somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিহ্বলা

১৫ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রায় তিন মাসেরও বেশি হবে আমার কলেজ যাওয়া হচ্ছে না। অবশ্য যাওয়ার মত পরিবেশও যে আছে তাও নয়। তবুও সময়গুলো আগের চেয়ে কেমন বিদঘুটে আর একঘেয়েমিতে ভরে গেছে। তাই আজকাল বিশেষ করে কলেজের ঐ সময়টায় বাড়ির পেছনের বাঁধানো ঘাটটায় আমি ঘুরে ফিরে একটু পর পর আসি। আগে দুপুরের যে সময়টায় নীলুফার ম্যাডামের নীরস রসায়নের ক্লাস করতে করতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত, এখন এই সময়টাই আমার কেটে যায় পুকুর ঘাটে। অনেক গাছপালা দিয়ে পুকুরটা চারপাশ থেকে ঘের দেয়া বলে বাইরে থেকে চট করে আমাদের এই পারিবারিক পুকুরটির আয়তন সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারে না কেউ। যদিও মা পছন্দ করে না আমার এখানে এসে বসে থাকা। বাড়ির উঠতি মেয়েদের দুপুরে আর সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে বসে থাকা, উঠানের এক কোণে যে চাপকল তার কাছ ঘেঁষেই যে দুইটা তালগাছ সেখানে যাওয়া আর খিলখিল করে হাসাহাসি করাটা শুধু মা-ই না, জেঠিও এটা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করেন প্রায়ই। সরাসরি ভূত- পেত্নীর কথা তারা না বললেও আকারে ইঙ্গিতে অমনটাই বোঝায় যে, তালগাছে জ্বীনেরা সাত বোন থাকে! আর এইসব শুনলেই আমার হাসি পায়।


এই যেমন এখানে পুকুর ঘাটে দুপুরবেলায় আমি বসে আছি, অন্যসময় হলে ঠিকই মা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসত। কিন্তু এখন তার হাঁটা – চলার গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে যাওয়াতে হুট-হাট করে আমাকে খুঁজতে পুকুর ঘাটে আসতে না পারলেও ভেতর বাড়ি থেকে গলা উঁচিয়ে ‘মায়া, মায়া ’ করে ডেকে একটু পর পর নিজের উপস্থিতির জানান দেয় কিংবা আমার ছোট ভাই হাসানকে পাঠায় খুঁজতে; আমাকে মায়ের আশেপাশে বা নিজের রুমের পাশে না দেখলে। যদিও খুঁজে না পেলে মা আমাকে বকাঝকা করে কিন্তু আমার তেমন একটা গায়ে লাগে না। রাতের বেলা দাদী তাই জানতে চায় –

- তুই ঐ পুকুরের ঐহানে বইসা বইসা কি করস রে,বুবু?
- কিছু না তো ! নিভুনিভু স্বরে আমি বলি।

দাদীকে বলা আমার উত্তরটা সঠিক নয়। আসলে আমি অনেক কিছু ভাবলেও আমার এসব কথা কাউকে বলা হয় না। মা বলে, “ সময়টা অহন চুপ কইরা থাকনের। কথা কম কইবি। মুখ খুললেই বিপদ!” আমার প্রতিবাদ করে উঠতে ইচ্ছে করে মায়ের কথায়। জেঠিও বলে “ দেখস না চাইরদিক কেমন নিঝুম হইয়া গেছে। অস্থিরতা একটু কমাও এখন, মুরুব্বী গো মুখে মুখে তক্ক কইরো না এত!” জেঠি বেশী রেগে গেলে আমাকে তুমি করেও বলে , আমাকেই না শুধু তার ছেলেদেরকেও বলে , হাসানকেও বলে।


আমি তর্ক না করলেও বিড়বিড় করে নিজের মনে অনেক কথা বলি। অন্য কেউ দেখলে বলবে নির্ঘাত আমার সাথে জ্বীন- ভূতের আছর আছে। আমাদের এই ছোট এলাকাটা হঠাৎ করেই কেমন যেন শুনশান হয়ে গেছে যা কিছুদিন আগেও বেশ সরব ছিল। গত একমাসে এই নীরবতা বেশ অনুভব করতে পারছি বলা যায়। ঈদের ছুটিতে মানুষজন তাদের আত্মীয়- স্বজনের বাড়ি বেড়াতে গেলে হঠাৎ করে যেমন পুরো এলাকা নৈঃশব্দ্যতায় ছেয়ে যায় এখন ঠিক সেইরকমই অনুভূত হচ্ছে। চার/ পাঁচ বাড়ির পরের বাড়ির রেহনুমার মায়ের হাঁপানির টান উঠলেও এখন নাকি পুরো এলাকার মানুষ শুনতে পায়, এমন ধরণের নীরবতা বিরাজ করছে আমাদের এলাকা ছাড়াও অন্য সব জায়গায়। এটা অবশ্য আমার কথা না, দাদীর কথা। মুরুব্বীরা অনেক কিছুই বাড়িয়ে বলে, যেটা ঘটেনি কল্পনায় সেটা ভেবেও তারা বাস্তব জবানীতে কথা বলতে পছন্দ করে – এটা আমি বুঝতে পারছি ইদানীং। গতকাল বিকেলের দিকে মামুন ভাইয়ের মা এসে গল্প জুড়ে দিয়ে বললেন – ‘ রাইত ভইরা কুত্তার কান্দনের চোটে ঘুমাইতেই পারি না ’।

দাদী জানতে চায় – তুমি কুত্তার আওয়াজ ক্যামনে পাও , মামুনের মা ! আমি তো সারা রাইত জাগনাই থাকি! এহন তো কুত্তারাও মিলিটারির ডরে রাও করে না।

দাদী ভুল কিছু বলে নি। মানুষ এখন খুব ভয়ে ভয়ে বাঁচে, নিচু স্বরে কথা বলে। ক’দিন আগেও মাছের ঠোক্করে পুকুরে নেমে গোসল করতে পারতাম না,এখন সে পুকুরেও নিস্তব্ধতা। তারা এখন আর আকাশপাণে মুখ তোলে না। সম্ভবত ভয়ে।আমাদের পুকুরের চারপাশে আব্বা অনেক গাছ লাগিয়েছিলেন। অবশ্য কোনো পরিকল্পনা মাফিক নয়। ডাব, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি যখন যেটা পেরেছেন আব্বা লাগিয়েছেন। ঝড়- বৃষ্টির দিন ঘনিয়ে এলেও তার কোনো লক্ষণ যদিও এখনো দেখা যায়নি কিন্তু রোজ কী করে এত পাতা ঝরে পড়ে থাকে পুকুরের পানিতে কে জানে! ঝরা পাতা আর ময়লার আস্তরণের সর পড়ে পড়ে পুকুরটাও বেশ দ্রুতই তার শ্রী-হানি ঘটিয়েছে। আসলে কোথায় যেন জীবনের একটা সুর কেটে গেছে আমাদের সবারই। এভাবে আর কতদিন বন্দী জীবন কাটাতে হবে কারোরই জানা নেই!



কয়েকদিন আগে দুপুরে মা যখন ঘুমিয়ে ছিল, আমি তখন রত্নাদের বাসায় গিয়েছিলাম। রত্না আমার ছেলেবেলার বান্ধবী। ওদের বাসায় ও আর ওর মা ছাড়া এখন আর কেউ থাকে না অবশ্য। কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে ওর মায়ের গলা শুনতে পাই – ‘ দ্যাখ তো রত্না, শামীম আইলো নি
! ’

দরজা খুলে শামীম ভাইয়ের বদলে আমাকে দেখতে পেয়ে খালাম্মা হতাশ হয়। আমিও মনে মনে হতাশ হই শামীম ভাই ফেরেনি জেনে। আমার বা রত্না কারো মুখেই কোনো কথা আসে না একে অপরকে দেখেও। তবু কি করে যেন এ ঘরের দুজন মানুষের বুকের ভাষা আর আমার অব্যক্ত ভাষা একাকার হয়ে মিশে থাকে একসাথে ! এই ঘরের মানুষ দুটো মনোবেদনা নিয়ে বাঁচে প্রতিনিয়ত, বেঁচে থাকে আশায় যে, একদিন শামীম ভাই ফিরে আসবে।

কোনো খোঁজ পাস নাই শামীম ভাইয়ের, না?

আমার কথায় অজান্তেই যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রত্নার।

- খোঁজ না পাওয়াই ভালো রে মায়া! রাজাকারগো নির্যাতনের মুখে কখন আবার কইয়া ফালাই আমার ভাই কই আছে কে জানে ! জানি না এইটাই এক শান্তি !

শামীম ভাই যুদ্ধে যাবার আগে আমাকে কথা দিয়েছিলেন যেখানেই থাকুক সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ আমার সাথে উনি দেখা করবেন। আমাদের একটা সংসার পাতার কথা ছিল – এ কথা আমি আমার বুকের মাটিতে পুঁতে রেখেছি। মানুষের জীবনে কখন কীভাবে কোন সম্পর্কের সূত্রপাত হয় তা আগেভাগে ধারণা করাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। শামীম ভাই কুমিল্লা হয়ে ঢাকায় যোগ দিবেন এমনটাই বলেছিলেন। চুপ করে শোনা ছাড়া সেদিন আমার কিছু বলার ছিল না। উনি যেদিন আমাকে জানালেন উনি চলে যাচ্ছেন, খবরটা আমার মাঝে কাঁপন জাগিয়েছিল ভীষণভাবে। তবে সে কাঁপন আমার অভ্যন্তরের হলেও আমি টের পাচ্ছিলাম আমার ধমনীতে প্রবলবেগে রক্তের চলাচল, কেমন যেন একটা আগুনের হলকায় পুড়ে যাচ্ছিল আমার ভেতরটা। আমার নিস্তরঙ্গ চোখে সে সময় কি কিছু দোল খাচ্ছিলো ? শামীম ভাই নিজের মতো করেই বলতে থাকেন যুদ্ধের ডাক এসেছে। তার ভেতরটা নাকি উল্টেপাল্টে গেছে। শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যার যার এলাকায়, বিভাগ জুড়ে তারপর গোটা বাংলাদেশে। কিন্তু যুদ্ধে যাবার আগে নিজেকে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে জড়িয়ে নিতে হবে আসলেই কেউ যুদ্ধে যেতে চায় কিনা । সেদিন আমাকে এসব বলতে বলতে শামীম ভাইকে অসহ্য আক্রোশে ছটফট করতে দেখে মনে হচ্ছিল তার রক্তে কেউ বিষাক্ত লাল পিঁপড়া ছেড়ে দিয়েছে।


শামীম ভাইয়ের সাথে সবার সামনে কথা তেমন আমার বলাই হতো না আর সবার চোখ এড়িয়ে একান্তে কথা বলার খুব একটা সুযোগ যে আমাদের অহরহ হতো তাও না। কিন্তু কি করে যেন তার সাথে আমি বাঁধা পড়ে গেলাম যেমন করে শামীম ভাইও পড়লেন ! কলেজ থেকে ফেরার সময় প্রায়ই দেখতাম উনি আর তার সংগঠনের বন্ধুরা ক্লাব ঘরে কাজ করছেন। গ্রামের উন্নয়নের কাজ নিয়েই সারাক্ষণ উনার ভাবনা। ফেরার পথে কখনোবা চোখাচোখি, পরীক্ষার আগে আগে হাসানকে নিয়ে শামীম ভাইদের বাসায় গিয়ে পড়াশুনা করানো, রত্নার সাথে গল্পের ছলে উনার কাছাকাছি একটু থাকা এভাবেই মনে হয় সম্পর্কটা গভীরতার দিকে যাচ্ছিলো । আমার ছোট ভাই হাসান যে স্কুলে পড়ে ঐ স্কুলেরই সহকারী প্রধান শিক্ষক উনি।

খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করতে উনি কবে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু কেন যেন পারি নি। আমাদের একটা ছোট স্বপ্ন ছিল ঘর বাঁধার। তাই আমিও আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করি সেপ্টেম্বর মাসের জন্য, শামীম ভাইয়ের ঘরে ফেরার জন্য।


রত্না যদিও চা করতে চেয়েছিল আমাদের তিনজনের জন্য কিন্তু ওকে বিছানা থেকে উঠে বসতে দেখি না। কেমন এক দৃষ্টিতে চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে ও ঘরের টিনের চালা ভেদ করে হয়তো বাইরের বিশাল আকাশটাকেই দেখে নিতে চাচ্ছে। আমিও রত্নার পাশে শুয়ে শুয়ে কি আকাশ দেখতে চাচ্ছি কিংবা কিছু ভাবছি কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। নিস্তব্ধ দুপুরের এই দুরন্ত অস্থির সময়ে রত্নাদের ঘরের টিনের চালে হয়তো কাক বা অন্য কোনো পাখি থেকে থেকে নখের খচমচ আওয়াজ তুলেই যাচ্ছে। শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে আমার চোখ লেগে এলে পাশের ঘর থেকে রত্নার মা জানতে চায় –

‘ কি রে হুনলাম, শিপ্রারা বলে মুসলমান হইয়া গেছে? কথাডা সত্য নি?’

শিপ্রারা আমাদের প্রতিবেশি। সংখ্যালঘু শব্দটা শুনতে ভদ্র হলেও বেশিরভাগ লোকই শিপ্রাসহ অন্যান্য হিন্দু পরিবারগুলোকে ‘মালাউন’ বা ‘ মালু’ বলেই ডাকে। যুদ্ধ কী বিচিত্র ভাবেই না একটা দেশ, তার মানুষ, সম্পর্ক আর পরিবেশকে বদলে দেয়! আজন্ম লালিত যে বিশ্বাস, সংস্কার বোধ নিয়ে শিপ্রা, ওর ভাই অঞ্জন যে বড় হয়েছে তাকে হত্যা করে যুদ্ধের খাতিরে, বেঁচে থাকার খাতিরে আজ তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। মৃত্যুভয় ধর্মের চেয়েও বড় হয়ে যায় ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো বা!

পাশের ঘর থেকে খালাম্মা নিজের মনেই বলতে থাকেন –

‘ মুসলমান হইয়া, পাঁচ কলেমা শিখ্যা, নামাজ পইড়া আমরাই কি এহন নিরাপদে বাঁচতাছি, নিশ্চিন্তে ঘুমাইতাছি ?’

শুনেছি শিপ্রার বাবা মানে আমাদের নির্মল কাকাও যুদ্ধে গেছেন। কিন্তু কাদের সাথে বা কোথায় গেছেন আমরা কেউ জানি না। শিপ্রারা সারাদিন ওদের বাড়িতে থাকলেও কাকীমা ওদের নিয়ে সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে চলে আসেন।




আমাদের উঠোনে গত কিছুদিন আগে বিশাল করে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। যখন কোনো যুদ্ধ বিমান যায় বা লোকমুখে কোনো গুজব শুনি, আতঙ্কে আমরা সবাই গর্তে ঢুকে বসে থাকি। তবে দিনের বেলায় এ গর্তের মুখের উপর তালপাতা, খড়কুটো, বাঁশের ভাঙা চাটাই জড়ো করে এমনভাবে রাখি যেন বাইরের কেউ দেখলে বুঝতে পারে যে, এখানে জঞ্জালের স্তূপ রাখা। এরকম বড় বড় গর্ত এখন মাটি কেটে বেশিরভাগ বাড়ির উঠোনেই করা হয়েছে।

এভাবে আমরা সবাই যখন গর্তের মাঝে গা জড়াজড়ি করে বসে থাকি, জানি না কার মনে কি ভাবের উদয় হয়। কিন্তু সে সময় আমি আলাদা করে একটা গরম ভাপ টের পাই, কেমন একটা ঝিনঝিন করা শব্দ শুনতে পাই, কান ব্যথা করে। মাটি থেকে ২/৩ হাত নিচে বসে থেকেই মনে হয় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। আর বুঝি কখনও পৃথিবীর আলো- হাওয়া- গন্ধ কিছুই পাবো না। আমার ছোট ভাই হাসান কিছুতেই সেই গর্তের ভেতর বসে থাকতে চায় না, শুধু ছটফট করতে থাকে আর বলতে থাকে –

‘ আমাগো যদি এখন আইসা কেউ কবর দিয়া দেয়! মা চলো এইখান থিক্যা বাইর হইয়া যাই। ঘরে গিয়া খাটে শুইয়া থাকি। আমার গরম লাগতাছে অনেক ...’

মা ওকে ধমক দেয় – ‘ চুপ কর। সুখ- দুঃখ দেখি কিছুই বুঝতে চাস না। সবা সময় খালি প্যাচাল পারোন লাগে তোর !’
বলতে বলতে মা নিজেও গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকে। মায়ের শরীর আস্তে আস্তে ভারি হচ্ছে। সম্ভবত এখন তার গর্ভধারনের পাঁচ মাস চলছে, কিছুদিন আগে তাকে জেঠির কাছে বলতে শুনেছি। এপ্রিলের এই গা চিটচিটে গরমে মা তার গায়ের কাপড়কে ভারবাহী কিছু ভেবে হয়তো বেশি বেশি ঘামতে থাকে, একটু কথা বলেই হাঁপাতে থাকে।

রাতে শুয়ে শুয়ে দাদীকে যখন বলি আমার গর্তের ভেতর ঢুকে বসে থাকতে ভালো লাগে না,চামড়ার মাঝে কেমন গরম একটা ভাপ লাগে, কানে ঝিনঝিন শব্দ হয়। এসব শুনে দাদী বলতে থাকে

- গরম ভাপ লাগব না আবার! ইগুলি হইল মাডির গোস্বা! মাডির উপরে যেমনে তোরা দপদপাইয়া চলস ! কব্বরে যাওনের আগে আলামত বুইঝ্যা ল, মরণের পর সেইখানে শুয়াইলে কেমন লাগব !

- ধ্যাত দাদী, তুমি কি সব উল্টাপাল্টা কথা কও না ! তুমি মায়েরে বল, আমরা যখন – তখন আকাশে পেলেন উড়লে, গোলাগুলির আওয়াজ পাইলে আর গর্তে ঢুকুম না।

- সেয়ানা ছেমড়ির মায়ের চিন্তা এহন কাঁচা বয়সে তুই বুঝবি না রে বু। তোর বাপটায়ও তো বাইত্তে নাই অহন! বলতে বলতে দাদী চুপ হয়ে যায়।


বাবা চিটাগাং থেকে শেষবার বাড়ি এসেছিলেন প্রায় ন’মাস আগে। তাদের অফিসের কি এক ঝামেলার কারণে বেশ কয়েকমাস তাদের অফিসের অস্থিতিশীল অবস্থার জন্য তাকে বাড়িতেই থাকতে হয় অন্যান্য সহকর্মীদের মতোই। আমার বাবা-মায়ের সম্পর্কের ধরণ বেশ অদ্ভুত। কেন কে জানে। আমাদের বাড়ি থেকে শহর বেশ কয়েক মাইল দূরে। এজন্য বাবার অফিসে ফোন করে খবর নেয়া হচ্ছে না আসলে তিনি কোথায় আছেন – যদিও এটা আমার মায়ের বক্তব্য। তবে আমি নিশ্চিত যে, বাবার অফিসের নাম্বারে ফোন করলে মা কী কথা বলবে তা-ই খুঁজে পাবে না। বাবা বাড়ি আসলেও তাদের দুজনের কাউকেই দেখি নি বিশেষ আহ্লাদিত হতে কিংবা কাউকেই দেখিনি চিঠি বিনিময় করতে। হয়তো বাবা যুদ্ধের মাঝে আটকা পড়েছেন বলে আসতে পারছেন না কিংবা হয়তো নিজেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন।

যদিও দাদী আমার জেঠার সাথে খ্যানখ্যান করে বলে –

‘ একবার চিটাগাং যাইয়া দেইখ্যা অ্যায় না নাজমুল বাইচ্যা আছে না মরছে?

‘ওহ মা, চুপ কর তো। এহন কইলেই কি যাওন যাইব এত দূরে ? দেখি শহরে যাইতে পারলে ওর অফিসে ফোন দিমু নে।’

একদিন, দুদিন করে প্রায় দু মাস পার হয়ে যাবার পরও জেঠাকে গরজ করতে দেখি না বাবার খবর নেয়ার জন্য ফোন করতে। অপেক্ষা করতে করতে আমার অভিব্যক্তিহীন মায়ের চোখেও অধৈর্যের ছায়া দেখতে পাই। মা’কে বলতে ইচ্ছে করে –

‘ মা, আমিই যাই শহরে। ফোন কইরা আসি বাবারে ! ’ কিন্তু মা কে বলতে পারি না। এ কথা শুনলেই মা বা জেঠি বলবে – মাইয়া মাইনসের এত সাহস ভালো না।

কিন্তু আমার ভাবতে ভালো লাগে যে একদিন শুনবো হঠাৎ করে বাবা ফিরে এসেছেন, তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন কিংবা আমি, হাসান খুব গর্ব নিয়ে শিপ্রাকেও বলতে পারবো ‘ আমাদের বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, যেমনটা তোদের বাবাও।’




আমার বাড়ি থেকে কাউকে না বলে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। মনে হয় আমিও কিছু করি দেশের জন্য। আমার জেঠা, উনি বাজারের চায়ের দোকানে যেসব আলোচনা হয় বাড়িতে এসে রাতে আমাদের সাথে খেতে বসে কখনও কখনও বলেন। তার মুখেই শুনেছিলাম দেশে নাকি মার্শাল ল জারি হয়েছে। মার্শাল ল কি জানতে চেয়ে হাসান ইতিমধ্যে উনার ধমকও খেয়ে ফেলেছে। জেঠা মার্শাল ল নিয়ে তার অজ্ঞতা ঢাকতে ঘরের সবার উদ্দেশ্যে বলেছেন –

‘ কোনো কথা বাইরে থিক্যা শুনলে সোজা গিল্যা ফালাইবা। পেডের মইধ্যে অইসব কথা উগলাইবা না। যত বেশি জানবা আর বুঝবা তত বেশি বিপদে পড়বা। মাইয়া মাইনসের বিপদ আরও বেশি।’

শেষের কথাটা অবশ্য চাচা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন। কারণ আমার পড়াশুনা, জেদ করে কলেজে ভর্তি হওয়াকে তিনি ভালো নজরে দেখেননি।

জেঠার বড় ছেলে, তারেক ভাই পরে আমাকে, হাসানকে, ঘরের অন্যান্য সদস্যদের বুঝিয়েছে পাকিস্তানিরা আমাদের মন্ত্রী পরিষদ, সংসদ, আইন সবকিছুকে স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করতে যে নিয়ম তৈরি করেছে তাকেই মার্শাল ল বলে। পাকিস্তানিরা আমাদের উপর অবৈধভাবে মার্শাল ল চাপিয়ে ঘোষণা করেছে – আমাদের দেশ নাকি এখনো গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়।

এর মাঝেই নাসির ভাই ( আমার জেঠার ছোট ছেলে) খবর শোনায় মুজিবনগর থেকে ১০ এপ্রিল ‘ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ দেয়া হয়েছে। সবাইকে ডাক দেয়া হয়েছে মুক্তির সংগ্রামে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

বঙ্গবন্ধুর অমোঘ ডাক উপেক্ষা করতে না পেরেই হয়তো আমার জেঠার দুই ছেলে যুদ্ধে চলে গেল কাউকে কিছু না বলে। কাউকে মানে জেঠা, জেঠি, মা আর ছোট চাচাকে না জানিয়ে। শুধুমাত্র আমি আর দাদী জানতাম। মূলত এসব যুদ্ধসংক্রান্ত খবর জেঠার অনুপস্থিতেই আমাদের ঘরে হতো। উনি ভীষণ ভয় পেতেন, ভাবতেন কেউ যদি শুনে ফেলে আমরা মুক্তির সংগ্রামের পক্ষে আছি তাহলে হয়তো আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাবো, মেরে ফেলবে আমাদের। কারণ এর মাঝে কিছু সুযোগসন্ধানী অ-মানুষেরা শান্তি কমিটিতে নাম লিখিয়েছিল। আমাদের এলাকার কয়েকজনও ছিল। তারেক ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম খুলনায় আনসার ক্যাম্পে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় যা নাকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো এবং পরবর্তীতে এ প্রশিক্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মাঠেও দেয়া হয় যার প্রশিক্ষণ কাল দেড় থেকে দুই সপ্তাহ।


আমাদের বাড়িতে আমরা রেডিও শুনতে পেতাম না। কারণ সেটা জেঠার জিম্মায় থাকত। মাঝে মাঝে অবশ্য রত্নাদের বাসায় গিয়ে রেডিওতে শুনে আসতাম মুক্তির গান কিংবা বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ যা বারবার মুক্তিকামী মানুষকে শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হতো।

ছোট থাকতেই রত্নার বাবা মারা গিয়েছিল। শামীম ভাই যুদ্ধে চলে যাবার পর শিপ্রাদের মত ওরাও বাড়িতে অরক্ষিত অবস্থায় ছিল বলে মা কয়েকবার দুর্বলভাবে জেঠার সামনে বলতে চেষ্টা করেছিল –

‘ রত্নারা না হয় দেশের অবস্থা ভালো না হওন পর্যন্ত আমাগো বাইত্তেই থাকুক।’

কিন্তু জেঠার হুংকারে মায়ের আর্জি আর আশার আলো দেখে নি যখন উনি বললেন –

‘ কোন আক্কেলে তুমি এই কথা কও মায়ার মা ? এমনেই শিপ্রারা থাকে আমাগো এই হানে। অহন যদি শামীমের মা আর বইনরেও আইন্যা আমাগো বাইত্তে জায়গা দেই তাইলে কাদের মিয়ার কানে খবর যাইতে দেরী হইব না। শামীম মুক্তিযোদ্ধা, জানো না তোমরা ?’

তারেক ভাই আর নাসির ভাইয়ের নিরুদ্দেশের পাশাপাশি ছোট চাচাও যখন নিরুদ্দেশ হলেন, আমরা সবাই ধরেই নিলাম উনিও যুদ্ধে গেছেন আর জেঠা আশ্চর্যজনকভাবে তখন থেকে বেশ নীরব হয়ে গেলেন। যদিও রত্নারা আমাদের বাসায় এসে থাকতে রাজি হয়নি। কেননা একটা পর্যায়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম রত্না সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সাথে।


আমাদের এলাকায় গোপনে গোপনে একটা দল গঠিত হয়েছিল, যার নাম ‘ লিবারেল পার্টি ’ আর সেই দলের নেতৃত্ব দিতো রত্না। শুনে তো আমি থ। ওদের কাজ ছিল রাজাকার বাহিনীতে কারা সরাসরি জড়িত ছিল তার লিস্ট তৈরি করা, তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা আর সেই খবর মুক্তিবাহিনীর কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। রত্নার কাছেই শুনেছি রাজাকার বাহিনী নাকি নিয়ন্ত্রণ করে জামায়াতে ইসলাম এবং রাজাকার শব্দটা নাকি ভুল, শুদ্ধ উচ্চারণ ‘ রেজাকার ’।

রাজাকার বা রেজাকার যাই হোক যা- ই হোক না কেন এরকম দমবন্ধ পরিস্থিতির মাঝে আমার ছোট ভাই হাসান একটা মজার কথা শোনালো। কাদের মিয়ার সাথে শহরের রাজাকার বাহিনীর সিরাজ সর্দারের দহরম মহরমের ব্যাপারটা আমরা সবাই-ই জানতাম। ঐ সিরাজ সর্দারের প্রধান চ্যালা ফরিদউদ্দিনকে আমাদের এলাকার লিবারেল পার্টির সদস্যরা সুযোগ মত একলা পেয়ে স্কুলের গাছের সাথে বেঁধে আটকে রাখে। হাসানের কাছে এই ঘটনা শুনে খুশিতে আমি নেচে উঠলেও রত্নার জন্য পর মুহূর্তেই আমার চিন্তা হতে থাকে। আমাকে খবরটা দিয়ে হাসান চলে যাবার আগে বলে গিয়েছিল –

‘ ফরিদ্যারে ক্যামনে শাস্তি দেওন যায় ভাইব্যা রাইখো তো মায়া বু। পরে আইসা শুইন্যা যামু। আমাগো লিবারেল পার্টি থেইক্যা বলছে সবার মতামত শুইন্যা অম্নেই রাজাকারটারে শাস্তি দিবো। মাইরাও ফালাইতে পারে মনে হয়।’

হাসান এখনো অনেক ছোট। ক্লাস ফোরে পড়ে ও। ওর মুখে ‘ আমাগো লিবারেল পার্টি ’ শুনে আমার মাঝে ভালো লাগার একটা বোধ কাজ করতে থাকে। লিবারেল পার্টির ব্যাপারটা হাসানের বয়সী আরও অনেক বাচ্চারাই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলো। ওরা মুক্তিযোদ্ধা – রাজাকার রাজাকার একটা খেলা খেলত। স্কুলের মাঠে গিয়ে সেই রাজাকারকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে মায়ের কাছে ঝাড়ি খেতে পারি ভেবে আমি অপেক্ষা করতে থাকি হাসানের বাড়ি ফিরে আসার অপেক্ষায়, কি শাস্তি দেয়া হয়েছে ঐ রাজাকারটাকে তা শোনার জন্য। বিকেল হতেই খবর আসে লিবারেল পার্টির সদস্যদের সাথে এলাকার মানুষরা মিলে ফরিদ উদ্দিনকে আচ্ছা মতো পিটিয়েছে। এক পর্যায়ে উৎসাহী জনতা থেকে সিদ্ধান্ত আসে –

‘ হারামিটারে খেজুর কাঁটা দিয়া ওর শইলডারে কেইচ্যা লবণ মাখাইয়া রইদে ফালাইয়া রাখো। এমনেই ওইটা মইরা যাইব। ’

লিবারেল পার্টির সদস্যরা সেদিন জনতাকে অখুশি করে নি। আমার এক সময় মনে হয়েছিল ফরিদউদ্দিনকে সর্বোচ্চ শাস্তির দেয়ার মধ্য দিয়ে সেদিন বিকেলে আমাদের ছোট এলাকাটিতে স্বাধীনতা নেমে এসেছিলো, লেখা হয়ে গিয়েছিল হাজারো মানুষের মুক্তির গান। খণ্ড খণ্ড অনেক ঘটনা যুক্ত হয়েই হয়তো একটা পরিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বাধীন মানচিত্র আসতে পারে। তবে এই কথাটা আমার না ; শামীম ভাইয়ের। হঠাৎ হঠাৎই আমার শামীম ভাইয়ের কথা তীব্রভাবে মনে পড়তো। একটা কান্না পাঁক খেয়ে খেয়ে পেটের মাঝ থেকে উঠে এসে আমার গলার কাছটায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থেকে আমাকে ব্যথায় আচ্ছন্ন করে রাখতো দিনভর। জানি, রত্নার কাছে হয়তো শামীম ভাইয়ের কোনো খবর পাওয়া যাবে না। তবু ওদের ঘরে গেলে, শামীম ভাইয়ের বিছানাটায় বসলে কিছুটা প্রশান্তি আমাকে আপাতত ছুঁয়ে যেত।



এর মাঝে বর্ষাকাল চলে এলে আগের মত আর তেমন ঘর থেকে বের হতে পারি না। রত্নাদের ওখানেও যাওয়া হয় না তেমন একটা। নাসির ভাই আর তারিক ভাই যুদ্ধে যাবার পর থেকে জেঠার গলার স্বরও তেমন উচ্চে না ওঠায় ভুলতে বসেছিলাম আমার রাগী রাগী জেঠার কণ্ঠস্বর। তবে বর্ষাকাল আসায় হাসান খুব খুশী যে, এখন আর তীব্র আতংক নিয়ে আমাদের সবাইকে যুদ্ধ বিমান উড়ে যাওয়ার শব্দে গর্তে ঢুকে পড়তে হয় না। কারণ বৃষ্টির পানি জমে গর্ত ভরে গেছে। যদিও বাজ পড়ার শব্দে আমরা আঁতকে উঠি। যুদ্ধ বিমান আর বাজ পড়ার শব্দ এখন একই লাগে। হাসানদের যুদ্ধ – যুদ্ধ খেলা সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও ওকে প্রায়ই দেখি কাগজে কী কী সব নকশা আঁকতে, নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলতে।

এদিকে মায়ের চোখের অস্থিরতাও বাড়তে থাকে; বাবার অপেক্ষায়। হয়তো নতুন বাবু হবার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। হাসান রাতে খেতে বসে জানতে চায় –
‘ ও মা, আমাগো নতুন বাবুটা হইলে কি নাম রাখবা ওর ?’

জেঠার সামনে মা ওকে চাপা ধমক দেয় – ‘ চুপ কর। খাইতে বইসা এত কথা কিয়ের ?’
জেঠা হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন –

‘ হাসান কথা মন্দ কয় নাই। নতুন বাচ্চাটার নাম আমরা “স্বাধীন” রাখতে পারি।
- কিন্তু জেঠা আমাগো একটা বইন হইলে ওর নাম কিন্তু “ মুক্তি ” রাখুম! বলে হাসান।

‘ হ তোরা আছস তোগো নাম রাখন লইয়া। কবে যে দেশ স্বাধীন হইব আর আমার পোলা দুইডা ঘরে ফিরবো ! বলতে বলতে জেঠির চোখ ভিজে ওঠে।

জেঠির কথা শুনে হয়তো মায়েরও আমার বাবার কথা মনে পড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া মায়ের কাছ থেকে আর কোনো শব্দ অবশ্য শোনা যায় না।

বড় চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করেন – শুনলাম শিপ্রারা নাকি ইন্ডিয়া যাইব গা ?

আমি উত্তর দেবার আগেই হাসান বলে ওঠে – ‘ ক্যান আমাগো এই দেশটা কি শিপ্রা বু গোও না?’

‘ হিন্দু থিক্যা মুসলমান হইয়া এহন ইন্ডিয়াতে গেলে কি ওরা ঐহানেও আর জায়গা পাইব ? এই দেশের খাইয়া পিন্দা, ধর্ম খোয়াইয়া এহন ইন্ডিয়া যাইয়া লাভ কি ? ’– বলতে বলতে দাদী তার ঘরের দিকে চলে যায়।

রাত আরও গভীর হলে বৃষ্টিও বেশ জোরেশোরে পড়তে থাকে। আমার ঠাণ্ডা লাগতে থাকলে আমি দাদীর গা ঘেঁষে আরও কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরি। আমি জানি বৃষ্টির ঠাণ্ডায় আমি এমন কাঁপছি না, শীত শীত লাগছে না। কেমন যে একটা হাহাকার আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে রাতের সাথে মিশে গেছে সে শুধু আমিই অনুভব করতে পারি। আমার চোখ বেয়ে ধীরে ধীরে পানির বেগ আরও দ্রুত হয়। আমি কাঁদতে কাঁদতে কেঁপে উঠলে দাদী আমার চুলে বিলি কাটতে থাকে। জানতে চায় -

- কান্দস ক্যান রে বু?
- দাদী, দ্যাশ কবে স্বাধীন হইব? আর কত দিন লাগব?
- বিস্টি বাদলারে হুনছি মিলিটারিরা ডরায়। এমনে বিস্টি পড়তে থাকলে আর কয়দিন বাদেই এই বদগুলা যাইবগা বাংলাদেশ ছাইড়া। অহন ঘুমা তো !

আমি দাদীর কথায় স্বস্তি পাই না। রাত শেষ হলে এক নিদারুণ অস্বস্তিতে ছাওয়া অপেক্ষার সুদীর্ঘতম দিনগুলো আবার আগামীকাল আমাকে একটা চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে জানি। আর তাই হয়তো এক নাম না জানা ভয় কিংবা না দেখা অথবা না-ছোঁয়া কোনো সুখের অপেক্ষায় এলিয়ে থাকি নিশ্ছিদ্র রাতের ভেজা বুকে।

সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ১:১২
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×