা ভালো করে দেখিনি, কারণ আমি সেই সময় বিয়ের জন্য মোটেও রেডি ছিলাম না । একটা বেকার ছেলে, যে কিনা নতুন ব্যবসা করার চিন্তা করছে, তার কপালে কি আদৌ কোন রাজরানী জুটবে !! ভেবেছিলাম, আব্বা হয়তো কোন গেয়ো ভূতকেই আমার কপালে জুটাবেন, এই জন্যই বাসর রাতে বউয়ের ঘুমটা খুলে প্রথমবারের মতন মুখ দেখার ইচ্ছাটুকুও ছিল না আমার । অনেক রাত পর্যন্ত বসে থেকে যখন মেয়েটি বুঝলো, তার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষটির আপাতত তার মুখ দেখার ইচ্ছা নেই, সে তখন ঐ মুখ ঘোমটাতে ঢাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লো । ঘুমিয়ে ঢুলে পড়া মাত্রই তার মুখ থেকে ঘোমটা সরে গেলো আর আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার দিকে খেয়াল করলাম । এ আমি কি দেখলাম !!! এ তো রাজরানী নয়, সাক্ষাৎ কোন পরী...... আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এটা কি সত্যিই নাকি কল্পনা ?

(বাকিটা আগামী পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×