সে কথা 'কালি ও কলম' এর চলতি অর্থাৎ ১১/০৯/২০০৯ তারিখের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। 'কালি ও কলম' এর সৌজন্যে লেখাটির মূল পাতা সেঁটে দিলাম। তাতে বোধকরি পত্রিকায় পাঠের তৃষ্ণা ও ঘুছবে।
============================================
‘এই জগতের যে কোনো বস্তুই কৃষ্ণগহ্বর হয়ে উঠতে পারে। আবার এই মহাজগৎটাই কৃষ্ণগহ্বরের অভ্যন্তরে অবস্থিত।’ স্টিফেন হকিংয়ের এ-কথায় কবিতার আলোচনা শুরু করা যাক। দৃশ্যত কৃষ্ণগহ্বরে বসেই আমরা নিয়ত খুঁজছি দূরের কৃষ্ণগহ্বরের ইঙ্গিত, যেখানে শূন্যতাও একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। জগতের গতিশক্তি যত মন্থর হয়ে আসে ততো ভারি হয় শূন্যতা। তবে অনুসন্ধানে শূন্যতা-ঝামর-স্থান নির্মাণ করে অর্থদ্যোতনা। বাজে শঙ্ক-নিনাদ। শূন্যতার আয়োজনে জেগে ওঠে মোহন সময়; স্ব-ক্ষমতায়। কৃষ্ণ-মোহন কিংবা গ্রহণকালের একজন কবি যখন বলেন-
'আর এখন উড়ছে কেবল বালিহাঁস, পাতিহাঁস
রন্ধ্রে রন্ধ্রে সজারুর মোহন কাঁটা
জ্বলে চিত্ত জ্বলে রাগ
জ্বলে সুগন্ধ বরাত
অংগার ভেঙে ঢলে পড়েছে গুল্ম নির্যাস।'
(জিয়ল জখম, ‘নওবত’, পৃ ৭০)
জিয়ল জখমের কবি শামীম আজাদ। ছত্রে ছত্রে ছড়িয়েছেন নিকট এবং দূরগামী সূর্যাস্তের তীব্র অথচ ক্ষয়িষ্ণু রেখা, প্রযত্ন সময়ের প্রতিভাষ, খণ্ডের সঙ্গে অখণ্ডের এবং প্রকল্পতায় আলো-অন্ধকারে এঁকেছেন বিপরীত জ্যোতির্ময় কোরাস।
এখন কবিতার পাঁজর খুলে দেখার সময়। অন্যজন কী রচনা করেছেন, সে-তুলনায় না গিয়ে বরং কবি এবং তাঁর কবিতার পোস্টমর্টেম হওয়াই জরুরি মনে করি। কেননা, এখন বিজ্ঞান-কবিতা-দর্শনের সম্পর্ক পরস্পরলগ্ন। কবির চিন্তা-দর্শন বিচারে বিজ্ঞান পরীক্ষাগার হতে পারে। এ-প্রক্রিয়ায় বিচার্য কবি এবং কবিতা। যদিও একজন কবি দার্শনিক নন, তাঁর পরিচয় ‘কবি’। কবিতার ‘রস’ চিহ্নিতকরণে বিজ্ঞান এবং দর্শনোপনীত হওয়া দরকার বলে আমি ভাবতে চাই।
খ
গ্রন্থের ত্রিশ পৃষ্ঠা থেকে তেত্রিশ পৃষ্ঠায় ব্যাপ্ত ‘ছায়াগুচ্ছ’ সম্পর্কে আলাদা আলোচনা করতে চাই। গুচ্ছপরম্পরায় প্রেমপ্রবর্তনা এবং সময় নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে নির্মিত হয়েছে কবিতা। প্রায় সবকটিতে জ্বলে উঠেছে সুনীল-রঙিন কাতরতা। এভাবে-
অচিরেই হবো মীন
ঘুমাবো জলের নগর
পিঠ ভরা চুল খুলে
রঙধনু আঁশ মেলে
জলের তপস্যা কলরব।
(‘ছায়াগুচ্ছ’, ৩)
স্মৃতি উগরে দেওয়ার প্রবণতা কবিতার মজ্জায় চির ধরায়। ভেঙে ফেলে যাবতীয় করণ-কৌশল। কবিতার জাতশত্র“ বলে আধুনিক কবিতায় স্মৃতি-ভ্রমণ-বৃত্তান্ত অত্যল্প। অথচ কবি সে-পথ পদচিহ্নহীন রাখেননি।
কবি এখানে নৃতাত্ত্বিক। মৃত্তিকার সন্তানেরা ক্রমবিবর্তনে নিজের অবস্থানে স্মৃতিচিহ্ন খুঁড়ে এভাবে দাঁড়ায়। স্মৃতি-বর্ণিত এ-ক্যানভাস কাব্যনন্দন-বর্জিত নয়।
ছুঁয়ে দেখো সৃষ্ট ওম প্রতিজ্ঞা
আমার, কবোষ্ণ মন্দিরা
ছোঁয়া পেলে শানিত হবো
কলঙ্ক অভিধা
(‘ছায়াগুচ্ছ’, পৃ ১৪)
ছায়াগুচ্ছের রক্তে উন্মত্ত-সঞ্চারী প্রেমনাদ এভাবে গীতলতায় অভিষিক্ত হলো। কলঙ্ক অভিধা জেনেও জানালো নিজের মনস্তাপ। কবিকে আরো পড়ি এভাবে ‘ক্লান্ত পিঁপড়েরা কি রতিক্রিয়া করে/ এক জনমে ওষ্ঠাধর কত জখম ধরে?’ অথবা, ‘আধো রাত সরে গেলে/ খোঁজো কার লতিকায় দুল?’ এভাবে বেজে উঠেছে ছায়াগুচ্ছের শরীরে বিরাজিত ক্ষয়, মৃত্যু, প্রেম এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সুর।
গ
কবি শামীম আজাদ কবিতায় অবস্থান চিহ্নিত করেছেন দৃষ্টিসীমার বাইরে অসীমতায়। বৃত্তে আবর্তিত ঘূর্ণায়ন কেন্দ্র থেকে নিরুদ্দেশমুখী নিজেকে তিনি আবিষ্কার করেন।
‘আমি সমগ্রের অংশ নই, সমগ্রের সঙ্গে সম্মিলিত নই, সমগ্রের মধ্যে গৃহীত নই।’ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দার্শনিক সোরেন কিকগার্ড এভাবে বন্ধনহীন অসীমের কথা বলেছিলেন। সেই থেকে বোধকরি আধুনিক বিচ্ছিন্নতাবোধের শুরু। যে-বোধ রোমান্টিকতা, বাস্তবতার বীজ বুনে দেয় চিন্ত্যন ভূমিতে। সেই ভূমিচিন্তার কবি শামীম আজাদ অলৌকিক ডানায় বয়ে জিয়ল জখমে জানিয়ে দেন নিজের ‘অবস্থান’।
ঘ
একজন কবির জন্যে সময় খণ্ডিত করা জরুরি বলে জানি। তারও চেয়ে জরুরি খণ্ডিত সময়ের খোলনলচে খুলে খচিত সুবর্ণ তিলক এবং দগদগে ক্ষত চিহ্নিত করা। প্রক্রিয়ায় কাব্যচিত্রক মনন উৎসারিত যে-ভাষিক জমিন তৈরি করেন তা হয়ে ওঠে কবিসময়ের বিস্তারিত ইলাস্ট্রেশন। কবি যখন বলেন-
পূর্ণিমার বাগান খুঁড়ে তুলে নেবো মুঠো পাপ...
পাথর বগলে গাঁথা দুই হাত
হায়! এই নিদয়া চক্ষুর ঘোড়া
তবু তুলে নিতে চায় ঘনবদ্ধ
কলিজার থোড়।
(‘আকাঙ্ক্ষা’, পৃ ৩৪)
এভাবে আজকের পৃথিবী, নাগরিকতা, সময় এবং ব্যক্তিদহনের কথা বলতে গিয়ে কবি মিশেল ফুকোর পাগলা গারদের মতো ঘিরে রাখেন পাঠককে। জিয়ল জখমের পুরো শরীরে পোড়া রক্তের ছাপ। মাটির ওপরে সচল যে-ক্রিয়া; তার আমূলে নিয়ত বিঁধে যাওয়া তীরের ফলা, যা কিনা তীব্র আকঙ্ক্ষায় কুড়িয়ে নেওয়া। অনবরত খসে খসে শূন্যে মিশে যেতে ধ্যানস্থ কবিকে আরেকবার পড়ে নিই -
হাড় ও কলিজা চেরা
উত্তরীয় উজান
কখনো নিই না তার নাম
তবু, কণ্টক মন্দিরা বাজে
মৃত্যু সমান।’
(‘স্থপতির স্তুতি’, পৃ ১৭)
এ কবিতাগুলোর সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল পড়ে নেওয়া যায় ‘থেরাপিউটিক’, ‘চন্দ্রভাষ্য’, ‘হতাশা’, ‘চলাচল’, ‘প্রবাহ’ ‘খুদের নগর’, ‘লন্ডিনিয়াম’, ‘দিকভ্রান্তি’, ‘নাই’ এবং ‘পোকা ও পাখোয়াজ’ ও অন্যান্য। কবি বেদনারস-মিশ্রিত চোখ ফেলেছেন প্রতিভাষ পৃথিবীতে। আবিষ্কার করেছেন কৃষ্ণগহ্বর অভ্যন্তরে শূন্য অন্ধকার, জগতের বহুমাত্রিক ছন্দ-রূপ। কবি এসব অনুসন্ধান করেছেন খণ্ড খণ্ড সময়ের মধ্যে। তাই কবিতাগুলো আধুনিকান্তিকতারই চোখে হয়ে উঠেছে নানাভাবে অর্থবহ। আমি তাঁর অনুরক্ত পাঠক হিসেবে বলতে পারি, শুধু ভাষার আধুনিকত্বের কারণে নয়, বরং দর্শন, চিন্তা এবং কবিতার সম্মিলিত সংগীতে কবিতাগুলো পাঠকের সঙ্গে দীর্ঘ সহবাসের দাবি রাখে।
ঙ
আবেগ কবিতার প্রাচীনতম সহযাত্রী। ফলে আবেগ কবিতার প্রধানতম রসায়ন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে রসদ-মিশ্রণত্রুটি ঘটলেই সৃষ্টি ব্যাহত হয়। কবিতারসদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম বলে মনে করি। বিশ্বসাহিত্যে অনেক কবিতা এই মিশ্রত্রুটির কারণে পাঠকপ্রিয় হয়েও মহাকালীন হতে পারেনি। একজন শিল্পীকে তাই রাশ টেনে ধরতে হয় আবেগের। জিয়ল জখমে রসদ ব্যবহারে শুনতে পাই কষ্টকল্পের পদধ্বনি। কবি কখনো কখনো আবেগাপ্লুত হলেও তাঁর বোধ ও গভীরতা থেকে একটি একটি হীরক তুলে এনে গেঁথেছেন মালা। এক একটি হীরক টুকরো ধারণ করেছে কবির ক্ষণমৈথুনে উঠে-আসা ফ্যাকাশে হলদেটে পাতা, আকাঙ্ক্ষা, শোক, দুঃখ এবং বিস্ময়। সুরেবাঁধা যন্ত্র যেমন প্রতীক্ষা করে সুরের জন্যে, আলোচ্য কবিও তেমনি এখানে প্রতীক্ষারত কাঙ্ক্ষিত বেদনার জন্য। এ-অভিযাত্রায় বৃহৎ ও ক্ষুদ্রের এবং রূপ ও অরূপের সন্ধানে প্রায় আত্মবিলাপে মগ্ন তিনি। মৃত্যুতে ব্যক্তির আত্মবিলোপ ঘটে। তাই বোধকরি জিয়ল জখমের উৎসর্গে দেখি ‘ভোঁ ভোঁ শবের বিছানায়/ পরাজিত মানুষেরা/ মাছি হয়ে যায়...।’ প্রেম ও ভালোবাসায় আত্মবিলোপ ঘটে সত্তার। আর এরই মাধ্যমে সৃষ্টি হয় দ্যুতিময় আত্মসমাহিত হীরক।
কবিতার শুরুতে আবেগ-উদ্বেল কবি - ‘এখানেই পাখির ছায়ার নিচে/ ঘ্রাণ ছিলো/ চিনিচূড় চম্পা/ রজবের চাঁদ আর রাজা শাইল স্বাদ’ বলে শেষে নিজেকে টেনে ধরেন এভাবে - ‘কিন্তু/ দুধের নহর ছাড়া/ বাদ বাকি সবই ছিলো মেদ’ (কোমল কঙ্কাল)। অঘ্রানের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া কবির মনোভূমি শামুকচূড় দহনে পুড়তে পুঁড়তে যখন কবির মনভূমি দীর্ঘ দাঁড়ায়, তখন তাঁকে আমরা চিনে নিই, যিনি মহাকাশকে, বাতাসকে শুনিয়ে যান পাঁজর খোলার দেহলিজ-দহন আলাপ। তখন আর কবির দৃষ্টি থির থাকে না। আকাশ ফুঁড়ে চলে মহাকাশের দিকে। সে-যাত্রা কখনো স্বস্তি দেয় না, ফেলে না শীতল ছায়া। শুধু জানিয়ে দেয় একজন কবির মহাযাত্রা। যে-কবি মৃত্যুর পরেও কবিতা তৈরি করবেন!
চ
শূন্যতা, ক্ষয়, বিরহ, রিরংসা এবং তেজ জগতে অস্তিত্ব সঞ্চার করে। যে-শূন্যতা আমি এবং আমরা বহন করি তা-ই অনন্তের অক্ষয়-সম্ভাবনা এবং আশঙ্কার চিহ্ন। কবি শামীম আজাদ নিজের সঙ্গে বয়ে যাওয়া গহ্বরের ভেতর কখনো শুনেছেন মোহন-সান্ধ্য বাঁশি, কখনো চিহ্নিত করেছেন নিজের ভেতর হিংস্র নখরে কাটা দগদগে ক্ষত। মোহান্ধ সময়ের করাত কীভাবে চিরে সুবর্ণ সুর। কত ত্যাগিলেও পাওয়া হয় না স্বর্ণালী ভোর, তা কবি ফোঁটা ফোঁটা রক্তে এঁকেছেন জিয়ল জখমে। আলোচনা শেষ করার আগে আরো কটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক -
রক্ত তুফান তোলা পাখি
ঠোঁট রাখো ঘ্রাণের ওপর
নাভীমূল থেকে সেঁচে নাও বনাঞ্চল
হাত থেকে ফেলে দাও লবঙ্গের লাল
পাড়ি দাও দাউ দাউ উঠান
(‘পাথর পরাগ’ পৃ ৭১)
তুমি হাঁটো উত্তরে আর
আমি যে নৈঋতে
জানিয়ো তবুরে বন্ধু
কখোনই কোনো কিরিচ ছিলো না
আমার পিরিতে।
(‘মধু শয়তান’, পৃ ৬৯)
তুলে আনি তুষারের তূণ
ভেঙে খেতে চাই রস জাগানিয়া
মনোহর মেওয়া
লাল লাল সরিষার দানা
সব মীথ
(‘ইচ্ছা’, পৃ ৫৩)
এক টানে জিয়ল জখমের কবিতাগুলো পড়া যায়। কবিচিন্তার মতো বাক্যরাও ক্ষিপ্রগতির। তাই কিছু কবিতা উদ্ধৃত হলো। মোট চুয়ান্নটি কবিতা এ-গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। আলোচ্য কবিতা বাদ দিয়ে অবশিষ্টগুলোও ব্যাখ্যাত হতে পারে। অতএব জিয়ল জখম বিষয়ে যে-কোনো সময় বিস্তারিত গদ্য লেখার ইচ্ছে রাখি। এ-গ্রন্থের অন্য কবিতাগুলো হলো ‘অনুপান’, ‘অশ্লীল’, ‘চৌষট্টি চারুলতা’, ‘অনিদ্রা’, ‘মনোবাঞ্ছা’, ‘মূল’, ‘পছন্দ’, ‘অধিবাস’, ‘বন পোড়ে আগে’, ‘অবশিষ্ট’, ‘দিকভ্রান্তি’, ‘নাই’, ‘জল-শুশ্রুষা’, ‘পোকা ও পাখোয়াজ’, ‘অভিলাষ’, ‘অঙ্গ সংস্থান’, ‘উপলব্ধি’, ‘কিশোরী আমানকার’, ‘সাম্প্রতিক’, ‘অতসী’, ‘দেহতত্ত্ব’, ‘বিরহকণা’, ‘লন্ডিনিয়াম’, ‘খুদের নগর’, ‘রাত্রিরাগ’, ‘জ্বলন্ত বর্ষা’, ‘আশংকা’, ‘প্রবাহ’, ‘চলাচল’, ‘হতাশা,’ ‘হলদে পাখি’ এবং ‘চন্দ্রভাষ্য’।
ছ
মেদহীন জিয়ল জখমের কবিতার শরীর। বাহুল্যবর্জিত বক্ররৈখিক কাঠামো কবিভাবনা ধারণ করেছে প্রতিটি আঁশে। কবিতার নামকরণ হয়ে উঠেছে অনুকথায় পুরোকথা। কবিতার শিরোনাম একজন পাঠকের নাকে গন্ধ তুলে দেয় মিশেল মশলার।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ভোর ৫:৩৩