নুহা - ১০
কিছু কিছু লোক থাকে না যাদের অপছন্দ করার মতো নির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও ভালো লাগে না , ওরকম ধরণের কিছু একটা হবে এই হামাদীর ক্ষেত্রে। রেজাকে বলেছিলাম যখন ও বলেছিলো -
- তোমার তো বেশি বেশি নাক উঁচা! কেন ঐ হামাদী কি তুমি রাস্তা দিয়া যাওয়ার টাইমে তোমার দিকে হা কইরা তাকাইয়া থাকে ?
- হা করে না তাকালেও যে একেবারেই তাকিয়ে থাকে না সেটাই বা ভাবলে কীভাবে !
- কেন তোমারে কিছু কইতে চায় নাকি ?
- নাহ ! আমাকে আবার কী বলবে ! কিছু বলেনি, তবে একজন মহিলাকে প্রায়ই দেখি ওর গ্যারাজে আসতে- যেতে।
- তার কাছে মহিলা আসতে যাইতেই পারে। হইতে পারে তার বান্ধবী বা আত্মীয়। তোমার সমস্যা কোনখানে ?
- কী আজব ! এই একটা ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছো কেন ? আমার হামাদীকে পছন্দ না সেটাই শুধু বলেছি। তার কাছে কে আসবে , যাবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার চোখে পড়েছে কয়েকদিন তার ব্যাপারটা তাই শুধু বললাম। আসলে আমি বলি একটা আর তুমি বুঝে নাও একটা। আমাকে রাগিয়ে দিতে পেরে রেজাকে দেখলাম বেশ খুশীই হয়েছে। ওর হাসি দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো।
একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি বাইরে থেকে এসে লিফটের বাটন চেপে দাঁড়িয়ে থাকা, ব্যাগ থেকে সময়মত চাবি খুঁজে না পেলে কিংবা গেট খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেরী হলে আমার মেজাজ খারাপ লাগে। সহ্য হয় না কতক্ষণে ঘরে ঢুকবো, নিজের ঘর। ঘর মানেই শান্তি। নিজের বিছানাটায় শুয়ে যে আরাম, ঘরের পরিচিত পরিবেশটা মনে যে কতটা শান্তির পরশ ছড়িয়ে দেয় সেটা কমবেশি আশা করি সবাইই বোঝে। ঘরে ঢুকে বুঝতে পারি রেজা এখনো ফেরেনি বাইরে থেকে। প্যাসেজের লাইটটা এ কারণেই দেখছি নেভানো। আজ সারাদিনে ও একটা ফোনও দেয়নি আমাকে। ও ফোন দেয়নি তো কি হয়েছে, তুমি পারতে না নুহা নিজেই তোমার স্বামীকে একটা ফোন দিতে? আমার ভেতরের আমিটা আমাকে প্রশ্ন করে।
- হুম পারতাম ওকে ফোন দিতে। কিন্তু ফোন না দিয়ে নিজেই তো গেলাম সশরীরে ওর সাথে দেখা করতে।
- মানুষের কত ব্যস্ততা থাকতেই পারে, এ যুগে ফোন না দিয়ে কারো সাথে দেখা করার জন্য একমাত্র বোকারাই পারে। এখন আবার রাগ দেখাচ্ছ, অভিমান করছো !
- ধ্যাত বেশি কথা বলো না তো ! বাইরে থেকে এসেছি ফ্রেশ হবো , খাবো , ঘুমাবো। চুপ করো
- বাইরে থেকে তো কাজকর্ম করে আসো নি। ঘোরাঘুরি করেই এসছো। এটা এমন কোনো জরুরী ব্যাপার না যে আবার মেজাজ দেখাচ্ছো।
- উফ চুপ করো, চুপ একেবারে
ব্যাগটা আলমারিতে রেখে গিজার অন করে আসি গোসল সারবো বলে। শোবার ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দেই যাতে ঘরে আলো হাওয়া ঢুকে বদ্ধ ভাবটা কমে যায়। বাইরে থেকে ঘরে এলেই কেমন খা খা একটা অনুভূতি কাজ করে আমার মাঝে, একটা শুন্যতা। শবনম ভাবীকে ফোন দিয়ে গল্প করলে হয়তো এই খারাপ লাগার অনুভূতি কিছুটা কমতো। কিন্তু তার আগে গোসলটা সারা দরকার।দুইএকবার রেজাকে বলেছি বাথটাব হলে গোসল করে আরাম পেতাম। ও শুনে বলেছে -
- খাইয়া আর কাজ নাই তোমার লাইগ্যা এখন বাথটাব বসাইয়া দেই। তাইলে ঐখানেই সারাদিন শুইয়া শুইয়া ভাবাভাবি করবা।
- বাড়িওয়ালাকে বলো সে ব্যবস্থা করে দিক
- হ , তুমি আন্নারে চিনো ? যে খাইস্টা স্বভাবের মহিলা , ও দিবো লাগাইয়া? ও বলবো - লাগাইতে হইলে নিজেরা টাকা খরচ কইরা লাগাইয়া নে। আর এইসব খুব ঝামেলার জিনিস বাথরুমের ফিটিংস টিটিংস বদলানো। এতো আরামের দরকার নাই , দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াই গোসল সারো।
কাঁচ দিয়ে ঘেরা ছোট পরিসরের জায়গাটায় গোসল করে আমি আরাম পাই না। হাত, পা নাড়ানো যায় না আর কেমন দম বন্ধ বন্ধ লাগে। তাই জানালাটা খোলা রাখি পর্দা নামিয়ে দিয়ে। রান্নাঘর, ডাইনিং আর গোসল করার জায়গা পরিসরে বড় হওয়া দরকার। যদিও এখানে ডাইনিং বলতে আলাদা কিছু নেই, রান্নাঘরেই খাওয়া এবং রান্নার কাজ চলে। অনেক বাড়িতেই এরকম দেখেছি। গোসল সেরে খুব ভালো লাগছে, সারাদিনের ক্লান্তিটা চলে গেলেও চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে ঘুমে। চুলটা ভালমতো মুছে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। শবনম ভাবীকে ফোন করবো ভেবেছিলাম,এখন হাত বাড়িয়ে কর্ডলেস ফোনটা উঠাতেও ইচ্ছে করছে না। বারান্দার দরজা দিয়ে বাতাস আসছে হালকা হালকা, সাথে পর্দাও উড়ছে। মনে হচ্ছে আমার আজ খুব গাঢ় ঘুম হবে।
গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম কিনা জানি না। চোখ খুলে একবার মনে হলো কেমন খুট খুট শব্দ হচ্ছে ঘরের মধ্যে। ইঁদুর নাকি ! পরক্ষণেই বুঝি ধ্যাত এখানে আবার ইঁদুর আসবে কী করে। আমার শোবার রুমে অন্ধকার আর আলোর খেলা পর্দার লুকোচুরিতে কিন্তু রান্নাঘরে আবার আলো জ্বলছে, কাঁচের দরজা ভেদ করে ফাঁকফোকর দিয়ে সে আলো আসছে। পানি খাবার জন্য হাত বাড়াই বিছানার সাথের সাইড টেবিলের দিকে। ওখানে একটা বোতল রাখা থাকে পানির। পানি খাওয়া দরকার, সারাদিনে কী আমি আসলেই কিছু খাইনি ! কেমন খিদে খিদে লাগতে থাকে।একলা ঘরে আমার কান্না পায়, মায়ের কাছে বসে তার হাতে ভাত খেতে ইচ্ছে করে। বড় হবার পরেও মা নিজের হাতে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতো। মা মা বলে আমি ডাকতে থাকি। ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে যাই আবার জেগে উঠি।
এই নুহা , নুহা ...
মা চলে এসেছে নাকি আমার কাছে! আমি খুশী হয়ে উঠি। বিছানায় উঠে না বসলেও চোখ খুলে তাকাতে চাই। মুখের উপর রেজা ঝুঁকে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তে জিজ্ঞেস করে -
- স্বপ্ন দেখছিলা নাকি? মা মা বইলা ডাকতাছ দেখি। আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেলি। সারাঘরে ঝলমলে আলো। সেই আলো চোখে লেগে কেমন অস্বস্তি লাগছে। উঠে বসতে বসতে বলি -
- জানি না স্বপ্ন দেখছিলাম কিনা। তুমি কখন ফিরলে কাজ থেকে ? ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি। দেখতে চাই ওর মুখের অভিব্যক্তি। নিজের কাছেই অবাক লাগছে রেজাকে নিয়ে আমার মাঝে একটা সন্দেহের বীজ উঁকি দিতে চাচ্ছে দেখে।
- বেশীক্ষণ হয় নাই। আইসা গোসল করলাম। রান্নাঘরে গিয়া দেইখা আসলাম কি রান্না করছো
- তুমি তো বাসায় ফিরে গোসল করো না কখনো। আজ যে গোসল করলে ! বলে আমি বিছানা থেকে নামি। চোখে মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হওয়া দরকার। খেয়ে আসছো হোটেল থেকে নাকি আমার সাথে খাবে?
- বাসায় ফিরা আগে গোসল করতাম না বইলা কি গোসল করা যাবে না এমন নিয়ম আছে নাকি ? খাবার গরম করো, আসতাছি আমি।
একবার ইচ্ছে হলো বলি, পারবো না খাবার গরম করতে। আজ তুমি টেবিলে খাবার সাজাও। কিন্তু বললাম না। ইচ্ছে হলেও আমরা মানুষেরা ভদ্রতার খাতিরে মনের অনেক কথা প্রতিনিয়ত এভাবে গিলে ফেলি। বলা হয়ে ওঠে না। নিজেই বুঝতে পারছি আমার আজকে মেজাজ খারাপ, হয়তো কথা বাড়ালে রেজার সাথে বিশ্রী একটা ঝগড়া হয়ে যেতে পারে। ও তো আর জানবে না আমার মেজাজটা কেন খারাপ হয়ে আছে। কিন্তু আমি আমার মাথা থেকেও নামাতে পারছি না ও আমার নাম নিয়ে মিথ্যে বলে দুপুরের আগেই হোটেল থেকে বের হয়েছে লিয়ানাকে সাথে নিয়ে। মিথ্যুক কোথাকার ! দেখি না ও কতটা বাড়তে পারে।বিরক্তি চেপে স্বাভাবিক আচরণ করাটা বেশ কষ্টের দেখা যাচ্ছে। উফ ! ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার গরম করে রেজাকে ডাকতে গিয়ে দেখি টিভি নিয়ে বসেছে। অন্যদিনের মতো তার হাতে রিমোট নিয়ে আজ টিভিটা বন্ধ করে দিলাম না। একবার ডেকেই চলে এলাম। প্লেটে খাবার দুজনের জন্য বেড়ে আমি একাই খাওয়া শুরু করে দিলাম।অসময়ের ঘুমের জন্য কিনা জানি না কপালের দু'পাশটা ব্যাথা করছে। রেজা এসে শব্দ করে চেয়ার টেনে বসলো।
- রেজা , আমাদের নিচ তলার কিয়ারার দাদী একটু অসুস্থ শুনেছিলাম ম্যাকের কাছে। চেয়ারে শব্দ করছো কেন?
- আমি কি মাগনা থাকি নাকি এই বাসায় ? ভাড়া দিয়া থাকি। নিজের ঘরে পুতুলের মতো চলবো নাকি যে শব্দ করন যাইবো না ? এই কথা কি তোমার বন্ধুর বৌ আইসা বইলা গেছে ? ম্যাকের সাথে আমার আসা যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে কথা হয় বলে রেজা ম্যাককে আমার বন্ধু বলে ক্ষেপাতে চায়। কী কথার মাঝে যে রেজা কী বলে তার ঠিক নেই। শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি খেতে খেতে ওর মুড বুঝার চেষ্টা করি।
- একটু বুঝে শুনে কথা বলো না কেন তুমি ? এখানে টাকা দিয়ে থাকো নাকি তোমার নিজের ফ্ল্যাট এ ব্যাপারটা কীভাবে আসলো সেটাই বুঝলাম না। তোমার বাসা বলে তুমি ইচ্ছেমতো এমন কাজ করতে পারো না যা তোমার আশেপাশের মানুষ বা প্রতিবেশীদের সমস্যা তৈরি করবে।
- হুম , কী হইছে ঐ বুড়ির ?
- কোন বুড়ি ?
- কোন বুড়ি মানে কিয়ারার দাদী ?
ওর এভাবে কথা বলার ধরণ দেখে আমি তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। আশ্চর্য মানুষ একটা। আমি উত্তর দেই না ওকে আর।আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার ও বলে -
- লেবু নাই ?
- ফ্রিজে আছে। নিজে কেটে খাও। আমার খাওয়া শেষ হওয়াতে উঠে পড়ি। প্লেট ধুতে গিয়ে দেখি পেট, গ্লাস ধোয়ার লিকুইড ক্লিনার শেষ। কালকেই মনে করে আনতে হবে ভেবে রাখি।
- তুমি তো উঠছোই , ফ্রিজ টা খুলে লেবু বের করে দাও না,প্লিজ।
- পারবো না। চা খাবে খাওয়া শেষ করে ?
- চা খাইলে কি আর রাত্রে ঘুম হইবো ? অবশ্য কাল তো আমার ছুটিই। আইচ্ছা দিও এক কাপ চা।
- কাল তো তোমার ছুটি না।হঠাৎ ছুটি নিলে যে ?
- আমার বৌ-রে তো সময়ই দেই না। তাই ভাবছি কাল সময় দিবো। কেন খুশী হও নাই ?
রেজার ছুটি নেয়া বা কাজে যাওয়া কোনটাতেই আমার উপরে খুব একটা প্রভাব ফেলে না এখন। আর আগে যখন ওর ছুটি কাটানো নিয়ে আমার মাঝে খুশী একটা প্রত্যাশা গড়ে উঠতো, সেটাও ওকে খুব একটা স্পর্শ করতো না। একদিন তো ও বলেই দিলো আমার অভিমান করা দেখে -
- দ্যাখো নুহা, আমি দেশে যাই ছুটি কাটাইতে। আর এইখানে এইটা হইলো আমার জীবিকা। কাজ করি সারা সপ্তাহ। একদিন ছুটি পাইলে আমার ইচ্ছা করে না বাইর হইতে। আর এইখানে দেখার কিছু নাই, কি দেখবা পুরাই পাত্থরের দেশ। সুতরাং এভাবে বলে দিলে অন্তত প্রত্যাশাকে সেখানেই কবর দেয়া উচিত। লজ্জায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে না আর। আমি অপেক্ষায় থাকি কখন ওকে সুযোগ বুঝে ধরবো লিয়ানা আর মিথ্যে বলে আমার নাম ভাঙ্গিয়ে কই গিয়েছিলো সে কথা জিজ্ঞেস করার জন্য।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৯