বাসটা মিস হয়ে গেলো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় এমন ঘটনার পূর্বাভাস আন্দাজ করছিলাম অবশ্য। সাড়ে সাতটার বাস। আকাশের লাল বৌ-টা সেই কোন সকালে উঠে গায়ে হলুদ মাখতে শুরু করে দিয়েছে; তখন সময় সাতটা। আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর বাহনটায় চড়তে তড়িৎ প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তড়িৎ বেগে হঠাৎ মায়ের হানা, ‘রুনা বিছানাটা ঠিক করে যাস্’। তিনটা বালিশ, তিনটা কাঁথা, পায়ের নিচে গুটিয়ে থাকা অস্তিত্ব সংকটে ভোগা চাঁদর আর সবার কাম্য পাশবালিশের শয্যাটা গুছিয়ে দেয়ার আদেশে আমি শুধু অসম্মতি জানিয়ে ক্ষান্ত হইনি, তাকে কিছুটা ক্রুদ্ধ স্বরে বলেছি - ‘আমাকে যাওয়ার আগে আর এইগুলা বলবানা তো। আমার সময় থাকলে তো আমি করি’ই। প্রতিবারে তুমি কিছু না কিছু বলো আর না করে বের হলেই দেখি কিছু না কিছু একটা ঝামেলা হয়। আজকে যদি কিছু হয় তো তোমার খবর আছে’। আমার ক্রদ্ধ কন্ঠস্বর বোধহয় কিছুটা মিছিলের মূল চালকের ন্যায় শোনা যাচ্ছিল, মা হাসতে হাসতে কানে হাত রাখলেন। তার এই হাসি মুখ দেখে বাসা থেকে রওনা দিলাম রিক্সায় চেপে।
রিক্সা থেকে নেমে দেখি বাসের সহযাত্রীরা কেউই আর অপেক্ষাতে নেই। নয়টা’য় আমার মিডটার্ম পরীক্ষা আছে ভার্সিটিতে। বাইরের বাসে যেতে হবে চিন্তা করে কষ্টই হচ্ছিল। ব্যস্ত এই সময়টাতে বাসে উঠতে পারাও রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিছুক্ষণ নিজের ভাগ্য পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে আবারো সেই যুগলপ্রিয় বাহন রিক্সার শরণাপন্য হলাম আমি, পরীক্ষাটায় কিছু সময়ের জন্য সঙ্গী হতে পারলেও বাঁচি।
ঘড়িতে তখন সাড়ে আট, পরীক্ষার চিন্তা ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর কখনো তেমন ভাবিত করতে সক্ষম হয়নি। বরঞ্চ যার চিন্তা ইদানীং বড্ড বেশি জ্বালাতন করছে তার নাম ‘বাবু’। বাবু আর আমি একই স্কুলে পড়তাম, দু’টো আলাদা সেকশনে। কথা হয়েছে কদাচিৎ। এস,এস,সি’র পরে ওর নামটাও স্মরণে ছিলনা। স্কুলের রি-ইউনিয়নে ওর সাথে আবার দেখা। কেমন তালপাতার সেপাই’য়ের মতো দেখাচ্ছিল সেদিন ওকে। সবার কেতা-দুরস্ত সাজপোশাকের মধ্যে ওকে এই অনুষ্ঠানের জন্য যুতসই ঠেকছিলোনা। স্কুলে থাকাকালীন আমার রোল তিন-চারের মধ্যে ছিলো। আমায় দেখে চিনতে পেরে বললো - ‘রুনা কি অবস্থা তোমার? কেমন আছো?’ আমি বললাম - ‘ভালো’। বাবুর সাথে টুক-টাক কথা হলো সেদিন। মেয়েদের আকর্ষণ করার মতো কোন গুণই বাবুর মধ্যে ছিলনা, তবু আমি আকর্ষিত হলাম। প্রথম প্রথম ওকে বিরক্তিকর’ই ঠেকতো। ‘মুখপুস্তিকার’ আলাপনে ওই আমার দেখা পেলে দরজায় কড়া নাড়ত। ও প্রশ্ন করতো আর আমি উত্তর দিতাম। দিন যেতে না যেতেই পরিস্থিতি আমাকে প্রশ্নকর্তা আর ওকে উত্তরদাতা বানালো।
- এই বাবু, সারাদিনে একটা খোঁজ নিলানা কেন?
- ঘুমাইছি।
- ও। তুমি কেমন জানি হয়ে গেছো। আগে কত্ত মেসেজ দিতা? রুনা তুমি কই? কথা বলবো, হেন তেন টেবিল ফ্যান...আর এখন?
- এখন?
- এখন কিছুনা। আমি গেলাম।
- কই যাও? থাকো।
- নাহ থাকবোনা। বাই।
- বাই।
- এই তুমি বাই দিয়ে দিলা!!??
- হা হা হা। তুমি না আগে দিলা।
- আমি আগে দিসি তো কি হইছে? তুমি আটকাইতে পারোনা?
- নাহ আমার গায়ে শক্তি কম, দেখোনা এক্কেবারে শুকনা।
- তুমি ভালোনা।
- জানি।
- ধূর। এইবার আমি সত্যি সত্যি চলে যাবো। তুমি থাকো। বাই
- বাই
- আছো? আমি কিন্তু যাইনাই।
- আমিওনা।
ওর সাথে কয়দিন পর পরই আমার এমন টুকটাক ঝগড়া লেগেই থাকে। তবু ওর সাথে দেখা হওয়া ভীষণ ভালো লাগা দিনগুলোতে আমি আমার জমাট বাধা রাগগুলোকে ভুলে যাই। গতকাল রাতেও আমার অভিমাণগুলোতে আরো একটা পালক যুক্ত হয়েছে। কত্ত বড় সাহস আমাকে বলে কিনা - ‘মেজাজ খারাপ, আর যদি ফোন করো তাইলে তোমার খবর আছে’। ওকে কোনদিন ভালোবাসবোনা ভেবেও এখন কেমন জানি হয়ে গেছি আমি! ওর ছোটখাটো অবহেলা, ধমক, বিরক্তি কিংবা রাগ সহ্য করার ক্ষমতা আমার কাছে বড় আরাধ্য মনে হয়। রাতে আমি মায়ের পাশেই শুই। শব্দহীন বৃষ্টিরা কোনদিনও মায়ের ঘুম ভাংগায়নি, মা টেরও পায়নি কোনদিন। বাবুকে এমন পরিস্থিতিতে সিনেমার নায়িকাদের মতো বলতাম - ‘আমি মরে গেলে ভালো হবেতো? তখন কার উপর রাগ দেখাও আমি দেখবো’। বাবু বলতো- ‘এই কথা তুমি কয়বার বলবা বলোতো? মরবানা তুমি’। অভিমানে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। ইচ্ছে হতো ব্লেড চালিয়ে দিই রক্তশিরায় কিংবা ডজনখানেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে একটা উচিত শিক্ষা দিই ওকে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছা হয়নি আমার কোনদিন, শুধুমাত্র মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে ওর মুখটা দেখতে ইচ্ছে হতো খুব। খুব করে কষ্ট পাক ও। পরক্ষণেই মনে হতো, এসব অঘটন ঘটিয়ে পরিবারের সবার কাছে কি অজুহাত দিবো আমি? থাক বাবা, এসব করে কাজ নেই!!
সময় পৌনে নয়টা। রিক্সা তখন নিউমার্কেটে। আমি বাবুকে ফোন দিলাম।
- ঘুমাচ্ছো?
- হুঁ
- আমার পরীক্ষা জানতানা? কালকে ধমক দিলা, আজকেও ফোন করে একটু খবর নিলানা?
- নাহ, আমি কুফা।
- তুমি কুফা? আমি যদি এখন রাগ করে গাড়ির তলে পড়ি?
- পড়োগা না যাও, আমারে বলতে আসছো কেন?
- আমি কিন্তু সত্য সত্যি পড়বো।
- সত্যি সত্যিই তো।
- আচ্ছা আমি রাখি।
- কেন গাড়ির তলে পড়বানা?
- নাহ।
ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। আমার চোখ টলটল করছে। বাবু কল দিচ্ছে, আমি তৃতীয়বারে ধরলাম।
- হ্যালো।
- স্যরি।
- কেন?
- এমনিই। ভালো করে পরীক্ষা দিও। আর সাবধানে যেও।
- আমি রাখি।
চারপাশে সবকিছু ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। কোন একটা কারণে সামনে অনেক হই-চই শুরু হলো। আমার আজকে আর পরীক্ষাটায় দেওয়া হবেনা। ডিপার্টমেন্টে যখন গেলাম দেখলাম পরীক্ষাটা বাতিল হয়েছে কোন কারনে। আমার কপালটাই ভালো। ক্লাসে একজনকেও দেখতে পেলামনা। ব্যাপারটা কি? ওরা কি সবাই জানতো যে এক্সাম হবেনা? হতেও পারে, হয়তো রাতে গ্রুপে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আমি চেক করিনি। বাবু বারবার আমাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। আমার কেন জানি এই প্রথমবার ওর ফোন ধরতে ইচ্ছা হচ্ছেনা। থাকুক টেনশনে!! মুখে যাই বলুক না কেন, আমি মরার কথা বললে ওর মধ্যে ভীতি কাজ করে আমি জানি। প্রতিবার দুই’তিনবারের চেষ্টার পরে ওকে ভুগাইনা, আজকে ধরলামনা ওর কল। মরুক!!
কালকে না ঘুমানোর জন্যই মনে হয় বাসে ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল আমার। বাসায় পৌঁছালাম। মা বাসায় থমথমে মুখ নিয়ে টিভি দেখছিলো। বেচারি এই সময়টা বড় একা হয়ে পড়ে। টিভি দেখা ছাড়া আর কিইবা করার আছে? খবরে বলছে নিউমার্কেটের দিকে একটা এক্সিডেণ্ট হয়েছে। হঠাৎ করে মনে ধাক্কা খেলাম, টিভিতে আমার নামই বলছে। মা শুনে জ্ঞাণ হারালো। আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম, মা! ওটা অন্য কেও, আমিতো বেঁচে আছি দেখো! বাবুকে একবার খোঁজ দেওয়া দরকার।
মাকে হসপিটালে নিতে হবে, বাবা ঢাকার বাইরে। বাবু ফোন দিয়েই চলছে। আমি মোবাইল খুঁজতে ব্যাগের দিকে হাত বাড়ালাম। কিন্তু একি!! ব্যাগ কোথায়? রিংটোন বেজেই চলছে অথচ আমি ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছিনা, রিংটোনটা যেন ঠিক আমার কানের কাছেই বেজে চলছে। সবকিছু দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। এইবুঝি মা ধাক্কা দিয়ে বলবে- ‘রুনা উঠ, আর কতো ঘুমাবি?’ আমি কি বাসে ঘুমের মধ্যে এসব উলটা পালটা দেখছি? কি অসহ্য দুঃস্বপ্ন!! কেও কেন আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছেনা?...............
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:২৩