somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নুহা-৯

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নুহা-৮

ভ্যাজালের ভয়ে অনুচিত ব্যাপারে স্বামী স্ত্রীর মতামত একই সুরে বাঁধা হতে হবে এটা আসলে মানা যায় না । রেজা অফিস থেকে বের হয়েছে আরও তিন ঘণ্টা আগে এটা নিয়ে আমি ভাবছি না। জরুরী কাজে সে বের হতেই পারে, আমাকে না-ও জানাতে পারে। আর ওকে যেহেতু আমি বলেও আসিনি ওর এখানে আজ আসবো , তাই ওকে না পেয়ে আমার মেজাজ বা মন খারাপ কোনটাই করা উচিত না। কিন্তু তবুও মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কারণ সম্ভবত ও অফিস থেকে মিথ্যে বলে বের হয়েছে বলে। তাও আবার আমাকে নিয়েই মিথ্যেটা বলেছে যে আমাকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হবে বলে ও ছুটি নিয়েছে। এই মিথ্যে ব্যাপারটাই আমার অপছন্দ। এরকম প্রস্তুতি আসলে ছিলো না যে আজ রেজার অফিসের কাছ থেকে আমাকে একাই আবার বাসার পথে ফেরত যেতে হবে। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর যে আবেগ আমাকে ঘিরে ছিলো, রেজার জন্যই হয়তো বা একটা হাহাকারের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিলো আমার মাঝে ক্ষণিকের জন্য আর সে অচেনা অনুভব যার জন্য দৌড়ে দৌড়ে এখানে আসলাম , সব মিলিয়ে খুব অস্বস্তিকর একটা কিছু আমার মাঝে কাজ করতে লাগলো এখন। জানি এই অস্বস্তিটাই একটা সময় পরে আমাকে বিষণ্ণতায় বেঁধে ফেলবে।

বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরে যাবার জন্য আস্তে আস্তে বাস স্টপেজের দিকে পা বাড়াই। না চাইলেও এখন ঘুরে ফিরে মনের মাঝে রেজার ভাবনাই চলতে থাকে। ভাবতে থাকি এর মাঝে আমি আমার এমন কোনও অসুস্থতার কথা রেজাকে বলেছিলাম কিনা যার জন্য শারীরিকভাবে কষ্ট পাচ্ছিলাম কিংবা সে কী আমাকে নিয়ে ইদানিং বেশিই ভাবছে, যত্ন-আত্তি করতে চাচ্ছে। কারণ ও প্রায়ই আমাকে বলে - আচ্ছা নুহা, তুমি জানি কেমন ! তোমাকে এতো কাছে পেয়েও বুঝি না , বলতে বলতে সে আমাকে তার দু'বাহুর মাঝে আটকে নিতো।

ওর মুখের উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে আমার কেমন দম দম বন্ধ লাগে। নিঃশ্বাসটা ঠিক স্বাভাবিক না, কামনার অনেকাংশে। তাই আমি ছাড়া পাওয়ার চেষ্টায় ছটফটিয়ে ওকে বলি -

- আমি আবার কেমন ? আর পুরো একজন মানুষকে বুঝে ফেলা কি ভালো রেজা ? পরে তো আমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে তুমি - বলে আমি হাসি হাসি ভঙ্গীতে ওর দিকে তাকাই। ওর চুলটা এলোমেলো করে দিয়ে ওর বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চাই।

- তাই বইলা কি তোমার নিজের পুরাপুরি আমারে তুমি দিবা না ? বলে রেজা একটা অভিমান ফুটিয়ে তুলতে চায় গলায়।

- কি সব বলো না তুমি ! পুরোপুরি কি দিবো বুঝলাম না ! সব তো দিয়েই দিয়েছি।

- নাহ , নুহা। তোমারে বুঝাইতে পারতাছি না। মানে আমি তোমারে শরীরের দিক দিয়া পুরোটা পাইছি ভাবলে সেটা ভুল , আর যদি বলো মানসিক দিক দিয়াও পাইছি সেটাও ভুল।

- ধুর কী সব বলো না টিনেজদের মতো ! --এরকম বলে সেদিন রেজাকে এড়িয়ে গেলেও আমি জানি আসলে রেজা কী বলতে চেয়েছিলো। সারাক্ষণ কানের কাছে প্যানপ্যান করার বা অভিযোগ, অনুযোগ করার অভ্যাস নেই বলে রেজাকে আমার মনের অনেক অলিগলির সন্ধানই দেয়া হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে রেজার এরকম গভীরভাবের উদয় হওয়ার কারণ কী সেটাও আমার কাছে পরিষ্কার ছিলো না। আর যদি রেজা এমন বলেও থাকে সেটা মুহূর্তের আবেগে হয়তো বলেছিলো এমনটাই ভেবে নিয়েছিলাম আমি কিংবা এরকমটাই আমার ভাবনায় থাকতো যদি না আমার কাছে এ মুহূর্তে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসতো, আমাকে না জানাতো আজ রেজার সাথে সাথে লিয়ানাও একই সঙ্গে ওর গাড়িতে করে অফিস থেকে বের হয়েছে।


চট করে কাউকে ভুল বোঝার ব্যাপারটা আমার মাঝে কাজ করে না। রেজা আর লিয়ানার একসাথে অফিস থেকে বের হবার মতো কারণ হয়তো থাকতেই পারে। তাদের অফিস থেকে একসাথে বের হবার সম্ভাব্য দুই একটা কারণ যে মনে আসেনি তাও না তবুও লিয়ানার ব্যাপারে আমার মনে একটু অস্বস্তি ছিলো । কেন যেন এই মেয়েটা আমাকে সহজ ভাবে নিতে পারতো না যেটা রেজার অন্য কলিগরা আমাকে প্রথম দেখাতেই নিয়েছিলো। তবুও এলোমেলো বা ভুল চিন্তাভাবনা যাতে রেজার ভাষায় আমাদের সংসারে " ভ্যাজাল " না করে তাই এসব চিন্তা করতে চাচ্ছিলাম না ও কেন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার নাম করে ছুটি নিলো , কেন মিথ্যে বললো। একটা অজানা আশংকায় আমার ভেতরটা তিরতির করে কাঁপছিলো কোনও খারাপ কিছু ঘটবে না তো রেজার সাথে আমার ! আর সেই অপরিচিত নাম্বারটার যে লোক আমাকে ফোন দিয়ে এসব তথ্য দিয়েছে সে রেজারই কলিগ হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম, তবে যে নাম্বার থেকে সে ফোন দিয়েছিলো সেটা সচরাচর সে ব্যবহার করে না এটা বুঝতে পেরেই আমি আর তাকে ফিরতি কল দেইনি। তারচেয়ে বরং অপেক্ষাই করা যাক বাসায় ফিরে রেজা কী বলে আমাকে, কতটা বলে আমাকে।

রেজার কাজের এই জায়গাটা থেকে আমাদের বাসার বেশ ভালোই দূরত্ব, নিজেদের গাড়িতে করেই আসি না কেন , কি বাসে,কি ট্রামে! এ জায়গাটার নাম - ভিয়া মন্টে ডেল গাল্লো। এই নামের অর্থ কি কে জানে! মন্টে মানে বুঝতে পারি মাউন্টেইন বা পাহাড়কে বোঝাচ্ছে। ওদের হোটেলটা পাহাড়ের মতো উচ্চতার একটা জায়গায়। আসলে এক অর্থে বলা যায় সবই পাহাড়। যে কোনও একটা জায়গায় যাবার সময় স্থূলভাবে টের পাওয়া যায় না যে কোনও উঁচু জায়গায় উঠছি কিন্তু সে জায়গায় পৌঁছে দূরে বা নিচের দিকে বা সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করলে বোঝা যায় এ দেশটা সমতল নয় সব জায়গায়, উঁচু- নিচু, পাহাড় কেটে কেটে নাকি রোম শহর বানানো হয়েছে, এটা রেজা প্রায়ই বলে আমাকে। এখান থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে মিনিমাম ঘণ্টা দুই থেকে আড়াই লাগবে যদি সময়মত বাস আর ট্রাম না পাই। ফেরার কথা ভাবতেই এখন ক্লান্তি লাগছে। আসলে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যদি সে কাজটা সঠিকভাবে করা না যায় তখন মনে হয় সারাদিনটাই আজ ব্যর্থ। আমি আমার স্বভাব জানি তো, আজ সব ব্যাপারেই আমার মেজাজ খারাপ হবে। সে কি রেজাকে চমকে দিতে এসে নিজেই চমকে গেছি বলে ? কি জানি বুঝতে পারছি না কিছু।

দূরে দেখা যায় বাস আসছে। এ রুটের বাস গুলো কমলা রঙের। কয়েকটা সীট খালি আছে পেছন দিকে কিন্তু অনেক যাত্রীই দেখি দাঁড়িয়ে ছাদের কাছের হুক বা সীটের হাতলে ধরে, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, হয়তো সামনেই কোনো স্টপেজে তারা নামবে বলে। রেজা আমাকে বলেছিলো বাসের একটা মান্থলি টিকিট করে নিতে যেহেতু আমার বাস , ট্রাম, মেট্রোতে চড়ার অভ্যাস বেশি। কিন্তু এতগুলো দিন হয়ে গেলো এখানে আছি আজ অবধি আমার আর মান্থলি টিকিট করা হলো না। এই মুহূর্তে ব্যাগে সকালের পাঞ্চ করা টিকিটটাই আছে। একেকটা টিকিটের মেয়াদ পঁচাত্তর মিনিট। এই মুহূর্তে টিকিট এখন ইনভ্যালিড আর চেকার এসে যদি টিকিট চায় নির্ঘাত জরিমানা করবে। অন্যমনস্ক ছিলাম বলেই আজ এই ভুলটা হয়ে গেলো। ধ্যাত - নিজের মনে মনে বলে উঠি আমি। আমার কাঙ্ক্ষিত স্টপেজে নামতে হলে আরও পাঁচটা স্টপেজ পার হতে হবে। ইংরেজিতে খুব স্বচ্ছন্দেই আমি স্টপেজ বললেও প্রথম প্রথম এসে যখন জানলাম স্টপেজকে এ দেশিয়রা ' ফেরমাতা' বলে অবাক হয়েছিলাম। আর অবাক হয়েছিলাম এই কারণে রেজা বলেছিলো ইংরেজি অনেক শব্দের সাথেই নাকি ইতালিয়ান শব্দের মিল আছে। কিন্তু ফেরমাতার সাথে মিল পাইনি বলেই অবাকটা হয়েছিলাম।এসব ভাবতে ভাবতেই আমি পেছন দিকের একটা সীটে গিয়ে গা এলিয়ে বসলাম। ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। মাথা,ঘাড় সব মিলিয়ে এদের ওজন এতো বেশি লাগছে যে আমি আর এদের ভার বহন করতে পারছি না। একটু চোখ বন্ধ করে হেলান দিতে পারলে ভালো লাগতো শুধু এটুকুই এ মুহূর্তে বুঝতে পারি। হঠাৎ করে তন্দ্রা এসেছিলো কিনা বুঝতে পারি না। বাসটা থেমে আছে এমন মনে হওয়াতে চোখ খুলে তাকাতে দেখলাম সিগন্যালে আটকেছে বাস। চোখ খুলে আরও একটা ব্যাপার দেখলাম, দেখে নিদারুন অস্বস্তিতে মনটা ভরে গেলো। চেকার উঠেছে বাসে, আমার এখানে আসতে হলে তাকে অন্যান্য যাত্রীদের টিকিট চেক করে তবেই আসতে হবে আর সে আমার এখানে আসতে আসতে আমি বাটন চেপে পরের স্টপেজে আমাকে নামিয়ে দেয়ার জন্য ড্রাইভারকে সংকেত দিয়ে রাখতে পারি। আমার ভেতরে এরকম একটা হীন চিন্তা কী করে আসলো যে আমি পালিয়ে যেতে চাচ্ছি চেকারের জরিমানার ভয়ে , ভেবে লজ্জা পেলাম। পালিয়ে যাওয়াটা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না বলে বসেই রইলাম চেহারায় একটা নির্লিপ্ততা নিয়ে। অন্যান্য দিন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগে, রাস্তার নাম পড়তে পড়তে যাই। এখন শুধুই তাকিয়ে আছি, কিছু দেখছিলাম না। বুকের ধুকপুকানি বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। ভয়ে না, বরং লজ্জায়। মাঝপথে আরও একজন চেকার এই বাসে ওঠায় আগের চেকারের সাথে কিছুটা গল্পগুজব করার কারণে বাসের পেছনের দিকে চেকার আর এসে দাঁড়ায় না, নির্ধারিত স্টপেজ এসে পড়লে আমি বাস থেকে নেমে যাই।

চলবে
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×