somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-সাত)

২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নীলুর দোহার হওয়ার খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। উচ্চ বর্ণের কেউ কেউ নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুললো, বিরক্তও হলো। নীলুর নিজের সম্প্রদায়ের কেউ কেউ বললো, ‘যাক নীলু, এতোদিনে তোর এট্টা গতি অলো।’ কেউ পিঠ চাপড়ে বললো, ‘লাগে থাক, লাগে থাক।’ আবার তাকে নিয়ে নতুন করে ঠাট্টা মশকরা করার লোকেরও অভাব হলো না।

এখন শীতের শেষ। ব্যস্ত সময় কাটছে নীলুর। কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত রামায়ণ পালার ভরা মৌসুম। মাসে পনের-বিশ দিন বিভিন্ন জায়গায় পালা থাকে। ফরিদপুর ছাড়াও রাজবাড়ী, গোপালঞ্জ, মাগুরা, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাদারীপুর, খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল এমন কি পদ্মার ওপার মানিকগঞ্জ এবং পাবনা থেকেও বায়না আসে। কেবল গ্রাম নয়, বিভিন্ন শহর থেকেও বায়না আসে। নানা জায়গায় নানা পরিবেশে পালা গাইতে হয়; কখনো গৃহস্থ বাড়ি, কখনো বিভিন্ন পূজা উপলক্ষে মেলায় কিংবা বারোয়ারি কালিখোলায়; কোথাও এক রাত আবার কোথাও পর পর চার-পাঁচ রাত। আয়-রোজগারও হয় ভালই।

এছাড়া বর্ষার সময় বাদে বছরের বাকি সময়টাতেও মাসে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় দিন পালা থাকে। নবদ্বীপ গোঁসাই যেমনি জনপ্রিয়, তেমনি তার যোগাযোগটাও ভাল। বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত গ্রামে তার অসংখ্য মন্ত্রশিষ্য রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্র দান করেন তিনি। তার শিষ্যরা আবার পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনকে উৎসাহ দেয় শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্য। এমনিভাবে ক্রমাগত তার শিষ্য বেড়েই চলেছে। আজ এক শিষ্য’র বাবার শ্রাদ্ধ তো কাল আরেক শিষ্য’র মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। এমন আরো নানান উপলক্ষে শিষ্যরা তাদের গুরুদেবকে এমনিতেই স্মরণ করে। সেই সঙ্গে নিকটজনের পরলোকগত আত্মার এবং নিজেদের মানসিক শান্তির জন্য বাড়িতে রামায়ণ-পালার আয়োজন করে। যতো পালা ততো পসার। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের অসংখ্য ধনী শিষ্য রয়েছে, যারা উদার হস্তে তাকে দান করে। আবার দানের জিনিষপত্রসহ গাড়ি করে পৌঁছেও দেয় বাড়িতে। গুরুদেবকে বেশি বেশি দান-ধ্যান করে পরকালের সুখ কেনার দিকে গরিবের চেয়ে মধ্যবিত্ত কিংবা ধনীদের ঝোঁকটাই বেশি। নবদ্বীপ গোঁসাইও চতুর, মানুষ চড়িয়েই খান তিনি। শিষ্যদের হৃদয়ের কোমল জায়গা তিনি স্পর্শ করতে পারেন, পড়তে পারেন তাদের অন্তর্পৃষ্ঠার দূর্বলতম অধ্যায়গুলি! তাই ঈশ্বর আর বিধি-বিধানের কপট শিকড়ে শিষ্য’র মন বেঁধে ঝোপ বুঝে মোক্ষম কোপটা তিনি দিতে জানেন সহাস্য মুখে।

তার ভাষ্যমতে, ‘শিক্ষামন্ত্র গ্রহণ না করলে স্বর্গপ্রাপ্তি অসম্ভব। নারী-পুরুষের উচিত বিয়ের আগেই শিক্ষামন্ত্র গ্রহণ করা। যাতে করে সুসন্তানের জন্ম হয়। শিক্ষামন্ত্র গ্রহণ ব্যতিত কোনো পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিলে সেই সন্তানের স্বভাব-চরিত্র ভাল হয় না, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় না; তাদের পূজার অর্ঘ্য পরমেশ্বরের চরণে পৌঁছায় না, পৌঁছায় ভূত-পিশাচের মুখে; পরলোকগত পূর্বপুরুষ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন, আর ধার্মিক মানুষের পক্ষে তাদের হাতের অন্ন খাওয়া মহাপাপ!’

ফলে অনেক পিতা-মাতাই জোর করে হলেও তাদের সন্তানকে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের কাছ থেকে শিক্ষামন্ত্র গ্রহণে বাধ্য করেন।

নীলু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের যোগ্য সাগরেদ হয়ে উঠেছে। পালা গাওয়া ছাড়াও তিনি যখন যেখানে যান নীলুকে সঙ্গে নেন। হয়তো কোনো শিষ্যবাড়িতে ভাগবত পাঠ করবেন, তিনি সঙ্গে নেন নীলুকে। আবার তিনি যখন কোনো শিষ্য বাড়িতে বেড়াতে যান, তখনো তার সঙ্গী হয় নীলু। এজন্য নরেন, যতীনদের চেয়ে তার অবসর কম। নরেন, যতীনরা অবসরে নিজেদের সংসারের কাজকর্ম করে। কারো পানের বরজ আছে, কারো-বা আছে চাষের জমি। তাই পালা না থাকলেও ওদের বসে থাকলে চলে না। আবার নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা পাবার জন্য নীলুকে ওরা ঈর্ষাও করে!

পরিচিত মহলেও যে নীলুর সম্মান বেড়েছে, সেটা সে মানুষের কথায়-আচরণে বুঝতে পারে। যারা তাকে তাচ্ছিল্যভরে নীলে নীলে বলে ডাকতো, তারাও এখন তাকে নীলু বলে ডাকে। কেউবা আরো এক ধাপ এগিয়ে ডাকে নীলকান্ত।

নিজের পরিবারেও তার কদর বেড়েছে। এখন তাকে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করে সবাই। তার মতামতকে মূল্যায়ন করা হয়। এখন আর মেনকার মুখ থেকে যখন তখন বটের গাঢ় কষের কষালো কথা শুনতে হয় না তাকে, তার মন বিষন্নতায় ডুবে থাকে না। সুবোধও বারান্দায় বসে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে না আগের মতো। বরং তার সাথে গল্প করতে চায়। বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা শুনতে চায়। রামায়ণের তত্ত্বকথাও বাদ যায় না। ভানুমতি নাতিকে কোলে নিয়ে বারান্দার এক কোনায় বসে থাকে গর্বিত মুখে। ভাবখানা এমন যে, তোমরা ওকে চিনতে পারো নাই। আমি মা, আমি ঠিকই চিনেছি! এতোদিন তোমার ছেলে, তোমার ছেলে করতে। এখন তো ঠিকই লোকের কাছে বলো আমার ছেলে এই করেছে, সেই করেছে। এখন তোমাদের মুখ থাকলো কই!

পাড়ার লোকজনও তার কাছে আসে। কানাই জ্যাঠা তো তাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। এক সময় যারা ঠাট্টা করেছে তারাও এখন তার কাছে ঘুর ঘুর করে। ভাব জমাতে চায়। নীলু কাউকেই অবজ্ঞা করে না। বৃদ্ধ মহলে সুবোধেরও অনেকটা দাম বেড়েছে। নীলুর মনে আছে একদিন গাওয়াল থেকে ফিরে তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে চোখের জল ফেলেছিল, কারণ তার বাবার ছোটবেলার বন্ধু মতিলাল তার বাবাকে বলেছিল, ‘নীলেরে তুই সার্কেসের দলে দিয়ে দে সুবোধ। ওরে দিয়ে তো আর কিছু অবিনে। বেশ পয়সা কামাবার পারবেনে।’

পয়সা, পয়সা আর পয়সা! কেবল পয়সাই এই সংসারের সব, আর কিছু না! বন্ধু মতিলালের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিল সুবোধ। হোক বামন। তবু তো নিজের ছেলে। তার ছেলে তার ঘাড়ে বসে খাচ্ছে। তাতে লোকের কী! তার ছেলেকে সে নিজে যা খুশি বলবে, কিন্তু লোকে কেন বলবে? তাও আবার মতিলাল তার ছোটবেলার বন্ধু! নীলু আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের মনোবেদনার সেই কথোপকথন শুনেছিল। দিনের রঙ বদলাতে সময় লাগে না। আজ সেই মতিলালও বাবার সাথে তাকে নিয়ে গল্প করে। তার প্রশংসা করে। শুনে নীলুর হাসি পায়। হায়রে মানুষ। শুধু কী দিন, মানুষ আরো দ্রুত তার স্বভাবের রঙ বদলায়, মনের খোলস পাল্টায়! সুদিনে মানুষ মানুষকে ঈর্ষা অথবা প্রসংসা করে, আর দুর্দিনে তিক্ত কথায় জীবন বিষিয়ে তোলে!

কখনো কখনো একটানা পনের-বিশ দিন বাড়ির বাইরে থাকে নীলু। তখন হাঁপিয়ে ওঠে সে। বাড়িতে ফিরেই পাড়ায় বেরিয়ে পড়ে, সবার খোঁজ-খবর নেয়। কখনো কখনো ফিরে এসে কারো মৃত্যু সংবাদ শোনে, তখন তার মন খারাপ হয়। আবার আনন্দের সংবাদও শোনে। কিন্তু সকল সংবাদের ভিড়েও কেন যেন মন উৎসুক হয়ে থাকে কণিকার সংবাদের জন্য। কণিকার সাথে তার যতোবার দেখা হয়, ততোবারই দ্যাখে কণিকা কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। ধান সিদ্ধ করে, গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে, উঠোন লেপে, রান্না করে, বাঁশের ডালা-কুলা বানায়, আরও কতো কী! যেন এই সংসার তার নিজের, আর কোনো কাজের লোক নেই। অথচ কণিকার দুটো বৌদি রয়েছে। তবু কণিকার বিশ্রামের সময় বড় কম। নীলু বুঝতে পারে কণিকা ভাল নেই, তাই কণিকার কাছে কখনো জানতে চায় না সে কেমন আছে। বলে, ‘কী করিস কণিকা?’

কণিকা নীলুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে, নীলু দু’চোখ জুড়িয়ে দেখতে চায় কিন্তু কণিকার পাথুরে চোখের দিকে সে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না। কণিকার উপবাসী, সন্ন্যাসিনী চোখ!

একদিন বাড়িতে নীলু একা। মেনকা দুই ছেলেকে নিয়ে গেছে বাবার বাড়িতে। ভানুমতিও বাড়িতে নেই, পাড়ায় গেছে। আগের দিন বিকেলে নীলু মাদারীপুরে পালা গেয়ে বাড়িতে এসেছে। জামা-কাপড় সব ময়লা হয়েছে। নীলু ডিটারজেন্টে ভেজানো জামা-কাপড় ধুয়ে তারে মেলে দিচ্ছে এমন সময় এলো কণিকা। কণিকা নিজেই পিঁড়ি টেনে বসলো ওদের বারান্দায়, হাতের কাজ সেরে নীলুও বসলো।
নীলু বাড়িতে থাকলে ব্যস্ত সময়ের ফাঁক গলে নানা ছুতোয় তার কাছে আসে কণিকা। গল্প করতে চায়। এটা ওটা জিজ্ঞাসা করে। কোথায় কোথায় পালা হলো তা জানতে চায়। নীলু বলে, যত্ন নিয়ে বলে। কোথাও এতোটুকও বাদ রাখতে চায় না। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করে বোঝাতে চায় কণিকাকে।

আজো তেমনি গল্প করছে ওরা, একটু পর ওদের সাথে যোগ দিলো সুজিত। কথা বলতে বলতে বর্তমানের কণিকার খোলসের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে মুহূর্তের জন্য উঁকি দিলো সেই আগের কণিকা! কিন্তু কিছু সময় পরই কণিকার বড়দার মেয়ে শিখা একটা ওষুধের পাতা মাঝখানে ভাঁজ করে ফুঁ দিয়ে বাজানোর চেষ্টা করতে করতে উদোম কালো গায়ে টিনটিনে পেট নিয়ে এসে দাঁড়ালো বারান্দা খুঁটি ধরে। ঠোঁটের কাছে ঝুলে পড়া সর্দি নাকের গুহায় টেনে নিয়ে মুখ থেকে ওষুধের পাতাটা নামিয়ে বললো, ‘পিতি মা তুমার দাকে। এককুনি যাবার কইচে।’

বলেই আবার ওষুধের পাতায় ফুঁ দিতে লাগলো শিখা। ওরা তিনজনই শিখার মুখের দিকে তাকালো। মেজাজ খারাপ হলো নীলুর, যেন কোন রাজকার্য ফেলে এসেছে কণিকা, রাজরানি পেয়াদা পাঠিয়ে দ্রুত তাকে তলব করেছে!

কণিকা উঠে পড়লো, ‘আমি যাইগে, কতা কও তোমরা।’
শিখার হাতের ওষুধের পাতার দিকে তাকিয়ে সুজিত বললো, ‘অ্যাই তোর হাতে ও কী?’

বলেই মিটিমিটি হাসতে লাগলো সুজিত। নীলু আর কণিকা যেন কিছুটা বিব্রত। শিখা বললো, ‘মা খায় এইতার ওষুধ, ফুরো গিচে তাই ফ্যালা দিচে।’

ওদেরকে অবাক করে আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো কণিকা, যেমন হাসতো সে বিয়ের আগে। ওর হাসির সংক্রমণ ছড়ালো নীলু আর সুজিতের ঠোঁটেও। শিখা হাসির কারণ বুঝতে না পেরে কেবল ওদের মুখের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। বিধবা হয়ে আসার পর এই প্রথম কণিকাকে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে দেখলো নীলু, যেন সেই আগের কণিকা! বিপুল আনন্দে তার ভেতরটা নেচে উঠলো, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো কণিকার মুখের দিকে!

শিখার কথা শুনে আচমকা হেসে উঠে নিজেই যেন লজ্জা পেলো কণিকা! হাসি থামিয়ে দু’পাটি দাঁতের ফাঁকে নিচের ঠোঁট চেপে ধরলো, তারপর শিখার বাঁ হাত ধরে বললো, ‘আয়।’

কণিকার ঠোঁটে এখনো শেষ বিকেলের রোদের মতো হাসির রেশ। শিখার বাম হাত ধরে কিছুটা গিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকালো সে। এবার আর ওর মুখে হাসির শেষ চি‎হ্নটুকুও নেই। দু’চোখের সৈকতে হঠাৎ আসা জোয়ারের মতো জলের আভাস। হাসির, নাকি কান্নার? শিখার হাত ফসকে হঠাৎ-ই মাটিতে পড়ে গেল মায়াবড়ির শূন্য পাতাটা

নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সান্নিধ্যে আড়াই বছর কেটে গেছে নীলুর। এখন সে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের চিন্তা, দর্শন ও কর্ম দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। তার চিন্তার সতন্ত্র পথ হারিয়ে গেছে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের চিন্তার পথের সাথে মিশে। নবদ্বীপ গোঁসাই যা করেন সেটাই তার কাছে সঠিক মনে হয়; তিনি যে দর্শনের কথা বলেন, সেই দর্শনই তার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের প্রতি অন্ধ মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে তার, যার ফলে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের আচরণে কোনো অসংগতি লক্ষ্য করলেও সেটাই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়ে সে উপেক্ষা করে এবং কোনো প্রশ্ন তোলে না। দলের অন্য সদস্যরা কখনো কখনো নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের আচরণের কোনো সমালোচনা করলেও সে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় না। নবদ্বীপ গোঁসাই তাকে শিখিয়েছেন যে গুরুনিন্দা মহাপাপ, গুরুনিন্দা করলে নরকবাস হয়; সে তাই-ই বিশ্বাস করে। নবদ্বীপ গোঁসাই তার কাছে যেন স্বয়ং ভগবানের দূত! তার মতো নিচকূল অজ্ঞানের পক্ষে গুরুদেবের ত্রুটি খুঁজতে যাওয়া মহাপাপ, এমনটাই তার ধারণা। সকল গুরু-ই অনুগত শিষ্য পছন্দ করেন, শিষ্যদের অকৃত্রিম পূজা ও সেবা পেতে লালায়িত থাকেন; সকল গুরুই চান শিষ্যরা তার চিন্তার দাস হোক, তার চিন্তা ও দর্শনের প্রচার করুক মানুষের মাঝে; তাই চতুর গুরুকে নিজের চিন্তার শিকড়ে শিষ্যকে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হয়। নবদ্বীপ গোঁসাইও নীলুর ক্ষেত্রে তাই করেছেন। ফলে আত্মসত্ত্বা হারিয়ে নীলু এখন হয়ে পড়েছে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের চিন্তার দাস। তার সকল চিন্তাই এখন আবর্তিত নবদ্বীপ গোঁসাই এবং তাঁর দর্শনকে কেন্দ্র করে।

বিচিত্র অভিজ্ঞতাও সে অর্জন করেছে এই আড়াই বছরে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালা গাইতে গেছে কখনো গাড়িতে, কখনো ভ্যানে-রিক্সায়, কখনো নদীপথে নৌকায়, আবার কখনো-বা ধুলো-কাদা মাড়িয়ে পায়ে হেঁটে। বিচিত্র সব জায়গায় গেছে, বিচিত্র মানুষের সঙ্গ পেয়েছে আর অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছে সে। প্রথম প্রথম স্বপ্নের মতো মনে হলেও এখন সে ধাতস্থ, অনেক পরিণত। বাড়ি থেকে তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করেছে। যদিও তার জন্য মেয়ে পাওয়া একটু কঠিন। তবু বাড়ির মানুষ মেয়ে দেখছে এবং একটা মেয়ে খুঁজেও পেয়েছে, মেয়ে এবং মেয়ের পরিবার নীলুর ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু বেঁকে বসেছে নীলু, কিছুতেই সে বিয়ে করবে না। নীলুকে রাজি করানোর জন্য সুবোধ গিয়ে ধরেছিল নবদ্বীপ গোঁসাইকে। নবদ্বীপ গোঁসাই তাকে বোঝাতে গেলে, করজোরে সে অপারগতা প্রকাশ করেছে। বিয়ের কথা ভাবতে গেলেই তার চোখে কেবল একজনের ছবি-ই ভাসে, যে সারাক্ষণ তার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে থাকে; কেবলই মনে হয় তার একজন আপন মানুষ আছে, মনের মানুষ আছে, যার কাছে সে মনের সকল কথা খুলে বলতে পারে।

বর্ষার এক বিকেলে কুমার নদের পারে হাঁটতে বেরিয়ে হিজল তলায় গিয়ে দাঁড়ালো নীলু। এখন আর আগের মতো হিজল তলায় আসা হয় না তার। হিজল গাছের সাথে কথা হয় না আগের মতো।
নীলু হিজল গাছের গায়ে হাত বুলালো, ‘কেমন আছিস তুই?’

গাছ থেকে পাখি ডেকে উঠতেই সে উপর দিকে তাকালো। কী একটা পাখি তিড়িং বিড়িং করে এ ডাল থেকে ও ডালে যাচ্ছে। সে নাম জানে না পাখিটার। সারা গাছে চোখ বুলালো, ফুল কবেই ঝরে গেছে, এখন দু’চারটা শুকনো ফল ঝরে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। ছোটবেলায় খেলার সময় হিজল ফুল দিয়ে কানের দুল বানাতো তারা। ছেলে মেয়ে সবাই! তারপর ডানে-বায়ে মাথা দোলাতো। নীলু মনে মনে হাসলো। গাছের যে ডালটা নদের দিকে হেলে পড়েছে, বর্ষায় নদের জল বাড়ায় ডালটার আগার দিকের কিছু অংশ জলে ডুবে আছে। জল থেকে খানিকটা উপরের ডালে একটা পাখির বাসা। বাসায় দুটো ডিম। নীলু ডিম দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর সেদিক থেকে চোখ ফেরাতেই তার চোখে পড়লো কিছুটা দূরে কণিকা হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। নীলুর বুকের ভারী বাতাস মিশে গেল প্রকৃতির বাতাসে, বাড়ির কাজ সামলে কণিকাকে এখন নদ থেকে হাঁস তাড়িয়েও আনতে হয়! দশ-বারোটা হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে নীলুকে অতিক্রম করে গেল। কণিকা দাঁড়ালো, ‘কবে আসলে?’
‘কাল রাতে।’ নীলু তাকালো কণিকার চোখের দিকে।
‘তোমার স্বাস্থ্য যেন এট্টু ভাল অইচে!’
‘ভাল আর কই।’

নীলু মুখে যাই-ই বলুক, সে নিজেও জানে তার স্বাস্থ্য একটু ভাল হয়েছে, আয়নার প্রতিচ্ছবি জানিয়েছে তাকে। গায়ের রঙেরও একটু উন্নতি হয়েছে। কণিকা নীলুকে খুঁটিয়ে দেখলো। নীলু বেশিক্ষণ কণিকার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না, সে নদের বুকে দৃষ্টি রেখে কথা বললো আর ফাঁকে ফাঁকে তাকালো কণিকার দিকে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ দূরে চলে যাওয়া হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে কণিকা বললো, ‘যাইগে নীলুদা।’

চলে যাবার জন্য পা বাড়ালে নীলু ডাকলো, ‘শোন।’
দাঁড়ালো কণিকা। নীলু বললো, ‘আমি পরশুদিন বাবা গোঁসাইয়ের সাথে ভারতে যাব।’

নীলু ভারতে যাবে তাতে কণিকার কী? কী আসে যায় কণিকার? তবু কণিকাকে বলতে ইচ্ছে করে। তার নিজের যতো কথা সব উপুড় করে ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে কণিকার কাছে। শুনতে ইচ্ছে করে কণিকার কথাও।
কণিকা যেন কিছু ভাবলো। তারপর বললো, ‘কী করতি যাবা?’

‘বেড়াবার যাব। বাবা গোঁসায়ের তিন ছেলের দুইজন-ই তো ভারতে থাকে। এই সময় পালার বায়নাও তেমন নাই। প্রতি বছরই এই সময় উনি ভারতে যান। এবার আমারে যাবার কোলো সাথে। আমার আর কী, ঝাড়া হাত-পা!’
‘দালালের সাথে যাবা?’
‘না, পাসপোর্ট-ভিসা করছি।’
‘কবে আসপা?’
‘তা মাসখানেক তো থাকা লাগবেনেই।’

নীলুর মুখে দৃষ্টি রেখে ঠোঁটদুটোকে একটু স্ফীত করে কণিকা বললো, ‘তুমি বেশ ভাল আছো নীলুদা। খুব সুখে আছো। তোমারে দেখলিই বোঝা যায়।’

নীলু চুপ করে থাকলো। সে বলতে পারতো, তা আছি। কিন্তু পারলো না। কণিকা তো ভাল নেই। কণিকা যদি ভাল থাকতো তাহলে সে বলতে পারতো, আমি বেশ আছি। সুখে আছি।

কণিকা হাঁসগুলোর দিকে তাকালো। অনেকদূর এগিয়ে গেছে ওরা। গোধূলির আগে আগে নদে ঢিল ছুড়ে চই চই বলে ডাকলেই নদ থেকে উঠে এসে বাড়ির পথ ধরে হাঁসগুলো। একবার রাস্তায় উঠে গেলে আর ডানে-বায়ে নামে না। দৃষ্টি নীলুর মুখে ফিরিয়ে এনে কণিকা বললো, ‘যাই নীলুদা। তুমি ভাল মতো ফিরে আসো।’
যেতে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো কণিকা, ‘নীলুদা...’

নীলু তাকালো কণিকার মুখের দিকে। কণিকা নিশ্চুপ। ওর নীরবতা দেখে নীলু বললো, ‘ক’বি কিছু?’
কয়েক মুহূর্ত নীলুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘না....’

বলেই আর দাঁড়ালো না কণিকা। হাঁসগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমাতে দ্রুত পা চালালো। কণিকা কী বলতে চাইলো? বলতে গিয়েও বললো না কেন? ভাবতে ভাবতে নীলু তাকিয়ে রইলো কণিকার গমন পথের দিকে। কী ডাগর ছিল কণিকা, আর এখন শুকিয়ে যেন চুপসে গেছে! খানিকটা অহংকারীও ছিল, নদীর ভাঙনের মতো শোকের গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে সে অহংকার। গভীর আঘাতে কী মানুষের হৃদয়াকাশ থেকে অহংকারের মেঘ উড়ে যায়!



(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:৩৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×