somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যাহ্নের কৃষ্ণ ছায়া

০৮ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।

বেশ কয়েকদিন ধরেই মেজাজ একটু একটু করে খারাপ হওয়া শুরু হয়েছিলো। মন বিষণ্ণ হলে তা নিজের মাঝে রেখে চুপচাপ দিন পার করা গেলেও মেজাজের কাঁটা বারবার ভেতরে একই জায়গায় হুল ফুটাতে থাকলে তা আশেপাশের সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারলে যে স্বস্তি হয় না আর সেটা জানি বলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না । গতকাল বাড়ি ফেরার পর থেকে তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে যখন আমার পছন্দ – অপছন্দ কখনো মৌনতায় বা ভ্রু কুঁচকে পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রকাশ করছিলাম – তখন তাদের চাহনি দেখেই বুঝেছিলাম আমার পরিবর্তনটা একটু হলেও তাদের নজরে পড়েছে। তা না হলে রাতে খাবার টেবিলে বসে মায়ের হাতের পরিচিত স্বাদের ছোঁয়া পেয়েও হোস্টেলের সরিষার তেল , ধনেপাতা বিহীন মোটা করে কাটা পেঁয়াজের আলুর ভর্তা আর ডালের কথাই মনে পড়বে কেন !


মাস তিনেক আগেও যখন অল্প কিছুদিনের জন্য বাড়ি এসেছিলাম তখনো মেজো আপা রেবাকে দেখেছি তার দুই ছেলে- মেয়ে নিয়ে এ বাসায় বেড়াতে এসেছে। শ্বশুর বাড়ি কাছাকাছি হলে যা হয় আর কি । এমনও হতে পারে আমি সেবার হোস্টেল চলে যাবার পর সে আর আসেনি এর মধ্যে কিংবা গতকালই এসেছে । সেটা আমার মাথা ব্যথার কারণ নয় তবে মেজাজ খারাপ থাকায় এই তুচ্ছ বিষয়ও আমাকে বিরক্ত করছে এখন । যদিও তাকে মুখে কিছু বলতে পারছি না যে ঘন ঘন বাবার বাড়ি সে কেন আসে তবে আমার সে বিরক্তির প্রকাশ তার মেয়ে ফাইজার উপর দিয়েই গেলো। ফাইজা মেজো আপার ছয় বছর বয়সী বড় মেয়ে। মেজো আপার ছোট আরেকজন মেয়ে আছে । বাসায় ঢুকবার পর থেকেই দেখছি ফাইজা কি এক মিউজিক্যাল গান দিয়ে একটু পর পর গুলি ছোঁড়াছুড়ি করে খেলায় তার ব্যস্ততার সাথে অন্যকেও সে ব্যস্ত করতে চাইছে। টয় কোম্পানিগুলো কেন যে এই অদ্ভুত সিস্টেমের খেলনা বের করে কে জানে। আমার মাথা পুরোই ধরে গেলো যখন দুপুরে সোফায় শুয়ে শুয়ে HBO তে একটা মুভি দেখছিলাম ও দৌড়ে এসেই –


- খালা মনি , তোমাকে গুলি করবো, বলেই সেই মিউজিক্যাল গান আমার কপালে ঠেকিয়ে চাইনিজ শব্দে আমাকে গুলি করতে লাগলো। উফ ! ও আমার মনোযোগ টিভির দিকে দেখতে পেয়েও আরও বেশী করে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো আমি যেন ওর সাথে একই খেলা খেলি । আমি গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছি , ব্যথায় ছটফট করছি এমন অভিনয় করতে। একপর্যায়ে দেখি আমার মনোযোগ পেতে সে রিমোট চেপে টিভির সুইচই অফ করে দিলো।

আমার বিবেক অনেকদিন ধরেই হ্রাস পাচ্ছিলো একটু একটু করে । তাই হয়তো পারলাম আছাড় দিয়ে ফাইজার খেলনাটা ছুঁড়ে ফেলতে মেঝেতে। এমনকি সোফা ছেড়ে উঠে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতেও পিছু ফিরে দেখতে ইচ্ছে করলো না ফাইজার খেলনাটা ড্রয়িংরুমের কোন কোণায় গিয়ে পড়লো কিংবা ভেঙে গেলো কিনা , ফাইজা কাঁদছে কিনা। আমি কি পিশাচ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন ?


২।

বাইরে থেকে ঘরে ফিরে আমার বরাবরের অভ্যাস গোসল করা। যদিও আমি তেমন ঘামি না বা ঘামে আমার গায়ে দুর্গন্ধ হয়না। গতকাল ময়মনসিংহ আমার বাড়ির নিকটবর্তী বাস স্ট্যান্ডে দুপুরের গনগনে রোদের মাঝে এসে নামতেই গরমের হলকায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো চোখে সানগ্লাস থাকা সত্ত্বেও। নাকের উপর হালকা ঘামের বিন্দুর সাথে টের পেলাম গা ভীষণ গরম হয়ে আছে। হয়তো অস্থিরতার প্রকাশ শরীরের তাপমাত্রায় প্রকাশ পাচ্ছিলো – যাকে আমরা জ্বর বলি।

মায়ের সাথে সাথে আরো অনেকেই বলে , আমার নাকি চণ্ডালের মতো রাগ। বন্ধু সংখ্যা এমনিতেও কম আর সবার সাথে মানিয়ে চলতে না পারাও এই রাগের কারণ হতে পারে। আর রহস্যজনক ভাবে দিন দিন আমার রাগ বাড়ছে অথচ চেপে রাখতে চাচ্ছি বলেই হয়তো ভেতরের অস্থিরতা আরো বেড়েছে। কাল বাড়ি ফিরেই দুই তলায় আমার রুমের দরজাটা বন্ধ করে চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ। যখন ঘরে ঢুকলাম দরজা খুলে দিয়েছিলো প্রিয়াঙ্কা। গরিব ঘরে জন্ম নিলেও সেই আক্ষেপ বোধহয় এরা প্রিয়াঙ্কা , শাবনুর ইত্যাদি নাম নিয়েই ঘুচায়। এই মেয়েটাকে কাজে নেবার পরেই মা আমাকে ফোনে কথায় কথায় জানিয়েছিল ওর কথা। ও হেসে আমাকে গেট খুলে স্বাগত জানিয়ে আমার ছোট লাগেজটা টেনে নিলেও প্রত্যুত্তরে সে আমার দন্ত বিকশিত হাসি ফেরত পেল না। অবশ্য এতে প্রিয়াঙ্কার মতো হা- ভাতে ঘরের মেয়েরা আহত বা নিহত কোনটাই হয়না। দুই তলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে শুনতে পেলাম প্রিয়াঙ্কার গলা –

- খালাম্মা , সুহা আপায় আইছে।

উত্তরা থেকে বাস ছাড়ার পর থেকেই নন্দিতাকে ফোন দিতেই দেখি ওর মোবাইল বন্ধ। বাস থেকে নেমেও জানিয়েছিলাম এসএমএস দিয়ে বাড়ি পৌঁছেছি। এখনো ডেলিভারি হয়নি। এই আমার এক খারাপ অভ্যাস কাছের কারো ফোন বন্ধ পেলে একটু পর পর তাকে ট্রাই করতে থাকি। নন্দিতা , আমার রুমমেট। ল’ তে পড়ছে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। বেশী কথা বলা মানুষ আমার পছন্দ নয় বলেই আমি ওর সাথে সময় কাটানোতে আনন্দ পাই। আর এই কারণেই হয়তো বছর খানেক ধরে উত্তরার লেডিস হোস্টেলটিতে রুমমেট হিসেবে আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারছি।



শাওয়ার নিতে গিয়ে টের পেলাম জ্বর বাড়ছে হু হু করে । সাথে মাইগ্রেনের ব্যথা। নিশ্চিতভাবে জানি নন্দিতার সাথে কথা না হওয়া পর্যন্ত আমার এই শারীরিক , মানসিক অস্থিরতা কমবেনা। ভেবেছিলাম একটু সময় নিয়েই শাওয়ার নিবো। হঠাৎ করেই মোবাইলে রিং এর আওয়াজ পেয়ে হৃদপিণ্ড যেন আমার লাফিয়ে উঠলো। নন্দিতার জন্য বিশেষ এক রিং টোন সেট করা আছে আমার মোবাইলে। নন্দিতাও আমাকে একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে। আমার কিছুক্ষণ আগের আটকে থাকা বিষাদ অস্থিরতা ধীরে ধীরে গলতে লাগলো পানির ফোঁটায় । আরামদায়ক শৈথিল্যে নিমজ্জিত হলাম যেন। আহ নন্দিতা !

ঈদ উপলক্ষ্যে ভার্সিটি বন্ধ হবার কারণ তো ছিলই তার সাথে রাস্তায় জ্যাম হবে এই আশংকায় বাবার ঘন ঘন ফোনে একরকম বাধ্য হয়েই হোস্টেল বন্ধ হবার আগেই ঢাকা শহরকে বিদায় জানাতে হয়েছিল । নন্দিতার বাড়ি রাজশাহীতে। ও বরাবর ট্রেনের যাত্রাই পছন্দ করে। ওর টিকিট কাটা ছিল বলে ওর হোস্টেল ছাড়ার তেমন ব্যস্ততা এত আগেভাগেই দেখাতে হয়নি।

নন্দিতার সাথে আমার সখ্যতা প্রথম দিনেই গড়ে উঠেছিলো । হোস্টেলের চার তলার যে রুমটিকে নন্দিতা নিজের মতো সাজিয়েছিল সেখানে এসে যেদিন আমিও ওর সঙ্গী হয়েছিলাম সেদিনকার কথা। ও আমাকে হ্যালো বলে সম্ভাষণ করা ছাড়া সেদিন সারাদিনে তেমন আর কোনো কথা বলেনি। দিনটা ছিল শুক্রবার। বয়স আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট হবে বোধ হয় , বড়জোর একুশ। ওর স্বল্পভাষী স্বভাবে মনে মনে খুশীই হয়েছিলাম কোনো ব্যাপারে বিরক্তিকর কৌতূহল দেখায়নি বলে। তবে এটা বুঝতে পারছিলাম ও বিছানায় শুয়ে শুয়ে যদিও পড়ছে কিন্তু মনোযোগ আমার দিকেও ওর আছে। বাড়ির বাইরে এত দূরে থাকার অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি বলেই একটা বাজে অস্বস্তিকর অনুভূতিতে কপাল হালকা কুঁচকে ছিল যা চাইলেও মসৃণ করতে পারছিলাম না।

রাতে ডাইনিং এ খাবারের সময় হলে নন্দিতা আমাকে এলো ডাকতে। আমার বিছানায় এসে যখন ও বসলো আমি চোখের উপর হাত ঢেকে শুয়ে থাকলেও অনুভব করছিলাম আমার মাঝে তিরতিরে একটা কম্পন বয়ে যাচ্ছে । একটু মজা করতে ও বলল স্কুল গার্লদের মতো আমি মন খারাপ করে আছি কেন। আমার মাঝে যে তখন সদ্য বিয়োগের ব্যথা সে কথা কি করে নন্দিতাকে বলি। দেরী হলে ডাইনিং এ তলানির খাবার খেয়ে থাকতে হবে বলে ও আমাকে শেষবারের মতো অনুরোধ করলো তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম নন্দিতার কাঁধে মুখ লুকিয়ে আমি কাঁদছি। ওর হাত আমার পিঠে যতই সান্ত্বনার পরশ দিচ্ছিল ততই যেন নিজেকে আরও বেশী একা আর ভাঙ্গাচোরা মনে হচ্ছিলো। দিশেহারা মানুষের মতো আমার হাতের মৃদু চাপ নন্দিতার পিঠে লাগলে আমার ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখে ও এক নিমিষেই বুঝে নিলো আমিও ওর মতোই একজন মানবী।


ধীরে ধীরে নন্দিতার সুখ- দুঃখ গুলো জানা হয়ে যায়। তাকেও জানানো হয় আমার বিয়োগ ব্যথাটির নাম – লাবণ্য, আমার স্কুল- কলেজ- ইউনিভার্সিটির বন্ধু এবং প্রতিবেশী। যদিও স্বল্প সময়ের পরিচয় নন্দিতার সাথে সে সব ছাপিয়ে লাবণ্যর প্রতি ওর ঈর্ষা কাতর মনের পরিচয় পেলে খুশীই হলাম যেন। হয়তো নন্দিতার আরো ইন্টিমেট ফ্রেন্ড আছে আমি ছাড়াও। তা নিয়ে অবশ্য আমার মাথা ব্যথা নেই। কেনোনা কারো শূন্যস্থানই শেষ অবধি শূন্য থাকে না যা আমি বুঝেছিলাম লাবণ্যর বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে।

৩।

লাবণ্যর প্রতি আমার বিশেষ ধরণের আগ্রহ প্রথম টের পাই ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠার সময়। অবশ্য এই আগ্রহ একতরফা ছিল না। প্রতিবেশী হবার সুবাদে লাবণ্যদের সাথে আমাদের পারিবারিক বন্ধন বেশ মজবুত ছিল। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে একদিন অনেক বলে কয়ে লাবণ্যকে আমাদের বাসায় সারাদিনের জন্য বেড়ানোর কথা বলে নিয়ে এলেও রাতে ওকে বাসায় ফিরতে দিলাম না। মা’ কে দিয়ে বলিয়ে রাতে থাকার পারমিশন নিয়ে নিলাম লাবণ্যের জন্য। জায়গাটা মফস্বল বলে ডিসেম্বরের শুরুতেই শীতের প্রকটটাও মন্দ ছিল না । মনে আছে শীত আসার আগে আগে কয়েকদিন বেশ বৃষ্টি হতো। মা বলতো ওটা নাকি শীত নামানোর বৃষ্টি। লাবণ্য যেদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো, তারও দু’দিন আগে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো ।


আমাদের তিন বোনের জন্য আলাদা আলাদা বেড রুম ছিল। রাতে খেয়ে –দেয়ে আমি আর লাবণ্য আমার রুমে শুয়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের “ নীল ঘূর্ণি ”পড়তে আরম্ভ করি। ঐ বয়সে আমাদের নীল ঘূর্ণি পড়ার বয়স ছিল না । মেজ আপার কালেকশন থেকে চুরি করে সেদিন বইটা আনলেও সে রাতে আমরা পুরো বই পড়ে শেষ করতে পারিনি বজ্রপাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে। ভূতের ভয় প্রাথমিক ভাবে কাজ করলেও যখন একই কম্বলের নীচে দুজনে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকার ফলে আস্তে আস্তে অন্য আরেক ভালো লাগার অনুভূতি কেমন যেন আমার মাঝে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। এর কিছুদিন পরে জেনেছিলাম লাবণ্যেরও সে রাতে আমার মতোই অনুভূতি কাজ করেছিলো। কেমন যেন এক শিহরণ বা ভালোলাগার মতো এক অনুভূতি , একটু ভয়ের মিশেল যেন। কিন্তু সে রাতে লোডশেডিং আর মেঘের গর্জনে অন্য এক অজানা শিহরণের কথা আমার প্রাণের বান্ধবীকেও বলতে পারিনি। অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে না পারার অপারগতা , লজ্জা, সব মিলিয়ে প্রাণপণে নিজেকে দমন করতে যেয়ে শীতের বর্ষণমুখর রাতেও লাবণ্যের পাশে শুয়ে ঘামছিলাম হালকা হালকা। আর তাই হয়তো কৈশোরের আমাদের গোপন কথাটা দুজনেই বেশ জোর গলায় নিজেদের শুনিয়েছিলাম --


“আমরা সারাজীবন পড়াশুনা করবো। কখনো প্রেম করবো না ছেলেদের সাথে। বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসে না ।”



আমি আর লাবণ্য সে কথা রেখেছিলাম। আমাদের জীবনে প্রেমের বার্তা নিয়ে কোনো পুরুষ আসলেও আমরা কখনো সে প্রেমে সাড়া দেইনি। অবশ্য সাড়া দেবার কথাও নয়। যদিও আমাদের সম্পর্কটা নিজেদের কাছে অনুচ্চারিত ছিল কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম আমরা সম প্রেমে বাঁধা পড়েছি। এভাবেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করলাম। আমরা পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী এবং এসএসসিতে রেজাল্ট ভালো করাতে আমাদের পরিবারের কেউই ছেলেদের সাথে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার নিয়ে আমাদের সন্দেহের চোখে দেখত না । তাই আমাদের নিয়ে তারা রিলাক্সেই ছিল। যদিও আমার আর লাবণ্যের মাঝে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের মাঝে তখনো পুরোপুরি আড় ভাঙেনি। কাছাকাছি থাকা , হাত ধরা, কারো বাসাতে এক সাথে শুয়ে গল্প- গুজব এসবের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল এইচ এস সি পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত।

এর মাঝেই আমার মেজো আপার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের বাড়িতে বড় আপা , অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন আসতে শুরু করলো। শপিং , বাড়িতে আলপনা , গায়ে হলুদের প্রস্তুতি নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় পার করছি । আর আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী লাবণ্য তো ছিলই। মেজো আপার গায়ে হলুদের দিন পার্লার থেকে সেজে গুঁজে যখন বাড়ি ফিরলাম, শাড়ি পরা নিয়েই বিপত্তিতে পড়লাম। শাড়ি নিজে নিজে পরার ব্যাপারে আমি বরাবরের আনাড়ি। আমার রুমে রেডি হচ্ছিলাম যখন লাবণ্য শাড়ি পড়াতে সাহায্য করেছিলো । শাড়ির কুচি ঠিক করে লাবণ্য যখন সেফটিপিন আটকে দিতে যাচ্ছিলো আমার অনুভূতিগুলো যেন আমার কুচির পরতে পরতে জেগে উঠছিল। ব্লাউজের সাথে শাড়ির আঁচল সেফটিপিনে যখন লাবণ্য আটকে দিচ্ছিল মনে হচ্ছিলো সময়টাও যেন সাথে আটকে গেছে । পিঠে অনুভব করলাম লাবণ্যের ঠোঁটের ভেজা , নরম স্পর্শ । কিছুটা সময়ের জন্য আমরা হয়তো এই পৃথিবীর কেউ ছিলাম না ঐশী এক সুখানুভবে ডুবে গিয়ে । সেদিন আমার পিঠের সাথে ওর স্তনের সেঁটে থাকা আমাকে অন্য এক উন্মাদনা এনে দিয়েছিলো পলকেই। সেই প্রথম আমার এভাবে চুমু খাওয়া এবং সাথে লাবণ্যেরও প্রথম অভিজ্ঞতা।

৪।

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর হঠাৎ করেই লাবণ্যের বিয়ে হয়ে যাওয়াটা যেন আমার পৃথিবীটাকে টলিয়ে দিলো। হয়তো বা লাবণ্যের ও । যদিও আমাদের দুই বান্ধবীর বিমর্ষতাকে যার যার পরিবার দুই বান্ধবীর বিচ্ছেদ বা শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়ায় আমরা একা হয়ে যাবো এরকম মামুলি ভাবেই দেখল। অথচ ব্যাপারটা মোটেও মামুলি ছিল না আমার কাছে। আমি জানতাম আমার অনুভূতির পারদ লাবণ্যের চেয়ে কতখানি গভীর।

ওর বিয়ের পর আমি অনেক চুপচাপ হয়ে গেলাম, আগের চেয়েও আরো বেশী। লাবণ্যের অনুপস্থিতে আমার মনোযোগ চলে গেলো ইন্টারনেটের দিকে। আমার বা লাবণ্যর মতো আরও অনেক মানুষ বাংলাদেশে বা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে যারা অসুস্থ নয় বলেই জানতে পারলাম এই নেটের কল্যাণে।পাকিস্তানি সমকামী কবি ইফতি নাসিমের তার ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে সম প্রেমের কথা জানার পর মনে হল আমার বা লাবণ্যর অনুভূতির সাথে তাদেরও তেমন ফারাক ছিল না। কবি নাসিমের বন্ধুর বিয়ের পরবর্তী ঘটনায় তাদের মুষড়ে পড়া এবং বন্ধুর নব বধূকে বিছানায় রেখে ভোরবেলায় তার দরজায় নক করা – এসব জেনে মনে হল পাকিস্তানি গোঁড়া সমাজে বড় হবার কারণে সমকামীদের প্রতি ঘৃণার ব্যাপারটা কবি নাসিম এবং তার বন্ধু জানতেন বলেই তাদের সম্পর্কের কথা অনেককাল পর্যন্ত তারা গোপনেই রেখেছিলেন।

যদিও আমি লাবণ্যের ফুলশয্যার রাতে ওর দরজায় নক করিনি। ওর স্বামী বিয়ের মাস তিনেক পর কানাডা চলে গেলে লাবণ্য আবার ওর বাবার বাড়িতেই চলে আসে। একসাথে চলাফেরা , মাঝে মাঝে দুজনের কাছাকাছি আসা হলেও আমি আর আগের মতো ওর সাথে মিশতে পারতাম না দুর্দান্ত আবেগ নিয়ে। হয়তো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়াটা মানতে পারিনি বলেই আমার মাঝে তৈরি হয়েছিলো তীব্র এক ধরণের ক্ষত। সেই সাথে অনীহাও এসেছিল পিছু পিছু।


অনার্স ফাইনালের মাস খানেক আগে আমারও একদিন বিয়ে হয়ে যায়। আমার স্বামী সোহেল পাঁচ মাসের ছুটিতে লন্ডন থেকে এসেছিল বলে আমি শ্বশুর বাড়ি না থেকে আমাদের বাড়িতেই সোহেল কে নিয়ে থাকতাম । তাছাড়া পরীক্ষার ও ব্যাপার ছিল । আর এ কারণে লাবণ্যরও আমাদের বাড়িতে আসা- যাওয়া কিছুটা কমে যায়। সে সময়টায় আমি প্রচণ্ড রকমের মানসিক পীড়ায় ভুগতাম। কারণ আমার জানা হয়ে গিয়েছিল আমার আভ্যন্তরীণ শারীরবৃত্তীয় আচরণ কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশযোগ্য নয় কিংবা লাবণ্যর সাথে কিংবা অন্য যে কোনো নারীর সাথে সংসার করার মানে পাগলামির শামিল বলেই গণ্য হবে সভ্য সমাজে।

আমি জানতাম আমার দ্বারা সম্ভব হবে না তবু চেষ্টা করেছিলাম সোহেলের সাথে আন্তরিক হতে। তার সাথে থাকা অবস্থায় শরীর নাড়া না দিলেও নিজেই নিজের কাছে বারবার বলতাম হয়তো একটা সময় ভালো লাগবে আমার সোহেলের সঙ্গ । কিন্তু নিজের উপর জোর করতে গিয়ে যেন মানসিক ভাবে আরও অসুস্থ হচ্ছিলাম একটু একটু করে। বরং সোহেলের স্পর্শ পেলে আমার গা ঘিন ঘিন করতো , মনে হত ও আমাকে অশুচি করে দিচ্ছে ।

“ হাউ ফানি , সুহা ! হি ইজ ইওর হাসব্যান্ড বেবি ! ”

আমার ভেতরে যে অবশিষ্ট বিবেকটুকু জাগ্রত ছিল তা আমাকে মাঝে মাঝে সোহেলের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করলেও আমার দস্যু মনটা তা মানবে কেন। বস্তুত আমার ভেতরে আরেকটা সুহা ওত পেতে থাকতো সোহেলের ত্রুটি ধরতে। সোহেল পাঁচ মাসের ছুটি কাটিয়ে চলে যাবার পরের এক ঘটনা। রাত তিনটায় আমার দরজায় নক করে মা ঘুম ভাঙালে বুঝলাম সোহেল মায়ের নাম্বারে ফোন দিয়েছে। ঐ সময় আমি আমার নতুন ইন্ডিয়ান বান্ধবীর সাথে স্কাইপিতে ভিডিও চ্যাটে বিজি থাকায় সোহেলের ফোন দেখেও ইচ্ছে করে রিসিভ করিনি। আর ততদিনে লাবণ্যের সাথে আমার দূরত্বও বেড়েছে অনেকটা।

- কি ব্যাপার , ফোন ধরছ না কেন ?

ওহ ডিসগাস্টিং ! কি নেকু নেকু কথা। শালা আমি ফোন ধরিনা আমার ইচ্ছে। তোর কি !

- সোহেল, রাত তিনটা বাজে সোনা। মা’ কে ফোন দিলে কেন আবার এত রাতে! সবাই ঘুমুচ্ছে এখন।

ওদিকে ইন্ডিয়ান বান্ধবীর মেসেজ স্কাইপিতে
- Hey ,whats wrong ?

- Oh darling , just wait. That fucker call me


- Its late nyt , Suha

- Jessica pls wait


কি সুহা , কথা বলছ না কেন ? একটু আগেই বাসায় ফিরলাম। ফেসবুকে আসো। গল্প করি তোমার সাথে।
- উমমমম ….. অনেক ঘুম পাচ্ছে

- আচ্ছা , তোমার ফেবুর লিস্টে দেখলাম রিয়াসাত নামের এক ছেলেকে নতুন এড করেছো। কে এই নতুন বন্ধুটা ?

- ছেলের নাম লিস্টে থাকাটাই তো স্বাভাবিক। মেয়েদের নামের লিস্ট দীর্ঘ হলে তো আবার লেসবিয়ান ভাববে আমাকে।

- হা হা হা …. সুহা। ভালোই জোক করতে পারো । গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত দেখলাম তুমি ফেবুতে ছিলে। এত রাত জেগে চ্যাটিং করা ঠিক না।

- ফেবুতে থাকা মানেই চ্যাটিং করছি এই ধারনার কারণ কি ? ভাবছি এম বি এ তে ভর্তি হবো । এডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন নিচ্ছি। একটু রিলিফ পেতেই ফেসবুকে ঢোকা। কেন কোনো সমস্যা নাকি ?


- Hey Suha , Hurry up Beb.Am missing ur horny voice

- Me too honey. Pls wait

- ক’ দিন পর তো লন্ডন চলেই আসছ । বাংলাদেশে ভর্তি হয়ে কি লাভ ! এখানে এসেই পড়াশুনা করো।

- আমি দেশে থেকে পড়াশুনা করলে তো তোমার পিত্তি জ্বলে যাবে সোহেল। অমুকে আমার দিকে তাকালো কেন , তমুকে রাস্তায় গা ঘেঁষে গেলো কেন , হিজাব পড়ি না কেন । আর লন্ডন আসলে পড়তে দিবে এত অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

- আমি তোমার হাসব্যান্ড, দুশ্চিন্তা হতেই পারে তোমাকে নিয়ে । আর যেহেতু ওমরা হজ্জ করেই আসছ তুমি হিজাব পড়তে বলা খারাপ কিছু নাকি ?

- ওহ শিট ! হাসব্যান্ড এর দুশ্চিন্তা আর সন্দেহগ্রস্ততার মাঝে পার্থক্য আছে সেটা তোমরা পুরুষরা বুঝবে না । পাউন্ড খরচ করে ফালতু ঝগড়া করো না আমার সাথে। এখন ঘুমবো। বাই


সোহেলের সাথে কথা বলে মুড অফ হয়ে যাওয়াতে আর ইচ্ছে করছিলো না জেসিকার সাথে চ্যাট করতে। বরং ওকে বিদায় জানাবার পরও কানে বারবার বাজছিল ওর শেষ কথাটা –Just leave him, just leave him.

সোহেলের সন্দেহ রোগ ছাড়া এমন কোনো বড় সমস্যা ছিল না। আর প্রবাসী, যারা বৌ দেশে রেখে যায় তাদের মনে একটু খচখচানি থাকবেই তা আমার বড় আপার অভিজ্ঞতা থেকেই জানতাম। হয়তো বন্ধু- বান্ধব বা পরিবারের লোকদের মুহুর্মুহু সতর্কতায় সোহেলের সন্দেহের চাবুক থেকে আমিও বাদ যাইনি তাই। ক’দিন পর পর একই ঘ্যানঘ্যানানি আমি মোবাইল সবসময় ঠিকমতো রিসিভ করি না কেন , রাত জেগে থাকি বলেই দিনের বেশির ভাগ সময়ে ঘুমাই, কেন এম বি এ তে ভর্তি হবো , কেন ঢাকায় গিয়ে হোস্টেলে থাকবো ইত্যাদি অভিযোগ। আমি সোহেলের অস্থির এসব আচরণের সাথে পরিচিত ছিলাম বলেই ওর অভিযোগ খণ্ডন না করে বরং নির্লিপ্ত থেকে ওকে আরও উস্কে দিতাম । ও তখন ফোনে হইচই করতো , রাগ দেখাত , F – ওয়ার্ড ইউস করতো আর আমি স্পিকারে দিয়ে আমার বাড়িতে সবাইকে শোনাতাম ওর ব্যবহার । মা’ কে বলতাম – দ্যাখো , তোমার মেয়ের শিক্ষিত স্বামীর আচরণ ! সবার মনে এই ধারনাটাই গেঁথে দিয়েছিলাম আমি পড়াশুনা করতে চাই বলেই এমন আচরণ সোহেল করে।


পড়াশুনায় সিরিয়াসনেস , চোখে পড়ার মতো কোনো ছেলে বন্ধু না থাকায় , যত্রতত্র ঘোরাঘুরির অভ্যাস না থাকায়, ফোনের প্রতি অনীহা আর ঘরকুনো স্বভাবের জন্যই আমার শ্বশুর বাড়ির সাথে আমার পরিবারও আমার নেগেটিভ দিক খুঁজে পায়নি কখনো। আমার স্বল্পভাষীতাকেই সবাই স্বাভাবিক আচরণ বলে ভাবত। তারা কি করে জানবে আমার অহর্নিশি অন্তর্দহনের কথা ! এদেশে মেয়েদের সাথে মেয়েদের বন্ধুত্বকে সবাই সরল চোখে দেখে বলেই আমি বিপদমুক্ত অবস্থানে ছিলাম।


৫।

আসলে প্রকৃতি বিরুদ্ধ , অস্বাভাবিক , প্রাকৃতিক নয় – ইত্যাদি যত ধরণের শব্দ চয়নেই আমার , নন্দিতা , জেসিকা লাবণ্যর বা আমাদের মতো আর যারাই আছে তাদের শারীরিক বা মানসিক অবস্থার ব্যাখ্যা যত ভাবেই দেয়া হোক না কেন , সব Social Norm বা Taboo ছাপিয়ে আমাদের মতো মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ আসলে নিজেদের সাথে, নিজের কাছে স্বীকার করে নেয়া যে নিজের জীবনটা আর দশ জনের মতো আমাদের স্বাভাবিক নয়। আমার এমন একটা বিশেষত্ব আছে আর তা জানতে পারলে কাছের সব প্রিয় মানুষগুলো আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে – এ রকম সব হারানোর ভয় নিয়ে কি পরিমাণ এক অসহনীয় এই আবর্তে পড়ে গিয়েছি – তা যারা আমার মতো ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হয়নি বোধ করি তা কখনোই এ যাতনা বুঝবে না।


নেটে এ বিষয়ে বিস্তর ঘাটাঘাটি করে দেখেছি কত রকমের সংজ্ঞায়ই না সম প্রেমকে বিজ্ঞানী , মনোবিজ্ঞানীরা একে সংজ্ঞায়িত করেছে। এই সমকামিতা ছাড়াও রুপান্তরকামিতা, উভকামিতা শুধু মানুষই নয় প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগতেও বিদ্যমান। পাকিস্তানের ইফতি নাসিম কিংবা নিউজার্সির গভর্নর জেমস ম্যাকগ্রিভির নিজের নিভৃত সমকামিতার কথা স্বীকার করে পদত্যাগ , রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার , খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকের গ্রিসের লেসবো দ্বীপের “ স্যাপো ” নামের নারীর সমপ্রেম কিংবা আধুনিক জীববিজ্ঞান একে যতই নিখাদ বাস্তবতা বলে ধরুক না কেন – তাতে আমার কোনরকম বিকার বা সান্ত্বনা আসে না । আসে না বললে ভুল বলা হবে – আমার সান্ত্বনার বা স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। আমার জীবনের সুখ বা যাতনা গুলো আমিই ভালো বুঝি । তবে জানতে ইচ্ছে করে এই সম প্রেম নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা , মনোবিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা দিয়েছে এই পর্যন্ত তারা কিসের ভিত্তিতে দিয়েছে এই ব্যাখ্যা। তাহলে কি ধরেই নিবো তারাও সমব্যথী হয়েই এসব বলেছে !

আমার জীবনটা তো আমিই কাটাচ্ছি। শিক্ষার্জনে প্রাপ্ত বিবেক বোধ , পারিবারিক আবহ , ধর্মীয় শিক্ষা , শরীরের আভ্যন্তরীণ তাড়না -- সব মিলিয়ে কিসের মাঝে আমার জীবন কাটে সে আমি , নন্দিতা , লাবণ্য কিংবা সম-প্রেমে বেঁচে থাকা আমাদের মতো মানুষরাই বুঝবে ভালো।


৬।

ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার পর লাবণ্যর সাথে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ করিনি। পুরনো সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে আমার কখনোই ভালো লাগে না কেন জানি। তবু না চাইতেও দর্জির দোকানে ওর সাথে দেখা হয়ে গেলে জোর করে ও ধরে নিয়ে গেলো ওদের বাড়ি। অনেকদিন পর ওকে দেখলাম। ওর চেহারায় অসুখী ছাপ একেবারে স্পষ্ট। দেখে খারাপ লাগলেও ঐ খারাপ লাগাকে পাত্তা দিলাম না। । লাবণ্যর অনেক কিছুই এখন আমার জানা নেই।

অনেকদিন পর ওর শোবার রুমের গন্ধ আমাকে বেশ বাজে রকমের এক অস্বস্তি দিচ্ছিল। এক ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে দমন করলাম যদিও কিন্তু ওর অভিমানী কণ্ঠস্বর , হঠাৎ হঠাৎ ওর চোখ শ্রাবণের আকাশ হয়ে যাওয়া দেখে ওকে চড় লাগাতে ইচ্ছে করছিলো। ন্যাকামি মনে হচ্ছিলো সব কিছু।

- You bloody bitch ! Once you loved that poor girl
- Oh no . Shut up
- You are a bitch
- Ya , I am. Now keep quite
- You are a bitch .

আমার আরেকটা সত্ত্বাকে চড় মেরে চুপ করাতে চাইলেও তার হিসহিসে কণ্ঠ আমার কানে তোলপাড় তুলতে থাকে।

- কিরে সুহা , তোর জ্বর নাকি ? আয় তো দেখি বলে ও আমার কপালে হাত ছোঁয়াতে চাইলে আমি ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়াই।

- আজ কিন্তু আমাদের বাসায় তুই থাকবি । কতদিন পর এলি। ঢাকায় গিয়ে তো ভুলেই গেছিস !

আমি কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার যে ভালো লাগছে না এখানে বসে থাকতে। ওর খোলা বুক দেখতে। ওর সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে শুয়ে থাকা দেহভঙ্গীমা দেখতে। ও কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছে একটানা । ও কি করে এতটা অনুভূতিহীন হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না ঠিক।

Gender is located above, and sex is bellow the belt.

বলে আমি লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এই হাসিতে শ্লেষ ছিল যা ওর চোখ এড়িয়ে গেলো।

- আচ্ছা লাবণ্য , তুই সেক্সকে “ দেহ কাঠামো ” নামক ছোট্ট চৌহদ্দির মাঝে দেখতে চাস কেন বলতো আমায় যেখানে Gender সেক্সকে আরও উন্মুক্ত বা অবারিত নীলিমায় সংজ্ঞায়িত করছে বা প্রকাশিত হচ্ছে আরও ব্যাপকভাবে ?

- আমি তোর মতো করে এত বুঝি না। আচ্ছা শোন , “ ঘেঁটু পুত্র কমলা ” ছবিটা দেখতে যাবি ? তাহলে টিকিট কাটাবার ব্যবস্থা করি।


- টিভিতেই দেখাবে এই ঈদে। তখন দেখে নিস। ঘেঁটু বালকদের ইতিহাস জানিস ? শুনবি ?

ওকে ইতিহাস শোনায় আগ্রহী মনে হল না । বরং দীর্ঘদিনের উপোষ ভাঙতেই তাকে বেশী সক্রিয় মনে হল।

- শোন লাবণ্য , আমার ভালো লাগছে না এসব তোর সাথে। উঠবো আমি।


- কি ব্যাপার খুলে বলতো। ডিস্টার্ব কেন তুই এত ? সোহেল ভাইয়ার সাথে কোনো সমস্যা ?

আমার ওকে বলতে ইচ্ছে করে না আমি এম বি এ শেষ করে এবছরই চলে যাচ্ছি লন্ডন। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ও আমাকে বসিয়ে রাখে আরও কিছুক্ষণ। শোনায় সন্তান দানে অক্ষম বলে ওর স্বামী ডিভোর্স পেপার রেডি করছে। শেষ পর্যন্ত ওর আর কানাডা যাওয়া হচ্ছে না। ডিভোর্স হচ্ছে বলে ওকে ততটা বিমর্ষ ও মনে হচ্ছে না। অবশ্য বিমর্ষ হবেই বা কেন !


আমিও খুশী। বাংলাদেশে বসে সোহেলকে ডিভোর্স দেয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং সোহেলের বিরহে দিনকে দিন নিজের মাঝে গুটিয়ে যাচ্ছি, ওর কাছ থেকে দূরে আছি বলে এবং সোহেলের দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও ওর কাছেই যেতে চাচ্ছি – এটা আমি মুখে না বলেও আমাদের দুই পরিবারকেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। অথচ কেউ টেরই পাচ্ছে না আমি আসলে কি কারণে লন্ডন যেতে রাজী হয়েছি। নাহ , আমার worldwide সম প্রেমের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। আমি নিভৃতে নিজের মতো পুরুষ সঙ্গমহীন একটা জীবন কাটাতে চাই যা আমি মুন্সী বাড়ির মেয়ে হয়ে পারছি না


আসলে আমরা কেউ কি জানি একেকটি মানুষ বুকের মাঝে কি গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায় ! কোনো বিষণ্ণতায় ভরা গজলের মাঝে এত হাহাকার থাকে না যতটা বেদনা প্রোথিত থাকে বা আমরা আমৃত্যুই আড়ালে রেখে দেই একটা অস্বাভাবিক জীবন কাটিয়ে আমাদের চোখের পাতায় পাতায়। আমি এই মন হু হু করা এই ব্যাকুল বিরহের নাম জানি না। আমার মতো মানুষগুলোর মাঝে কতো যে পাতা ঝরার কান্না আর শব্দ মেঘের মতো ঘনীভূত হয়ে আছে তা নিজের দগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা দিয়েই বুঝতে পারছি। বিপন্নতায় ভরা এই দীর্ঘশ্বাসগুলো বড্ড হলুদ আর ধূসরাবৃত ঠিক যেন মধ্যাহ্নের আকাশে ম্লান কৃষ্ণ বর্ণ চোখের মতো।


( সমাপ্ত )







সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ সকাল ১০:৪০
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×