somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বর্ষা বিলাসে বান্দারবান (ত্লবং (ডাবল ফলস্), কেও.ডং ফলস্, জাদিপাই, বাকত্লাই ও কাইথন ঝিরির নাম না জানা ফলস্)

০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বর্ষা বিলাসে বান্দারবান
(ত্লবং (ডাবল ফলস্), কেও.ডং ফলস্, জাদিপাই, বাকত্লাই ও কাইথন ঝিরির নাম না জানা ফলস্)
পরিকল্পনা ছিল বছরের শুরুতেই, এবার শীত কি শরৎ নয় বর্ষার সময় বান্দারবন যাব। বান্দরবান যাবার একটা বাতিকে পেয়ে বসেছে গত পাঁচ বছর যাবত। নিয়ম করে বছরে একবার পাহাড় পর্বত আর ঝিরি ও ঝর্না না দেখলেই নয়। এবারকার প্লান ছিল সাফা হাফং হাইক করার। তবে তার সাথে আমি জুড়ে দিলাম আরও কিছু যায়গা। ব্যাস যদিও অনেকটা ঘুর পথ হবে তবে বর্ষার মেঘ বৃষ্টির মাঝে ঐ চেনা যায়গা গুলোই অচেনা রূপে হাজির হয়। মোটের উপর যে রোড প্ল্যান করেছিলাম সেটা এ রকম…রুমা দিয়ে বগালেক হয়ে কেওকারাডং তারপর পূর্ব দিকে নেমে ত্লবং ও জিংসিয়াম সাইতার দেখে থাইক্যাংপাড়া হয়ে বাকত্লাইল ফলস দেখে সিম্পলাম্পি পাড়া হয়ে সাকা /মোদক রেঞ্জের পথ ধরবো।
সবঠিকঠাক ঈদের রাতেই বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে গেল আমাদের বাস। তবে সন্ধ্যার পর থেকেই শ্রাবণের অঝর ধারা, যা থামার নাম নেই। বর্ষা বিলাস বলে কথা…. বৃষ্টি নিয়ে ছুটে চললাম….
ভোর ছ’টায় বান্দরবান নেমেই চলে গেলাম রুমা বাসস্ট্যান্ড। যদিও প্রথম বাস ৮টা’র পর। তারপরও যদি অন্য কিছু মেনেজ করা যায়। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর আরও একটা গ্রুপ দেখতে পেলাম, তারাও রুমা যাবে আট জনের দল আর আমরা মাত্র দু’জন। বাস ছাড়তে অনেক দেরী তার উপর মনভরার মত যাত্রী না পেলে বাস ছাড়বে আরও দেরী করে। সে সব কথা থাক ওদের সাথে কথা বলে জিপ ভাড়ার একটা ব্যবস্থা করে ফেলি। ব্যাস সময় নষ্ট না করে স্হানীয় আরও দু’জনকে সহ বার জন ছুট দিলাম রুমার উদ্দেশ্যে। রুমা পর্যন্ত জিপে যাওয়া যাবেনা রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, তারমানে এক নম্বার ঘাটে নামিয়ে দেবে সে, তার পর হয় নৌকা নয়তো আবার একটা জিপ নিতে হবে। কথা না বাড়িয়ে বললাম চল….(রুমা ব্রিজ হবার আগে কইখংঝিরি থেকে নৌকায় যেতে হত সে রাস্তাটা এখন মিস করি)।
অভাগা যায় বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে। সেরন পাড়া পার হয়ে অল্প কিছু যাবার পর জিপের পিছনের চাকা পাংচার। ঠিক আছে চাকা সারাও। সমস্যা পিছুই ছাড়ছে না। জ্যাগ কাজ করছে না, অন্য কোন জিপ দাঁড় করিয়ে তাদের কাছ থেকে ধার নিয়ে কাজ চালাতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কোন জিপের দেখা না পেয়ে সবাই মিলে জ্যাগের কাজটা করে দিলাম স্পিয়ার চাকা লাগানো হলো, গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছ। মিনিট বিশ পর বুঝতে পারলাম চাকায় কিছু একটা গুলমাল হচ্ছে। গাড়ি দাড় করিয়ে চাকা দেখে মেজাজ বিগরে যাবার অবস্থা, স্পেয়ার চাকার হাওয়া খুবই কম চলার মত না… সেজন্যই জিপ দোলনি খেতে খেতে চলেছে...। আবার অপেক্ষা, শেষে অন্য আর একটা জিপ থেকে চাকা ধার নিয়ে এক নাম্বার ঘাট। এখান থেকে রুমা বাজার খুব দূরে না । ইচ্ছে করলে হেঁটেই যাওয়া যায়। তবে গত রাতের বৃষ্টি এখনও পিছু ছাড়েনি। এখান থেকে লক্করঝক্কর মার্কা আর একটা জিপ নিতে হবে আর আমাদের সবার জন্য চাই দু;টো। দরকশাকশি করে অবশেষে রুমা। রাস্তা না বলে মরণ ফাঁদ বলাই ভাল। সেই সাথে বৃষ্টিও জেকে বসেছে। রুমার বাজারের কাজকর্ম সেরে বগার উদ্দেশ্যে যখন যাত্র শুরু করি তখন সাড়ে এগারো..আমাদের দুজনের আজই সানসং পাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চাঁদের গাড়ি থেকে যখন নামি তখনও বগা এক ঘন্টার বেশি পথ। রাস্তা খারাপ আর বৃষ্টি তাই অনেক আগেই আমাদের নেমে যেতে হয়। এখন পর্যন্তও আমরা পুরো দশ জনের দু;টো দলই এক সঙ্গে আছি।
বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে বগালেক আর্মি ক্যাম্পে যখন তখন ঘড়িতে একটার উপরে। তাই বগাতে বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না। এখান থেকেই আমাদের দু’জনের ডুয়েল ট্রেকিং ও হাইকিং শুরু। বিশ মিনিটের জন্য বগালেকে সময় বরাদ্দ। আমার দেখা সেই বগালেক আর নেই। আদিবাসিদের ঘরবাড়ির বাঁশ কাঠের বদলে যায়গা নিয়েছে ইট সিমেন্ট আর দোকানে দোকানে আছে এনার্জি ড্রিংক। যাক, তবে বগায় এখনো মেঘ ও জলের মিতালি একই রকম আছে। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। আমরা কেওকারাডং এর পথে। এ পথের বর্নণা নাই বা দিলাম। এটা আমার তৃতীয়বার যাত্রা এ পথ ধরে। বর্ষায় মেঘ আর পাহাড় অপূর্ব রূপে সেজেছে। কিছুক্ষণ হল বৃষ্টি শুরু হয়েছে বৃষ্টিতে ভিজেই কেওকারাডং এর গা বেয়ে তার চূড়ায় ছুটে চলেছি। মেঘ, বৃষ্টি আর চির সবুজের মোহ মায়ায় কখন যে দার্জিলিং পাড়া এসেগেছি বুঝতেই পারিনি। বগায় ইচ্ছা না থাকলেও কিছুটা সময় বেশি কাটাতে হয়েছে তাই দার্জিলিং পাড়া যখন পার হচ্ছি তখন সন্ধ্যা ৬টা। সূর্য ডুবতে এখনো মিনিট পঞ্চাশ বাকি। অরিবাম বৃষ্টির ধারা মনে হয় চির সঙ্গী হয়ে উঠেছে। দার্জিলিং পাড়া পার হয়ে বাঁক ঘুরেই পথটা উপরের দিকে উঠে গেছে এখান থেকে কেবল উচুঁতেই উঠতে হয়। রাস্তা কিছুটা পিচ্ছিল তবে বেশ ভালই বলতে হবে। চূড়ায় পৌছুতে পৌছতেই কবর অন্ধকার নেমে এল। একে তো শুক্লপক্ষের সবে শুরু তার উপর কালো মেঘে আকাশে কোন তারার দেখা নেই। হঠাৎ করেই বেশ শীত নেমে আসে আর ঘন কোয়াশার মত মেঘ সেই শীতলতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। অবশেষে যখন কেওকারাডং এর চূড়ায় তখন বৃষ্টি কমে এসেছে তবে চারিদিকে মেঘ আর সাঁ সাঁ শব্দ করা হিমেল পাগলা হাওয়া। আমাদের ইচ্ছে পাসিং পাড়া পর্যন্ত যাওয়া কিন্তু সেনা বাহিনীর একটা ক্যাম্প আছে এখানে তাঁরা এই অবস্থায় আধার রাতে ট্রেক না করতে বললেন। অগত্যা লালার কটেছে রাত্রি যাপন। আমাদের প্ল্যান থেকে অনেকটা সময় পিছিয়ে গেলাম, ইচ্ছে ছিল সুনসাং পাড়ায় থাকবো। রাতে বাঁশ কেরুল, পাহাড়ি শাক, ডাল ও ডিম ভাজি দিয়ে খাওয়া শেষ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ভোর বেলা উঠেই বুঝতে পারলাম কেওকারাডং এর চূড়ায় মেঘ-বাতাসের তান্ডব চলছে। এখানে বার মাস শীত। মেঘের জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না, এর মাঝেই আমাদের বেরিয়ে পরতে হল। পাসিং পাড়া পনের মিনিটের পথ। পাসিং পাড়া তখনও পুরোপুরি জেগে উঠেনি। পাসিং পাড়া থেকে পূর্ব দিকে যে রাস্তাটা নেমে গেছে সেটা ধরে চলে গেলেই দেড় কি দু ঘন্টার পথ সুনসাং পাড়া। বেশ খাড়া রাস্তা, সাবধানে পা ফেলে কেও.ডং থেকে নেমে আসলেই একটা ঝিরি পাওয়া যায় এখন এখানে কাঠের সুন্দর একটা সেতু তৈরি করেছে সেনাবাহিনী। এরপর আরও একটু খাড়া নেমে তার পর প্রায় সমতল একটা প্রসস্থ পথ যার দু পাশে সবুজ বন। সেই মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই সুনসাং পাড়া। প্ল্যান অনুযায়ি সুনসাং পাড়ায় ব্যাকপ্যাক রেখে জিনসিয়াম যাবার কথা সেখান থেকে ফিরে এসে ত্লবং (জোড়া জলপ্রপাত) দেখে থাইক্যাং এর পথ ধরবো। কিন্তু সময়ের জন্য জিনসিয়াম বাদ দিয়ে দিলাম । সেটার জন্য অন্য একটা রোড আছে রাইখ্যং ফলস দেখে রুমানা হয়ে আসলেই জিনসিয়াম দেখা যাবে। তাই কাচি চালাতে হল প্ল্যানে। সুনসাং পাড়ার মাঝ দিয়ে (পশ্চিম দিকে) সোজা যে রাস্তা থাইক্যাং এর দিকে গেছে সেটি ধরে এগিয়ে গেলই একটা মোড় পরবে। হাতের ডানে থাইক্যাং এর রাস্তা আর সোজা সরু একটা পথ নিয়ে যাবে ত্লবং এর পথে। রাস্তা বেশ ভাল, চড়াই উৎরাই কম। আর গত রাতের বৃষ্টিও নেই। আকাশে হল্কা মেঘ ও রোদের লুকচুরি। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাসকেডের কাছে চলে এসে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিলাম, ইচ্ছে থাকলেও বুক পানি ভেঙে ক্যাসকেডের কাছে যেতে ইচ্ছা করলা না। আর পাহাড় মাড়িয়ে এর উপর উঠার লোভও জাগল না, যা সচরাচর আমাদের পেয়ে বসে। ক্যাসকেডের জলক্রীড়া হাতের বামে রেখে সাঁকো পার হয়ে ত্লবং পানে হাটা। মিনিট বিশ হাঁটার পরই পাহাড়ের একটা ছোট বাঁক তারপর কানে আসবে জলের আত্মহত্যার শব্দ। মিষ্টি রোদের মাঝেই ডানে মুখ ফেরালেই নিচে দেখতে পাবেন ত্লবং বা জোড়া জলপ্রপাত বা ডাবল ফলস্। কালো একটা পাথর আছে, এখান থেকে দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক বিশ্রাম নিয়ে খাড়া সরু একটা পথ রেখা ধরে ঝোপ ঝাড়, শন মাড়িয়ে নিচে নেমে যাচ্ছি এমন সময় আমার সামনে থাকা সঙ্গীর চিৎকার। আমার নাম ধরে একবার চিৎকার করেই চুপ, আমি দ্রুত পা চালিয়ে শন গাছ গুলোর পর একটু ডানে কেটে নিচে তাকাতেই দেখি ও (মনির হোসেন), উপর হয়ে কিছু একটা দেখছে । আঙুলের ইশারা শব্দ না করে নিচে আসতে বলল। মনিরের গা ঘেসে দাড়িয়ে দেখি সাত আট হাত লম্বা একটা সাপ। মেটে রঙের আর হাল্কা লাল রঙের লম্বা দাগ যা মাথা থেকে লেজের দিকে বিস্তৃত। সাপের এমন লম্বালম্বি দাগ এর আগে কখন দেখিনি। সাপটাকে তার রাস্তায় চলে যেতে দিলাম। তারপর হাতের বাঁশদিয়ে ঝোপ ও শন গাছ গুলোতে আঘাত করতে করতে নিচে নেমে আসি। ত্লবং এর পাগলা রূপ। ত্লবং হচ্ছে রেমাক্রি খালের উৎস। বর্ষার জল পেয়ে ডাবল ফলস পাগলপারা। জল যে যায়গা এসে পরছে সেখানে পুকুরের মত তৈরি হয়েছে এরকম শুনে ছিলাম পূর্বেকার অভিযাত্রিদের কাছ থেকে। বর্ষায় জলের ধারা এত তীব্র যে, নিচে নামাই মুশকিল। পুকুরের কোন অস্তিত্ব পেলাম না তীব্র জলের ধারা বড় বড় বোল্ডারের গা ঘেসে শব্দ করে লাফিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির প্রচন্ড বেগে নিচে পরার শব্দ আর বাতাসের সাথে জলের কনা মিশে কোয়াশার মত তৈরি করেছে। এখানে ক্যামেরা গেজেট সাবধানে, ইচ্ছা না থাকলেও আপনাকে ভিজতে হবে। গোসল করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু উপায় নেই। নল খাগড়া, শন আর পানির স্রোত ও পরিমাণ কোনটাই অনুকূলে না থাকায় সে ইচ্ছে জলের কোয়াশার ঝাপ্টা খেয়ে মিটাতে হল। আবেগকে বশে রাখতেই হবে এখানে কেননা ছোট কোন দুর্ঘটনার জন্য মেডিকেল সাপোর্ট পেতে আপনাকে যেতে হবে উপজেলা সদর পর্যন্ত। বেশ কিছুক্ষণ সময় ত্লবং এর সাথে কাটিয়ে ফেরার পথ ধরি।
পরিবর্তীত প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের থাইক্যাং পাড়া হয়ে ক্যাপিটাল মাউন্টেনের পেট ধরে বাকত্লাইলের পথ ধরার কথা। বর্ষায় বাকত্লাইল জলপ্রপাতের চেহার কেমন হয় সেটা দেখতেই হবে। অন্যথায় থাইক্যাং পাড়া > তাম্ল পাড়া> দুলাচরন পাড়া> ঝিরি পথ ধরে হানজুরিপাড়া হয়ে নেফু পাড়ার একটা ট্রেইল আছে। মোদক টং যেতে রাস্তাও কম সময়ও কম লাগে এ পথে। বর্ষা বলে ঝিরি পথ একটু বিপদ সঙ্কুল হয়। আমাদের গাইড ক্ষেত্র মোহন এ পথে যেতে না রাজি। আমার আবার বাকত্লাইল ফলস্ ও পাড়ার সাথে একটা প্রেম অতিত অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিয়েছে। আমার সঙ্গী হঠাৎ করে নতুন সুরে তাল দিল, তার প্রস্তাব যেহেতু জিনসিয়াম বাদ দিলাম আবার সাফা যাবার পরিকলাপনা আছে আবার বাকত্লাইলও যাব তাহলে অঝথা থাইক্যাং পাড়ায় রাত্রি না কাটিয়ে আবার ক্যাপিটালের রাস্তায় রাতে না ট্রেক করে উল্টো পথে কেও.ডং। বুঝলাম জাদিপাই যাবার ইচ্ছা । আমি সরাসরি বলে ফেললাম জাদিপাই যাবি তো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা অনেক। তার মানে ত্লবং এ অনেক সময় পার করেছি, মধ্যাহ্ন হতে চলে। এখান থেকে থাইক্যাং কাছেই বেশি সময় লাগবে না আবার বাকত্লাইল দিনে দিনে যেতেও পারবো না। কি আর করা ঘুর পথে আবার কেও.ডং। লাভের মাঝে কেও.ডং ফলস দূর থেকে দেখা। সানসং পাড়ায় আম, ডাব আর নাম জানা কিছু ফল খাওয়া। পোনে চারটা নাগাদ আমরা জাদিপাই পারায় । কেও.ডং এর পাসিং পাড়ার শেষ মাথা থেকেই নিচেই যে পাড়াটা দেখা যায় সেটাই জাদিপাই পাড়া। রোদ হাওয়া নিয়ে ভাল সময় কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ কেও.ডং মাথার উপর কালো মেঘের ঘনঘটা জাদিপাই ফলসের দিক থেকে দেখতে দেখতে বৃষ্টি দৌড়ে শব্দ করে আসতে লাগল। মুহূর্তের মাঝেই বদলে গেল সব। অঝর ধারায় বৃষ্টি পরছে তো পরছেই। ঘড়িতে পাঁচটা পার হয়ে গেল তবু আমি আশা ছাড়লাম না এখনও সময় আছে বৃষ্টি কিছুটা কমলেই যাব কিন্তু সে আসায় গুড়েবালি। অগত্যা খান দাদার কটেছে আরও একবার রাত্রি যাপন। বেশ ভাল লোক যে যায়গায় বাসাটা করেছেন সেটাও চমৎকার। এর আগেও একবার এখানে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। আমি অপেক্ষা করে থাকলাম বৃষ্টি কিছুটা কমবে কিন্তু যখন সে থামল তখন সন্ধ্যে ৬. ৩০টা। আমি এতক্ষণে আমার জংলী বুট খুলে অপেক্ষার পালা শেষ করলাম। শেষ বেলায় একটু রোদ উকিঁ দিল পশ্চিম আকাশে। মায়াবি একটা লাল আভা কেও.ডং এর উপর। খান দাদার কটেজের বেঞ্চে বসে আলো আধাঁরি দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে আসল।
রাতটা পার করে ভোরেই জাদিপাইয়ের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করি। এ রাস্তা আমাদের চেনা। খান দাদার কটেজের পাশ ঘেসে খাড়া যে রাস্তাটা নেমে গেছে সেটা ধরেই। ভোর থাকায় আর বৃষ্টিতে রাস্তা বেশ পিচ্ছিল। আমরা ৪০ মিনিটেই জাদিপাইয়ের কাছে। এত সকালে পৌছে গেলাম ঘড়িতে তখন সকাল ৬.৩৫টা। এ পথে জোকের বেশ উপদ্রব আছে্ । যদি আমি জোক নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনা। জাদিপাইয়ে অনেকটা সময় পার করে আমাদের স্থানীয় সঙ্গী লালহোম বম এর কাছ থেকে কিছু রেসিপি ও তার অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে শুনতে গাড়ি রাস্তা ধরে আবার ফিরে আসি পাড়ায়। ফিরতে সময় লাগল ৫৫ মিনিটের মত। ভাত খেতে মন চাইল। আমাদের গাইড ক্ষেত্র ভাত না খেলে সে হাটতে পারবে না। ক্ষেত্র এক বিচিত্র মানুষ। আমাদের পূর্ব পরিচিত। বাজে অভ্যাস আছে… পাহড়ি চু ছাড়া তাকে কখনও হাটতে দেখি নাই। ধমক, বকা-ঝকা, অনুরোধ সব করা হয়েছে কিন্তু তার সেটা লাগবেই। যাক সে কথা । এই শরাবি গাইড আমার বেশ কবার বান্দরবান যাত্রায় সঙ্গী হয়েছে। বর্ষাকাল বাঁশ কেরুলের মওসুম। বাঁশ কেরুল ভাজি আর ডাল দিয়ে নাস্তা সেরে বাকত্লাইয়ের পথ ধরি। পাসিং পাড়ার শেষ সিমানায় যেখানে স্কুল ও হোস্টেল গুলো সেখানটা পার হয়ে পাড়ার সীমানা বেড়া অতিক্রম করে থাইক্যাং পাড়ার মোড় পার হয়ে সুজা গাড়ির রাস্তা ধরে এগুতে হবে। এ রাস্তা আমি ও আমার সঙ্গী বেশ কবার অতিক্রম করেছি। থাইক্যাং পাড়ার রাস্তাটা বাম পাশে রেখে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেলে হাতের ডান দিকে একটা গাছ আছে বকুল ফুলের গাছের মত, আমার নাম জানা নেই। গাছটির পাশ দিয়ে সরু একটা পথ কেও.ডং এর লেজের পেট ধরে নিচে নেমে গেছে। এটি ধরে এগিয়ে চললেই বাকত্লাইয়ের রাস্তায় যাওয়া যাবে। রাস্তাটা পাহাড়ের পেট ঘেসে আর বাম পাশে খাড়া ঢাল এবং ডানে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের দেয়াল। ঝোপ জঙ্গল প্রথম দিকে এতটা নেই। এর আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এ রাস্তায় বেশ ঝোপ ঝাড় ছিল। বেশ কিছু দুর এগিয়ে যাবার পর কিছুটা উঠা নাম করে বেশ কটা পাহাড়ি খাড়াই পার করলেই ভয়ঙ্কর ক্যাপিটাল। ভংঙ্কর এ জন্য যে এ পথটা যেমন সরু সেরকমই খাড়া ঢাল আর স্যাঁতস্যাঁতে ও ঝোপ ঝাড়ে ভরা। আর জোকের জন্য বিখ্যাত এই ট্রেলটি। ক্যাপিটালের খাড়া ঢাল কে কখনও বামে কখনও ডানে রেখে এগিয়ে চলছি এমন সময়ই মরার উপর খাড়ার ঘা। বৃষ্টি শুরু হবার আর সময় অসময় নেই। শ্রাবণের বৃষ্টি তো কাউকে বলে কয়ে আসে না। আমাদের সাথে পথে আরও একটা সাত জনের দল যোগ দিয়েছিল। আমরা যখন ক্যাপিটালের ঠিক মাঝামাঝি তখনই বৃষ্টি। আমি ছবি তুলতে তুলতে আয়েসি ভাবে সবার পিছনে ছিলাম। বৃষ্টির আয়োজন দেখেই দ্রুত পা চালাতে হল। কারণ বৃষ্টি হলেই জোকেদের উৎসব। আর এই পথে মহাউৎসব।
ক্যাপিটাল ধরে এগুতে থাকলে এমন সব পাহাড়ি বাঁক আসবে যেখানে মনে হয় কখনও সূর্যের আলো পরে না। এর মাঝে তৃতীয়টি একটু বেশি ভয়ঙ্কর। শেষ প্রান্তটিতে মাটিতে খাজ কাটা সিঁড়ি যাতে পায়ের অর্ধেক অংশ রাখতে পারবেন আর ডান পাশটা ঘন বাঁশঝাড় আর বড়বড় গাছের জঙ্গল, তার উপর খাড়া নিচে নেমে গেছে খাদটি। এ রকম তিনটি বাঁক পার হলে মোটামুটি একটা নিরাপদ অপেক্ষাকৃত কম খাড়া ঢাল চলে আসে। প্রথম বাঁকটির নিচ থেকে উপরে উঠার সময় মেঘের ঘনঘটা শুরু আর বাঁকটি ধরে কিছুটা উপরে উঠে আবার নিচে নেমে যেতে যেতে বৃষ্টির আলিঙ্গন। আমার সামনের অভিযাত্রিদের হঠাৎ নাচার শখ হল কেন? বুঝতেই পারছেন জোকের অ্যামবুশ আক্রমণে পরেছে সবাই। হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে জোক সারাতে ব্যাস্ত। এ কাজটাই মস্তবড় ভুল। কারণ আপনি একটি ছাড়াতে যেয়ে আরও দশটিকে সুযোগ করে দেবেন। পিছন থেকে আমি থামতে নিষেদ করি এবং বলি চলতে চলতে জোক গুলো ছাড়ানোর চেষ্টা করুন। কিন্তু লাভ হল না, ক্যাপিটালের পেট এই মানুষ গুলো হাত-পা ছুড়ে বৃথা চেষ্টা করেই চলেছে। একজনের অবস্থা মারাত্মক হাত পা আর ঘার এ কম করে হলেও গোটা পঞ্চাশেক জোক। আমি আমার পায়ের দিকে নজর দিয়ে দেখি আমার অবস্থাও খারাপ। দু পা মিলিয়ে পনের বিশেক জোক চেষ্টা করছে জংলী বুটের ফাঁক গলে যায়গা করা যায় কিনা আর গোটা পাঁচেক হাঁটুর উপরে চলে এসেছে। আমি চলতে চলতেই হাত দিয়ে ওগুলোকে সরিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। পিছন ফিরে ওদের শেষ বারের মত না দাঁড়িয়ে চলতে বলে নিজের পথ এগিয়ে যাই। জোক ধরবেই এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার আর বর্ষাকালে এধরনের রাস্তায় এর পরিমাণও থাকে বেশি। তাই আপনাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে আগেই। ঝোপ ও স্যাঁতস্যাঁতে যায়গা গুলোতে বেশি সাবধান থাকা। যাহোক আমি আমার সঙ্গীকে অবাক করে দিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালাম, যে আমার থেকে বেশ কিছুটা রাস্তা এগিয়ে ছিল । অন্য সবাই আমাদের পিছনে পরে গেল। ওদেরে সঙ্গে গাইড আছে তাই তিন মিনিটের একটা ছোট বিশ্রাম নিয়ে দ্রুত ছুটে চললাম বাকত্লাইল পাড়ার দিকে। ছোট ছোট চড়াই উৎরাই পার হয়ে যখন জুম খেতের দেখা পেলাম তখন বুঝলাম পাড়া আর বেশি দূরে না এখান থেকে চল্লিশ মিনিটের মত পথ। যেতে যেতে হাতের ডানে জুমের রাস্তাটা পাশে রেখে সামনে এগিয়ে চলেছি। ডানের রাস্তা ধরেই বাকত্লাইয়ের নিচে নেমে যাবার রাস্তা। সে গল্প একটু পরে বলছি। এক নজর পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ কিছু জোক এখনও আছে। যা হোক একদম পাড়াতে গিয়ে তারপর দেখা যাবে। বৃষ্টি থামার নামগন্ধও নেই। অবশেষে ছোট একটা ঝিরি পার হয়ে সোজা উপরের দিকে জুমের রাস্তা আর অল্প ডানে মোড় নিয়ে কাঁদাময় রাস্তাটা ধরে উঠে গেলেই পর্বত কন্যা বাকত্লাই। বাকত্লাইয়ের মাথা কাটা গাছটা সেরকমই আছে ডানের যায়গাটা বেশ খালি ছিল এখন অনেক গুলো নতুন ঘর আর বিশ্রাম বৃক্ষটির নিচের বেঞ্চটি এখনও একটু বসার জন্য আহ্বান করে। এই মায়াবি আহবানকে উপেক্ষা করে লাখলেইনের ঘরের দিকে পা বাড়াই। বাকত্লাই এবার নিয়ে তৃতীয় বার যাওয়া। যত বার গেছি বা যাব লাখলেইন এর ঘর আমাদের সেরা আশ্রয়। মিনিট বিশ পর আমাদের গাইড ক্ষেত্র হাজির। আমি চোখের ইশারায় কি অবস্থা জিজ্ঞাসা করে কাছে আসতে বলি। বুট খুলছি, বাঁ পায়ের টা খুলতেই বুট মোজার ফাঁকে ছোট বড় ছটি জোক। আমি চাকু নিয়ে বুট ও মোজা থেকে জোকগুলোকে ফালছিলাম আর ক্ষেত্রকে গুল দিয়ে জোকগুলোকে মারতে বলি। এগারোটা জোক ক্যাপিটাল থেকে বাকত্লাই ভ্রমন করে ফেলেছে। এত কিছুর পরও আমি অক্ষত। তাহলে আমার পরিকল্পনা ও প্রটেকশন সঠিক ছিল ?
কাপড় ছেড়ে বৃষ্টির মাঝেই গোসল করতে চলে গেলাম। এখন বেশ ভাল ব্যবস্থা হয়েছে, ঝর্নার পানি পাইপ দিয়ে নিয়ে এসে কলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গোসলখানাও আছে। বাকত্লাইয়েও দিন বদলের হাওয়া….ভাল কিন্তু আফসুস ! ঝিরির গোসলটা এখন মিস করি।
বাকত্লাইয়ের আকাশে শেষ বিকেলে সূর্যের দেখা পাওয়া গেল তাও মিনিট বিশের জন্য। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ও পরিকল্পিত পাহাড়ি গ্রাম বাকত্লাই । চমৎকার একটা ফুটবল মাঠ আছে। পুরো পাড়াটাই সমতল; মনে হবে পাহাড়ের শীর্ষ দেশ কেটে তার উপর তৈরি করেছে। দু পাশে সারিবদ্ধ ঘর, কেবল পাড়ার মাঝখানটাতে একটা প্রার্থনা গৃহ। অন্ধাকার নেমে এলে ঢোলের মৃত আঘাত আর প্রার্থনা গীত অন্যরকম একটা আবহ তৈরি করে। মাদলের মত কিন্তু মিষ্টি একটা আওয়াজ সেই সাথে বমদের ভায়ায় কোরাস সংগীত; যীশুর মায়াবী শ্মশ্রুশোভিত ঈশ্বরীয় চেহারাটা ভেসে উঠে মানস পটে। খানিকটা কষ্টও হয় নিজদের আদি বিশ্বাসরীতি ত্যাগ করতে হয়েছে ওদের। আদিবাসী বম জনগোষ্ঠী এককালে জড়োপাসক ছিল। জড়োপাসক বমদের মাঝে ভূত-প্রেত, ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্র, ওঝা-বৈদ্য, জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি বিশ্বাস ছিল । বমরা খুজিং-পাথিয়ানকে বিধাতা পুরুষ মানে। আমাদের স্রষ্টার মতও তাঁর অনেক গুণাবলী আছে যেমন : তিনি সকলের স্রষ্টা, কখনো রুষ্ট হন না, সদা কল্যাণময়ী। তাই তাঁর জন্য পুজা, যজ্ঞ কিছু করতেও হয় না কেননা তিনি কারও অমঙ্গল করেন না। আহারে!পৃথিবীর জন্য এরকম একটা সর্বজনীন ঈশ্বরই তো দরকার ছিল…..। বমদের যত পূজা অর্চনা, যজ্ঞ বলিদান সব অপদেবতার নামে। এদের পুরোহিতের উপাধি ‘বলপু’। বমরা ১৯১৮ সাল হতে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে। ব্রিটিশ লেখকরা বমদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন যেমন : বনজো, বনযোগী, বুনজোস। বাকত্লাই বা বাক ত্ লাই পার দা মৌজার বর্তমান রেমাক্রি প্রাংশা ইউনিয়নের রুমা উপজেলায় অবস্থিত। থানচি যখন ইউনিয়ন ছিল তখন তার অধিনস্ত ছিল বাকত্লাই। থানচির সাথে অপেক্ষাকৃত যোগাযোগও সহজ।
সন্ধ্যানামার সাথে সাথেই অন্ধকার জেকে বসল । চাঁদের তো সবে শুরু। হিম শীতল একটা মৃদু হাওয়া বইছে আর সোলার বাতির টিমটিমে আলোয় সমস্ত পাড়া ভিন্ন রকম নিরবতায় ডুবে গেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর তার সাথে কোয়াশার মত মেঘ চারদিকে ঘিরে ধরেছে। লাখলেইনের ছোট বারন্দায় আমি ও আমার সঙ্গী বসে বসে আলো আধারির এই মেঘ-মেঘ খেলা উপভোগ করতে করতে রাত অনেক হয়ে যায়। লাখলেইনের পরিবার ঘুমের রাজ্যে, কেবল তার স্ত্রী এখনও ঘরে আসেননি, কোন এক কাজে পড়শির বাড়ি গেছেন। মুরগ পোড়া আর ঝাল ঝোল ও নাম না জানা একটা শাক জাতীয় সবজী দিয়ে রাতের খাবার পর্বটা শেষ করে ফিরে আসি বারান্দায়। রাত অনেক হয়েছে দিদি (লাখলেইনের স্ত্রী) ঘরে ফিরে সব দেখে ঠিকঠাক করে ঘুমোতে চলে গেছেন। মেঘ-বৃষ্টিও নেই। সঙ্গীকে ঘড়ি দেখতে বলি, সে জানায় সাড়ে দশ টা। বারান্দা থেকে ছোট কাঠের সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসি। সমস্ত পাড়ায় কবর নিরবতা, কেবল বাতাসের সাথে রাতের নিজস্ব একটা শব্দ। হাঁটতে হাঁটতে মাঠের কাছে এসে দাঁড়াই। সামনে ঘোরলাগা গা ছমছম করা অন্ধকারে ডুবে গেছে মাঠটি। চারপাশে সুনশান নিরবতার মাঝে পাহাড়গুলো অপার্থিব সৌন্দর্যের মায়াযাদুর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। হঠাৎ পাহাড়ের সাথে সাথে চোখ রাখি আকাশে…। নির্বাক প্রস্তর মূর্তির মত কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম দু’জনে বলতে পারবো না। আকাশ জুড়ে তারার মিছিল। রেমাক্রির জলের মতই তারার মিছিলটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে বাকত্লাইয়ের বুক বরাবর সুয়ে আছে। সে দেখবার মতই একটা নেশাগ্রস্ত দৃশ্য। আমার এখান থেকে শুক্লা দ্বাদশির চাঁদ দেখার অভিজ্ঞতা আছে । আজ বিপরীত দৃশ্যপট অন্য রকম কাব্য শুনিয়ে গেল।
বেশ ভাল একটা ঘুম দিয়ে সকাল সকাল জেগে উঠি। আকাশে মেঘ করে আছে… বৃষ্টি তুমি যখন তখন ঝরে পরতে পার… এই অবস্থা। আগেই কথা ছিল লাখলেইন দার সাথেই চলে যাব বাকত্লাই ফলস্ এ। তার জুম ক্ষেতের পাশেই জলপ্রপাতটি। পাড়া থেকে আবারও ক্যাপিটালের দিকে যেতে হবে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মিনিটের পথ। হাঁটতে হাঁটতে জুম ক্ষেতের কাছে চলে আসি। এই জুমের পাশ দিয়ে ছোট একটা নালার মত বয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে। এই নালার হাঁটু পানি ভেঙে দশ মিনিটের পথ বাকত্লাই ফলসের উপরের অংশ। কি আর করা আমাকে জংলী বুট খুলে খালি পায়েই নেমে যেতে হল। পানিতে স্রোত আছে সেই সাথে কিছুটা কাদাময় তলদেশ পার হলেই পাথুরে জমি পায়ের নিচে ঠেকবে। দু মিটাররে মত একটা ছোট ফলস্ পার হয়ে আবার সামনে এগিয়ে কিছুটা ডান বাম করে মোড় নিলে সুড়ুঙ্গের মত দূরে আকাশের দেখা পাবেন। কারণ এ যায়গাটায় দু পাশেই খাড়া পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। বিশালকায় একটা গাছ এপাশ থেকে ওপাশে ৪৫ ডিগ্রী কোণ করে সুয়ে আছে। গাছটির নিচ দিয়ে জলের রাস্তা ধরে ওপাশে বিশ কদম গেলই জলের শব্দের তীব্রতা আর দূরে পায়ের নীচে ঘন সবুজ অরণ্যের উপর মেঘ দেখে সহজেই বুঝতে পারবেন… পথিক তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে? বাকত্লাইয়ের জল যেখান থেকে নিচে নেম যাচ্ছে সে অংশটা বেশ ঢালু ।বাম দিক দিয়ে জলের মূল ধারাটা নিচে নেমে যাচ্ছে। ডান দিকের ঝোপ পরিস্কার করে একদম মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এ যায়গায় সাহস করে না দাঁড়ালে বুঝতেই পারবেনা কি খেলা খেলে চলেছে বাকত্লাই। উপর থেকে দেখে মনে হয় রূপার পুঁথির বৃষ্টি হচ্ছে আর আপনি মেঘের উপর বসে তা দেখছেন। সবুজ অরণ্যের মাঝে শুভ্র সিঁদুর দিয়েছে প্রকৃতি। তবে এর জন্য নিতে হবে মারাত্নক একটা ঝুঁকি। সাথে রশি বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকলে এ ভুল করবেন না। জল ভেজা পিচ্ছিল ঐ অংশে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাই বেশি। বাকত্লাইয়ের মুখে থাকতে থাকতেই বৃষ্টির শুরু। আরও কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিল বিশেষ করে কিছুটা পিছনে এসে হেলানো গাছটি পার হলে বেশ কিছু পাথর আছে যেখানে বসে অন্য রকম একটা অনুভুতি নেয়া যায়। যা ভাষাতীত। ঝিরি পথ ধরে ফিরে আসতে না আসতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হল। কাছে ছোট একটা ঝুম ঘর আছে যারা এ রাস্তা ধরে কেও.ডং থেকে পাড়ার দিকে যাবেন সবার নজরেই পরবে। এই জুম ক্ষেতটির ওপাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরেই বাকত্লাইয়ের নিচে যাবার রাস্তা। চারদিক ঘোলা করে বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই । জুম ঘরে বসে আছি। অলস সময় আর লাখলেইনের কাছ থেকে তাদের শিকার কাহিনী শুনছি। গত বছর বড় একটা হরিণ শিকার করেছিল। বাংলাদেশ মায়ানমারের সীমানায় মোদক রেঞ্জে। বনছাগল, বনবিড়াল, সজারু ইত্যাদিও আছে তার শিকারের তালিকায়। বাকত্লাইয়ের নিচেও গহিন অরণ্য আছে, এখনও কালো ভালুক জুম ক্ষেতের কচি ভূট্টা খেতে আসে। বৃষ্টি কমতে কমতে আবার বড়ে যায়। অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না। সময়ও নেই, আজ সিমলাম্পি হয়ে থানদুই পাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। যদিও রাস্তার অবস্থা আর বৃষ্টি একটা শঙ্কা তৈরি করেছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে অবশেষে বৃষ্টির ভিতরেই এগিয়ে যাই বাকত্লাইয়ের নিচের দিকে। জুম ক্ষেতের পাশ ধরেই কিছুটা এগিয়ে গেলে তারপর আবার জুম ক্ষেত তারপর কিছুটা জঙ্গল পার হয়ে নিচে নেমে যেতে হবে। আরেকটু গেলে খাড়া নিচে নেমে যাওয়ার যে রাস্তাট ছিল সেখানটায় ধস নেমেছে। প্রায় নব্বই ডিগ্রীর মতই খাড়া হবে। উপরে দাড়িয়ে নিচে তাকালে বুক তড়াক করে উঠবে। এপথেই নামতে হবে। জুমীরা চিকন বাঁশ মাটিতে পুঁতে বাকঁনো রেলিংয়ের মত তৈরি করেছে। ঝুরঝুরে মাটি আবার বৃষ্টির জন্য কাদায় পা পিছলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। হলও তাই, তাতে কি! যেতে হবেই। ধসটির নিচে নেমে বাঁ পাশ ধরে ধসে ভেঙে পরা বাঁশঝারটির পাশ ঘেসে একটু নিচে নেমে গেইল চোখে আসবে জুম ক্ষেত। চোখ বাম থেকে ডানে সরে গেলেই দূর থেকে দেখা যায় মাটির বুক চিরে বাকত্লাইয়ের জলের লম্ফঝম্ফ। একটু নিচেই আরও একটা বেশ বড়সর জুম ঘর। এটা লাখলেইনের বাবার ঘর। জুম গুলো পার হয়ে একটু নিচে নেমে গেলেই সেই মায়াবি বনের শুরু। প্রথাগত কোন রাস্তা নেই তাই লাখলেইন আর আমি দুজনেই ঝোপ কাটতে কাটতে এগিয়ে যাচ্ছি। এই পথের জোকের কথা আর নাইবা বলি। যত ব্যবস্থাই নিন দু একটা কামড় সহ্য করতেই হবে। ঘন বাঁশঝার আর লতার জন্য কখনও দাড়িয়ে কখনও বসে পড়ে ঝোপ পরিস্কার করতে করতে খাড়া নিচে নামতে হবে। বেশ কিছু কালো পাথর আছে যে গুলোর গা বেয়ে নিচে নামতে হবে। প্রায় চল্লিশ মিনিটের মত আমরা তিন জন খাড়া পিচ্ছিল এই জঙ্গলময় পথ অতিক্রম করার পর জলের শব্দ পাই। লাখলেইন জানাল প্রায় এসে গেছি। এই জঙ্গলটি বিভিন্ন দিক দিয়ে নামা যায়। বর্ষাকাল তাই প্রথাগত রাস্তাটির আর কোন চিহ্ন নেই। আরও খানিকক্ষণ খাড়া ঝোপজঙ্গল মাড়িয়ে নেমে আসলেই ফলসের বোল্ডার গুলো নজরে আসবে। তার পাশ দিয়ে ঠিক মাঝ বরাবর একটা বড় পাথরের উপরে উঠে দু’হাত উঁচু করে...এই তো এসে গেছি……। আমার পিছন পিছন আমার সঙ্গীয় পাথরটাতে উঠে আসে। এই পাথরটি থেকেই বাকত্লাইয়ের সবচেয়ে সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। নীচ থেকে, উপর থেকে বা প্রথম স্টেপ থেকে যেখান থেকেই বলুন আমার মনে হয়েছে এটাই হচ্ছে বাকত্লাই ফলস দেখার বেস্ট পজিশন। আপনার মনে হবে শত শত ( আনুমানিক ৫০০) ফুট উপর থেকে পানি ঝাপিয়ে পরে আপনার শিরা-উপশিরা হয়ে জলকেলী খেলা খেলে ছন্দ্য তুলে পা ছুঁয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। নিচের ভিউটিও অসাধারণ। বর্ষাকালে পাগলপারা জলের ধারা আর সেই সাথে অবিরাম শ্রাবণের বৃষ্টির জল বাকত্লাইয়ের যৌবণকে উন্মত্ত করে তুলেছে। এমনিতে এই ফলসে এত জল থাকে না। বাকত্লাইয়ের এই রূপ দেখে পথের ক্লান্তি ভুলে যাবেন । ফেরার কথাও ভুলে গেলাম, সব যাক জলে এখানেই কাটাই না কিছুটা সময়…….। এরমাঝেই বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে আবারও সেই পথ ধরি। ফেরার পথে লাখলেইন বাঁশ কেরুল সংগ্রহ করতে লাগল। পথে নামর সময় যে পাথর বেয়ে নিচে গিয়েছিলাম এটা এখন বেশ উচুঁ মনে হল। পাথরটা এরিয়ে যাবার চেয়ে পার হয়ে যাওয়াই ভাল মনে হল এতে অনেকটা পথ ও সময় আর জোপ পরিস্কারের ঝামেলা কমবে। আমার সঙ্গীকে ঠেলে উপরে উঠিয়ে দিলাম তারপর সে আমার হাত ধরে টেনে তুলল। জঙ্গলময় পথটা এবার দ্রুতই শেষ করে উপরে উঠতে উঠতে যখন জুমের দেখা পেলাম একটা প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল। জুম ক্ষেতের দুটো পাহাড় মাঝ বরাবর নষ্ট না করে চলে আসি সেই জুম ঘরটাতে। পিছন ফিরে দেখলাম আবার বাকত্লাই ফলসকে। অল্প কিছুক্ষণ পর লাখলেইন আসে। চা’র কেটলির দিকে দৃষ্টি পরতেই লাখলেইন বলল..দাদা চা খাবে….। এই বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডায় এক কাপ চা তো সোনায় সোহাগা….। জুম ঘরটার তিন দিক খোলা ও বেশ বড়সর। লাখলেইন জুম ঘরের নিচে আগুন জ্বেলে চা বসাল…আমরা জুম ঘরের বাঁশের মেঝেতে গা এলিয়ে বাকত্লাইয়ের দিকে তাকিয়ে….। টিনের কাপে চা খেতে খেতে আবার বৃষ্টি। এরমাঝেই লাখলেইন তার জুম ক্ষেত দেখতে চলে যায়। আমাদের কাছে সময় থমকে গেল…যত দূর চোখ যায় নিচে ঘন জঙ্গল আর একপাশে ফলস। পাহাড়ের ঢালে জুম ঘরটার চার ধারেই জুমের মায়াবি সবুজ। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারলাম পাহাড়ের সঙ্গী জোক আমাকে এবার পেয়েছে। বাম থাইয়ে..। বুট , ট্রাওজার, গেঞ্জি খুলে ভাল করেদেখে নিলাম আরও কোথাও আছে কিনা। তারপর রোমাল দিয়ে ভাল করে যায়গাটা বেঁধে রাখলাম রক্তপরা থামার জন্য। আমার সঙ্গী ও লাখলেই তিন জনই কম বেশি আক্রান্ত হয়েছে। যাই হোক এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা, এরকম বহুবার হয়েছে….।
পাড়ায় ফিরে আসার পর সে কি বৃষ্টি সেই সাথে পাগলা হাওয়া। চলল সন্ধ্যে পর্যন্ত। চারটায় পাড়ায় ফিরে ঘর বন্দী হয়েই থাকতে হল। জুম ঘরে থাকতেই আবহাওয়া, সময় ও রাস্তার অবস্থা বিবেচনা করে সাকা যাবার প্ল্যানটার বাতিল হবার শঙ্কা বাড়তে থাকে। লোক পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেল। একে তো জুমের মৌসুম তার উপর বৃষ্টি ঐ পথে কেউ রাজি হচ্ছে না। হয়তো সিম্পলাম্পি থেকে লোক পাওয়া যেতে পারে আর যদি না পাই? সন্ধ্যার পর বিষাদ আর হতাশা নিয়ে দু জনেই মোদক তং যাত্রা বাতিল করি। বৃষ্টি তখনও চলছে। কষ্ট হলেও এরকম হয়…। এটাই মেনে নিতে হয়। যাহোক থানচি ফিরে যাবো আমি সিম্পলাম্পি হয়ে তাজিংডং তারপর শেরকর পাড়া হয়ে বর্ডিং পাড়া তারপর থানচি এই পথটি যেমন দীর্ঘ সেরকম সময়ও লাগবে অনেক। তারচেয়ে নতুন একটা রাস্তায় যাওয়া ভাল তাই কাইথন ঝিরি ধরে কাইথন পাড়া হয়ে বর্ডিংপাড়া তার পর তো একই রাস্তা এতে সময়, পথ কমবে আর কাইথন ঝিরির থ্রিলটাও নেয়া যাবে। আমার গাইড এই পথটা চিনে না তাই গড়িমসি শুরু করে আমি অনড় থাকি। গাইড কেবল নিতে হয় বলে নেয়া ক্ষেত্রকে জানিয়ে দিলাম তুমি না যেতে চাইলে ঐ দিক দিয়ে আস থানচিতে দেখা হবে। রাতটা বৃষ্টি আর দমকা খাওয়ায় পার করে একটু দেরীতে বিছানা ছাড়ি। সব ঠিকঠাক করে যখন বের হচ্ছি তখন ক্ষেত্রও হাজির সেও এ পথে যেতে রাজি।
পাড়ার ফুটবল মাঠের পশ্চিম দিকে নেমে কিছু দূর এগিয়ে গেলেই কাইথন ঝিরির পথটা । সকালটা ছিল অদ্ভুত, সারা পাড়া মেঘে ঢাকা। মাঠের পাশ দিয়ে যখন নিচে নেমে যাচ্ছি তখন তিন হাত দূরেও আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। রাস্তাও বেশ পিচ্ছিল। পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসতে লাগলাম। লাখলেইন আমাদের কাইথনের রাস্তাটা দেখিয়ে দিবে। নিচে নেমে এসে কিছু হাঁটার পর লাখলেইন বিদায় নিল আর বলে দিল এই পথে সামনে গেলই কাইথন ঝিরি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় কাইথন ঝিরির সামনে। গত রাতের অবিরাম বৃষ্টি আর এখনও টিপ টিপ বৃষ্টি এসব মিলিয়ে কাইথনে বেশ পানি । ক্ষেত্র বলল অপেক্ষা করি ঢল কমলে তারপর পার হওয়া যাবে। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমার বন্ধু সঙ্গীর দিকে চোখ রাখতেই বুঝতে পারলাম সে রাজি এই ঝুঁকিটা নিতে। আত্মবিশ্বাস আর সাহস নিয়ে পা রাখলাম কাইথনের পানিতে। বেশ স্রোত..পানিও হাঁটু থেকে কোমার ছুঁই ছুঁই। মাঝখানটাতে আসতেই বুঝতে পারলাম কাজ বেশ কঠিন হবে পিঠে ব্যাকপ্যাক, ক্যামেরা আর সেই সাথে আমি জংলী বুট পরা। পানিতে ভিজে বুট ওজনে দ্বিগুন হয়ে যায়। শরীরের তাপ শুষে নেয় তাই ক্লান্তিও আসে দ্রুত। বেশ কবার এপাশ ওপাশ করে পার হতে হবে ঝিরিটি তা জানাই ছিল। কিন্তু এত দেখছি পাঁচ কদম পর পর, মানে প্রতি বাঁকে বাঁকে পার হতে হচ্ছে কাইথন। এরকম দশ বার বার পার হবার পর দেখি পানি কিছুটা কমে এসেছে এবং বৃষ্টিও থেমেছে। কাইথন ডান বাম করতে করতে যত এগিয়ে যাচ্ছি রাস্তাও তত গুলমেলে হচ্ছে। কাইথন এত একেবেঁকে চলেছে যে হাটার ট্রেইলটা বুঝা বেশ মুশকিল। তার উপর ঝিরির পানি ও অবস্থা বুঝে আগ পিছ করে পার হতে হয়। কাইথন কোন কোন যায়গায় বেশ প্রশস্থ। আনুমানিক চল্লিশ থেকে ষাট ফিট হয়ে গেছে এই মৌসুমে। তাই কখনও কখনও গোলকধাঁধার মত ওপারের রাস্তাটা বুঝা যায়না। সেই সাথে বর্ষায় জন্ম নেয়া শন আর মৌসুমি জলার জঙ্গল । কখনও কখনও দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ভয়ঙ্কর বাঁক নিয়েছে সেখানে স্রোত ও জলের পরিমাণ দু’টোই তীব্র ও বেশি। এই পথে আপনাকে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসতে পারে। কিন্তু মনসংযোগ হারানো যাবে না। ঝিরি পথে এমনিতেই বেশি সাবধান থাকতে হয়। পাথর, পানি, স্রোত আর এবড়োতেবড়ো রাস্তা এসব কিছু মাথায় রেখে তারপর চলতে হয়। এরকম কত বার পার হতে হবে তা গুণে রাখতে পারবে না। নতুন রাস্তা বলেও কথা। শেষবারের মত যখন কাইথন পার হয়ে উপরে উঠা শুরু করি তখন বুঝতে পারলাম পাড়া কাছেই হবে। আর একটু সামনে যাবার পর জোপ ঝারের জঙ্গল পার হয়ে এগিয়ে গেলেই মুরং পাড়া পরে যার নাম ওলাং পাড়া। এটা কাইথন পাড়ার বর্ধিত অংশ। একটু বিশ্রাম নেবার জন্য একটা দোকানের খুঁজ করে ব্যর্থ হয়ে এগিয়ে যাই। ওলাং পাড়া ও কাইথন পাড়াকে কাইথন ঝিরি দু’ভাগে ভাগ করেছে। আবারও কাইথন পার হয়ে পাড়ায় ঢুকি। পাড়া জুড়ে নিরবতা। সবাই জুমের কাজে ব্যস্ত। কাইথন বেশ বড় পাড়া আমরা পাড়ায় না দাড়িয়ে বর্ডিং পাড়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই।
চলতে চলতে একটা যায়গায় এসে আটকে গেলাম। রাস্তার কোন চিহ্ন পাচ্ছি না। একটু উপরে উঠে ঝিরির পাশ ধরে এক বার ডান বাম করে একটু নিচে নেমে ঝিরিতে চরের মত নূড়ি পাথের একটা অংশ পার হয়ে এগিয়ে গেলেই সামনে খাড়া পাহাড়ের মাঝ দিয়ে কাইথন ইংরেজি এল আকার ধারণ করেছে। যে যায়গায় এল এর মত বাঁক ঠিক সেখানেই খাড়া দু’টো পাহাড় এমন ভাবে দাঁড়িয়ে যে, রাস্তা কোন দিকে বুঝে উঠা মুসকিল। আমাদের সামনে দু’টো পথ খোলা। হয় ঝিরি ধরে প্রথমে খাড়া ওপাশের পাহাড়ের গোড়ায় তার পর তার গা ধরে পানি দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমরা যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখান থেকে বাঁকের ওপাশে কি আছে তা বুঝতে পারছি না । আর এযায়গার পানি বুক পর্যন্ত তো হবেই। গভীর বলেই পানি শান্তভাবে এপাশের পাহাড়টার গায়ে জোড়ে ধাক্কা খেয়ে ডানে চলে যাচ্ছে। বাম পাশে তিনটা পুরনো ট্রেইল । এগুলো ধরে আমার সঙ্গী ও গাইড শেষ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। তারমানে আমরা পথ ভুল করেছি। আমার ধারণা যে পরিমাণ পথ আমরা পার করে এসেছি সে অনুযায়ি বর্ডিং পাড়া খুব একটা দূরে হবার কথা নয়। আমার সঙ্গী বলল পথ থাকলে তা এই ঝিরি পার হতে হবে। আমারও ধারণা এরকম। তারপরও জায়গাটার দিকে তাকিয়ে মনে হল এত পানি পার হয়ে কেউ যাবার কথা না। খাড়া পাহাড় দু;টোর বাঁকটাতে জলের পরিমাণ আশপাশে জলের দাগ যে পর্যন্ত আছে তার চেয়েও উপর দিয়ে জল বইছে । এ পাশ থেকে বাঁকের ওপাশের ভুমিও দেখা যায়না শুধু জল বাঁক নিয়ে ডানে চলে গেছে। রাস্তায় কারো দেখাও পেলাম না। কি করব..মিনিট দশ বিশ্রাম নিয়ে কিছুটা পথ ফিরে যাব বলে ঠিক করি। যেমন চিন্তা তেমন কাজ কিছু দূর যাবার পর কাইথনের পার ধরে নূড়ির চরের মত যায়গাটা আবার দেখে মনে হল আমরা মনে হয় ভুল করছি। সঙ্গীর দিকে তাকাতেই সে যা বলল তা আমার মনের কথাই। যাই থাকুক ঝিরি ধরে এগিয়ে যাওয়াই উচিত, প্রয়োজনে সাঁতার পানি হলেই কি। অন্তত বাঁকের ওপাশে কি আছে তা তো জানা হল। এখন গাইড বেঁকে বসল। ঠিক এমন সময় একজনের পায়ের আওয়াজ, আমরা যে পথ ধরে এসেছি সে পথেই। যাক তাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল আমি বর্ডিং পাড়ার লোক। রাস্তা এদিক দিয়েই ঝিরি পার হতে হবে। বাঁকের থেকে কিছুটা উজানে এসে ব্যাকপ্যাক ও ক্যামেরা মাথার উপর নিয়ে বুক পানি ভেঙে প্রথমে ওপাশের পাহাড়ের কালো পাথুরে অংশটার কাছে যেতে হবে তারপর সেখান থেকে পাহাড়টার গা ঘেসে সামনে এগুতে হবে। এখানেও পানি বুক ছুঁইছুঁই। বাঁক ঘুরে বুঝতে পারি আসলে পাহাড়ের এই অংশটা সামনের দিকে নাকের মত বের হয়ে এসেছে। আবার পাহাড়ের গা ঘেসে ঘেসে শুকনায় উঠে এলাম। যতটুকু যায়গা সমতল ও শুকনা সেটা ছোট একটা বালিয়ারির মত। এটাকে পেচিঁয়ে আবার ডান দিকে বাকঁ নিয়েছে কাইথন। তাই পনের/বিশ কদমের বালিয়ারির মত যায়গাটা পার হয়ে আবার কাইথন। আবার পার হয়ে কিছু যাবার পর কাইথন বাঁ দিকে বিশাল পেট নিয়ে বাঁক নিয়েছে। এটাপার হবার পর অনেকটা পথ উচুঁতে উঠতে হয়। এখানেই কাজু বাদামের বাগানের দেখা মেলে। শেষ বারের মত ঝিরি পথ রেখে উপরে উঠে যাবার সময় দেখতে পাওয়া যায় কাইথনের উপর আছরে পরছে একটি ফলস্। বেশ বড়, উচ্চতাও কম নয়। বর্ডিংপাড়া এসে বিশাল বিশ্রাম মাচাটায় সব কিছু রেখে বসে পরি। আর বুট খুলে ফেলি এগুলো আমাকে ঝিরি পথে বেশ যন্ত্রনা দিয়েছে।
সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আকাশ কালো করে ঝড় শুরু হয়ে গেল। আমরা দু;জন জড়োসড় হয়ে গামছামুড়ি দিয়ে সে যায়গাই বসে থাকলাম। সেকি বৃষ্টি আর বাতাস সেই সাথে বজ্রপাত। তান্ডব চলল ঘন্টাখানেকের মত। তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসতে থাকে কিন্তু বৃষ্টিটা থামল না। আমি বুট গুলো পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে দিলাম। রাবার সেন্ডেল পরে বাকি পথটুকু যাব। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরি। পদ্ম ঝিরি পার হয়ে পাড়ার শেষ ঢাল ধরে কিছটা উপরের দিকে উঠতে হবে। এখন এখান থেকে গাড়ির রাস্তাধরেও যাওয়া যায় আবার কমলা বাগানের রাস্তায় যাওয়া যায়। পাড়াতে থাকা অবস্থায় স্থানীয় একজন জানিয়ে ছিল কমলা বাগানের রাস্তায় ধস হয়েছে যাওয়া যাবে না। তারপরও আমি ঐ রাস্তায় যাবার জন্য গো ধরলাম। আমার সঙ্গী ও গাইড গাড়ির রাস্তা ধরে যাবে। আমি তাদের বললাম আকাশে বৃষ্টি তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের থানচি যেতে হবে। গাড়ির রাস্ত ঘুর পথ হবে সময়, শ্রম বেশি থ্রিল কম। অবশেষে তাদের রাজি করিয়ে কমলা বাগান ধরে থানচির পথ ধরি। এ পথের বর্ননা অনেক দেয়া হয়েছে……. । চারটায় আমরা থানচি পৌঁছে যাই। আমাদের দু;ঘন্টা সময় বেঁচে যায়। আবার অধরা থেকে যায় সাকা হাফং….। এবছরই আবার সাকা অভিযানের পরিকলাপনা করে ফেলেছি। এবার প্রথমে সাকা সামিট তারপর অন্য কিছু…..।

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৭:৪৭
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×