somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নষ্ট মানুষ

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের জিএম আনিস স্যারের চেয়ারটা দখল করতে পারলে এমডি স্যারের খুব কাছাকাছি চলে আসা যেত আমি নিশ্চিত। কিন্তু আনিস স্যারকে গিয়ে তো তো এটা আর বলা সম্ভব না যে – ‘ স্যার আপনি পদত্যাগ করলে আমার জন্য সুবিধা হত !’ একা নিজের রুমে বসে ভিলেনি কায়দায়ও প্র্যাকটিস করেছি বহুদিন , সোজা তার রুমে গিয়ে ঢুকে কলার চেপে ধরব, চোখের আগুনে পুড়িয়ে দিব তাকে যদি সে আমার আদেশ মেনে তার চেয়ারটা আমার জন্য না ছাড়ে। সজোরে চড় কশাবো তার গালে - এরকম কতদিন কাজের ফাঁকে কল্পনায় বিভোর হয়ে দেখেছি আনিস স্যারের বাঁ গালে লাল লাল হয়ে ফুটে আছে আমার আঙুলের নির্দয় ছাপ! এসব ভাবতে ভাবতে এক পর্যায়ে দেখলাম আমার কল্পনাগুলো তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে লাগলো প্রতিনিয়ত; খুব ধীরে ধীরে। তাকে চাকরীচ্যুত করার জন্য সম্ভাব্য হুমকি ধমকি নিজে নিজে এতবার রিহার্সাল দিতাম কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই , একটা সময় আমার কাছে আমার এ অন্যায্য চাওয়া, চিন্তা আর লোভগুলো কে আর অস্বাভাবিক কিছু মনে হত না । বরং আমার মাঝে এ ধারণা স্পষ্ট হয়ে চেপে বসতে লাগলো যে , অফিসের সবাই মিলে আমাকে জোর করে, অন্যায়ভাবে সুবিধা বঞ্চিত করে রেখেছে। এর মাঝে আমি বেনামীতে আনিস স্যারের বাসায় তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে গোটা তিনেক চিঠি অবশ্য পাঠিয়েছি। এক ছুটির দিনে পোস্ট অফিসের সামনে যে টাকার বিনিময়ে চিঠি লিখে দেয় তাকে দিয়ে তিনটা চিঠি লিখিয়েছি। সেই চিঠি লেখকের নাম – বাদশা মিয়া। ফোনে তার স্ত্রীকেও অপহরণের হুমকি দিব কিনা সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত বদল করে ফেলি কারণ হঠাৎ করে মনে পড়ল নিঃসন্তান আনিস স্যারের স্ত্রী মাস পাঁচেক হল মারা গিয়েছেন। এক পর্যায়ে এটাও মনে হয়েছিল হাজার দশেক টাকা খরচ করে গুণ্ডাপাণ্ডা দিয়ে তার হাত পা ভেঙ্গে তাকে হসপিটালে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু উত্তেজিত হলে আমার পরিকল্পনা বিফল হতে পারে ভেবে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনি। বরং তাকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন করে তুলতে পারলে আমার সফল হবার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। তাই সেদিকেই মনযোগী হবো বলে ঠিক করলাম অবশেষে ।


তাকে খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতে গিয়ে বুঝলাম, অনেক কাজের ভিড়ে থেকেও উনি মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যান। তাই আমার দিকে তার মনোযোগ আকৃষ্ট করতে একদিন অফিসে লাঞ্চ টাইমে তাকে বললাম আমার কাছ থেকে খাবার শেয়ার করতে। হালকা গল্পগুজবের ফাঁকে ফাঁকে আমি বাসা থেকে আনা আমার সুস্বাদু খাবারগুলোর দিকে তাকে মনযোগী করে তুলি, তার প্লেটে খাবার তুলে দেই। এভাবে পরপর কয়েকদিন তার সাথে লাঞ্চের সময়টা পার করলে তার সাথে আমার একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং একদিন বিকেলে উনার রুমে আমাকে উনি কফি পান করতে ডেকে পাঠান। আমার মতো উনি নিজেও কথা কম বলেন বলে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না ঠিক কীভাবে আমাদের আড্ডাটা শুরু করব। অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই আমি একটা তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যের অবতারণা করি এই বলে যে , ‘ বই অবসরের একটা ভালো সঙ্গী হতে পারে !’

কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে জানান কিছুদিন যাবত উনিও একই কথা ভাবছিলেন। কেননা বাসায় ফেরার পর সময় কাটানো টা তার কাছে বিরক্তিকর, একঘেয়ে লাগছিল। তার এই ইচ্ছা পোষণের জন্য তাকে আমি স্বাগত জানাই এবং কথা দেই তাকে কিছু ভালো মানের বই পড়ার সুযোগ করে দিব কিংবা উনি চাইলে তাকে কোনো জার্নাল কিংবা সিনেমাও যোগাড় করে দিতে পারি।

এ কথা শুনে আনিস স্যার আমার প্রতি কৃতজ্ঞ অনুভব করেন এবং আমিও তাকে বোঝাতে সমর্থ হই – উনার এ বয়সের একাকীত্ব কতটা যন্ত্রণার! আমি জানি আমি কী করতে চলেছি তাই উনার সামনে গেলে আমি আমার প্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতাম। আমার ধ্যান-জ্ঞান তার মাঝে ছড়িয়ে দিতে মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে বা বিকেলে আড্ডা দিতে দিতে আমার পড়া কোন বইয়ের অংশবিশেষ নিয়ে তার সাথে কথা বলতাম। আমি জেনে বুঝেই তাকে নিঃসঙ্গ মানুষদের গল্প শোনাতাম। শুনে উনি বিষণ্ণ হতেন। তবে নিঃসঙ্গ মানুষও তার একঘেয়েমি কাটাতে জীবনে বৈচিত্র্য আনতে আগ্রহী হতে পারে। এরকম একটা বই-ই তাকে পড়তে দিয়েছিলাম একবার। বৈচিত্র্য নিয়ে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া নিয়ে উনি সেদিন তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন –

“ ….গল্পে লেখক, নিখিল বড়ুয়ার একাকীত্ব কাটাতে তাকে রান্নাবান্নার প্রতি মনযোগী না করলেও পারত ! কিংবা দেখো, মধ্য বয়সে এসে লোকটার কি এমন প্রয়োজন ছিল গান শেখার ? বরং এত ঝামেলায় না গিয়ে নিখিল বড়ুয়াকে লেখক একটা বিয়ে করিয়ে দিলেও পারত।
তোমার কি মনে হয় ? ”

আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে উনাকে বলি – নারী কখনই স্থায়ী কোনো বৈচিত্র্য কিংবা বিনোদনের আদর্শ সঙ্গী হতে পারে না; একমাত্র যৌন-সঙ্গী ছাড়া। তবুও যৌনতায় নারীর ক্রমাগত নিরাসক্ততা কিংবা একই ভঙ্গিতে দিনের পর দিন উপস্থিতিও বিরক্তির কারণ তৈরি করতে পারে। নারী শুধু তাই না, একজন পুরুষের সৃষ্টিশীলতা কমিয়ে দেয়, তাদের বায়না , লোভ সব মিলিয়ে জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারে ইত্যাদি নানা যুক্তি দেখাই বিয়ের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে। কারণ আমি কিছুতেই চাচ্ছিলাম না , আনিস স্যারের মনোযোগ বিয়ে-কেন্দ্রিক হয়ে যাক।


একসময় আনিস স্যার স্বীকার করতে বাধ্য হন, ঠিক স্বীকার না – একরকম কনফেশান বলা যায়। উনি জানান বর্তমানে বিছানায় হাত-পা আয়েশ করে ছড়িয়ে ঘুমাতে গিয়ে উনি টের পাচ্ছেন স্ত্রী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্তও উনি একটা খাঁচার মাঝে এইটুকু জায়গায় ঘুমাতেন। হাত দিয়ে উনার শোবার জায়গার প্রসারতা দেখাতে ভুল করেন না। বিছানার চাদর কুঁচকে থাকা নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকা কিংবা সপ্তাহান্তে বাজার করার ঝামেলাও অনুভব করছেন না । তাছাড়া খেতে বসে চপচপ শব্দ করেও খেতে পারছেন যা আগে উনার স্ত্রী জীবিত থাকতে করতে পারতেন না। তখন একটা সময় উনার মনে হচ্ছিল উনি খাবারের স্বাদও হারাতে বসেছেন। এসব বলতে গিয়ে একই সঙ্গে তার চেহারাতে খেলা করে পুরনো ক্রোধ এবং স্বস্তির ছায়া।



একবার উনাকে একটা বই দিয়েছিলাম পড়তে। বিষাদগ্রস্ত হবার মতো বই, নামটা যদিও মনে পড়ছে না। অনেকদিন আগে সেই ছাত্রাবস্থায় Orphanage Band এর Oblivion album এর একটা গান শুনে ভালো লেগেছিল বলে লিরিকটা কপি করে রেখেছিলাম। সেই লিরিক খুঁজে বের করে আমি বইয়ের ভাঁজে তিনটা আলাদা কাগজে লিখে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। লাল কালিতে গাঢ় করে লেখা লাইনগুলো যাতে তার মগজে গিয়ে বিদ্ধ করে এই ছিল আমার উদ্দেশ্য –

Welcome to addiction, depression, corrosion, affliction
correction, repression, relapsing, collapsing
Into the abyss of progression


আরেক পাতায় লিখলাম –
Confined in yourself
Confined in pain
Confined in agony and shame


এবং বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় আরেকটা কাগজে লিখে রেখে দিলাম
I SHOULD DIE

আমি নিজের ঘরে বসে দিব্যি দেখতে পাচ্ছিলাম গল্পের বইয়ের বিষয়বস্তুর চেয়ে শেষের পাতার ওখানে রাখা লাল কালিতে লেখা I SHOULD DIE এই দিকেই উনার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। চোখে জেগে উঠেছে মৃত্যু চিন্তা, ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে হয়ত উনি রাতের খাবারটাও খেতে পারছেন না। কল্পিত এইসব দৃশ্যপট আমাকে সেদিন ভীষণ আনন্দ দিয়েছিল।

এরমাঝেই তাকে এক ছুটির দিনে জানাই আমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে সন্ধ্যায় তার বাসায় আসব তাকে সঙ্গ দিতে এবং রাতের খাবারটা এক সাথেই খাব। নির্ধারিত সময়ে তার বাসায় গিয়ে পৌঁছালে উনি খুব আহ্লাদিত হয়ে আমাকে জানান আজকালকার ছেলে-মেয়েরা কেউই সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। সে তুলনায় আমি একজন রত্ন ! সেদিন খাবারের প্যাকেটের পাশাপাশি আমার হাতে ছিল আরও একটা বই - Emile Durkhein এর যুগান্তকারী বই ‘ সুইসাইড ’, যা শুধু একটা কেস স্টাডিই ছিল না , ছিল আত্মহত্যার ওপর একটা ক্লাসিক প্রতিফলনও ।

আমি চাচ্ছিলাম উনি বইটা পড়ে জানুন ঠিক কী কী কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে, যাতে নিজের সামাজিক মূল্যায়ন বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন, উনি কার কার কাছে প্রয়োজনীয় এবং হতাশ হয়ে যেন বেছে নেন নানাবিধ মৃত্যুর উপায় থেকে পছন্দনীয় একটা পদ্ধতিতে, আলিঙ্গন করুন ‘ মহান মৃত্যুকে ’! মৃত্যু আবার মহান হয় নাকি? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করি। আমি একটা মানুষকে মৃত্যুর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে তার কাছে মৃত্যুকে মহান করতে নানান যুক্তি নিজের মাঝে গুছাতে থাকি যা দিয়ে আনিস স্যারকে প্রভাবিত করা যায়। মানব জাতির শেষ গন্তব্য যেহেতু মৃত্যু, তাহলে কেন রোগ- ব্যাধি, মানসিক যন্ত্রণা, একাকীত্ব সয়ে জীবনকে দীর্ঘাইয়িত করা এবং সাথে নিজের প্রিয় মানুষগুলোকেও ব্যথিত করা – এধরনের বক্তব্য নিজে নিজে অনেকবার রিহার্সাল দেই যাতে উনার বইটা পড়া শেষ হলে শুধুমাত্র যেসব ব্যক্তিরা আত্মহত্যা করেছে তাদের পক্ষে সহমত জানাতে পারি যে – তাদের সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক।

সেদিন আমার আনা খাবারগুলো তাকে ঠিক তৃপ্তি দিচ্ছিল না । আমিও চাচ্ছিলাম উনি আর কোনোদিন যেন তৃপ্তি না পান খেয়ে, ঘুমিয়ে, এমন কি চলাফেরা করেও। এই বয়সে তোমার আর খেয়ে কি হবে বুড়া ভাম কোথাকার ! বয়স তো আর কম হল না। আটান্ন পার করে ফেললে ! এবার চেয়ারটা ছাড়ো – আমাকে জীবনটা উপভোগ্য করে তুলতে দাও অর্থের বিনিময়ে – খেতে খেতে আমি এসব চিন্তাকেও হৃষ্টপুষ্ট করছিলাম। উনার প্লেটে খাবার তুলে দিতে গেলে উনি অস্বীকৃতি জানান। আমি ব্যথিত হবার ভান করলে উনি বলেন – চল, হোম থিয়েটারে কোন মুভি দেখি।
হোম থিয়েটার তোমার ইয়ে দিয়ে ঢুকাবো - মনে মনে বলি আমি। উনি ততদিনে আমাকে ‘ তুমি’ সম্বোধনে নেমে এসেছেন নিজের অজান্তে। আমি তাকে জানালাম মুভি দেখার চেয়ে আমরা বরং বারান্দায় বসে ঢাকার রাতের সৌন্দর্য দেখতে পারি সুউচ্চ এপার্টমেন্ট থেকে।

মনের উপর চাপ ফেলতে কিংবা নিজের চেহারার অসৎ অভিব্যক্তি লুকোতে অন্ধকারকেই আমার যথার্থ এবং নিরাপদ মনে হয় । ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেই। আনিস স্যার আর উনার স্ত্রী সম্ভবত মাঝে মাঝে বারান্দায় এসে বসতেন পাশাপাশি দুটো চেয়ার দেখে ভেবে নেই আমি। গাঁজা ভরা একটা সিগারেট উনার দিকে এগিয়ে দিলে আবছা অন্ধকারেও তার প্রফুল্ল হয়ে ওঠা চেহারা দেখে মনে হয় – এই মুহূর্তে উনি হয়ত মনেমনে এটাই আশা করছিলেন। যদিও উনি ধূমপায়ী নন কিন্তু তার আবেগের দুর্বল মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে সিগারেটকে করে দিয়েছি তার কাছের সঙ্গী হিসেবে কোন ফাঁকে উনি বোধ হয় তাও ধরতে পারেন নি। তাই গাঁজা ভরা সিগারেট টেনেও উনি এম্যাচার হিসেবে এর তফাৎ ধরতে পারেন না। তাকে বলি –

‘ স্যার, আপনি কি জানেন বিশেষ এক প্রজাতির পাখি আছে যারা ঝাঁক বেঁধে বছরের কোনো এক সময়ে আত্মহত্যা করে কোনো কারণ ছাড়াই ? আরও আছে এক প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী তারাও দল বেঁধে সমুদ্রের পানিতে নেমে পড়ে? ’

উনি সে সব প্রজাতির আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাকে আমি Weltschmerz নিয়ে বলি। মানসিক ব্যথা, বিষণ্ণতা, পদত্যাগ , পলায়ন প্রবৃত্তি, উন্মত্ততা ইত্যাদি কারণে বা কোন সার্বজনীন ব্যথায় কিংবা কারণ ছাড়াই আত্মহত্যা নিয়ে বোঝাতে বোঝাতে অপেক্ষা করি উনি কখন বলে উঠবেন –

‘ আসলেই জীবনটা অর্থহীন !’

তখন আমিও তাকে বলতে পারব আসলেই তার বেঁচে থাকার জন্য শক্তিশালী কোনো কারণ নেই ।


আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও তাকে বলতে শুরু করি –

এত দীর্ঘ জীবন কাটিয়েও মানুষ কেন আরো বেশীদিন বেঁচে থাকতে চায় আর এ চাওয়াটা যে নিছক নির্বুদ্ধিতা সেটা একদিন দেরীতে হলেও মানুষ বুঝবে। মূলত বুদ্ধিমান তারাই যারা রোগ- ব্যাধি, আর্থিক-মানসিক-সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার আগেই মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। কেননা তারা জানে দীর্ঘজীবন মানেই অবসাদ এবং একঘেয়েমিতে ডুবে যাওয়া।



আনিস স্যারের আধো আলো-ছায়ায় ঘেরা বারান্দায় লিভিং রুম থেকে ভেসে আসা সিডি প্লেয়ারের ধীর লয়ের ভায়োলিনের সুর এই মুহূর্তে পরিবেশটাকে আমার উদ্দেশ্য পূরণের অনুকূলে রেখেছিলো। আর উনাকে দেখে মনে হচ্ছিল ধ্বসে পড়ার জন্য অপেক্ষারত কোনো প্রতিকৃতি। ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটা পার করলে আমার স্ত্রী ফোন দিতে পারে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে পারে – এটা ভেবে উনার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলে উনি কাতর হয়ে জানান আজ রাতটা যেন উনার বাসাতেই কাটাই। কিন্তু নিজের বিছানা ছাড়া আমার ঘুম হয় না , দম আটকে আসে বলতেই উনি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বলেন –

‘ ক’দিন আগেই তো বলছিলে নারী বৈচিত্র্য এবং বিনোদনের কোনো স্থায়ী সঙ্গী হতে পারে না। তারা পুরুষদের প্রতিভাকে গলা টিপে হত্যাও করতে পারে সুযোগ পেলে। তবে কেন বাসায় ফিরতে চাচ্ছ ? নাকি বউ ছাড়া চলে না ?’ বলতে বলতে উনি চিৎকার করতে থাকেন অজানা কোনো ভয় বা নিঃসঙ্গতা কাটাতে।

হাহাহ বুড়ো ভাম , বুঝতেই তো পেরেছ কেন বাড়ি ফিরতে চাইছি। নতুন বিয়ে করা বউ রেখে তোমার সাথে সময় কাটানো আমার জন্য সুখকর কোনো বিষয় না। বরং সময় আসলে সবকিছু সুদে-আসলে উসুল করে নিবো। কিন্তু এসব তাকে না বলে আমিও আমার কণ্ঠে একদিকে অসহায়ত্ব অন্যদিকে ক্রোধ ফুটিয়ে তুলি , নিজেকে উনার মতই নির্যাতিত বলে উপস্থাপন করি। উনার হাত ছুঁয়ে উনাকে আশ্বস্ত করি খুব শীঘ্রই ,একদিন এসে থাকব।

আনিস স্যার আমার কথা বিশ্বাস করেন। আবেগে তার চোখ ভিজে ওঠে। বিড়বিড় করে উনি বলতে থাকেন আমি যেন আমার স্ত্রীকে ছেড়ে খুব দ্রুতই আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উনার ফ্ল্যাটে উঠে যাই। তাহলে আমি এখানে হতে পারবো আমার ইচ্ছের মালিক। নিজের ইচ্ছেমত খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কিংবা চিন্তা-ভাবনায় বিঘ্ন ঘটাবার কেউ থাকবে না। তার এসব কথা শুনে আমি আশ্বস্ত হবার ভান করি, তাকেও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভেবে আমার দু’চোখে স্বপ্নের আবেশ নিয়ে আসি। প্রতিশ্রুতি দেই খুব শীঘ্রই আমার স্ত্রীকে ত্যাগ করে প্রবেশ করব তার স্বর্গ রাজ্যে। উনি পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সাথে যোগ করেন

– ‘ প্রয়োজনে সামিহাকে খুন করো। তোমার মেধা সংসারে বিকিয়ে দেবার জন্য না ।’

এ কথা বলতে বলতে এলোমেলো পায়ে আমার পেছন পেছন আসছিলেন আমাকে বিদায় দিতে। ভাগ্যিস এসব বলার সময় উনি আমার পেছনেই ছিলেন এবং সেজন্যই আমি জোর গলায় বলেছিলাম ‘ অবশ্যই ’। আলোর সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে , তাও আবার নির্লিপ্ত ভাবে বলার মানে হচ্ছে সত্যিই মিথ্যে বলা। যদিও উনি পেছন থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না বা আমি নির্লিপ্ত হবার ভান করছিলাম কিন্তু উনার কথা শুনে আমার ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল, দু’তিন সেকেন্ডের জন্য চোখও বুঝি বা বিস্ফোরিত হয়েছিল । অবশ্য গাঁজার নেশায় তার এতক্ষণে আচ্ছন্ন হয়ে যাবার কথা।
কাল অফিস আছে , স্যার। শুয়ে পড়ুন – বলে উনাকে বিদায় জানালে উনি ঘুম ঘুম আবেশে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলেন উনার অফিসে যেতে সত্যিই ভালো লাগে না।

শুনে আমার ঠোঁটের প্রান্তে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।মনে মনে বলি- তুমি আর কখনোই অফিসে না যাও আমি তো তাই-ই চাই। তুমি অথর্ব হয়ে যাও, হয়ে পড় দৃষ্টি শক্তিহীন, আক্রান্ত হও বধিরতায় – আমি যে সেটাই চাই বুড়ো ভাম।

যেতে যেতে শুনি বুড়োটা বলছে ‘ দরজাটা ভেতর থেকে লক করে যেও, ।’

যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাসায় ফিরলে সামিহার রাগ ভাঙ্গাতেও বেশ বেগ পেতে হবে। বাসার কাছাকাছিই একটা সুপার শপ আছে যা গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। ওখান থেকে নতুন ফ্লেভারের ‘ ব্ল্যাক ফরেস্ট ’ আইসক্রিম নিতে হবে ওর জন্য। ও যখন আহ্লাদ করে করে আইসক্রিম খায় দেখতে আমার ভালই লাগে। সামিহা, আমার স্ত্রী । এখন পর্যন্ত যার গা থেকে বিয়ের নতুন গন্ধও পুরোপুরি ছেড়ে যায় নি। সাফল্য, টাকা, ফ্ল্যাট, প্রোমোশন – এ সব কিছুই তো সামিহাকে নিয়ে উপভোগ করব বলে শিকার করলাম জিএম স্যারের মত বুড়োটা কে !



গত রাতের শারীরিক- মানসিক অবসাদ কাটিয়ে আজ আনিস স্যার অফিসে আসতে পারবেন না মনে করি , আর যদিও বা আসেন সময় মত পৌঁছাতে পারবেন না , আমি জানতাম। কেননা উনার চিন্তার জগত ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল আমি টের পাচ্ছিলাম এবং আশায় ছিলাম খুব তাড়াতাড়িই আমি সফল হব আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে।

আমাদের বছরে দু’বার ইনক্রিমেন্ট হয়। সব স্টাফদের হিসাবনিকাশ গুছিয়ে এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা স্যালারি পাওয়া আনিস স্যারের হাতে আজ আমার তুলে দেয়ার কথা , যেখানে এমডি স্যারের স্বাক্ষর থাকবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম স্যার এসে কখন ডাকবেন আমাকে।

যথাসময়ে এমডি স্যারের রুমে ডাক পড়লে আমি আমাদের স্টাফদের পারফর্মেন্সের রিপোর্ট স্যারের টেবিলে রাখছিলাম যখন তিনি আনিস স্যারের খোঁজ করে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, তখন বলতে হয়- আনিস স্যার অসুস্থ থাকায় আজ আসতে পারেন নি। সময়মত কোনো কাজ না হলে কিংবা কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে না পাওয়া গেলে যে কারোরই বিরক্ত লাগতে পারে এবং একেকজনের প্রকাশভঙ্গি একেক রকম হতে পারে। এমডি স্যারও তার ব্যতিক্রম নয় যে কারণে তাকে বলতে শোনা গেল ‘ রাবিশ ’।

প্রায় পাঁচ দিন পর আনিস স্যার অফিসে আসলেন এক বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে। তার মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর কোঁচকানো পোশাকের ভাঁজ থেকে কেমন একটি বিবর্ণ , অস্পষ্ট মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছিলাম। তার চোখ দুটো ছিল নিভুনিভু। ক’দিন আগেও যে মানুষটাকে সোজা হয়ে হাঁটতে দেখেছি আজ দেখি উনি কেমন কুঁজো হয়ে হাঁটছেন।

তার নিজের চেয়ারে ভীরু ভীরু ভঙ্গিতে তাকে বসতে দেখে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম উনি এখন আলোর সামনে আসার চেয়ে অন্ধকার আর নিরিবিলিতে থাকতেই আরাম বোধ করেন বেশী। দুপুরে খেতে বসে উনি জানান উনাকে আরও কিছু বই যোগাড় করে দিতে। আমি উনার কথার উত্তর না দিয়ে খাওয়ার দিকে মনোযোগী হতে চেষ্টা করি, অবশ্য সেই সাথে অপেক্ষাও করি উনার এতদিনের না বলা কথাগুলো শোনার জন্য। কিন্তু উনিও কিছু জানান না উনার পরবর্তী পদক্ষেপ বা এতদিনের অনুপস্থিতে কি কি ভাবলেন বাসায় বসে , বিশেষ করে চাকরী নিয়ে কিছু ভেবেছেন কি না। সিনিয়র অফিসার হিসেবে পাঁচ বছর কাটিয়ে শুধুমাত্র ইনক্রিমেন্টে সন্তুষ্ট হয়ে আমার পক্ষে ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়া আর সম্ভব হচ্ছিল না। আমার পদোন্নতি চাই যে কোন মূল্যে, চাই আনিস স্যারের চেয়ারটা !

স্যার জানান আগামী আরো কিছুদিন উনি ছুটি কাটাবেন। শুনে তাকে আমি উৎসাহ দেই তার সিদ্ধান্তের জন্য। বলি , এখন তার বিশ্রাম নেবার বয়স। অতিরিক্ত পরিশ্রম, অফিসের কাজের চিন্তা তার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিস্বরূপ এবং তার ছুটি কাটাবার চিন্তা সময়ের প্রেক্ষিতে একেবারেই সঠিক। তাকে এ বলেও আস্বস্ত করি যে তার অনুপস্থিতে তার কাজগুলোও আমি করে দেবো। শুনে উনি আস্বস্ত হন , চোখ বুজে থাকেন কিছুক্ষণ। এই চোখ বুজে থাকা ভাত ঘুমের প্রভাবেও হতে পারে।


আগামী দিন সন্ধ্যায় তার জন্য আরও কিছু বই নিয়ে আমি তার ফ্ল্যাটে যাবো এটা নিশ্চিত করলে উনি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়েন যেন , ‘ আপনার অনেক দয়া , আপনার অনেক দয়া বলে ’ আমার সাথে করমর্দনের চেষ্টা করেন। উনি যে আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন সেটাও হয়ত ভুলে গেছেন। এরপর উনি নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে অফিস থেকে বের হয়ে যান কাউকে কিছু না জানিয়ে এবং উনি বেরিয়ে যাবার ঘণ্টাখানেক পরেই এমডি স্যারের রুমে তার ডাক পড়লে যখন তাকে পাওয়া গেল না সেদিন এ অফিসে আনিস স্যারের জন্য অমোচনীয় কালিতে লেখা হয়ে গেল ‘No Entry ‘ সাইনবোর্ড।


আগামীকাল আনিস স্যারের অন্ধকারাচ্ছন্ন ফ্ল্যাটে শেষবারের মত যাবো বলে মানসিক প্রস্তুতি নেই। উনার সাথে খেলাটা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছিল বেশ, এমনটাই মনে হচ্ছিল। এর শেষ দেখা দরকার। অফিস শেষে আজ অবশ্য আমার একটা জরুরী কাজ আছে বলে বাসার দিকে না যেয়ে উত্তরাতে এক ভদ্রলোকের সাথে সময় দেয়া ছিল বলে সেখানেই রওনা হই। গত পরশু মারুফ হোসেন নামের এই ভদ্রলোকটি এসেছেন সুদূর মিলান শহর থেকে যার হাতে করে আমার শৈশবের বন্ধু তাতান বেশ কিছু মুখোশ পাঠিয়েছে আমার জন্য । তাতান অবশ্য খুব অবাকই হয়েছিল ইউরোপে থাকা বন্ধুর কাছে আমার ক্ষুদ্র আবদারের কথা শুনে। হাসতে হাসতে বলেছিল –

কি রে শেষ পর্যন্ত চাকরী ছেড়ে থিয়েটারে যোগ দিবি নাকি ?

জীবন তো এক ধরণের রঙ্গমঞ্চই ! – আমার কাছ থেকে এ রকম হেঁয়ালি উত্তর শুনে তাতান অবশ্য প্রসঙ্গ বদলাতে খুব একটা দেরী করে নি বরাবরের মত আক্ষেপ করা ছাড়া – ‘ তোরে আজও বুইঝ্যা উঠতে পারলাম না রে দোস্তো !’ ফোনে তাতানের দীর্ঘশ্বাসটা বেশ কিছুক্ষণ আমার কানে বাজে। এক পর্যায়ে ও নিজ থেকেই ফোন রাখতে চাইলে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইনটা আমিও কেটে দিয়েছিলাম।

আমাকে লোকে যত কম বুঝবে ততই ভালো আমার জন্য। এত বুঝাবুঝির ব্যাপার চলতে থাকলে তো মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যেই পৌঁছাতে পারত না। বিশেষ করে আমার মত লোভ যাদের মনের অলিতে গলিতে সারাক্ষণ বিচরণ করেছে ! আমার অন্ধকারে মোড়া উদ্দেশ্যগুলো লুকোতে হাতে মুখোশের প্যাকেটটা পেয়ে আমি তাতানের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করি কিছুক্ষণ।



মুখোশ পড়ে চেহারার অভিব্যক্তি লুকোনোর সাথে গলার আওয়াজ লুকোনো এবং কোনরকম কাঁপাকাঁপি ছাড়াই যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলা যায় সেটা অনুভব করে কিছুক্ষণ আগে পাওয়া মুখোশ গুলোকে এরই মাঝে আমার খুব আপন মনে হচ্ছিল বলে বাসায় ঢোকার আগেই আমি একটা মুখোশ পড়ে নিলাম। গেট খুলে সামিহা আমাকে দেখে একটু থমকে গেলেও কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ও নিজেও মুখোশ পড়ে ঘুরছে আমি ঘরে ঢোকার পর। শুধু তাই নয় , ওখান থেকে একটা মুখোশের মালিকানাও সে দাবী করে বসলো।

বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হবার পর সেদিন সামিহার পরামর্শে আমরা আমাদের চারপাশে একটা ইউরোপিয়ান আবহ ফুটিয়ে তুলতে সব কটা রুমের উজ্জ্বল বাতিগুলো নিভিয়ে মৃদু, নরম আলো ছড়িয়ে দিলাম। সাথে ছাড়লাম সফট সোলো মিউজিক, সামিহা ওর বিয়ের লাল গাউনটা পড়ল এবং দুজনে দুটো মুখোশ দিয়ে নিজেদের সজ্জিত করে একে অপরের কোমর জড়িয়ে ধরে তালে তালে নাচতে লাগলাম। অকারণ হাসিতে অসংখ্যবার আমরা একে অপরের গায়ে লুটিয়ে পড়লাম, দুজন দুজনের খুব কাছাকাছি আসলে নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলে আমরা শোবার ঘরে এসে উত্তেজক লাল রঙের বাতি জ্বালালাম এবং সে রাতকে উপভোগ্য করে তুলে স্মরণীয় করে রাখলাম। অবশ্য মনে মনে স্বীকার না করে উপায় নেই যে, বৈচিত্র্যতা আনতে মুখোশের জুড়ি নেই !


অফিস থেকে বের হয়ে পরদিন সন্ধ্যায় আমি আনিস স্যারের ভূতুড়ে ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হই। অন্যদিন তার ফ্ল্যাটে ঢুকলে কেমন এক বিবর্ণ, অস্পষ্ট মৃত্যুর মতো গন্ধ নাকে এসে লাগত। আজ উনার বিল্ডিং এর আশেপাশেও মনে হয় এ গন্ধ ছড়িয়ে গেছে। ধক করে এসে নাকে লাগছে গন্ধটা। তাতানের পাঠানো মুখোশ থেকে সবচেয়ে বীভৎসটা বেছে নিয়ে আমি লিফটে উঠেই পড়ে নিলাম। সামিহা সকালে অফিসে বের হবার সময়েই মুখোশের প্যাকেটটা মনে করে সাথে দিয়ে দিয়েছিল। এজন্য ভাবলাম বাসায় গিয়ে সামিহাকে আজ পুরস্কার হিসেবে একটু বেশীই আদর করব। ডোরবেলের শব্দে খুট করে উনি দরজা খুলে মুখোশ পরিহিত আমাকে দেখে আঁতকে উঠলেও আমার কণ্ঠস্বরে নিশ্চিত হয়ে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেন। বলেন –

- ওহ তুমি ! আমি ভেবেছিলাম ….
- কি ভেবেছিলেন ?
- নাহ কিছু না !

উনি কথা সমাপ্ত না করেই দরজা আটকে দেন। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে আলো আঁধারির খেলা। ঘরের বাতাস কেমন গুমোট আর বাজে দুর্গন্ধে ঠাসা মনে হচ্ছিল। রক্তবর্ণ চোখওয়ালা মুখোশের মাঝে থ্যাবড়ানো নাক, কোঁচকানো চামড়ার মুখমণ্ডল, সূচালো দাঁতসহ আমার ভেতরটাকে আমি প্রস্তুত করতে থাকি ধীরে ধীরে যে আজ এ বুড়োটার একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। আমি উনাকে মৃদু স্বরে কিছু বলতে চাইলেও আমার ভেতর থেকে কেউ একজন কর্কশ স্বরে ধমকে জানতে চায় –

বলছেন না কেন দরজা খুলে আমাকে দেখে প্রথমে কি ভেবেছিলেন ?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে বরং জানতে চান আমি উনার জন্য বই এনেছি কি না । আমি তাকে ধমকে উঠি। বলি –

ইহকাল নিয়ে আর মনযোগী না হতে। পৃথিবীর প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থেকে থাকলে যেন নিজের জীবনটা পৃথিবীর জন্য উৎসর্গ করেন যুগে যুগে যেভাবে মহৎ মানবেরা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। পৃথিবীর আলো- বাতাস- জমির ভাগ নিজের দখলে আর না রেখে এবার অন্যকে যেন সেটা উপভোগ করতে দেন।


আমার কথা শুনে উনি খুব কাতর হয়ে পড়েন। তাকে দেখে আগের চেয়ে আরও বেশী নিঃসঙ্গ এবং দুঃখী মনে হয়। উনি হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে পড়েন। করজোড়ে মিনতি করেন আরও কিছু দিন বেঁচে থাকবার জন্য। লোকটা পাগল না হলে বুঝতে পারত তাকে বাঁচিয়ে রাখবার বা মৃত্যুদণ্ড দেবার আমি কেউ নই ! হাহহাহ ! আমার মুখোশের ভেতর থেকে খসখসে সুরে কেউ বলে উঠলো –

ওপারে আপনার জীবনসঙ্গিনী নাজনীন আক্তার নিঃসীম একাকীত্বে লীন হচ্ছেন অহর্নিশি , সে খেয়াল কি আপনার আছে ? লোভ ত্যাগ করুন এবং জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হন সময় থাকতে !

আনিস স্যার তার কিছুক্ষণ আগের বক্তব্যের স্পষ্টতা হারিয়ে ধন্ধে পড়ে গেলেন। স্ত্রীর নামটা শুনে হয়ত বা কোনো বিয়োগ বেদনা জেগে উঠলো যা উনি হারিয়েছেন এবং পুরনো কান্না জেগে উঠলে অপ্রকৃতস্থ হয়ে ওঠেন। তবে দীর্ঘক্ষণ পর তার মাঝে কিছুটা স্থিতি আসলে উনার পূর্বের বিলাপের তীব্রতা কমে আসে।

হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে জানতে চান আমি এখনো কেন তার ফ্ল্যাটে পাকাপাকিভাবে উঠে আসছি না আমার স্ত্রী সামিহা কে ছেড়ে। আমি নিরুত্তর হয়ে রইলে উনি খেঁকিয়ে ওঠেন, তার ঐ মুহূর্তের ভঙ্গি দেখে আমার মুখোশের অসৎ আমির চেয়েও তাকে বেশী শক্তিশালী মনে হয়। বলেন-

‘ শেষবারের মতো তোমাকে বলছি , সামিহাকে খুন করাই হবে তোমার জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ !’

বুড়ো হাবড়া , তোর কথাতে আমি আমার বউ-কে খুন করব নাকি ? মনে মনে এ কথা বললেও আমি আমার বীভৎস মুখোশটা বদলে একজন অসহায়, বউ দ্বারা নির্যাতিত মানুষের মুখোশ পড়ে নেই। জানতে চাই –
কীভাবে খুন করা যায় ?

উনি জানান পানি ভরা চৌবাচ্চায় সামিহার মাথা ঠেসে ধরে তাকে শ্বাসরোধ করে। এতে খুনির কোন চিহ্ন ভিক্টিমের শরীরে পাওয়া যাবে না।

উনার কথা শুনে আমি আমার মুখোশে বোকা, মূর্খ মানুষের অভিব্যক্তি নিয়ে আসি। চৌবাচ্চা বা শ্বাসরোধ শব্দ আমি জীবনে এই প্রথম শুনলাম এবং এর অর্থ বুঝতে আমি ব্যর্থ – এটা উনাকে জানালে উনি আমাকে হাতে কলমে বোঝাতে চান এর মানে।

আমার বোকা বোকা, গোবেচারা মুখোশও আনিস স্যারের এই হাতে-কলমে দেখানোর সিদ্ধান্তে মুচকি হেসে আলো আঁধারির মাঝে উনার অলক্ষ্যে ক্রুর, ধূর্ত আরেকটি মুখোশ পড়ে নেয়।

উনি আমাকে ভাল করে খেয়াল করতে বলেন পানিতে পরিপূর্ণ চৌবাচ্চার প্রতি। উনার এক সময়ের সজ্জিত বাথরুমের চৌবাচ্চাটা দেখে মনে হল হয়ত এখানে উনার কোনো সুখ স্মৃতি থাকতে পারে প্রয়াত নাজনীন আক্তারের সাথে কিংবা উনিও হয়ত চিন্তা করেছিলেন স্ত্রীকে এভাবে চৌবাচ্চার পানিতে মাথা ঠেসে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার। আমি উনাকে জানাই চৌবাচ্চাটার পানি দেখতে অনেকটা সমুদ্রের নীল জলরাশির মতো । খুঁজলে এখানে নিশ্চয়ই ঝিনুক ভর্তি মুক্তো কিংবা তন্বী মৎসকন্যা পাওয়া যেতে পারে।

ধূর্ত মুখোশের কথা শুনে বুড়ো ভামের চোখে তন্বী মৎসকন্যা দেখার লোভে চকচক করে ওঠে। উনি ডুব দিতে চান সেই নীল জলরাশিতে। ধীরে ধীরে আমার হাত তাকে আরও অতলের সন্ধান দিতে চাইলে তিনি হাঁসফাঁস করে ওঠেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য। একটা সময় পর জলরাশির ঘূর্ণন কমে গিয়ে চারদিকে একটি নিস্তব্ধতা নেমে এলে আমি মুখোশটা খুলে ফেলি।

আমার দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে হয়ত বা এবং সেখানে কয়েক বিন্দু ঘাম জায়গা করে নিলেও সূর্যালোকের মতো আশার আলো ছড়িয়ে পড়ে আমার সারা দেহে , বিশেষত চোখে। হাতের কাছে আয়না থাকলে হয়ত দেখা যেত সেখানে ফুটে উঠেছে আমার স্বপ্নের সিঁড়িতে ওঠার পরবর্তী শিকারের মুখচ্ছবি।

আনিস স্যারের ফ্ল্যাট থেকে রাস্তায় নেমে এসে নিজের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, কামনা-বাসনাগুলোকে জাগ্রত রেখে ঠাণ্ডা বাতাসে কপালের ঘাম জুড়িয়ে নেই আমি।

আগামীকাল সকালের জন্য একটা নিপাট, ভালো মানুষের মুখোশ আজকেই গুছিয়ে রাখতে হবে বাসায় ফিরে। রাত্রির আঁধার কাটতে আর ক’ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে মাত্র !

সমাপ্ত


২৩টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×