নুহা-৯
এক বাস থেকে নেমে আরেক বাসের অপেক্ষায় আমাকে এবার বেশি সময় দাঁড়াতে হলো না। কাছেই একটা পেপার, ম্যাগাজিনের দোকান ছিলো , ওখান থেকে দুইটা টিকিট কিনে নেই। ক্লান্তি ঝেঁকে ধরলো তখন যখন মনে হলো এ বাস থেকে নেমে আমাকে মেট্রোতে করে বা আবার বাস বদলিয়ে সানপাওলো নামতে হবে। ইশ এ যে দেখি বিরাট ঝক্কি। যাবার সময় এতবার বাস বদল করতে হয় না কিন্তু ফেরার পথের রুটটা একটু অন্যরকম। এবার সুবোধ বালিকার মতো বাসে উঠেই টিকিট পাঞ্চ করে নেই, জানতাম এ বাসে কোনো চেকার উঠবে না। উঠবে কেন এখন টিকিট কিনেছি না ! আরেকটু হলেই প্রেস্টিজ আমার পাংচার হবার দশা হতো। এমনিতেই আমাদের বহিরাগতদের প্রতি এ দেশিয়দের ভাবনা খুব একটা উন্নত না নানা কারণে। প্রতি বছর বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্ডিয়া, রাশিয়া, মালয়শিয়া, রোমানিয়া, তুর্কি, পাকিস্তান, আরব দেশ থেকে এতো মানুষ অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢোকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে কেউবা সম্পত্তির শেষ অংশটুকু বিক্রি করে দিয়ে। আর এভাবে আসা লোকগুলো ভালো কোনো চাকরিবাকরিও যে পায় তাও না। ফলে কেউবা হকারি, কেউবা কোনো ব্যস্ত সিগন্যালে দাঁড়িয়ে গাড়ি পরিষ্কার থেকে শুরু করে ফুল বিক্রি করেই জীবিকা ধারণ করে এবং কেউ কেউ হাত পেতে বা রাস্তায় বসে ভিক্ষাও করে। কেউ দয়াপরবেশ হয়ে এক ইউরো বা পঞ্চাশ সেন্ট দিলেও তারা অতিরিক্ত অর্থ দাবী করে বলে বহিরাগতদের উপর এমনিতেই এ দেশিয়রা মহাবিরক্ত এবং ঘৃণার চোখে দেখে। এরকম অনেক মানুষ দেখেছি বিশেষ করে বৃদ্ধ মানুষ তারা আমাদের গায়ের রঙ , পোশাকআশাক আর জুতোর দিকে তাকিয়ে শ্রেণী বিবেচনা করে। এমনকি একবার এক বৃদ্ধ মহিলা ফুটপাথ ধরে হেঁটে আসার সময় ( আমি ফুটপাথের পাশেই এক বেঞ্চিতে সে সময় বসে ছিলাম ) আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার ব্যাগ খুলে একটা রুটি আর জুসের প্যাকেট বের করে বলেছে -
আমি এগুলো ফেলে দিবো ডাস্টবিনে কারণ অহেতুক এগুলো আমার ব্যাগের ওজন বাড়াচ্ছে। তুই কি খাবি ?
সে সময় আমি একটা আয়নার বড্ড অভাব বোধ করছিলাম। আয়না থাকলে দেখা যেতো আমাকে ক্ষুধার্ত বা ভিক্ষুক শ্রেণীর কেউ মনে হচ্ছে কিনা। এমনও হতে পারে আমার সালোয়ার কামিজ দেখে আমাকে সে রোমানিয়ার উদ্বাস্তু মহিলা মনে করেছে, ঐ সব মহিলারা একটা ব্লাউজের মতো টপস আর ঘাগরা জাতীয় স্কার্ট পড়ে এবং খুব নোংরা, চুলে ময়লা ছাড়াও তাদের গা থেকে খুব বাজে গন্ধ বের হয় হয়, যদিও আমার গা থেকে গন্ধ বের হচ্ছিলো না কিংবা রুক্ষ্ম চুল এলোমেলো হয়ে বাতাসেও উড়ছিলো না। অবশ্য আমাকে ' তুই' করে বলাতে আমি বিশেষ কিছু মনে করিনি। কারণ এদের সম্বোধনের ভাষাটা এমনই তবে যাদের মাঝে সহবত জ্ঞান আছে, শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপার বা অভিজাত শ্রেণী না হলেও মানবতা বোধ প্রবল তারা নিতান্ত অপরচিত মানুষকে ' আপনি' সম্বোধনও করে ক্ষেত্রবিশেষে। এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি এখানে যে ইতালিয়ানরা পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে তুই তুই করে সম্বোধন করে! আমি সেদিন সেই বৃদ্ধকে ধন্যবাদসহ একটা হাসিও ফেরত দিয়েছিলাম এই বলে যে, ' আমি ক্ষুধার্ত নই'। পরে রেজাকে যখন বলেছিলাম এই ঘটনা ও শুনে খুব হেসে বলেছিলো -
তোমারে তো কতবার কইছি মাঝে মাঝে জিন্স পইড়ো। তোমার হাইট ভালো, দেখতে ভালোও লাগবো। আমার কথা তো শোনো না। কালকা মালিয়ানার চৌরাস্তায় যে মার্কেটটা আছে ঐখান থেইকা চাইর পাঁচটা প্যান্ট কিন্যা নিও।
এরমাঝেই দেখি বাস প্রায় পিরামিডের কাছে চলে এসেছে। এখানে এসে প্রথম যখন এই জায়গার নাম শুনি মিশরের পিরামিড এইখানেও আছে ভেবে আমি বেশি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম কবে দেখবো। ভিক্টোরিয়া বাঙালি এক এরিয়ার নাম, ইতালি আসার কিছুদিনের মাঝেই সেখানে যাওয়ার পথে সেই প্রতীক্ষিত পিরামিডের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রেজা বলেছিলো -
এই যে দেইখ্যা নেও তোমার পিরামিড।
দেখলাম সেই পাথরের তৈরি পিরামিড, ত্রিভুজের মতো দেখতে প্রতিটা সাইড থেকেই, মাথাটা সূচালো। পাথরের গায়ে খোদাই করে সন তারিখ কিছু লিখে রাখা আছে। মেট্রো স্টেশনের কাছেই রাস্তার উপরে সেই পিরামিড। আমার কাছে নতুন বলেই আমি আগ্রহ ভরে দেখি সেটা। কিন্তু যারা রোজ সে রাস্তায় চলাচল করে বা সে এলাকার বাসিন্দা তাদের কাছে যে কোনো নতুনত্ব নেই সেটা তখন না বুঝলেও এখন বেশ বুঝি। আকাঙ্ক্ষিত সেই পিরামিডটা দেখে প্রথমেই মনে হয়েছিলো এমন বিবর্ণ লাগে কেন দেখতে। অবশ্য এমন না যে সেটা আগে রংচং করা ছিল এখন সময়ের পরিক্রমায় রঙ জ্বলে গেছে। বলতে চাচ্ছিলাম এই পিরামিডটাকে কি পলিশ করা হয় না ধুয়ে মুছে ? এ কথা শুনে রেজা বলে -
- কি যে বলো না তুমি , এইটা কি ঘরের ডিস্টেম্পার করা ওয়াল পাইছ সাবান আর ডিটারজেন্ট লাগিয়ে ঘষা দিবা আর ময়লা উইঠা যাইবো সাথে সাথে ?
- আমি সেরকম কিছু বলেছি নাকি ?
- সেইটা বলো নাই কিন্তু যেমনে বললা শুইনা তো অমনই মনে হয়। এরপর সে জানায় এসব ঐতিহ্য সংস্কার করতে অনেক সময়, সরকারের অনুমতি এবং অনেক ধৈর্য আর যত্ন নিয়ে করতে। যদিও সংস্কারের পদ্ধতি নিয়ে তাকে বলতে ততটা আগ্রহী মনে হলো না আর আমি জিজ্ঞেস করলে হয়তো নিজের অজ্ঞতাকে ঢাকতে আরও গা জ্বালানো ধরণের কথা বলবে তাই আর এ বিষয়ে কথা বাড়াই না। সেসব ইতালি আসার প্রথম দিককার কথা অবশ্য।
পিরামিড নেমে মেট্রোতে সানপাওলো এবং সেখান থেকে ১২৮ নাম্বার বাসে করে আমার বাসার কাছাকাছি স্টপেজে নেমে পড়ি মানচিনিতে। আমার বাসার কাছাকাছি যে বাস স্টপেজটা তার পাশ দিয়েই একটা ছোটখাটো সুপারশপ যেখানে খাবার দাবার থেকে শুরু করে রান্নাঘরের তৈজসপত্রও পাওয়া যায়। এতটা ক্লান্তি আজ শরীর জুড়ে, বাস থেকে নেমে সুপারশপের দিকে চোখ গেলে একবার থমকে দাঁড়াই ঘরের জন্য কোনও দরকারী কিছু নিতে হবে কিনা। মাথা মনে হয় আজ আমার ফাঁকাই হয়ে গেছে, কিছুই মনে করতে পারছি না। আবার ভেতরে ঢুকলে দেখা যাবে যেটা প্রয়োজন নেই সেটাই বাস্কেটে তুলে নিয়েছি আর রেজা দেখলেই বলবে -
হুদাই পয়সা নষ্ট করলা ! সামনের সপ্তাহে তো ভিক্টোরিয়া বাজার করতে যাইতামই ! পেচকা ( পিচ ফল) কত দিয়া কিনলা দেখি তো ?ইশ টোডিশে ( সুপারশপ ) তো পুরাই ডাকাতি করে দেহা যায়। বাঙালি দোকান থাইক্যা কিনলে কমপক্ষে ৭০/৮০ সেন্ট কমে কিনতে পারতা।
রেজা এমন বলে ঠিকই অমুক জায়গায় নিয়ে যাবে, তমুক জিনিসটা বাজার করে আনবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর সাথে আমার কোথাও আর যাওয়া হয়ে ওঠে না, বাজারটা সেই আমাকেই করতে হয়। থাক অতশত ভেবে লাভ নাই, 'হুদাই' পয়সা খরচেরও দরকার নাই। ঘড়িতে প্রায় আটটা বাজে। রান্না তো করেই গিয়েছিলাম, ঘরে ফিরে একটা গোসল দিয়ে ঘুম দিবো যদি ততক্ষণে রেজা ঘরে ফিরে না থাকে। কিন্তু আমার আগে ঘরে ফিরলে তো অন্তত একটা ফোন দিত আমাকে ! বাস থেকে নেমে আমার বাসায় হেঁটে যেতে আরও মিনিট দশেক লাগে এবং হাঁটতে হাঁটতে বোঝা যায় জায়গাটা ক্রমশ উঁচুর দিকে উঠছে। পা পুরো ব্যথা হয়ে যায় বিশেষ করে কাপমাসলে। এই দশ মিনিটের পথ পার হবার সময় একটা ট্রেন লাইনও পড়ে। অবশ্য সেটা রাস্তা থেকে উপরে মানে একটা ব্রিজের নিচ দিয়ে রাস্তাটা পার হতে হয়। মাঝে মাঝে ব্রিজের নিচ দিয়ে যাবার সময় ট্রেন যদি যায় কেমন একটা হুম হুম ধরণের আওয়াজ হয় , অনেকটা প্রতিধ্বনির মতো। আমার খুব ভালো লাগে আওয়াজটা শুনতে। বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি হাঁটতে হাঁটতে। আমাদের বিল্ডিং এর উল্টো পাশেই একটা গাড়ির গ্যারেজ আছে, এটার মালিক কে জানি না কিন্তু দেখাশোনা করে এক জর্ডানি টেকো মাথার লোক, নাম সম্ভবত হামাদী।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:০৩