নুহা-৭
ঝটপট মুরগী আর ডাল ভুনা রান্না শেষে শাওয়ার নিয়ে রুমে আসার পর ভাবছিলাম রেজার অফিসে কী ড্রেস পড়ে যাওয়া যায়। প্রথমবার যখন ওর অফিসে যাই ( অফিস না বলে বলা যায় একটা হোটেল , ওরা বলে রিলিজিয়াস হোটেল। ভ্যাটিকেন সিটির পাশেই ।) সেদিন শাড়ি পড়ে গিয়েছিলাম আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য তুলে ধরতে। শাড়ি পড়ে আমি স্বস্তি পাই না অনভ্যাসের কারণে কিন্তু রেজাকে খুশী করতেই সেদিন শাড়ি পড়েছিলাম। ওর কাজের জায়গায় যাবার পর অনেককেই দেখেছিলাম খুব আন্তরিকতা নিয়ে আমার সাথে পরিচিত হতে আসতে। পুরুষদের চেয়ে নারী সহকর্মীই ওর বেশি দেখেছিলাম। তবে একটা মেয়ের উপরে বিশেষ ভাবে আমার চোখ পড়েছিলো। লিওনা মেয়েটির নাম। খুব চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো এক কোণে আর আমাকে দেখছিলো। ওই মেয়েটাকে দেখলে কেন যেন খুব অস্বস্তি হয় আমার । বাসায় ফিরে সেদিন রেজাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম -
- আচ্ছা রেজা , একটা কথার উত্তর দেবে ?
- কি !
- লিওনা আমার সাথে একটা কথাও বলেনি , এমনকি হাই , হ্যালো টাইপ কিছুও না। তুমি কি খেয়াল করেছ ব্যাপারটা ?
- কি জানি , জানি না। আর প্রথমদিন তোমাকে দেখলো কী বলবে , মাত্রই তো দেখা হলো ! খুব বিরক্ত হয়ে রেজা যেমন উত্তর দিলো , সেই সাথে লিওনার প্রসঙ্গটাও ও কেমন যেন এড়িয়ে যেতে চাইলো , আমার এমনটাই মনে হলো। এই ধারণাটা আমার শক্ত হলো যখন রাতে রেজাকে খেতে ডাকলে সে জানালো সে খাবে না , খিদে নেই। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটা তাই আমার মনে কাজও করেনি রেজা কিছু নিয়ে রেগে আছে বলে রাতে খায়নি , কিন্তু আমি একা একা খেয়ে নিলে অনেকদিন পর এই প্রসঙ্গ তুলে রেজা একবার বলেছিলো -
- তুমি আমার কথা তেমন ভাবো নাকি ?
- মানে ?
- ভাবলে কি আর আমাকে রেখে একা একা খেতে পারতে ঐদিন ? ওর কথা শুনে আমার তো আকাশ থেকে পড়ার দশা ! বলে কি ! স্মৃতি হাতড়েও ওর কথার মানে খুঁজে না পেলে ও মনে করিয়ে দেয়া ওর দায়িত্ব মনে করে যে প্রথম যেদিন ওর কাজের জায়গা থেকে আসি , সেদিন রাতে ও না খেলেও আমি ঠিকই খেয়ে নিয়েছিলাম।
- তুমি না খেয়ে থাকলে আমিও খেতে পারব না খিদে লাগা সত্ত্বেও এমন কোনও নিয়ম আছে নাকি রেজা ! আমি না খেয়ে থাকলে কখনো , তুমিও না খেয়ে থাকো বুঝি ! বাহ চমৎকার তো !
- কিসের সাথে কিসের তুলনা দাও তুমি !
- এই যে দুপুরে আমি বাসায় থাকি বা বাইরে যেখানেই থাকি , আমি খেয়েছি কি খাইনি সে হিসেব কি তুমি করো রেজা ? বরং তুমি লাঞ্চ সেরে আমাকে ফোন দাও আমি কি করছি জানতে। কত কত দিন আমি রাতে তোমার সাথে খাবো বলে বসে থাকি , অথচ তুমি বাসায় ফিরেও জানাও আজ হোটেল থেকে কাজ শেষ করে কলিগদের সাথে ডিনারও করে এসেছ ! কই আমি তো কিছু বলি না তোমায় !
- নুহা , সারাদিন অনেক পরিশ্রম করি , খিদে যখন লাগে তখনই খেয়ে ফেলি , বোঝো না কেন !
- আমি বুঝি রেজা। তাই হৈচৈ করি না । আমারও খিদে লেগেছিলো তাই সেদিন আমিও খেয়ে নিয়েছিলাম। সোজা হিসেব ! অথচ তুমি মানতে পারছ না ! এমন না যে তোমাকে জিজ্ঞেস না করেই খেতে বসেছিলাম। তুমি বলেছিলে খাবে না তুমি।
মানুষ কত আশ্চর্য প্রাণী ! ইউরোপের মতো আধুনিক আর সভ্য দেশে থেকেও রেজা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের গণ্ডি ছাড়িয়ে উঠতে পারলো না এখনো ! যাই হোক বাসা থেকে বের হয়ে বাস স্টপেজের দিকে যেতে যেতে পুরনো কথা গুলো মনে পড়ে গেলো। আচ্ছা, রেজাকে না জানিয়ে ওর অফিসে যাচ্ছি ও আবার রাগ করবে না তো ! অবশ্য আমি তো সরাসরি অফিসেও যাচ্ছি না , কাছাকাছি গিয়ে ফোন দিবো যে আমি এসেছি। পরে একসাথে বাড়ি ফিরবো এই তো প্ল্যান আমার। আর ফিরতে ফিরতে পথে কোনও আইসক্রিমের দোকানে বসবো। আমার সঙ্গ পেতে তো রেজা পছন্দই করে , রাগ করবে না মনে হয় ! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি রাস্তা পার হয়ে বাস স্টপেজের কাছে যেতেই দেখলাম প্রতিবেশী ম্যাক দাঁড়িয়ে আছে। দেখা হতেই স্বভাবসুলভ হাসি -
- হেই নুহা , কি খবর তোমার ? সুপ্রভাত !
- সুপ্রভাত ম্যাক ! তুমি এখানে !
- চাকরিজীবী বৌ আজ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। তাই আমি পদব্রজে । হাহহাহা
- আহ , তুমি বুঝি জব করছ না !
- মহিলাতান্ত্রিক সমাজে আমি এক অসহায় পুরুষ , নুহা । আমাদের ব্যথা কি তুমি বুঝবে কখনো । বলে কপট দুঃখের ভান করে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাক। আর আমি হাসতে থাকি ওর বলার ভঙ্গীতে। এর মাঝেই বাস চলে আসলে আমি আর ম্যাক বাসে উঠি। আমার গন্তব্য জেনে ম্যাক জানালো ও দুই স্টপেজ আগে নামবে আমার।
- আজ ছুটি হলেও লাভ নেই। ঘরে শুয়ে বসে রিল্যাক্স করতে চেয়েছিলাম , পারলাম না। গাড়ির ইন্স্যুরেন্স দিতে এই দেখো এখন ছুটতে হচ্ছে !
- তাই ! যদিও ম্যাক খুব প্রাণখোলা স্বভাবের মানুষ তবুও সরাসরি জিজ্ঞেস করাটা অভদ্রতা ভেবে ম্যাকের ছুটি কাটাতে কী সমস্যা হয়েছে জানা হয় না।
- তোমার সময় কাটাতে সমস্যা হয় না , নুহা ?
- খুব খারাপ লাগে ম্যাক , এভাবে শুয়ে বসে ঘুরে ফিরে সময় কাটাতে ! আমার দীর্ঘশ্বাসে ম্যাক নীরব হয়। ও জিজ্ঞেস করার আগেই আমি বলি - আজ রেজাকে বলব আমি জব করতে চাই। দেখি ও কী বলে।
- তুমি এরই মাঝে এখানকার ভাষা ভালোই রপ্ত করেছ। আশা করি তোমার চাকরিজীবন ভালোই কাটবে। তবে তোমার জায়গায় থাকলে আমি কখনোই জব করতে চাইতাম না। ঘরে থাকার মজাই আলাদা ।
- তুমি যদি ভেবে থাকো আমি টাকার জন্য জব করতে চাচ্ছি সেটা ভুল ধারণা। আমার আসলে সময় কাটে না , ম্যাক।
- আসলে নুহা , জীবনে অনেক সমস্যা থাকে। একটু স্বচ্ছন্দে চলার জন্যই জব করছি। আমার বৌও করছে। যে ফ্ল্যাটে থাকছি সেটা নিজেদের হলেও ইন্সটলমেন্ট এখনো শেষ হয়নি। আমার মা, কিয়ারার বেবি সিটার , কিয়ারার পড়াশুনার খরচ সব মিলিয়ে আমার একলার ইনকামে হয় না বলেই কিয়ারার মাকেও জব করতে হচ্ছে। তুমি জানো কিনা জানি না আমার শাশুড়িও আমাদের সাথেই থাকে। উনার বাকী ছেলেমেয়রা ইতালির বাইরে থাকে বলে। সত্যি কথা বলতে কি জানো নুহা, নিজে ইনকাম করলে পরিবারে আলাদা একটা মত প্রতিষ্ঠার জায়গা হয় , আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ে, মনও বেশ ফুরাফুরা থাকে।
- হুম ! দেখা যাক !
- নুহা , আমি প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। তোমার দিন রেজার সাথে ভালো কাটুক !
- তোমারও !
এই এলাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্কে সমস্যা নাকি কে জানে ! নেটওয়ার্ক আসছে , যাচ্ছে বারেবারে। রেজাকে একটা ফোন করা দরকার ! রেজার অফিসে ( হোটেল বলতে আমার ভালো লাগে না কেন যেন ) একটা ফোন দিবো কিনা ভাবছি নাকি দুপুরের খাওয়াটা একা একাই সেরে নেবো ভাবছি। রান্না সেরে বের হলেও আমার খাওয়া হয়নি। একা একা খেতে আর কত ভালো লাগবে ! আবেগ , অনুভূতি, প্রাপ্তি -অপ্রাপ্তি না থাকলে বা কুসুম ভাবীর মতো হলে না হয় আমি বুঝতাম। আশ্চর্য ধরণের এক স্বার্থপর মহিলা। শবনম ভাবী অবশ্য ঐ ভাবীটাকে 'মাতারি' বলে, বলা বাহুল্য সেটা কুসুম ভাবীর অনুপস্থিতিতে। শবনম ভাবী পুরান ঢাকার মানুষ, জন্ম আর বেড়ে ওঠা সেখানে। তাই প্রায়ই তার মুখে আজব আজব শব্দ শুনতাম। আলী ভাই বকলেও ভাবী এসব আমাকে বলতে বলতে হেসে কুটি কুটি হতো।
ঘড়ির কাঁটা তিনটা পেরিয়ে গেছে।রেজা নিশ্চয়ই এতক্ষনে ওর লাঞ্চ সেরে নিয়েছে।এখন ওর ঝিমানোর সময়। তিন চার ঘণ্টা সময় কাজে ব্রেক পেলেও ও বাসায় যায় না কারণ ড্রাইভে নাকি ওর অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। তাই এ সময়টা কাজের এখানেই একটু জিরিয়ে নেয়। সাতপাঁচ ভেবে অবশেষে ওর মোবাইলে ফোন দিয়েই স্বয়ংক্রিয় গলার আওয়াজ শুনতে পাই মোবাইল বন্ধ আছে। ওর অফিসের আশেপাশের মার্কেটগুলোও যেন এ সময়টা ঝিমাচ্ছে। লোকজনের আনাগোনা এ সময়টাতে একটু কমই যেন এখানটায়। যে এক অস্থিরতায় তাড়াহুড়া করে রান্না শেষেই রেজার এখানে ছুটে এলাম, এখন নিজের কাছেই অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আবেগের আতিশয্যেই কাজটা করে ফেলেছি। রেজা আমার স্বামী, তার কাছে আমার আবেগ প্রকাশ পেলেই বা কি , বরং সে খুশীই হবে - এমনটাই নিজেকে আমি বুঝাই। সব স্বামীরাই তো চায় তার স্ত্রী মুখেই প্রকাশ করুক ভালোবাসার কথা, সুযোগ পেলেই মানুষজনের সামনে টকাস টকাস চুমু খাক, স্বামীর একটু জ্বর কাশিতে স্ত্রীর চেহারায় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পাক -- এসবই নিজের মনে মনে বলতে থাকি আমার অস্বস্তি কমাতে। কিন্তু আমি তো আসলে এমন ধরণের মেয়ে নই। কেমন ধরণের মেয়ে নিজেও খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা করতে পারি না। নিজের আবেগ প্রকাশ করার চেয়ে আড়াল রাখতেই যেন বেশি স্বস্তি আমার। ধ্যাত আর ভাল্লাগে না এসব হিসাব নিকাশ। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘোরাঘুরিই বা আর কতক্ষণ ভালো লাগে। এক সময় ওর অফিসের নাম্বারে ফোন দিয়েই ফেলি। ওর কলিগ মান্নান ভাই ফোনটা ধরলে সৌজন্য আলাপ শেষে রেজাকে চাইলে মান্নান ভাই বেশ অবাকই হয়। বলে -
- রেজা ভাই এখনো বাসায় যায় নাই ভাবী ! উনি তো আরও তিন ঘণ্টা আগেই বের হইছে। আজ নাকি আপনার হাসপাতালে কিসের এক এপয়েনমেন্ট আছে বইলা ম্যানেজারের কাছ থেকে তো ছুটিও নিয়া রাখছে সকাল বেলাতেই।
মান্নান ভাইয়ের কথা শুনে আমি তাৎক্ষণিক কিছু বলতে পারি না উনাকে শুধু ও , আচ্ছা এসব ছাড়া। ওদিকে মান্নান ভাই আবারো জানতে চায় -
- তা ভাবীর শরীর কি বেশি খারাপ ? কি নতুন খবর পাচ্ছি নাকি ?
এই লোকটার আসলে ভদ্রতা জ্ঞান কত সামান্য ভেবে অবাক হই। কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে যে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে হয় না , কবে যে এসব বুঝবে উনি বা উনার মতো মানুষেরা কে জানে ! উনার কাছ থেকে দ্রুত বিদায় নিয়ে ফোন রাখতে এক রকম বাধ্যই হই। ভয় পাচ্ছিলাম রেজার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আবার কোন ব্যক্তিগত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যাই। আর উনিই হচ্ছেন কুসুম ভাবীর স্বামী। উনারা স্বামী- স্ত্রী দুজনের মানসিকতাই এক রকম, অন্যদের ব্যক্তিগত বিষয়ে অগাধ আগ্রহ। রেজার এখানে রেজাসহ আরও আট জন বাঙালি কাজ করে।অবশ্য রেজা বলে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মানসিকতা এক হলেই ভালো, সংসারে ভ্যাজাল কম হয়।
চলবে