নুহা-১৩
অবশ্য বিয়ের পর জেনেছি রেজা ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে ক্লাস করেনি একদিনও, জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছে ইতালিতে। এতো পইড়া কী হইবো, যার অনেক টাকা আছে, তারে কী কোনোদিন কেউ জিগায় তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী? আর টাকা দিয়া যেখানে সার্টিফিকেটই কিনতে পাওয়া যায় সেখানে কে আর সময় নষ্ট কইরা পড়াশুনা করবো বলো ? এমনটাই বলেছিলো রেজা তার পড়াশুনা করতে না পারার কারণ হিসেবে। আবার এটাও ঠিক বিয়ের পর থেকে আরাম আয়েশী জীবনে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই বলে মনের বিরুদ্ধে আপোষ করে চলাটা ভীষণ শক্ত হয়ে যায় কখনো কখনো। কতটা সময় এসব ভেবে ভেবে পার করেছি জানি না, হয়তো মিনিট দশ কী পনেরো। রেজা গা এলিয়ে পড়ে আছে আমার পাশে। স্বামী-স্ত্রী আদর সোহাগ কী একতরফা হয়ে যাচ্ছে না? এমনটা ঘন ঘনই হচ্ছে। যদিও শরীরই যাদের কাছে মুখ্য তার চোখে এসব ধরা পড়বে না,তারা শুধু জানে উপগত হতে। ঘুমটা আর হলো না, ভাবছি গোসলটাই সেরে নেবো। রেজাকেও বললাম ফ্রেশ হয়ে এসে শুতে। আমার কথায় কান না দিয়ে বরং চাদরে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বললো - এখন আরামের ঘুমটা নষ্ট কইরো না তো! ঘুমের থেকে উঠে করবো নে গোসল। তুমিও ঘুমাও।
হাহ্ আমার আর ঘুম। বিছানা থেকে নেমে ওয়ারড্রব থেকে জামাকাপড় নেই। মাথা ব্যথা করছে। গোসল সেরে দেখি এক কাপ কফি খেতে হবে। অনেকদিন গান শুনি না, আজ গান শুনবো।
গোসল সেরে আমি সরাসরি পাশের রুমে চলে আসি, শোবার রুমে না ঢুকে, রেজা ঘুমাচ্ছে,ওর যাতে ডিস্টার্ব না হয় আমার টুকটাক প্রসাধনের কাজে। সাইনাসের সমস্যা বলে ডাক্তার বলে দিয়েছে গোসলের পর চুল ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিতে। এখন ঐ রুমে গেলেই ড্রায়ার চালাতে হবে আর সে শব্দে রেজার ঘুম নষ্ট হবে। শরীরটা এতো ক্লান্ত লাগছে যে এখন আর ইচ্ছে হচ্ছে না রান্নাঘরে ঢুকি কফি বানানোর জন্য। এ রুমে আমার গল্পের বইগুলো রাখা বলে আমি এর নাম দিয়েছি লাইব্রেরী রুম। এ রুম আর আমাদের শোবার রুমের বারান্দা দুটোই একসাথে লাগোয়া। রুমে ঢুকে বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দেই। দরজা লাগিয়ে রাখার পরেও কোত্থেকে যে এতো ধুলোবালি এসে জমা হয় কে জানে ! বুকশেলফের উপরে, কাঁচের সাইডে সাইডে ধুলো পড়ে আছে। গোসল সেরে এসে আর ইচ্ছে করছে না এ রুমের ঝাড়পোছের কাজ শুরু করতে। কম্পিউটারের টেবিলটাও পরিষ্কার করা দরকার ছিলো, কম্পিউটার অন করতে করতে ভাবি। আচ্ছা করবো নে এক সময়। এখন আমার গা জুড়ে রাজ্যের আলস্য। আমার পছন্দের গানের ফোল্ডারটা ওপেন করে কিছু গান সিলেক্ট করে দেই যাতে বারবার উঠে বদলাতে না হয়। বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া গান একেকটা কালেক্ট করেছি একেক সময়ে। আমার আবার একই গান বারেবারে রিওয়াইন করে শোনার অভ্যাস আছে। আমার মা এবং রেজা দুজনেই বলে - এটা তোমার অভ্যাস না, বলো যে বদভ্যাস। অভ্যাস বা বদভ্যাস যাইই হোক না কেন এক গান আমার বারবার শুনতে ভালোই লাগে যদি কোনো গান আমার মাঝে দাগ কেটে যায়। হয়তো এভাবে শুনতে শুনতে কোনো কোনো গানের লিরিক আবার কোনটার সুরই মুখস্থ হয়ে যায়। একটা মজার ব্যাপার হলো, আমি বারবার একই গান শোনার ফলে সেই গানের সুর মাঝে মাঝে মাকেও দেখছি গুনগুন করে ভাঁজতে। ব্যাপারটা এখন মনে করে আবারো আমার হাসি পেলো। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে দুলে দুলে গান শোনার মজাই আলাদা। চোখ বন্ধ করে আমি এখন গান শুনছি, লো ভলিয়ুমে।
" এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে
এসো না গল্প করি ... "
- আরতি মুখোপাধ্যায়ের এই গানটা আমার এতো প্রিয় কী বলবো। খুব রোম্যান্টিক একটা গান। বিয়ের পর পর যখন রেজার সাথে গল্প করতাম, এই গানটা বেশিই শোনা হতো। তখন ও হাসি হাসি মুখে শুনতো, ভালো না লাগলেও হয়তো শুনতো। যখন আমি বলতাম, গানটা কত সুন্দর তাই না?
ও বলতো - তাই ! হুম সুন্দর!
- কল্পনা করোতো দৃশ্যটা! জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মাখিয়ে কত সুন্দর আহ্বান একজন প্রিয় মানুষের জন্য একজন নারীর, অনুভব করতে পারো রেজা ?
- হুম। ভালোই তো খারাপ না । কিন্তু বাংলা গান শুনলে আমার ঘুম চলে আসে বুঝলে? কিছু মনে করলে না তো !
তখন রেজা আমার সাথে কথা বলার জন্য লোকাল ভাষাটা ব্যবহার করতো না। নাহ কিছু মনে করার মতো এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি না। আমার যে কাউকে বুঝতে, তার কাজের ধরণে হিসেব মিলাতে সময়ই লাগে। গাড়িতে বাংলা গানের সিডি রাখা হয় না কারণ রেজা শুনতে চায় না। হিন্দি গান ওর পছন্দ, আমারও হিন্দি গান পছন্দ তবে সফট মিউজিক। রেজার কাছে রবীন্দ্রসংগীত মানেই নাকি প্যানপ্যানানি। তাই যে কোনো বাংলা গানের প্রতিই ওর অনীহা চলে এসেছে। এই তো গেলো নববর্ষে ওকে বলেছিলাম আজকে ছুটি নাও, চলো বাইরে কোথাও ঘুরে আসবো কিংবা বাঙালিদের যে নববর্ষ উদযাপনের যে মেলা হয় ওখান থেকে বিকেলে শবনমকে সাথে নিয়ে না হয় বেড়িয়ে আসবো। ও উত্তর দিলো - হুম খেয়ে দেয়ে আর কাজ নাই, সারা মেলা জুইড়া প্যানপ্যানানি গান চলবো আর আমি যাবো ঐ জায়গায়। অন্য কোথাও হইলে বলো বিকালে ছুটি নিয়া যামুনি ঘুরতে। মাঝে মাঝে ওর কথাবার্তা শুনেলে হাসি পায় রাগ করতে গিয়েই। ইজিচেয়ারের দুলুনির তালে তালে কেমন ঘুম ঘুম লাগতে থাকে। আমি দুলতে থাকি গান শুনতে শুনতে, তলিয়ে যেতে থাকি ঘুমের রাজ্যে। আহ্ ঘুমোতে কী ভীষণ শান্তি। গত কয়দিনের নির্ঘুম রাত্রিগুলোর দেনাপাওনা নিজেকে বুঝিয়ে দিতে আমি এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেও রেজার ডাকে এক সময়ে ঘুম ভাঙে আমার। কত সময় ঘুমিয়েছি বুঝতে পারি না। বাইরে সূর্য ডুবে অন্ধকারের রঙ ছড়িয়েছে ছিটেফোঁটা ইতিমধ্যেই। ঘুম থেকে এ সময় ওঠার পর সবসময়ই আমার কেমন বিষণ্ণ লাগে, বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে, মা আর বাবার কথা মনে পড়ে। খুব কান্না কান্না পায়। রেজা গায়ে মৃদু ধাক্কা দেয়, বলে - ওঠো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
- হুম , উঠছি বলে আমি আরও কিছুক্ষণ হেলান দিয়ে থাকি চেয়ারে। রেজা রুমের লাইট জ্বালিয়ে টিভি অন করে। টিভিটা আজ দুপুরেই এ ঘরে আনা হয়েছে। এখন ও একটানা টিভি দেখবে। আমি উঠে কম্পিউটার সাট ডাউন করে দেই।একটু আড়মোড়া ভেঙে ফ্রেশ রুমের দিকে যাই।
ঘুম ভাঙার পরেও ঘুমের আমেজ কাটতে সময় লাগে আমার। চোখে মুখে পানি দিয়ে মনে হলো দাঁতটাও ব্রাশ করে নিলে ভালো হয়। কেমন জানি লাগে ঘুম ভাঙার পর মুখের ভেতরটা। ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দাঁড়িয়েই থাকি বেসিনের সামনে। বেসিনটার সাথে সুন্দর স্কয়ার সাইজের আয়না লাগানো আর তার দুই পাশে লম্বা মতো দুইটা বক্স। ওখানে আমার, রেজার ব্রাশ, শ্যাম্পু, সাবান, বাথরুম পরিষ্কারের মেডিসিন ইত্যাদি জিনিস ছাড়াও রাখা আছে কাপড় ধোয়ার লিকুইড। ঘরে আমাকে কাপড় ধুতে হয় না এটা একটা সুবিধা। রেজা আমাদের কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, ভারী, পাতলা সব ধরণের কম্বল সব হোটেল থেকেই ক্লিন করে আনে। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছি মনে হয় মিনিট পাঁচেক হয়ে গেছে। প্রচণ্ড আলসেমী লাগছে ব্রাশ করতে। টুথপেস্ট দেখার মাঝে কোনো সৌন্দর্য আছে এমন না, তারপরেও ইচ্ছে করছে না ব্রাশটা দাঁতে লাগাতে। বেসিনের আয়নাটার উপরের দিকে ছোট ছোট দুইটা লাইট আছে। আমি সে দুইটাও জ্বালিয়ে দেই। আমার চোখে মুখে উজ্জ্বল আলো এসে পড়ে আর ফ্রেশরুমের মেইন লাইটটা অফ করে দেই। এইবার বেশ শান্তি লাগে, অকারনেই। একটা ছেলেমানুষি আনন্দ বলা যায়। বেসিনের কলটা ছেড়ে আমি আয়নার লাইটের আলোতে নিজের চেহারা দেখতে থাকি। অনেকদিন পর মনে হয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছি। সবাই বলে আমার চেহারায় নাকি আমার বাবার সাথে অনেক মিল আছে গায়ের রঙ বাদে। বাবার গায়ের রঙ কালো আর আমারটা ফর্সা। রেজা ফান করে বলে কাপুচিনোর মতো তোমার গায়ের রঙ। বাবার মতোই আমার নাকটা লম্বা, চোখ গুলোও বড় বড়। আর কী আছে আমার চেহারায় দর্শনীয় দেখার জন্য মুখটা আয়নার দিকে আরেকটু এগিয়ে নেই। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি আয়নার ভেতর দিয়ে, খুব কাছাকাছি। আমার চোখ দেখতে তেমন স্পেশাল কিছু না, শুধু টানা টানা, কাজল দিলে আরও লম্বা লাগে এই আর কী! চুলগুলো খুব একটা লম্বা না হলেও সিল্কি। আচ্ছা চুলগুলো কী একটু ছেঁটে আসা দরকার পার্লারে গিয়ে কিংবা কালার করে আসবো। এমনিতে আমি সাজুগুজু করিই না বলতে গেলে। তবে ছোট ছোট যত্নআত্তি নিজের জন্য মনে হয় করা উচিত। পার্লারে যদিও খরচটা একটু বেশিই হয় এ দেশে। খরচ হয় হোক, পার্লারে যাবো এমন একটা সিদ্ধান্ত নেই এবং সাথে চুলে কালার করাবো। আমার চুলের রঙ কুচকুচে কালো। এতে মেরুন কালার দিলে চুলে হালকা একটা রেডিস ভাব আসতে পারে মনে হয়। মেহেদী দিতে পারলে ভালো হতো। বাংলাদেশে থাকতে মাসে দুইবার দিতাম মেহেদী, ডিম, চা- পাতা ভিজিয়ে এর পানি আর মেথি মিশিয়ে। মেহেদীর গন্ধটা আমার অদ্ভুত ভালো লাগে, এই ভালো লাগার অনুভূতি ব্যাখ্যার ভাষা আমার জানা নেই। আচ্ছা তাহলে ঠিক করলাম কি কি ? চুল কাটাবো আর চুলে কালার করাবো। ফেসিয়াল টেসিয়াল এসব করাবার ইচ্ছে নেই। আমার মনে হয় এগুলো করাতে গেলে অকারনেই স্কীনে র্যাশ হবে। মুখের, গলার কাছটার চামড়া ভালো মতো আয়নার সামনে নিয়ে দেখি, চোখের কোণায় রিংকেল পড়লো কিনা। কই, কোনো রিংকেল তো নেই। আর পড়লেই বা কী। নায়িকা হতে তো আর যাচ্ছি না। এ কথাটা ভেবেই ফিক করে হেসে ফেলি। আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে ক্লোজ বান্ধবী রিপার কথা মনে পড়ে যায়। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। সে সময়ে রিপারা ওদের বাসায় 'তারকালোক' এই ম্যাগাজিনটা রাখতো। কোন তারকার খাবারের রুটিন কী, কে কী ড্রেস পড়লো, কোন জুতো কিনলো ইত্যাদি সব খবর সে রাখতো এবং তাদের রূপচর্চার নিয়মকানুনও ফলো করতো। যখন জিজ্ঞেস করতাম না খেয়ে খেয়ে এভাবে ডায়েট করিস ক্যান ? ও জানাতো - বলা তো যায় না, কখন কোন অডিশনে চান্স পেয়ে যাই।
- এই বয়সে ?
- এখন না হোক, পরে বড় হলে। যখন কলেজে উঠবো। আমার মডেল হওয়ার অনেক শখ। দেখিস না রুবি এখনই দুইটা অ্যাড করে ফেলছে।
রেজা এসে দরজা নক করে। কী ব্যাপার আজকে কী আর বের হইবা না ?কী করো এতক্ষণ তুমি ?
- আসছি।
ইশ অনেকটা সময় পার করে দিয়েছি ছেলেমানুষি আবেগে। নিজেকে আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাকে কী ছেলেমানুষি আবেগ বলা যায় ? কী জানি ! রেজা গেলেই তো জিজ্ঞেস করতে থাকবে এতো দেরী হলো কেন । ফ্রেশরুম থেকে বের হয়ে সোজা রান্নাঘরের দিকে যাই। রাতের রান্নাটা শুরু করার আগে এক কাপ কফি খাওয়া দরকার। চুলায় কফির জন্য দুধ বসিয়ে বসিয়ে রাতের খাবারের মেনুর জন্য ঠিক করা গরুর মগজ আর শিং মাছটা রান্নার জন্য পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, অন্যান্য মশলা কাবার্ড থেকে নামাই। এক চুলাতে ভাত বসিয়ে দেই। দুপুরের ডাল যেহেতু বেঁচে গেছে, ওটা ওভেনে গরম করে নিলেই হবে ভেবে রাখি। ও ঘর থেকে রেজা গলা উঁচিয়ে বলে -
- এক কাপ চা, কফি কিছু দিবা না নাকি ? বিস্কুট থাকলে বিস্কুটও দিও।
দুইটা কাপে কফি আর বিস্কুট নিয়ে বারান্দায় রাখি। রেজাকে বলি বারান্দায় এসে বসতে। টিভির প্রোগ্রাম রেখে উঠতে হব এবলে ঘ্যানঘ্যান করলেও শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরের পাশের বারান্দায় এসে বসে। যদিও বসার জন্য চেয়ার টেবিল নেই। আমরা দুজনেই ফ্লোরে বসি। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে রেজা বলে - কী ব্যাপার তুমি এতক্ষণ ফ্রেশরুমে কী করছো ? পেট খারাপ নাকি ?
- ধুর কী সব বলো এইগুলি ?
- এক ঘণ্টা হইয়া গেছে বাইর হও না তাইলে কী কমু আমি ! হাসো কেন ?
- নাহ্ কিছু না। এমনি হাসি। আমি আমার হাসিটা কেন যেন থামাতে পারছি না।
- কও না হাসতাছো কেন ?
- এমনি হাসি। ফ্রেশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখছিলাম। স্কুলে- কলেজে থাকতে যেভাবে দেখতাম।
- কী দেখলা ?
- দেখলাম আমার চেহারাতে কতটা পরিবর্তন আসছে, নিজের সৌন্দর্য বাড়াতে আর কী কী করা দরকার এসব।
- তুমি তো এমনিতেই সুন্দরী। নাদুসনুদুস। বলে ও আমার গালটা টিপে দেয়।
- হুম সুন্দরী ! নাদুসনুদুস না ভুটকী ? জিমে ভর্তি হওয়া দরকার।
- মন চাইলে ভর্তি হও, কিন্তু স্লিম হইলে তোমারে ধইরা কী আর মজা পামু ?
- ধরাধরি পরে করবে, এখন এসে পেঁয়াজ কেটে দিয়ে যাও। পেঁয়াজ কাটতে আমার ভালো লাগে না। আমি চায়ের কাপ গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াই।
- তুমি অনেক রসকষহীন নুহা
- হাহাহহা, আর তুমি রসের আঁধার। দুইজনে এক হলে কী করে হবে। আমি না হয় একটু কমই থেকে দুনিয়ার সমতা রক্ষা করি, কী বলো ? আমি হাসতে হাসতে চলে যাই রান্নাঘরের দিকে। এসে দেখি ভাত প্রায় হয়ে এসেছে। প্লাস্টিকের ছাঁকনিতে ভাতটা ঢেলে দেই মাড় গালতে। প্লাস্টিকের ছাঁকনিতে ভাতের মাড়টা ঝরাতে দিলে ভাতটাও খুব সুন্দর ঝরঝরে থাকে, একটার সাথে আরেকটা লেগে যায় না। এখানে আসার সময় খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম কারণ ভাতের মাড় গালতে পারি না, মাছ কাটতে পারি না, অনেক কিছুই আমি পারি না। রান্নবান্নাও পারি না তেমন। মা তো বলে - পারবি কই থেকে? পড়াশুনা ছাড়া আর কোন কাজটা তুই পারিস শুনি? এগুলো রেজার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবার পরের কথা। তখন বাবাই আমার পক্ষ হয়ে দুই একটা কথা বলতে এগিয়ে আসে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মা'কে বলে -
- আমার মা পড়াশুনা কইরা সময় পায় কই ! ও পারে না এইসব কাটাকাটি, রান্নাবান্নার কাজ তো তুমি আছো কী করতে। শিখাইয়া দাও বকাবকি না কইরা।
আমার মায়ের বকাবকি যদিও কমেনি কিন্তু ডিম ভাজা, মাছ ভাজা, টুকটাক দুই একটা তরকারি রান্না শিখেছিলাম ভাত রান্না করা ছাড়া। মায়ের বকা খেয়েও পারিনি ভাতের মাড় গালা শিখতে। মা, চাচী উনাদেরকে দেখি কতো দক্ষ হাতে এলুমিনিয়ামের ঢাকনা দিয়ে ভাতের হাঁড়ির মুখ আটকে কেমন চটপট মাড় গেলে ফেলে। উফ এর চেয়ে কঠিন আর কী হতে পারে। বিয়ের পর পর রেজা যখন আমাদের বাসায় আসতো, একদিন বাবা কথায় কথায় রেজাকে জানায় রান্নাঘরের কাজে আমার অপটু হাতের কথা। শুনে রেজা হেসেছিলো, বলেছিলো - চিন্তা করবেন না। দেশের বাইরে গেলে আর নিজের সংসার হলে এমনিতেই মেয়েরা কাজকর্ম শিখে যায়। রেজার কথায় আমার বাবা নিশ্চিন্ত হলেও মায়ের দুশ্চিন্তা কমেনি। এখনো বাংলাদেশে ফোন দিলে রান্নাবান্না কতোটা শিখলাম সে খোঁজ নিতে ভোলে না। রেজা পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ , করলা আর আলু কেটে দিয়ে চলে যায়। যদিও বলেছিলো রাতের রান্নাটা ও নিজেই করবে কিন্তু এখন ওর মনোযোগ টিভির দিকে। শিং মাছে হালকা মশলা মাখিয়ে একটু ভেজে নেই। মাছ আর গরুর মগজ রান্না করতে বেশি সময় লাগার কথা না। রান্নার সময় রান্নাঘরের দুইটা দরজাই বন্ধ করে নেই। মশলার ঝাঁঝে প্রতিবেশীদের সমস্যা হতে পারে, রেজা এখানে আসার পরপরই আমাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলো। দুই চুলায় দুই তরকারী বসিয়ে দিয়ে আমি পেঁয়াজ, তরকারী খোসা গুলো টেবিল থেকে পরিষ্কার করে নেই। বেসিনটা মুছে রাখি। আদা-রসুন ব্লেন্ড করা দরকার, কালকের দিন পর্যন্ত রান্না চলবে যে পরিমান ব্লেন্ড করা আদা বক্সে আছে। এখন রাত করে আর ইচ্ছে করছিলো না এসব করতে, তাছাড়া ব্লেন্ডারে শব্দও হবে বেশি রাতের বেলা। দরজা খোলার শব্দে দেখি রেজা কর্ডলেসটা নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। জানায় - শবনম ভাবী ফোন করছে। কথা বলো । ফোন নিয়ে হ্যালো বলতেই শবনম বলে -
- কিরে তোর জামাই বাসায় আসছে কখন ?
- আজকে তো কাজেই যায় নাই । তুই কী করিস ?
- ওহ জামাই বাসায় দেইখাই তুই আজকে ফোন দেস নাই। হায়রে পিরিত রে জামাইয়ের লগে। বলে ও হাহহা করে হাসে। ওর সাথে আমিও হাসি। বলি -
- হুম পিরিতই তো ! ভিক্টরিয়া গেছিলাম বাজার করতে, তারপর রান্নাবান্না, ঘুমাইছিও। এখন আবার রাতের রান্না। আলী ভাই আসছে বাসায় ? তোর রান্না শেষ ?
- নাহ, চিংকু এখনো বাসায় আসে নাই। কাজে গেছে তো দুপুরে। ঘরে ফিরতে রাইত বারোটা বাজবো। ভাল্লাগতাছে না ঘরে একলা একলা। তাই ভাবলাম তোরে ফোন দেই। হ রান্না শেষ করছি বিকালেই। তারপর দেশে একটু আম্মুরে ফোন দিলাম, শম্পারে ফোন দিলাম।
- তুই বাসায় একলা আছিস এইটা আরও আগে জানালেই তো পারতি, তাইলে বাজার কইরা ফেরার পথে তোরে আমাদের বাসায় নিয়া আসতাম।
- তোর বাসায় আসি নাই ভালো হইছে একদিক দিয়া। আর তোর জামাইয়ের তো আজকা ছুটি, আমি আসলে বরং রেজা ভাই বিরক্ত হইতো। হের তো বউয়ের লগে ঘসাঘসি না করলে হয় না।
শুনে আমি হাসি। শবনমও ফোনের ওপাশে হাসতে থাকে। বলি - আসলে রেজা সব সময় অমন করে না। শুধু শুধুই তুই লোকটাকে নিয়া টিজ করতাছিস। বলে আমি আবার হেসে ফেলি। শবনম বোঝে আমিও ফান করছি।
- আচ্ছা শোন, আমি ফোন রাইখ্যা দেই। তোর রান্না শেষ হইছে ? আর কালকে আমার সাথে একটু হসপিটালে যাইতে পারবি সকাল নয়টার দিকে?
- হুম পারবো। আমি তাহলে তোর বাসায় আর আসবো না, একবারে সানপাওলোর মেট্রো স্টেশনে থাকবো। তুই ওখানেই চলে আসিস আর আমি বাসা থেকে বের হবার আগে তোকে ফোন দিবো নে। তারপর বিদায় নিয়ে শবনম ফোন রেখে দেয়।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৮