somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিথিলা এবং ছায়াচ্ছন্ন সৌরভ

১৬ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১।
আমাদের মহল্লার করিম গুণ্ডার ছোট ভাই সুজন মারা গিয়েছে। সকালের দিকে খবরটা শুনতে পেয়ে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া হয় নি আমার মাঝে। একজন মানুষ মারা গিয়েছে , এ রকম কত মানুষই তো পথে-ঘাটে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন – সুজনের মৃত্যু সংবাদের ব্যাপারটাও এমনই একটি নিত্যকার ঘটনার মতো ছিল আমার কাছে। গুণ্ডার ভাই হয়ে গুণ্ডামি করতো , হয়তো এন্টিপার্টির সাথে বন্দুক যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে – তার পরিবার আর মহল্লা থেকে একটি আবর্জনা সাফ হয়েছে ভেবে, খানিকটা স্বস্তি পাওয়াই আমাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।কিন্তু পরদিন দুপুরে যখন এলাকায় মাইকিং শুরু হলো বাদ আসর সুজনের জানাজা পড়ানো হবে তখন জনির কাছে জানতে পেরেছিলাম যে, সুজনকে কেউ মেরে ফেলেনি , বরং আত্মহত্যা করেছিলো সে।

আত্মহত্যা অনেকেই করে থাকে কিংবা এর আগেও অনেকের আত্মহত্যার খবর শুনেছি বা জেনেছি নানা ভাবে। কিন্তু সুজনের আত্মহত্যার ঘটনার পেছনে যেটি মূল কারণ ছিল, তা সত্যিই আমাকে বিচলিত করে তুলেছিল । যাওয়া- আসার পথে অনেকদিন তাকে দেখেছি সিরাজ মামার হোটেলে তার গ্রুপের অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। কত আর বয়স হবে ওর , বড়জোর বিশ কি একুশ বছর। তবে মহল্লার ভদ্র এবং বড় ভাই হিসেবে চলার পথে কখনো আমার সাথে তার মুখোমুখি হলে সে সালাম দিয়ে কিংবা হাতের সিগারেটটা চট করে তালুর মাঝে লুকিয়ে ফেলার সুনিপুণ দক্ষতা দেখাতেও কখনো ভুল করে নি। সবচেয়ে বড় কথা , আমি বেশ শক্ত ধাতুতেই গড়া একজন মানুষ বলে ভাবি নিজেকে, এত সহজে বিচলিত হবার ছেলে আমি নই । তবে খুব সুক্ষ্মভাবে আমি টের পাই যে, সুজনের আত্মহত্যার কারণটির সঙ্গে হয়তো কোনো না কোনো দিক দিয়ে আমিও কম বেশি জড়িয়ে আছি জানুয়ারির সকাল কিংবা সান্ধ্য কালীন ফিনফিনে কুয়াশার মতোই।

মরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে সুজন রেললাইনের ওপর শুয়েছিল আর তার ওপর দিয়ে একটা যাত্রীবাহী ট্রেন চলে গিয়েছিলো বলে শরীরটা বেশ কয়েকটি টুকরোতে ভাগ হয়ে গিয়েছিলো। বিচ্ছিন্নভাবে ট্রেন লাইনের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার শরীরের টুকরোগুলো খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল বলে আত্মহত্যার ঘটনার দু’দিন পর জানাজা হয়েছিলো তার। আমার যতটা বিশ্বাস, সে মূলত আত্মহত্যা করেছিলো ভালোবাসার কারণে। যতটুকু আমি জানি যে, একটা মেয়েকে ভালোবাসতো খুব নীরবে। কিন্তু তার হৃদয়ের সেই বার্তা কখনো পৌঁছোয়নি মেয়েটির কাছে। একদিন হঠাৎ মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়াতে হয়তো ঘটনাটি সে মেনে নিতে পারেনি মন থেকে। আর সেই অভিমান থেকেই হয়তো আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। কিভাবে নিজের হাত – পা বেঁধে , নিজের মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে দেহটাকে বিছিয়ে দিতে পেরেছিল রেল লাইনের ওপর, সময়টা তখন মধ্যরাত কিংবা আরো গভীর ছিল কিনা এবং সে সময়টিতে কোনো সুখী মানুষ গুনগুনিয়ে কোনো চেনা সুর তুলছিল কিনা তার গলায় - কেউ জানতে পারে নি।

তবে আমার ধারণা মেয়েটাকে ভালোবেসে বেসে ক্লান্ত অথবা বোধ-বিবেচনাহীন হয়ে গিয়েছিলো সুজন। তাই হয়তো রেললাইনে শুয়ে থেকে ট্রেন আসার শব্দ পেয়েও সেখান থেকে সরে যেতে ইচ্ছে হয়নি তার কিংবা তার প্রত্যাশা মতো তখনই মেয়েটা এসে ওকে বুকে তুলে নেয় নি। কেই বা তাকে বুকে তুলে নেবে বা সেই মেয়েটাই বা আসবে কোথা থেকে! অবশ্য আমার মতো যদি তারও একজন মিথিলা আপা থাকতো তাহলে ঠিক শেষ মুহূর্তে এসেও হয়তো বেঁচে যেতে পারতো সে । আমার খারাপ কিছু হলেই কি করে যেন টের পেয়ে যান তিনি বুঝতে পারি না। আর সে জন্যই তাকে এতটা ভালবাসি আমি। তাকে সবাই মিথিলা বলে ডাকলেও আমার কাছে তিনি “ মিথি”। আর বিশেষ মুহূর্তে “আমার মিথ” কিংবা শুধুই “মিথ ”। আহ ! আমার মিথ-এর কথা মনে হতেই সুজনের আত্মহত্যার ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ ভাবটুকু যেন উবে গেলো মুহূর্তেই। মিথির সৌরভ এমনই মাদকতার সুগন্ধিতে মোড়ানো যে, আমি তার মৌতাতে লীন হয়ে যেতে থাকি গলিত মোমের মতোই। আর তাই যেন আমার মনের কোনো এক দূর্গম উপত্যকায় ধ্বনিত হয় বারংবার-
তুমি তো আমার মিথি, মোহন শিল্পের বর্ণালী বিভাসের তুমুল আধার। প্লাস্টার অভ প্যারিস ঢাকা দুধ-সাদা সারাবেলা- সচঞ্চল দিনরাত্রি। তিরতির মাংসের ভেতর আগ্রাসী অন্ধকারে ধূপ-চন্দন মাখা হৃদয়ের আরতি!

২।

আমি যখন প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়ে সদ্য কলেজে ঢুকেছিলাম, বড় হয়ে গেছি এমন একটা ভাবের ঘোরে যখন আমার বরাবরের মৌন স্বভাবের মাঝে আরও কিছুটা গম্ভীরতা নামের বাতাবরণ সেঁটে দিয়েলাম , তখন মিথিলা আপারা নতুন এসেছেন আমাদের মহল্লায়। নিজেদের বাড়ি বানিয়ে উঠেছিলেন সেখানেই। উনি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সে সময়টায় নতুন প্রতিবেশী এবং কৌতূহলজনিত কারণে আমি , মৃদুল , ফয়সাল আর জনি দুপুরবেলাটায় উনাদের বাসার সামনে দিয়ে বেশ কয়েকবার চক্কর কাটতাম। না সময়টা ঠিক দুপুরে নয় যখন ঘড়িতে পৌনে তিনটা বাজতো , সুখী মানুষগুলো যে সময়টাতে ভাত ঘুমে বিভোর , সে সময়টায় মিথিলা আপা বারান্দায় তার প্রিয় চেয়ারটায় বসে গল্পের বই পড়তে পড়তে অকস্মাৎ উদাস হয়ে চরিত্রগুলোর সাথে মিশে যেতে চাইতেন, মনেমনে তখন আমি তাকে ডেকে যেতাম প্রাণপণে। অবশ্য ছোট ছিলাম বলে হয়তো আমার ভেতরের সেই ডাক গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো লুটিয়ে পড়তো মিথিলা আপার পায়ের কাছে।

বিশেষ করে মেয়েরাও যে দুর্বোধ্য হতে পারে কখনো কখনো সে বয়সে টের পাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে ,যখন খুব সন্তর্পণে সুরভিত হতে শুরু করেছিলাম মিথিলা আপার কাঁঠালিচাঁপা সৌরভের মাদকতায়।
আমার দু বছরের বড় চাচাত ভাই জিতু আর পাশের মহল্লার সাথীর প্রেমের সম্পর্কে রীতিমত পরিপক্কতা চলে এসেছে, তার মুখে তখন প্রায়ই শুনতে পেতাম,

-আরে মেয়েরা হইলো ছোট্ট একটা মার্বেলের মতন , হাতের তালুতে রাইখ্যাই যেদিক ইচ্ছা ঘুরানো যায়।

সেই মার্বেলটা মসৃণ না হলে যে মনোযোগ বাঁধাগ্রস্ত হতে পারে এ কথাটি শিখিয়ে দেয় নি জিতু, বলেও দেয় নি বিকল্প কিছু। আর মিথিলা আপাকে দেখে সেই বুঝতে না পারার অক্ষমতা যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল আমাকে। আমার হাতের তালুতে নিয়ে মিথিলা আপাকে যতটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চাইতাম উনি যেন ততটাই চঞ্চল কোনো কিশোরীর মতো হাতের তালু থেকে গড়িয়ে যেতেন । আর সে সময়টায় আমি আমার অসহায়ত্বের নৃত্য দেখে দেখে বিষণ্ণ হয়ে পড়তাম। কিন্তু জানতাম মিথিলা আপাকে ঘিরে থাকা আমার মনোজগতের কুয়াশা-চাদর কেটে যাবে খুব শীঘ্রই ।

তোরা কোন বাড়িতে থাকিস রে? বলে, মিথিলা আপা আমাদের বাসার সামনের যে পুকুরঘাটের বাঁশের মাচাটা বিকেলে মানুষজনের বসার জন্য বানানো হয়েছিলো সেখানটায় বসে পড়লেন। এত সাদামাটা ভাবে মিথিলা আপার সাথে সেদিন বিকেলে পরিচয় হয়ে যাবে কে জানতো ! মিথিলা আপা হচ্ছেন একটা গোলাপি পরী – এটা উনি যদি জানতেন তাহলে কোনোদিন আমাদের মহল্লার এই ম্যাড়ম্যাড়ে , জৌলুসহীন বাঁশের মাচাটিতে এসে বসতেন না।

মিথিলা আপা যেখানটায় বসেছেন , ওখানে ঠিক পাশেই একটা তারকাঁটা আছে দেখতে পাচ্ছি, মিস্ত্রি শালা যেটাকে হাতুড়ি মেরে ঠিক মতো গাঁথেনি। অবশ্য মিস্ত্রিকে গালি দিয়েই বা কি লাভ ! সে কি আর জানতো ওখানে কোনো একদিন বিকেলে এসে একজন গোলাপি পরী এসে বসে পড়বে? মনে হচ্ছিল তারকাঁটাটা যেন তার ভোঁতা চোখ দিয়ে ড্যাবড্যাব করে নির্লজ্জের মতো দেখছিল মিথিলা আপাকে। ইচ্ছে করছিল দেই হাতুড়ির এক ঘা দিয়ে ওর মাথাটা মাচার ভিতরে সেধিয়ে। সময় মতো কিচ্ছুটি হাতের নাগালে পাওয়া যায় না ভেবে, রাগে আমার মুখে থুতু জমতে শুরু করে। একটা হাতুড়ি বা নিদেনপক্ষে একটা দশ ইঞ্চি ইট হাতের সামনে পেলেও দিতাম তারকাঁটাটাকে ভোঁতা করে। বিরক্তির ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম একটা ইট খুঁজে আনতে। আমার গোলাপি পরী এ মুহূর্তে সুরক্ষিত নয়। মিথিলা আপাকে দেখে লোভী হয়ে তারকাঁটাটি তার ভোঁতা মুখ থেকে কেমন লকলকে এক জিভ বের করে দিয়েছে
কিরে , এভাবে মুখ ভোঁতা করে বসে ছিলি কেন ? তোর বন্ধুরা আজ কই ?
আমার গোলাপি পরীর জন্য বসেছিলাম , জানো না তুমি ? আমি একা হলেই পরীটা ঠিক আমার কাছে আসবে জেনেই তো ফয়সাল , জনি , মৃদুল ওদের ফাঁকি দিয়ে এখানে আসলাম। তুমি কি বুঝতে পারোনি মিথিলা আপা? ঠিক এই কথাগুলোই আমি বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার গলায় চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। যে কারণে কথাগুলো আর বলা হয় না আমার।

তোদের মহল্লার মানুষগুলো যেন কেমন ! কেউই আমার সাথে কথা বলতে চাস না। কই, আমাকে তোরা নতুন প্রতিবেশী হিসেবে স্বাগত জানাবি তা না , ভাব ধরে থাকিস ! বললেন মিথিলা আপা।

আমি মনে মনে বল্‌ উফ মিথিলা আপা চুপ থাকো। আমি প্রতিদিন তোমার সঙ্গে কথা বলতেই আসি , প্রতিটা দিন তোমাকে দেখে দেখে রাখি। তুমিই তো কথা বল না, আমার দিকে তাকাও না ভুলেও! বারো সপ্তাহ হয়ে গেলো আর আজ তুমি এসেছ আমার সাথে কথা বলতে? অথচ আমি রোজ কথা বলেছি তোমার সাথে । ঐ সময়টায় তোমার চোখ ছিল গল্পের বইয়ের অরণ্যে আর কানে গুঁজে রেখেছিলে কিশোরকুমার আর হেমন্তের গুঞ্জরিত গান। তাই আমার একটা কথাও তোমার শোনা হয় নি । আজ সুযোগ পেয়েও তোমাকে বলতে পারলাম না। অদৃশ্য কেউ একজন এসে যেন দু হাতে আমার গলা চেপে ধরে রুদ্ধ করে দিলো সাজানো সব পঙক্তিগুলো ।

হতাশায় নুয়ে যেতে যেতে আস্ত একটা ইট দিয়ে থেঁতলে দিতে থাকি তারকাঁটাটার ভোঁতা মাথা। এটা আসলে তারকাঁটা না , একটা সাপ। কত্ত বড় একটা ভারী পাথর যে নেমে গেলো আমার বুক থেকে সাপটিকে মারতে পেরে, আহ।

কিরে , একা একা হাসছিস কেন জানতে চান মিথিলা আপা। আহা, তোর নামটাই তো এখনো জিজ্ঞেস করা হলো না।

আমার মুখটা কখন যে সাফল্যের সাথে সাপটা মারতে পারার কারণে হাসি হাসি হয়ে গিয়েছিলো টের পাই নি। সময় মতো ফণা তুলে আসা সাপটার মগজটাই থেঁতলে দিতে পেরেছিলাম আমি। হাতটায় কেমন নোংরা লেগে গেছে মনে হচ্ছিল।পুকুরের পানিতে উবু হয়ে হাতটা ধুয়ে নিবো কিনা যখন ভাবছি শুনতে পাই আমার গোলাপি পরী বলছে-

-দিলি তো শুধু শুধু ইটের গুঁড়া দিয়ে বসার জায়গাটাই নোংরা করে। তোদের পুকুরঘাট, তোদের মহল্লার মাচায় আমাকে বসতে দিবি না সে কথা আগে বললেই পারতি! বলে, উঠে দাঁড়ান মিথিলা আপা।

মিথিলা আপা এত পাওয়ারের চশমা পড়েও দেখতে পেলেন না যে, ঐ তারকাঁটাটা আসলে একটা সাপ ছিল। ইটের গুঁড়াগুলো আসলে ছিল সেই মৃত সাপটির থেতলানো মাথার রক্ত । সাপটার মাথা থেঁতলে দেবার পরেই ঐ রক্ত গুলো বের হয়েছিলো, যাকে মিথিলা আপা ইটের গুঁড়া বলছেন । আফসোস , মিথিলা আপার চোখ দুটো সত্যিই তার দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। এটা ভেবে আমি একটু দমে গেলেও বলি– আপনাদের বাড়ির পাঁচটা বাড়ির পর যে আকাশি রঙের পাঁচ তলা বিল্ডিংটা তার তিন তলায় থাকি। মিথিলা আপা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন যেন। তিন মাস হলো এখানে এসেছি আর তুই কোথায় থাকিস তা জানব না? তোদের বাসায় ও তো আমার মাকে নিয়ে গিয়েছি। অবশ্য তুই তখন বাসায় ছিলি না . শুধু তোর নামটাই জানা হয় নি – মিথিলা আপা এ কথা বললে আমি একটু বোকার মতো হাসি।

ধ্যাত এরকম সাইরেন কে বাজাচ্ছে ! কানে তালা লেগে যাচ্ছে আমার। আগুন লাগলো নাকি কোথাও ? আকাশটাও তো কেমন মনে হচ্ছে যেন ছাই ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে।

ইশ , মাগরিবের আজান হয়ে গেছে রে – বলে মিথিলা আপা ওড়নায় তার মাথা ঢেকে উঠে দাঁড়ালে বুঝি, আসলে কোথাও সাইরেন বাজে নি। আজান হচ্ছিলো। কিন্তু আমি যে স্পষ্ট সাইরেনের শব্দ শুনলাম ! কি জানি , আজকাল হয়তো আমিই ভুল শুনছি । এই তুই আমার নাম জানিস তো ? আমি মিথিলা।

তুমি তো পরী। আমার কাছে সুন্দর একটা গোলাপি পরী। তোমার নাম তো সেই প্রথম থেকেই জানি, যেদিন তুমি আমাদের মহল্লায় নতুন এলে । কিন্তু তুমি কেন টের পেলে না মিথিলা আপা ! অভিমানে আমার ঠোঁট ফুলে ওঠে। কিন্তু সন্ধে তার তামশের চাদর বিছিয়ে দেয়ায় আর কেউ দেখতে পায় না আমার অভিমানে ফুলে ফুলে ওঠা দু ঠোঁট।

আমার নাম অরূপ। আর এটা মিথিলা আপাকে বলার আগেই দেখি চারদিক থেকে শত্রুরা আমাদের দুজনকে ঘিরে ফেলেছে। সেই গত তিন মাস ধরে এরা আমার পিছু নিয়েছে। মিথিলা আপাকে নিয়ে যে করেই হোক আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে।

এই অরূপ আজ বিকেলে তুই কই ছিলি রে? বলে জনি।

আমাকে দেখিয়ে মিথিলা আপা জনিকে জিজ্ঞেস করে এর নাম বুঝি অরূপ ? কোনো কথা জিজ্ঞেস করলে দেখি এই ছেলে উত্তরই দিতে চায় না। আর বইলেন না মিথিলা আপা , ও ছোট বেলা থেকেই জানি কেমন, কথা কম বলে – জনি জানায় মিথিলা আপাকে। একে একে জনি, মৃদুল, ফয়সাল মিথিলা আপাকে তাদের নিজ নিজ নাম জানালে সেদিন ঠিক ঐ মুহূর্ত থেকেই আমার ছোট বেলার বন্ধুগুলোকে আমার শত্রু ভাবার খুব যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেলাম। এই স্টুপিডগুলো যখন সত্যিই আসল ব্যাপারটা জেনে যাবে যে, মিথিলা আপা শুধুই আমার। তখন ওদের ভালো রকম একটা শিক্ষা হবে ভেবে, আমি হেসে ফেললাম। অবশ্য কেউ এই ফিকে অন্ধকারে আমার হাসি দেখতে পেলো না। এমন কি মিথিলা আপাও না। আজ থেকে এই শত্রুদের ওপর নজর রাখতে হবে বেশ বুঝতে পারছি।

৩।
সেদিনের পর থেকে মিথিলা আপা আমাকে তার বন্ধু ভাবতে শুরু করেন। যদিও মিথিলা আপা বলতেন জনি , মৃদুল আর ফয়সালকেও উনি বন্ধু ভাবেন। কিন্তু আমি জানতাম উনি মিথ্যা কথা বলতেন যাতে আমার ছোট বেলার সেই বন্ধুরুপী শত্রুগুলো মন খারাপ না করে। আমি অবশ্য মেনে নিয়েছি মিথিলা আপার এই মিথ্যে ভাষণ। কারণ আসল সত্যি জানতে পারলে অন্ধকারে কখনো মিথিলা আপাকে একা পেয়ে যদি ওরা কোনো ক্ষতি করে ! আমিও কম না। তক্কে তক্কে থাকি, কেউ একটা বেচাল করলেই ওদের কোমর আর পেটের মাঝামাঝি জায়গায় দেবো চাকুটা ঢুকিয়ে। যেটা আমি প্রতিদিন বাইরে বের হবার আগে সঙ্গে নিয়ে বের হই এই ভেবে, মিথিলা আপার যাতে আসা-যাওয়ার পথে কোনো বিপদ না ঘটে। খেলনার মতো দেখতে চাকুটা আমি ভাঁজ করে প্যান্টের পকেটে রাখি বলে সবসময় ডান পকেটে আমাকে হাত ঢুকিয়ে রাখতে হয়।

আমাকে ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখতে দেখে জনি মৃদুলকে বলে, পাঁচ-ছ’দিন ধরে এক হাত পকেটে ঢোকানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখতে নাকি গ্রাম থেকে আসা ‘প্যাঁক পারাইন্যা নতুন আবুল’ মনে হয়। আর এ কথা শুনে শত্রুগুলো কুৎসিত রকম ভাবে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে।

ওরা অন্ধ নাকি ? গর্দভগুলো বলছে আমি নাকি পাঁচ-ছ’দিন ধরে প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখছি। মিথিলা আপার সাথে সেদিন বিকেলে পরিচয় হলো তাও তো প্রায় মাস দেড়েক হয়ে গেলো। আমি তো সেদিন থেকেই চাকুটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিয়েছি। কখন আবার মিথিলা আপার কোন বিপদ হয়ে যায় ভেবে। তাই সবসময়ই আমি সতর্ক থাকি। ওরা কি বুঝবে , ওদের তো আর একজন মিথিলা আপা নাই !

এই অরূপ , তোর পকেটে কি রে দোস্তো - বলে আমার সামনে এগিয়ে আসে জনি। ওর বেশী কৌতূহল আর পাকামির জন্য ঠিক করেছি সবার আগে ওর পেটের আর কোমরের মাঝখানটায় চাকুটা ঢোকাবো আমি। কত্ত বড় সাহস, আমার পকেটে হাত ঢোকায়!
- শালা, শুধু শুধু পকেটে হাত ঢুকাইয়া রাখস আর ভাব লস মেশিনগান রাখছস।
- হুম , রেখেছিইত , খুঁজে পাস নাই ?

ওরা কেউ আমার লুকানো চাকুটা দেখতে পায় না। আমি ম্যাজিক স্পেল দিয়ে ওটা ঢেকে রেখেছি। মিথিলা আপার চারদিকে বিপদ ওঁত পেতে রয়েছে !

মিথিলা আপাকে তিন দিন হলো বারান্দায় বসে থাকতে দেখি না। এই হারামি জনি আর মৃদুলটা সারাক্ষণ জোঁকের মতো লেগে থাকে আমার সাথে সাথে। না হলে এখন যেতে পারতাম উনাদের বাসায়। সেদিন উনার মা অবশ্য বারান্দা দিয়ে আমাকে উনাদের বাসার সামনে দেখে অনেক ডেকেছিলেন কিন্তু আমি যাই নি।

সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে , সবার রুমের বাতি নিভে যাবে আর মিথিলা আপার রুমের নীল ডিম লাইটের মায়াবী নীল আলো জ্বালিয়ে আমাকে মদির কণ্ঠে ডাকবে আমি তখনই যাবো। গিয়ে দেখে আসবো আমার গোলাপি পরীকে। আধো আলো – ছায়াই ভালো, উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলোর চেয়ে। কারণ ফকফকা আলোয় আমাকে দেখে আবার মিথিলা আপা লজ্জা পেতে পারেন। আমি বুঝি না উনি আমাকে এত লজ্জা পান কেন। অবশ্য জিতু ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম প্রেমে পড়লেই নাকি মেয়েরা তার পুরুষটির দিকে তাকাতে লজ্জা পায়। লজ্জাবতী রাতের মিথিলা আপা একেবারে অন্যরকম, যা শুধু আমিই দেখেছি। ঘুম ঘুম কণ্ঠে উনি যখন অরূপ , অরূপ বলতে বলতে আমার বুকে... আচ্ছা থাক। এটা আমার আর মিথিলা আপার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

৪।
দিন- বদলের পালায় সময় দৌড়েছে দ্রুততায়। সে সাথে আমাদের পরিবারের সাথে মিথিলা আপার পরিবারের সখ্যতাও বেড়েছে একই পাল্লায়। এর মাঝে আমার এইচ এস সি পাশের খবর এলো। ইচ্ছে করছিলো মিথিলা আপাকেই সবার আগে খবরটা শোনাই। কিন্তু আমি জানি উনাকে আমি না জানালেও ঠিক টের পেয়ে চলে আসবেন আমাদের বাসায়।

আজ সন্ধ্যায় মিথিলা আপা যখন আমার রেজাল্টের জন্য অভিনন্দন জানাতে আসবেন ঠিক করেছি তাকে একটা উপহার দেবো। আমি যে একজন আর্টিস্ট এটা মিথিলা আপাকে এখনো জানানো হয় নি অবশ্য। সন্ধ্যার আগে আগেই রং-তুলি, ক্যানভাস নিয়ে বসতে হবে, তা না হলে উনি আসার আগে ছবিটা আঁকা শেষ করতে পারবো না। মিথিলা আপা প্রায়ই বলেন, আমার ঘরের পরিবেশটা নাকি আমার মতোই অদ্ভুত। নিস্তব্ধ। কখনো লাল- নীল আলো ঘিরে থাকে আমার চারপাশে রহস্য তৈরি করতে। শুকনো বেলি ফুলের গন্ধের সাথে একটা ভেজা ভেজা সোঁদা গন্ধে ভার হয়ে থাকে আমার ঘরটা। আমিও নাকি অনেকটা সেরকম ঠিক এভাবেই বলেন মিথিলা আপা।

আমি অনেকদিন ধরেই জানতাম আমার নিস্তব্ধতার কথা , বিষণ্ণতা বা খুশিতে আমার শরীরে তৈরি হওয়া লাল- নীল বলয়ের কথা আর ফুলের পাপড়ি শুকিয়ে সেখান থেকে ভেজা , সোঁদা গন্ধের কথা যা মিথিলা আপাকে দেখার পর আরও পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। দু বছর আগে যখন মিথিলা আপাকে দেখেছিলাম, তখন থেকেই এমন অদ্ভুত অদ্ভুত সব ব্যাপার জড়িয়ে গিয়েছিলো আমার সাথে । ততদিনে মিথিলা আপা আমার কাছে শুধু “ মিথি বা মিথ ” হয়ে উঠেছিলো। আমি যদি জনি , মৃদুল আর ফয়সালের মতো চ্যাটারড বক্স হয়ে যেতাম তাহলে হয়তো মিথিলা আপা আমার এই নৈঃশব্দ্যের কথা টের পেতেন না ।

আমি আসলে মিথিলা আপার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। মূলত উনার জন্যই আমি ধীরে ধীরে একজন আঁকিয়ে হয়ে উঠেছি। যেদিন যেদিন মিথিলা আপা তার সৌরভ ছড়িয়ে আমার পাশে এসে বসেছেন , তার উচ্ছ্বাস আমাকে ছুঁয়ে যেত, সেদিনই আমি বাসায় এসে উনার একটা করে ছবি এঁকে আমার রুমের দেয়ালে টানিয়ে দিতাম। একেকটা ছবি এত সুন্দর , ক্যানভাস জুড়ে থাকে কেমন আলো – আঁধারির খেলা ! কিন্তু আফসোস , মিথিলা আপা নাকি আমার ঘরের দেয়ালে কোনও ছবি টানানো দেখেন না। এতদিন ধরে ভাবছি , বলবো বলবো করেও মিথিলা আপাকে বলা হচ্ছে না যে, তার চশমার প্লাস মাইনাসে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেক করাতে তার চোখ আর চশমা। উল্টো সেদিন সন্ধ্যায় এসে বললেন কিরে , দেয়ালের দিকে মুখ উঁচিয়ে কি দেখিস ? ছবি দেখছি। বলতেই, উনি তার গভীর মায়াবী হাসিতে তরঙ্গ তুলে বললেন , ওহ তুই তো আবার শিল্পী , কল্পনার রাজ্যে তোর বিস্তার বেশী। ছবিতে কি দেখছিস শুনি তো - বলে উনি উনার কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের ঢল পিঠের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসলেন আমার বিছানায়।

ঐদিন আমার ঘরে অন্য কাউকে আর ঢুকতে দেই নি। মিথিলা আপার শরীরের কাঁঠালিচাঁপার সৌরভ আমার রুমের চারদেয়ালে আটকে গিয়েছিলো। মিথিলা আপা বিছানায় আমার পাশটায় বসার ফলে তার হৃদপিণ্ডের শব্দে দারুণভাবে আলোড়িত হচ্ছিলাম আর একটু একটু করে সেই সাথে আমার শরীরও দুলছিল , মাথা নাড়াচ্ছিলাম। অস্পষ্ট একটা হাসির রেখা ছুঁয়ে ছিল আমার হালকা , কোমল সবুজ উঠতে থাকা গোঁফের আড়ালে। যদিও মিথিলা আপা দেখতে পান নি আমার সেই হাসি। আমি নাকি স্বভাবে লাজুক – মিথিলা আপা তাই-ই বলেন। আমার বর্ণিত আঁকা ছবি দেয়ালে টানানো না দেখে তাই আর পিড়াপীড়ি করলেন না । বরং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন বাসায় চলে যাবেন বলে।

আমার রেজাল্ট উপলক্ষ্যে আজ মিথিলা আপা সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসবে এটা আমাকে কেউ বলে নি কিন্তু আমি জানি। সন্ধ্যার আগের এই মুহূর্তটা বেশ। ক্যানভাসটা গাঢ় কালো রঙে স্নাত করানোর আগে মোম দুটো জ্বালানো দরকার। কেউ হয়তো বুঝবে না এ দুটো মোমের সিম্বল কি । মোম দুটোর একটি হলাম আমি আর অন্যটি মিথিলা – আমরা দুজন। মিথিলা আপার স্মিত হাস্যের চেহারাটা কল্পনা করে আঁকতে শুরু করি তার জন্য আমার ভালোবাসার অর্ঘ্য।

একজন ছায়ামানবী। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অরণ্যে তুমুল হাওয়ার বন্যা। মাথার ওপরের চাঁদ অরন্যের ঘন ডালপালার ফাঁক গলে পুরো জায়গাটা আলোকিত না করলেও শুধুমাত্র ছায়ামানবীর মুখমণ্ডলকেই উদ্ভাসিত করেছে শুধুমাত্র। তার ঠোঁটের রহস্যময় হাসি ভিঞ্চির সৃষ্টিকর্মকেও ছাড়িয়ে গেছে। আরামদায়ক এক আলস্যের মাখামাখি তার শুয়ে থাকা মোটা করে টানা কাজল কালো দু’চোখে। জোনাকি পোকার সৃষ্ট আলোর ফ্ল্যাশের চেয়ে চাঁদের আলোয় উনাকে জীবন্ত করে তুললে উনি খুশী হবেন নিশ্চিত। কোঁকড়া চুলের দু’ তিন গাছি চুলে তার বাঁ চোখটা একটু ঢেকে যাওয়ায় তার চিবুকের নক্ষত্রটা যেন আরও প্রানবন্ত হয়েছে। মিথিলা আপার গোলাপি ঠোঁটে আমার ঠোঁটের বাদামি রঙ ছাড়া আর কিছু মানাবে না কিংবা অন্য রঙ ওখানে দিলে উনি কষ্ট পেতে পারেন ভেবে ঠোঁট জোড়াতে আর অন্য কোনো রঙ স্পর্শ করি না।

ছবিটা আঁকা শেষ হলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখি কি এক অপার্থিব সৌন্দর্য খেলা করছে মিথিলা আপার মাঝে। ক্যানভাসে আমার দিকে শুয়ে থাকা মিথিলা আপাকে দেখার জন্য আমি আমার রুমের উজ্জ্বল বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে ইজেলের পাশে একটা আর ক্যানভাসের ডান দিকে একটা মোম জ্বালিয়ে দেখছিলাম তাকে আর প্রাণ সঞ্চারিত করছিলাম আমার মুগ্ধতায়। অন্ধকারে মোম বা চাঁদের নরম আলো ছাড়া এই ছবিটা না দেখলে মিথিলা আপার সৌন্দর্য কেউ কখনো বুঝবে না।

দরজায় ধুমধাম শব্দে কিল পড়তেই বুঝতে পাড়ি আমার শত্রুগুলো এসেছে। আমার আঁকা এই ছবিটা দেখলে আমি নিশ্চিত ওরা মিথিলা আপাকে চুরি করে নিয়ে যাবে আর ওদের গায়ের দুর্গন্ধে রুমটাকে ভরিয়ে তুলবে। এমনও হতে পারে ওদের সাথে একটা রক্তারক্তি কাণ্ডও হয়ে যেতে পারে মিথিলা আপাকে তুলে নিয়ে যেতে চাইলে। ওরা তো জানে না আমি যে সবসময় পকেটে একটা চাকু ভাঁজ করে রেখে দেই মিথিলা আপাকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে।

- আমার মাথা ব্যথা। পরীক্ষা পাশের সেলিব্রেট পরে করবো , তোরা যা এখন – দরজা না খুলেই গলার আওয়াজটা একটু উঁচিয়ে বলে ওদেরকে বিদেয় করি।

আমি অস্থির হয়ে পায়চারি করতে থাকি আমার রুমে , মিথিলা আপার অপেক্ষায়। গরমে দরদর করে ঘামতে থাকলেও ফ্যান ছাড়ি না , জানালাও খুলি না বাতাসে মোমের আলো নিভে যেতে পারে ভেবে। এমনিতেই ক্যানভাসে আঁকা অরণ্যের বাতাসে আর জ্যোৎস্নার ফোয়ারার বেগে ইজেলের পাশে রাখা মোম দুটো তিরতির করে কাঁপছে। উফ মিথি আমার , কখন আসবে তুমি !

ভেতরে ভেতরে চমকে উঠি আমি। সেই হাসির মুর্ছনা । আহ ! কিছুক্ষণ আগের নিদারুণ প্রতীক্ষায় মৃতপ্রায় আমার ফের জীবন্ত হয়ে ওঠা আর কাঁঠালিচাঁপার মৌ মৌ সৌরভে ঘরের দরজায় মিথিলা আপার মৃদু গুঞ্জন যেন নূপুরের মতো বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলে দেই তার জন্য।

- রুম অন্ধকার করে কি করিস? বলতে বলতে মিথিলা আপা আমার রুমে ঢুকে তার উচ্ছ্বাসের সজীবতা ছড়িয়ে দিলেন। উনি বাতি জ্বালাতে গেলে আমি খুব মৃদু কণ্ঠে বললাম, ছবি এঁকেছি একটা , যা অন্ধকার ছাড়া দেখা যাবে না। আলোটা জ্বেলে দেবেন না মিথিলা আপা।

- উফ, তোর যতসব উদ্ভট উদ্ভট কথা !

আমি হাত টেনে ধরে মিথিলা আপাকে বিছানায় আমার পাশে বসাই। আমার তপ্ত হাতের স্পর্শে মিথিলা আপা ক্ষণিকের জন্য স্থির হলেও শেষপর্যন্ত বসে। তাকে ফিসফিস করে বলি -
“ দেখো মিথিলা , ইজেলের পাশে যে মোমের আলো সেই আলোতে তোমাকে কত অপরূপাই না লাগছে ! কত নিশ্চিন্তে তুমি শুয়ে আছো সেখানে। একটু স্থির হও। তোমার হৃদপিণ্ডটা আমাকে ছুঁতে দাও। আমার চোখের দিকে তাকাও । এই তো আমি দেখছি তোমার গোলাপি ঠোঁটের কাঁপন , তুমি কি পাচ্ছ না দেখতে ? ” কিন্তু কি আশ্চর্য মিথিলা আপা শুনতেই পান না আমার কথা।

ভ্যাপসা গরমে দম বন্ধ বন্ধ লাগছে বলে মিথিলা আপা আমার রুমের জানালাটা খুলে দিলেন। শুধু তাই নয় , বাতিটা জ্বালিয়ে আমার ক্যানভাসটাও পুড়িয়ে দিলেন। ক্যানভাসের পোড়া গন্ধ মিথিলা আপার সৌরভকে চাপা দিতে পারলো না অবশ্য।

- কই তোর ছবি ? এত মিথ্যে শিখেছিস না অরূপ ! বড় তো হয়ে গেলি । কোথায় , কোন সাবজেক্টে ভর্তি হবি কিছু ঠিক করেছিস ?
- আমার রেজাল্টে খুশী হয়েছেন মিথিলা আপা ?
- অনেক খুশী হয়েছি । আচ্ছা , তুই আমাকে তুমি করে বলতে পারিস না ? চুপ করে থেকে সারাক্ষণ কি এত ভাবিস রে তুই- বলে মিথিলা আপা উনার আঙুলে আমার চুলে স্যান্ডি ঝড় তুলে দিলেন।

মিথি , তোমাকে তো আমি সবসময়ই তুমি করে বলি। কিন্তু তুমি তো শুনতে পাও না । কেউই শুনতে পায় না , জানেও না।

অদ্ভুত ছায়াচ্ছন্ন এক ঘোরের মাঝে মিথিলাকে চুমু খাই আমি ওর পাতলা ঠোঁট দুটিতে। অকৃত্রিম কণ্ঠে ‘ মিথি, তোমাকে ভালোবাসি ’ উচ্চারন করতে গিয়ে টের পাই আমার কণ্ঠের সীমাবদ্ধতা। উফ , নিদারুন এক ঘোর , ঘোর আর ঘোর !

- কি রে বিড়বিড় করে কি বলছিস তখন থেকে ? আয় চল তোর বন্ধুরা ড্রয়িংরুমে বসে আছে । খালাম্মা – খালুকে সালাম করবি না ? বলে, টানতে টানতে মিথিলা আপা আমাকে জনারণ্যের ভিড়ে ঠেলে দেয়। সেখানে মিশে যেতে যেতে ভাবি মিথিলা আপার চোখের সাথে সাথে কি তার শ্রবণ যন্ত্রেও তাহলে সমস্যা দেখা দিলো ? কেন যেন উনি আমার উনাকে ঘিরে করা আমার কোনো রূপ-বন্দনার কথা শোনেনই না কানে। তাকে কত স্পষ্ট উচ্চারনেই না জানালাম – ভালোবাসি তোমাকে মিথি । আফসোস !

আহা মিথি , রোজ রোজ কেন আমাকে তুমি খুন করছ !

৫।
এগুলো অবশ্য মিথিলা আপার সাথে পরিচয়ের পর থেকে আমার খণ্ড কিছু অনুভূতির প্রকাশ মাত্র। এর মাঝে আরও তিনটা বছর চলে গিয়েছিলো। নতুন আরও কিছু ঘটনা, আমার সহস্র স্বপ্নের পতনও হয়েছে অবশ্য। অনার্সের শেষ বর্ষে চলে এসেছিলা্‌ সে সময়কার এক ঘটনা। আসলে ঘটনা না , মিথিলা আপার সাথে আমার প্রত্যেকটা অনুভূতিই বর্ণনার যোগ্য।

মিথিলা আপা ততদিনে বি সি এস ক্যাডার হয়েছেন , শিক্ষাবিভাগ ছিল তার প্রথম পছন্দ। জরুরী প্রয়োজনে দুদিনের জন্য বগুড়া যেতে হবে বলে তাকে বাসে তুলে দিতে গিয়েছিলাম। বরাবরের মতোই নিশ্চুপ আমি নিজেকে রিকশায় তার পাশে বসে ভীষণ ভাগ্যবান মনে করছিলাম আর ভাবছিলাম কতটা সতর্কতায় শত্রুদের স্পর্শ , মহল্লার করিম গুন্ডা আর আলামিন গ্রুপদের চোখ বাঁচিয়ে মিথিলা আপাকে নিরাপদে নিয়ে বের হতে পেরেছি ! সবাই কেন যে আমার মিথির উপরে এত নজর দেয় ।

সামাজিকতার ভয়ে যাকে কোনোদিন মন খুলে আমার ভেতরটা দেখানোর সুযোগ হয় নি, কিন্তু আজ সে মানুষটা আমার গায়ের এতোটা কাছে বসে আছে অথচ কিছু সময় পরেই দুদিনের জন্য বগুড়া চলে যাবে ভেবে মনটা বিমর্ষ লাগছিলো আমার। এমন একটা ভাবনা হতেই দেখি আমার দু’চোখ শ্রাবণের আকাশ হয়ে উঠলো। কিন্তু একি রক্ত পড়ছে কেন আমার চোখ থেকে ! মিথিলা আপার অফহোয়াইট শাড়িতে একটু একটু করে রক্তের ছিটে লেগে যাচ্ছে । গত জন্মদিনেই তো শাড়িটা কিনল । আমি হাত দিয়ে তার শাড়ির রক্তের দাগ মুছতে গেলে এদিক সেদিক আরও কয়েক জায়গায় রক্তের দাগ লাগিয়ে থেবড়ে ফেললাম আমার মিথিলার অফহোয়াইট সুন্দর শাড়িটা।

- ইশ মিথিলা আপা , তোমার শাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো রক্তের দাগ লেগে !
- কোথায় আবার রক্ত দেখিস তুই ? কই , ঠিকই তো আছে শাড়ি – বলতে বলতে আঁচলটা টেনে ঠিক করে নিলো মিথিলা আপা। কিন্তু পরক্ষনেই দেখলাম তার হঠাৎ করেই বিমর্ষ হয়ে ওঠা, হতাশার গভীরে তলিয়ে যাবার শব্দ।
- মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে রে অরূপ ! আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে ।

আমাকে ছেড়ে দু’দিনের জন্য শহরের বাইরে যাবে তুমি , আমার মাঝে তোমার সবুজ বাগানটা দেখতে পাবে না। আর দীর্ঘ সময় সবুজ না দেখতে পেলে মানুষ এমনিতেও ক্লান্তি বোধ করে। আমার মতো করে তুমিও আমাকে ভালোবাসো মিথিলা আপা। কিন্তু বলতে পারো না বলে তোমার একলা লাগছে আর এজন্যই তোমার মরে যেতে ইচ্ছে করে, আমি জানি। এসব কথা আমি মুখে না বললেও ঠিক জানি মিথিলা আপা এসব টের পেয়ে যাবেন খুব শীঘ্রই। তাই ধৈর্য ধরাই উপযুক্ত মনে করে আমি চুপ করে থাকি। মিথিলা আপাকে তার মরে যাবার কথা শুনে কোনো সান্ত্বনা দেই না।

ধ্যাত এত তাড়াতাড়ি বাস স্ট্যান্ডে চলে এলাম কি করে ! রিকশাওয়ালা ব্যাটাও দেখি আমার মিথিলাকে দেখে তার রিকশায় গতি ফিরে পেয়েছে।

- আজাইরা

মিথিলা আপা চোখ তুলে জানতে চায় আবার কি হলো তোর ! বলি – কিছু হয় নি আমার। এই আজাইরা শব্দটা উচ্চারন করার পিছনে আমার কারণ ছিল যা মিথিলা আপার না জানলেও চলবে। বাসের টিকিট চাইতেই তার হাতে টিকিট দুইটা ধরিয়ে দিতেই জিজ্ঞেস করলেন , কিরে তুইও কি আমার সাথে যাচ্ছিস নাকি ? বাসায় বলে এসেছিস ?

দুইটা টিকিট দেখে আর আমি যাবো এটা ভেবে কি আমার গোলাপি পরীটার গাল দুটি আর গোলাপি আভায় ভরে উঠলো ? ইশ যদি যেতে পারতাম মিথিলা আপার সাথে – ভেবে আমার হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে একপাঁক নেচে ওঠে। কিন্তু কি করে যাই মিথিলা সোনা , তুমি যে আমাকে একবারও তোমার সাথে যাওয়ার জন্য আমাকে বল নি।

- এত দূরের পথে যাচ্ছ , যাতে আরামে হাত– পা মেলে ব্যাগ নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে যেতে পারো তাই দুটো টিকিট কেটেছি তোমাকে না জানিয়েই।

আমি মিথিলা আপার সাথে যাবো না শুনে আমি নিশ্চিত তার চোখের নক্ষত্র দুইটার সদ্যই মৃত্যু হলো , যাদের সাথে আমার এ যাবত পর্যন্ত ছিল গভীর নিবিড়তা। তার পাশের সিটটায় একটা শকুন যদি এসে বসে , ধারালো নখ আর ঠোঁট দিয়ে যদি নষ্ট করে দেয় মিথিলা আপার পেলব ত্বক , শাড়ির কুঁচিটা যদি খুলে ফেলতে চায় – সে সব কথা তো মিথিলা আপাকে বলতে পারি না। কিন্তু খুব শীঘ্রই মিথিলা আপা আমার দুইটা টিকিট কাটার কারণটাও বুঝে ফেলবেন আমি জানি। তাই মিথিলা আপার দুই দিনের অনুপস্থির বিয়োগ ব্যথাটা ভুলে যাবো সিদ্ধান্ত নেই।

- যাই রে অরূপ । মা’কে বলিস বগুড়া পৌঁছে জানাবো।

আমি ঘাড় কাত করে নাড়ি শুধু, কিছু বলি না। আমিই মিথিলা আপার সেই পুরুষ যে ডান হাতে তার হৃদপিণ্ডটা চেপে ধরে বাসের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকা কাঁঠালিচাঁপা সৌরভের রাজকন্যেটাকে দেখছে। যে চোখে আঁকা আছে একটা পুরুষের দিনরাত্রির ব্যর্থতার কষ্ট। আমি আমার অদ্ভুত , বিষণ্ণ চোখ দুটি বন্ধ করে ফেলি। হঠাৎ করেই যেন পৃথিবী শব্দহীন হয়ে ওঠে। খুব ধীর লয়ে আমার স্নায়ুতে টের পাই চারপাশের ভিড় ঠেলে বাস থেকে নেমে আমার দিকেই আগিয়ে আসছে মিথিলা আপা। আমার মাটিতে স্থির হয়ে থাকা পায়ের পাতায় অনুভব করি চুমু খাচ্ছে সে। আর তখনই আমার হৃদপিণ্ডটা বুকের যেখানটায় আটকে ছিল সেখান থেকে এক উড়ালে চলে গেলো আমাকে ছেড়ে বগুড়ার দিকে যেখানে আমার মিথিও যাচ্ছে।

রিকশাওয়ালার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেতেই দেখি ক্ষয়িষ্ণু , ভঙ্গুর এক বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাস স্ট্যান্ডের সামনে। বুঝতে পারি শয়তান বাসওয়ালা আমার মিথিলাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। স্পষ্ট দেখতে পাই আমি, বাসটাকে আটকাতে পারি ভেবে ড্রাইভারটা মিটারের কাঁটা বাড়িয়ে দিয়েছে নব্বই থেকে একশ , একশ বিশে। কেউ থামাও বাসটা , এক্সিডেন্ট করবে তো !

একটা ফাঁকা সাদা ক্যানভাসে নাম না জানা নানান রঙের অস্পষ্টতা নিয়ে আমি বাড়ির দিকে ফিরতে থাকি রিকশায় চেপে। চোখ থেকে আবার আমার রক্ত ঝরা শুরু হয়েছে টের পাই। রক্তধারায় আমার শার্ট , প্যান্ট ভিজে ভিজে সেখান থেকে চুইয়ে রক্ত জমা হতে থাকে রিকশার পা-দানিতে। আর এ কারনেই বুঝি রিকশাওয়ালা টেনে নিয়ে যেতে পারছে না রিকশা সহ আমাকে। লোকটা তার সর্বশক্তি দিয়ে প্যাডেল মারতে থাকে , আমি তার বুক থেকে হাঁপরের ওঠানামার শব্দ শুনতে পাই ।

৬।
কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা কখনোই মোমের মতো গলে গিয়ে জমাট , ভারী কোনো বর্জ্যের স্তুপ তৈরি করে না। আমার আর মিথিলা আপার সম্পর্কটাই তেমনি ধরণের। ছোট একটা আক্ষেপ আমার রয়ে গেছে অবশ্য। মিথিলা আপা আমার কোনো অনুভূতিই টের পায় না। এই যে তাকে চিৎকার করে করে কত ভাবে বলি, তাকে ভালোবাসি – সে সেটাও শুনতে পায় না। তার চোখে সমস্যা তো আগে থেকেই ছিল তাই সে তার আশেপাশের শত্রুদের আনাগোনা টের পায় না , আমার আঁকা ক্যানভাসগুলো দেখতে পায় না। শুধুমাত্র আমার ক্ষেত্রেই তার এই সমস্যাটা হচ্ছে। অথচ কত নির্দ্বিধায় সে ঘর থেকে বাইরে যাচ্ছে , সেদিনও রাত নয়টায় ঘরে ফিরেছে। তার টেনশন হবেই বা কোথা থেকে ! কারণ আমি নিশ্চিত সে জানে তার জন্য জেগে আছি এই আমি , সারাক্ষণ। আমার চোখের তারায় জেগে থাকে আমার দিনরাত্রি – সারাবেলার সঙ্গী মিথিলা আপা – মিথি – আমার মিথ। সুতরাং মিথিলা আপার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আফসোস সে এখনো বুঝতে পারছে না যে, তার সাহসের আধারটা আমিই। দুশ্চিন্তা করি না অবশ্য , আমি জানি খুব শীঘ্রই সে বুঝে ফেলবে আমাকে, আমার একেকটা অনুভূতিকে। যা গড়ে তুলেছি বিগত দিনগুলোতে। আমি নিষ্পলক ভাবে তাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি আমার আভ্যন্তরীণ দহনকার্য। মিথিলা আপার সামনে যাওয়ার আগে গায়ে সুগন্ধি লাগিয়ে যাই বলে সে আমার ভেতরের পোড়া গন্ধ টের পায় না।

মিথিলা আপা বগুড়া থেকে ফেরার পর অপেক্ষা করছিলাম আমি কখন সে আমার চিঠি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে আমাকে ডেকে পাঠায়। তার কাঠের একটা ছোট বাক্স আছে যেখানে সে তার কাজল আর টিপের পাতাগুলো সাজিয়ে রাখে, সেখানে আমি চিঠিটা লিখে তার জন্য রেখে এসেছিলাম। তার মানে কি এই যে বগুড়া থেকে ফেরার পর মিথিলা আপা চোখে একদিনও কাজল দেয় নি , কপালে ছোট গোল পাথরের টিপ পড়ে নি ? সে কি জানে না আমি তার কৃষ্ণকাজল চোখ দুটি কত পছন্দ করি ! একদিন মার্কেটে গিয়ে মিথিলা আপা খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে একজন তরুণীকে দেখিয়ে বলল, দেখ দেখ অরূপ মেয়েটা কত সুন্দর ! বলতে বলতে তার চোখ মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো।

- কেমন মরা মানুষের মতো চোখ দেখেছো ? হাতের আঙুলগুলো দ্যাখো কেমন সরু , চামড়া ফুঁড়ে হাড় বের হয়ে আছে। আর ঠোঁট থেকে রক্ত পড়তে পড়তে আটকে আছে। মেয়েটার পেটের মাঝখানটায় দ্যাখো কালো ছোপ ছোপ রক্ত লেগে শুকিয়ে আছে, দেখে মনে হয় কেউ মাংস খুবলে তুলে নিয়েছে। এর মাঝে তুমি কি সৌন্দর্য খুঁজে পেলে মিথি ? আসলেই তোমার চোখ গেছে।

- কি রে দেখেছিস মেয়েটাকে ? সুন্দর না খুব ?
- মিথিলা আপা , মেয়েটার চোখ তোমার কাছে কেমন মরা মরা লাগছে না ? চোখে তো কাজল দেয় নি !

যে চোখ একবার মিথিলাকে দেখেছে সে চোখ আর কিছুই দেখবে না। আস্তে আস্তে এই মার্কেটের সব লোক অন্ধ হয়ে যাবে। কারণ তারা মিথিলা তাদের চর্ম চোখে দেখেছিল। তাই আমি মিথিলা আপাকে নিয়ে দ্রুত মার্কেট থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম।

কিন্তু আমার চিঠিটা কেন মিথিলা আপার চোখে পড়লো না ভাবছি আমি। কেউ আবার তার কাঠের বাক্স থেকে বের করে পড়ে ফেলেনি তো? সে বগুড়া যাওয়ার পরদিন সন্ধ্যার কিছু আগে তাদের বাসার সামনে যখন দাঁড়িয়েছিলাম আমার পা দুটো কে যেন চেপে ধরেছিল মাটির সাথে। নীচের দিকে তাকাতেই দেখি খসখসে ফেটে যাওয়া চামড়ার দুটো হাত কবজি পর্যন্ত বের হওয়া , মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে আমার গোড়ালি খামচে ধরে আছে। ভাবখানা এমন যে, আমার দু পা আজ গুড়িয়েই দেবে।

আমি কি কিছুই বুঝি না ? ঠিকই বুঝেছি ভূ-তল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা এই হাত দুটোও আমার আরেকটা নতুন শত্রুর তালিকায় নাম লেখাতে এসেছে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। আমি আমার পা দুটো এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে ঐ কবজি পর্যন্ত বেরিয়ে থাকা হাত দুটির আঙুলগুলো পা দিয়ে মাড়িয়ে থেঁতলে দিতে দিতে দারুন এক উল্লাস অনুভব করতে থাকি। তখন হাত দুটির সে কি আর্তনাদ করে কান্না ! এদেরকে একেবারে মেরে ফেলতে আমারও প্রচুর শক্তি খরচ হয়ে যাওয়ায় আমি হাঁপাচ্ছিলাম বেশ।

- কি রে অরূপ বাইরে খাড়াইয়া আছস ক্যান আন্ধারের মইধ্যে ? ঘরে আয়!

চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি মিথিলা আপার মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকছেন আমাকে। তাদের বাড়িতে পা রাখতেই মিথিলা আপার শরীরের সেই কাঁঠালিচাঁপা সৌরভ আমাকে গ্রাস করে নিতে থাকে আস্তে আস্তে। আমি চলার শক্তি হারাতে থাকি। মিথিলা আপার মা জানতে চায় – কিরে তোর শইলটা কি খারাপ লাগতাছে ? এমনে হাপাইতাছস ক্যান , যা মিথিলার ঘরে যাইয়া একটু শুইয়া থাক।

খালাম্মার মুখে এই কথা শুনে আমি কৃতজ্ঞতার চোখে তার দিকে তাকালে উনি আমার ঘোলা ঘোলা চোখ দেখে আঁতকে ওঠেন। আয় , আয় তাড়াতাড়ি শুইয়া থাক বিছানায়। আমি শরবত বানাইয়া আনি তোর লাইগ্যা। বলতে বলতে উনি রান্নাঘরের দিকে চলে যান।

মিথিলা আপার রুমে তার টান টান করে রেখে যাওয়া বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে যাতে তাকে ভালোমতো অনুভব করতে পারি এজন্য খালাম্মা রুমের লাইট অফ করে আমাকে একলা থাকার সুযোগ করে দিলেন। আমি দ্বিতীয়বারের মতো এই মহিলার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাতে চেষ্টা করলাম । কিন্তু মিথিলা আপা আমার চোখের পাতায় চুমু দিয়ে দিয়ে আমাকে কেমন ঘুম পারিয়ে দিতে চাইছে।
বুঝতে পারি এখন উঠে দরজাটা লাগানো দরকার ।
কারণ এই সময়টায় আমি আর মিথ এখন দুনিয়া থেকে কিছুটা সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। আমি মিথিলাকে টেনে আমার বুকের কাছে এনে শোয়ালাম। কেমন কাঁপা কাঁপা লাজুক স্বরে মিথিলা আপা আমাকে বলে, ডিম লাইটের নরম আলোটাও নিভিয়ে দিতে। আমি একটা আঙুল ওর ঠোঁটে ছুঁইয়ে ওকে চুপ করতে বললে ও ছটফটিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে যায় সুইচ অফ করতে। নামার সময় ওর ওড়নার প্রান্ত আমার মুখমণ্ডল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত মিথিলা আপা আমার কথা শুনলই না। বরং উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ঘর ভাসিয়ে দিলো । খুব রাগ হয়ে গেলো আমার।

- কি রে তোর শইলটা কি এখন একটু ভালো লাগতাছে ? নে , শরবতটা খাইয়া নে! বলে, খালাম্মা আমার হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দেয়।
মিথিলাটা এত দুষ্টু কি বলবো। নিজে চলে গিয়ে মা’কে পাঠিয়েছে শরবতের গ্লাস হাতে। বুঝতে পেরেছি নিশ্চয়ই মিথিলার লজ্জা লাগছিলো। রাত আরো গভীর হলে ও নিজেই আসবে আমার বুকে , সাঁতার কাটবে একান্ত ধ্যানমগ্নতায়।

নাহ , এবার ওঠা দরকার। ভাবছি যাবার আগে মিথিলাকে একটা চিঠি লিখে যাবো, যাতে বগুড়া থেকে ফিরে জানতে পারে আমি এসেছিলাম।

“ প্রিয় মিথ ,
রাত এখনো টহল দিতে নামেনি তোমার শহরে। যদিও আকাশে চাঁদ উঠে গেছে বহুক্ষন।
বাইরে থেকে ফিরে গোসল সেরে যখন ক্লান্তি দূর করতে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে, তখন দেখবে, আসলে তোমার হাতে চায়ের কাপ নয় , আমার এই চিঠিটি কথা বলছে।

আমি জানি, দূরে বসেও তুমি জেনে যাচ্ছ হু হু হাওয়া উঠেছে আমার বনে বনে। দপ করে জ্বলে উঠছে দাবানল। আসলে দাবানল নাকি আলেয়া যেখানে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে অন্ধকার অরণ্যের পটভূমিতে তোমার কোঁকড়া চুলের কৃষ্ণকাজলে আঁকা মায়াবী দুটি চোখ।

ঝুরো ঝুরো হাওয়ায় শুকনো পাতার মচমচ ধ্বনি বলে যে ভ্রম তোমার হয়, আসলে তা আমার গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের লাইন --

কাছে যবে ছিল পাশে হলো না যাওয়া
দূরে যবে গেলো তারি লাগিল হাওয়া ।

চলে এসো। দেখা দিও ।

-- তোমার আনন্দ , তোমার বিষাদ
অরূপ ”



৭।

এখন আমি মিথিলা আপার সাথে আমার সম্পর্কের শেষ অধ্যায়ে যেতে পারি। আসলে ভুল বললাম। শব্দটা শেষ অধ্যায় না হয়ে হবে আমাদের দুজনের পরিনত অধ্যায়ের দিকে মোড় নিলো অবশেষে। কারণ আমার আর মিথিলা আপার সম্পর্কের শেষ নাই আর হবেও না কোনোদিন। এতেই আমি ভীষণ খুশী।

এই তো কয়েকদিন আগে আমাদের বাসায় যখন মিথিলা আপা আর তার মা এসেছিলো আমার মায়ের সাথে গল্প করতে হঠাৎই আমার বোকা মা’টা বলে উঠলো

- হ্যাঁ রে মিথিলা , তুই কি আর বিয়াশাদী করবিই না ঠিক করছস ? বয়স তিরিশ পারাইলে কোনো জুয়ান বেডা মানুষ কি তোরে আর ঘরে নিবো ?
- হ আপা , বুঝান না আমার মাইয়াটারে একটু। বাপটা প্যারালাইসিস হইয়া পইড়া আছে , কয় অয় ই নাকি আমাগো পোলা – মাইয়া দুইটাই। কোনোদিন বলে বিয়া করবো না। বাইচ্যা থাকতে মনে হয় নাতি- নাতনীর মুখ দেখুম না! বলে, মিথিলা আপার মা কেমন দুঃখী দুঃখী হয়ে যান।

তাদের এইসব কথায় মিথিলা আপার চেহারা যে ব্যথায় বেগুনী হয়ে ওঠে তারা বোঝেনও না। জনি , মৃদুল, ফয়সাল ওরা তো সবসময়ই বলে , কোনোদিন বিয়া করবো না এইগুলি হইল মিথিলা আপার পার্ট। দেখ গা তার নিশ্চয়ই কোনো ‘ কেস ’ আছে। এমন ইয়াং মাইয়ার কোনো বন্ধু নাই , প্রেমিক নাই ব্যাপারটা সন্দেহজনক লাগে।

প্রতিদিন ওদের এ ধরণের নীচু মানসিকতার কথা তাও আবার মিথিলা আপাকে নিয়ে, আমি যেন সত্যিই ভীষণ বিকারগ্রস্তের মতো হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের মহল্লা থেকে দশ মিনিট হেঁটে গেলে বাজার পড়ে আর তার পাশেই আছে ছোট একটা ব্রীজ। যেখানে সন্ধ্যার পর আমরা প্রায়ই আড্ডা মারতাম। ঐ হারামি , আমার শত্রুগুলো রোজকার মতন মিথিলা আপার বিয়ে না করার পেছনের সম্ভাব্য ‘ কেস ’ স্টাডি নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে হাসছিল।

ওদের কথা শুনতে শুনতে আমার গলা দিয়ে জান্তব আওয়াজ বের হচ্ছিলো আর চোখ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছিলো আগুনের ফুলঝুরি। হঠাৎ করে আমার এই রূপ দেখে ওদের কলকাকলি বন্ধ হয়ে গেলে , আমি এত বছর পর আমার প্যান্টের ডান পকেটে লুকিয়ে রাখা ভাঁজ করা চাকুটা বের করে আনি। শুনেছি মানুষ তার মৃত্যুর আগে নাকি মৃত্যুর ঘ্রাণ পায়। ওরা তিনজনও সেই ঘ্রাণ পেয়েছিলো। তাই আমার চাকুটার রুপোলী ধারালো ফলাটা আমার চোখের আগুনের ফুল্কিতে চকচক করে ওঠার আগেই দেখলাম ওরা ব্রীজ থেকে নীচের হেজে পচে যাওয়া পুকুরে টুপটাপ লাফিয়ে লাফিয়ে পড়তে লাগলো প্রাণ বাঁচাতে। আসলে ঐ হারামিগুলো লাফ দেয়ার আগ পর্যন্তও জানতো না দৃশ্যত ওটা পুকুর মনে হলেও তা ছিল মূলত চোরাবালি। যাক , আমার অন্তত ওদের নিজ হাতে মেরে হাত রক্তাক্ত বা অশুচি করতে হয় নি।

চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই শুনি ফয়সালের বিস্মিত কণ্ঠ – আরে এরকম বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন , কথা বল !

- নাহ তোরা আড্ডা দে। ভাল্লাগছে না , টায়ার্ড লাগছে! বলে, চলে আসতে উদ্যত হতেই জনির স্বভাবসুলভ খোঁচা মারা কথা – চাকরী তো আমরাও করি , তুই একলা তো আর করস না ।

আমি জনিকে চোখের আগুনে ভস্ম করে বাড়ির পথ ধরি। মনটা ভীষণ তেতো করে দিয়েছে ওরা। মিথিলা আপাকে নিয়ে কারো বাজে কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না। মিথিলা যে কাউকে বলতে পারে না ও আমাকে ভালোবাসে তাই অন্য কাউকে বিয়ে করছে না। ব্যাপারটা পানির মতোই পরিষ্কার। ও আসলে এতই লাজুক আমাকেও বলতে পারে না। তাই না , মিথিলা ? জিজ্ঞেস করি ওকে আমি। ও স্মিত হাস্যে চোখের পাতা দুবার কাঁপিয়ে মাথা নাড়ে। আমি বুঝে নেই ওর সম্মতি , ওর আহবান। এরকমটাই ভেবে নিয়ে আমি নিজেকে ধৈর্য ধরতে শেখাই অনাগত দিনের জন্য।

এই তো গত পরশুদিন আমি অফিস থেকে ফেরার পর জামাকাপড়ও ছাড়তে পারি নি , মিথিলা আপা ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসেছিলো। স্পষ্ট মনে আছে সেদিনই মিথিলা আপা খুব যত্ন নিয়ে সেজেছিল। তার কোঁকড়া চুলগুলোকে বশ মানাতে দেখলাম সেদিন সে চুলে ক্লিপ আটকেছে। চোখে বরাবরের গাঢ় কাজল , গোলাপি তাঁতের শাড়িটায় তার গালের ঔজ্জল্যতাও বাড়িয়ে দিয়েছিলো অনেকখানি। আর কপালে সেদিন পড়েছিলো কুমকুমের টিপ - পাথরের টিপের বদলে। কি সুন্দরই না লাগছিলো মিথিলা আপাকে ! তাকে দেখে আমার সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে গিয়েছিলাম।

আমার রুমে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে মিথিলা আপা। উফ তোকে দেখার জন্য , খবরটা দেয়ার জন্য প্রাণটা ফেটে যাচ্ছিলো আমার – এই কথা বলতে বলতে... নাহ থাক, বলবো না। এই গোপন সুখটুকু আমার বুকেই ধরা থাকুক।

- তোমার হাতে কিসের এত কাগজপত্র মিথিলা আপা ?
- আরে এটা বলতেই তো এলাম । এই যে দেখ স্কলারশিপের কাগজ। অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছি কিছুদিনের মাঝে।
মিথিলা আপার এই কথাগুলো আমার কান টপকে তিনতলা থেকে লাফিয়ে সন্ধ্যার বুকে হারিয়ে গেলো । খবরটা দেয়ার পর মিথিলা আপার উচ্ছ্বাসও কিছুটা কমে আসে যেন। আর আমার কাছে সবকিছুই সাদামাটা আর অর্থহীন মনে হতে থাকে।

- পি এইচ ডি করে তুমি তো আবার দেশে ফিরে আসবে তাই না মিথিলা আপা ?
- বুঝলি , অনেকগুলো টাকা পাবো অস্ট্রেলিয়া গিয়ে কোর্স কমপ্লিট করলে। এদেশের চেয়েও অনেক বেশী টাকা। মিথিলা আপা আপন মনে এসব বলে চলেছে, বলতেই থাকে।

ওহ মিথ , তুমি কি জানো সব নারীকে ছাপিয়ে তুমি কীভাবে আমার মাঝে দিনে দিনে জেগে উঠেছিলে ? কি অদ্ভুত এই গড়ন ক্রিয়া ! ভাবলেই গা কেঁপে কেঁপে ওঠে ভালোলাগায় ।


- হ্যাঁ যার জন্য ছুটে এসেছিলাম শোন। সামনে অনেক ব্যস্ত হয়ে যাবো, বুঝলি ? কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানিস অরূপ , স্কলারশিপের খবরটা যখনই কনফার্ম হলো ঠিক তক্ষুনি এতটা ক্লান্তি ছাপিয়ে এলো শরীর জুড়ে । এখন মনে হচ্ছে চলে গেলে খুব খারাপ লাগবে। বলতে বলতে মিথিলা আপা আমার খাটে হেলান দিলো। পরক্ষনেই উঠে বলল, যাই তোর মা- বাবাকে খবরটা জানিয়ে আসি।


আসলে এতদিনে মিথিলা আপার ব্যাপারে আমার বিস্মিত হবার বোধ কমে আসছিলো। কারণ কখন সে কোন কথাটা বলবে , কোন কাজটা করবে একমাত্র আমিই বুঝতে পারতাম। মিথিলা আপার কাগজপত্রের ভিড়ে বেখেয়ালে একটা কাগজ মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলো। কাগজটার রিনরিনে কান্না শুনে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে চোখ বুলাতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। যদিও পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন, তবু মিথিলা আপার হাতে লেখা সেই কথোপকথনের অংশবিশেষ দেখে মনে হলো কোনো এক ছুতোয় মিথিলা আপাই আমাকে জানিয়ে গেলো তার নিজের কথা –

“আজকাল তাই
পাট-ভাঙা শাড়ি পরে লিপষ্টিক ঠোঁটে ছোঁয়ালেই
আকাশ বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে।
তোমার চিঠির খাম খুললেই সূর্য ডুব যায়। ”


৮।

মিথিলা আপার ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছিলো তার বিদেশ যাত্রাকে কেন্দ্র করে। আমার মাঝে অবশ্য এ নিয়ে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ছিল না। মধ্যাহ্নের শান্ত পদ্ম-দীঘির মতো স্থিরতায় আমি জানতাম মিথিলা আপা শুধুমাত্র আমারই, তাকে দেখতে পেতাম সর্বত্রই – অনুভবে, জাগরণে , মধ্যরাতের তন্দ্রাচ্ছন্নতায়। জানতাম, যেখানেই সে যাক না কেন, কাজ শেষে আমার কাছেই ফিরে আসবে আবার।


এই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার মিথির আদুরে মুখটা , তার ওড়নার সিল্কি গড়িয়ে পড়া, আকাশি শাড়ির তাঁত আঁচল আর থুতনির হালকা ঘেমে ওঠা। তাই আমি স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়েছিলাম তাকে কারণ সে ফিরে আসবে ঘুরে ফিরে আমার বুকের নিরাপদ স্থানে।

আমি তো শুধু একটা ব্যাপার নিয়েই চিন্তিত ছিলাম। আর তা হচ্ছে সুজনের এইভাবে নীরবে আত্মহত্যার ব্যাপারটা আমাকে ভাবাতো। একটা তির্যক পেন্ডুলামের মতো জিজ্ঞাসা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে আমার পাশে চক্রাকারে ঘুরতো।

- সুজন ছেলেটা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাই করলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলি আমি।

- হুম কি বললি ?... হ্যাঁ ওসব ভেবে আমাদের কাজ নাই বলতে বলতে মিথিলা আপা তার ব্যাংকের জমা বই , পুরনো বিদ্যুৎ বিলের কিছু কাগজ একটা এনভেলপে ভরে আমার হাতে দিয়ে জানায় এগুলো যত্ন করে রেখে দিতে। মা’ তো অতশত বোঝে না অরূপ তুই এসব রাখ তোর কাছে যাতে দরকারে খুঁজে পাওয়া যায় এগুলো।

- সুজন কেন আত্মহত্যা করেছিলো জানো মিথিলা আপা ? জিজ্ঞেস করলে মিথিলা আপা বলে , মানুষের মৃত্যু অবশ্যই একটা দুঃখজনক ব্যাপার। মানবিকতার খাতিরে সে মানুষটার জন্য আমরা সমবেদনা জানাতেই পারি । কিন্তু গুন্ডা , বদমাশরা মরে গিয়ে যদি আমাদের সাধারণ মানুষদের বেঁচে থাকতে স্বস্তি এনে দেয় তাহলে সেটাই ভালো , বলে কেমন অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে মিথিলা আপা।


- কিন্তু মিথিলা আপা সুজন তো মারা যায় নি , আত্মহত্যা করেছিলো। বললে, মিথিলা আপা কোনো উত্তর দেয় না কিংবা জানার আগ্রহও প্রকাশ করে না কী সেই কারণ।


মিথিলা আপা তার ব্যস্ততা কমলে যখন একটু স্থির হয়ে বসবে , আমায় মিস করবে অস্ট্রেলিয়ার নাম না জানা কোনো রাস্তায় , হাঁটতে গিয়ে অকস্মাৎ বৃষ্টির মাঝে বর্ষাতির নীচে মুখ লুকোবে কিংবা কোনো ছুটির বিকেলে লেকের ধারটিতে গিয়ে বসবে – আমি জানি তখন তিনিও আমার মতোই সুজনের আত্মহত্যার ব্যাপারটা চিন্তা করে বিষণ্ণ হবেন। তাই মিথিলা আপা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করলেও আমি চুপ করেই থাকি।

তুই এ নিয়ে মন খারাপ করিস না! বলেই, মিথিলা আপা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে কোন কোন কাপড়গুলো ওখানে নিয়ে যাবে বাছাই করতে।

মাথাটা ভার বোধ হতে থাকায় মিথিলা আপাদের বাসা থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। নিজের রুমে ঢুকে গায়ের কাপড়গুলো খুলে শূন্যে ঝুলিয়ে দিয়ে শাওয়ার নিতে ঢুকি ।

ভাবি সুজনের আত্মহত্যার সাথে আমার জীবনের কোনো অংশের সাথে মিল আছে কী না ? আমি তো সেই কলেজ লাইফের শুরু থেকে জীবনের এই অধ্যায়ে এসে চাকুরীজীবনে ঢুকেও এখনো সেই মিথিলা আপার সাথেই আছি। এই যে তাকে এতবার বলেছি চিৎকার করে করে তাকে ভালোবাসি , তার জন্য রাতের ক্যানভাসে একের পর এক ছবি এঁকেছি কিছুই তার চোখে পড়ছে না , আমার কথা শুনতেও পাচ্ছে না। জানি না কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে।

কারো জন্য বেঁচে থাকা যে কতটা অপরূপ একটা ব্যাপার তা কেন যে সুজন বা সুজনের মতো যারা না বুঝেই নিজেকে নিয়ে হত্যার নেশায় মেতে ওঠে, এটা ভেবে ভেতরে ভেতরে আমি ঘেমে উঠতে থাকি। তৃষ্ণা বোধ করতে থাকি চারদেয়ালে ঘেরা ছোট্ট স্নান ঘরটায় বসে। বালতি উপচে ট্যাপের জল আমার শরীর স্পর্শ করলে আমার চামড়ার নীচে শুয়ে থাকা মৃতপ্রায় কোষগুলো জলের ধারায় সজীবতা ফিরে পেতে মিহি সুরে কান্না জুড়ে দেয়। ওদের একটানা এমন রিনরিনে কান্নার সুরে আমি কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুমের অতলে হারাতে থাকি। কি মায়াময় এক স্বপ্নরাজ্য খুঁজে পাই জলের তলদেশে। মানুষ যে কেন আত্মহত্যা করে ! বেঁচে থাকলে দেখতে পেতো কি রকম এক জলজ ভালবাসাময় রাজ্য লুকিয়ে আছে এই পৃথিবীতে। অবশ্য সবার তো একজন মিথিলা আপা নেই !

আমি ধীরে ধীরে ডুবতে থাকি সে জগতে। যেখানে আমাকে স্বাগত জানানো হলে আমিও আমার ইন্দ্রিয়ের ছিদ্রপথের দ্বার উন্মুক্ত করে দেই জলকণাদের জন্য । চোখ মেলে দেখতে পাই কিছু বর্ণমালাদের রঙধনুর রঙে বর্ণিল হয়ে আমার সামনে ডিগবাজি খেতে , ভেসে যেতে। আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেই মি-থি-লা , মি-থি , মি-থ এই মায়াবতী বর্ণগুলোকে।

গুচ্ছ গুচ্ছ পালকের মতো হালকা কাশফুল আমি মিথিলা আপার আদুরে কোঁকড়া চুলের ওপর ছড়াতে থাকি। স্বপ্নঘোরে আমি আমার অঞ্জলি পেতে দেই তার দিকে। মিথিলা আপাও যেন এই প্রথম আমার শুন্য অঞ্জলিতে তার পলায়নপ্রবণ, খেয়ালী , তৃষ্ণার্ত হাতটা স্থাপন করে আমাকে আঁকড়ে ধরে। প্রতি মুহূর্তে তার মাঝের যে ভাঙ্গন , সেই ভাঙনকে আজ অতিক্রম করতে পেরেই যেন তার ভয় কেটে যায়। খুশিতে মিথিলা আপার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফাস স্বরে বলতে থাকি --

ইচ্ছে ছিল সুনিপুন মেক আপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো ,
আহা তুমুল বাজাবো .....


ঘোরময় ছায়াচক্রে টাল খেয়ে ওঠে আমার ফুসফুস , অগাধ জলরাশির ফোয়ারায় ধুয়ে মুছে উজ্জ্বল হতে থাকে আমার ভেতরের বিষণ্ণ , নরম বেদনারা।

নিঃশ্বাসের মতো কোনো শব্দে টের পাই আলতো স্বরে মিথিলা আপার বলে ওঠা .... আমি আসবো ....

( সমাপ্ত )

*** ইচ্ছে ছিল সুনিপুন মেক আপ-ম্যানের মতো…..কবিতাংশ হেলাল হাফিজ






২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×