নুহা - ১৪
শবনমের ফোন রেখা দেবার পর রান্নাঘর মোটামুটি ভদ্রস্থ গোছের করে টেবিলে খাবার সাজাই। মনে করে ফ্রিজ থেকে লেবু বের করে রাখি। আমার কেন যেন লেবু কাটার কথা মনেই থাকে না। আর রেজা এটা নিয়ে বিরক্ত হয় খুব। আমি টক খেতে পছন্দ করি না, এমনকি আচারও না, হয়তো খেতে বসলে লেবু দেয়ার কথা এ কারণেই ভুলে যাই। রেজা খুব অবাক হয় আর বলে -
কেমন মাইয়া মানুষ তুমি, টক খাইতে ভালোবাসো না ! রেজা আবার টক খেতে খুব পছন্দ করে। ও যেভাবে কাঁচা আমের ভর্তা, কামরাঙ্গা কচ কচ করে চিবিয়ে খায়, দেখলে আমার গা শিরশির করে। গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু এটা কেমন কথা রেজা ' মাইয়া মানুষ' হলেই টক খেতে হবে বা 'মাইয়া মানুষ' মানেই টক খায় এমনটা ভাবার কারণ কী - এ প্রশ্ন করলে রেজা আমতা আমতা করে এড়িয়ে গিয়েছিলো। বলেছিলো - আরে অমন সিরিয়াস মিন কইরা কিছু বলি নাই। সব কথা এতো খপ কইরা ধইরা ফালাও কেন। আমি আর এ বিষয়ে পরে কথা বাড়াইনি কিন্তু ব্যাপারটা ভাবতে ভালো লাগে না যে এখনো মেয়েদের ' মাইয়া মানুষ' বলে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। মেয়েদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে চলাফেরার, কাজকর্মের এবং প্রকৃতি প্রদত্ত হয়তো কিছু দুর্বলতাও আছে ক্ষেত্রবিশেষে, আর সেটা আমিও জানি। কিন্তু এসব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া কিংবা মনের মাঝে এই ধারণা পোষণ করে রাখা সেটাও আমার পছন্দ না। কাজ দিয়েই একজন মানুষের পরিচয় হওয়া উচিত; হোক সে নারী কিংবা পুরুষ।এসব কথা শুনলে আমার মা'ও বলে - হইছে এতো নারীবাদী হইতে হইতে হইব না।মাইয়া মানুষ, মাটির দিকে তাকাইয়া চলবি। জিদ মাটি কইরা ফালা, বিয়ার পর মাইয়াগো আবার নিজের বলতে জীবন আছে নি ? কী সব অদ্ভুত ধারণা নিয়ে যে মানুষ জীবন চালাচ্ছে, অবাক হই, রাগ লাগে অনেকক্ষেত্রে ।
রান্না ঘর থেকেই রেজাকে ডাক দেই খেতে আসার জন্য। আমি প্লেটে ভাত বাড়ি। রেজা আরও মিনিট পাঁচেক পর আসে খেতে। আজকে দেখি আমি বলার আগেই লেবু কাটছ , গুড গার্ল। বলে রেজা চেয়ার টেনে বসে। গরম গরম সব খাবার খাইতেই মজা, কী বলো ? আমি মাথা নাড়ি - হুম। মজাই। কিন্তু তুমি এই মজাটা প্রায় দিনই পাও না, হোটেল থেকে খেয়ে আসো বলে। ওকে শিং মাছের তরকারীটা এগিয়ে দেই।
- আজকে দেখি তোমার বান্ধবী তাড়াতাড়ি ফোন রাইখা দিলো ! এতো তাড়াতাড়ি কথা শেষ হইয়া গেলো ! রেজা উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে কাঁচা মরিচ বের করে আনে। বলে, কাঁচামরিচের গন্ধই আলাদা, অন্যরকম। মাছের তরকারীটা ভালোই হইছে।
- আমি রান্না করছিলাম তাই বেশি কথা বলে নাই শবনম। একটা কথা জানতে ফোন দিয়েছিলো।
- কী কথা ? ওর কথা শুনে আমি ওর দিকে তাকাই, বলি -
- কাল হসপিটালে ওর এপয়েনমেন্ট আছে। ওর সাথে যেতে পারব কিনা জিজ্ঞেস করলো
- কেন, আলী ভাই নাই ? নাকি উনি ব্যস্ত ?
- আলী ভাই নিয়ে যেতে পারলে তো আর আমাকে বলতো না নিশ্চয়ই ! ওর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি এ কথা বলে, ওর পরের কথা শুনবো বলে
- তাও কথা। তুমি তো আজাইরাই থাকো ঘরে, যাইও তাইলে উনারে নিয়া। ওর কথা শুনে আমি হাসি। ও জিজ্ঞেস করে -
- হাসো কেন ?
- তোমাকে আমার এই ' আজাইরা থাকার' ব্যাপার নিয়েই কিছু কথা বলবো ভাবছিলাম। ভুলে যাওয়াতে আর পরে বলা হয়নি। তুমি মনে করিয়ে দিয়েছ, এজন্য হাসি।
- এইখানে হাসির কী হইলো ?
- হাসির কিছু হয় নাই। খাও, খাওয়া শেষ করে এ ব্যাপারে কথা বলবো। ওর দিকে গরুর মগজ ভুনা এগিয়ে দেই। প্লেটে আরও ভাত তুলে দেই। বাকী সময়টা আমরা নিঃশব্দেই খাই, রেজার চপচপ করে আওয়াজ করে খাওয়ার শব্দই শুধু পাওয়া যাচ্ছিলো। এ ব্যাপারে ওকে অনেকদিনই বলেছি, এভাবে আওয়াজ করে যে খাও, তোমার কলিগরা বিরক্ত হয় না? শব্দ করে খাওয়াটা তো এ দেশে অভদ্রতা, আন স্মার্টনেস এরকম ভাবেই দেখে ওরা। ও জানায় -
- ইতালিয়ানদের সামনে কী আর এমনে খাই নাকি? পাগল ! নিঃশব্দেই খাই। এমনকি হাঁচিও দেই আওয়াজ ছাড়া। একবার কী হইছে শোনো, বরিশাইল্যা কালাম ভাই আওয়াজ ছাড়া হাঁচি দেয়ার প্র্যাকটিস করতে গিয়া নাকে মুখে আটকাইয়া নিঃশ্বাস বন্ধ হওনের দশা। বলে, ভাই, মোরে ধরেন, মোর হাসিরে একটা খবর দেন। ও অভিনয় করে বলতে থাকে ঐদিনের কথা। হাসি ভাবী, কালাম ভাইয়ের স্ত্রী। ইতালিতে এসেছেন বছর খানেক হবে। কিন্তু শুধু কালাম ভাই বললেই আমি চিনতাম, বরিশাইল্যা কালাম ভাই না বললেও পারতো রেজা। আমি একটা বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ি। বুঝি সবার রুচি সমান না।
খাওয়া শেষে রেজা ওর নিজের প্লেট ধুয়ে শোবার রুমের দিকে পা বাড়ায়। আমি দুপুরের ডালের পাতিল,আমার প্লেট, তরকারীর বাটি ধুয়ে ফেলি। টেবিল পরিষ্কার করে বাড়তি তরকারী বাটিতে বেড়ে ফ্রিজে রেখে দেই আগামীকালের জন্য। ভাতও বেঁচে গেছে অনেকটা। কাল দুপুরের জন্য না রান্না করলেও চলবে। রাতে রেজা বাসায় আসার আগে কিছু রান্না করে নেবো। রান্নাঘরের বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে লাইট অফ করে আমি বের হই রান্নাঘর থেকে। দরজাটা খুলে না রাখলে রান্নার গন্ধটা দেখা যাবে এখানেই ঘুরেফিরে পাক খেতে থাকবে। শোবার ঘরে গিয়ে দেখি রেজা এরই মাঝে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বললো -
- টিভিটা থাকলে তো আরাম কইরা এখন শুইয়া শুইয়া টিভি দেখতে পারতাম।
- হুম , এতো আরাম ভালো না। চর্বি জমে যাবে পেটে। আর খেয়েই তুমি শুয়ে পড়লে যে, ওঠো। একটু হাঁটাহাঁটি করো বারান্দায়। ব্রাশ করে আসো।
- ব্রাশ কইরা কী হইবো ? তুমি তো আর চুমা দিবা না, রাইতে তো ধরতেও দিবা না। হাহহাহা
- রেজা চুমু খাওয়া আর ধরাধরির বাইরে কী বৌ কে সোহাগ করার কথা ভাবতে পারো না? তুমি মাঝে মাঝে বলো না যে আমাকে তুমি বুঝতে পারো না, আমি কেন কাছে এগিয়ে এসে নিজ থেকে তোমাকে আদর করি না, ধরি না ? বলো না এইগুলো ? তোমাকে মিস করি না , ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক কিছুই বলো। তোমার সাথে নিরবিলিতে দুইটা গল্প করতে পারি আমি ? ঘরে এসেই টিভি নিয়ে বসো, না হলে ঘুমাও। তোমাকে নিয়ে বারান্দায় বসলে, তোমার গা ঘেঁষে শুয়ে টিভি দেখলে তোমার কামোত্তজনা হয়। সারাক্ষণ কী করে তোমার মাঝে এসব ব্যাপার ঘোরে রেজা বলো তো দেখি ? সেক্স ছাড়াও যে ভালোবাসা যায়, ভালোবাসা হয় সেটা কী কখনো ভাবো না? যে কোনও প্রসঙ্গ তোমার এই শরীরের মাঝেই শেষ হয় কেন বলতে পারো আমাকে ? আমি কেন এভাবে হঠাৎ ঝড়ের গতিতে একটানা এসব বলে গেলাম জানি না। রেজা খুব অবাক হয়ে গেছে আমার উত্তেজনায়। সচরাচর আমি রাগি না, খুব ঠাণ্ডা ভাবে কথা বলি। ও শোয়া থেকে উঠে বসে বিছানায়। জিজ্ঞেস করে -
- আরে এতো ক্ষেপলা কেন তুমি? তোমার সাথে ফান করা যাইব না নাকি ?
- রেজা, ভালো মতোই জানো কোনটা তুমি ফান করে বলো আর কোনটা ফান না। অসুবিধায় পড়লেই সেটা তোমার ফান হয়ে যায়। আমার কথা শুনে রেজা বিছানা থেকে নেমে আমার হাত ধরে আমাকে বিছানায় এসে বসায়। বলে -
- তোমার মন খারাপ কী নিয়া? এমন বার্স্ট করলা কেন ? মন খুইল্যা না বললে কীভাবে বুঝুম তোমার কী নিয়া সমস্যা? আমি কাঁদতে থাকি ওর কথা শুনে। ঠিক ওর কথা না, কী নিয়ে আমার দুঃখ উথলে ওঠে, আমি জানি না। আমি শুধু কাঁদতে থাকি। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে -
- তোমার কী হইছে আমারে বলো। সারাদিন তো তোমারে ভালোই দেখলাম। এমন কী হইলো এর মাঝে আমি সত্যিই বুঝতে পারতাছি না নুহা। আমারে বলো প্লিজ। আমি ততক্ষণে আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছি। এখন লজ্জা লাগছে এভাবে কেন কেঁদে ফেললাম। রেজার দিকে তাকিয়ে বললাম -
- তুমি কী জানো, আমি সারাদিন কীভাবে সময় কাটাই? সারাদিন কী করি, কই কই ঘুরি ? কোনোদিন জানতে চাও? ভেবেই নিয়েছ হয়তো আমাদের জীবনটা এভাবেই যাবে। আমি সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবো, রান্না করবো আর তুমি সারাদিন কাজ শেষ করে এসে খেয়ে ঘুমাবে !
- আচ্ছা তুমি কী চাও বলো ?
- আমার এভাবে সময় কাটে না রেজা। খুব একা লাগে। তুমিও আমাকে সময় দাও না। আমি বুঝি কাজ করতে হয় তোমাকে। কিন্তু তুমি ঘরে ফিরে এসেও আমার সাথে তেমন একটা কথা বলো না। আমি এ অবস্থার পরিবর্তন চাই। আমার জীবনটা অর্থহীন লাগে খুব।
- সেইটাই তো জিজ্ঞেস করলাম, কী চাও তুমি? রেজাকে খুব গম্ভীর লাগে।
- আমি চিন্তা করছিলাম কোনও জবে ঢুকবো কিনা? আমার কথা শুনে হো হো করে রেজা হাসতে থাকে। বলে -
- কী বললা ? জব করবা ? এইটা বাংলাদেশ পাইছ ? সার্টিফিকেট নিয়া গেলা আর তোমার রেজাল্ট দেইখা তোমারে একটা চেয়ার টেবিল ধরাইয়া দিয়া বলবো , ন্যাও কাজ শুরু করো ?
- হাসবে না। এ দেশে কাজ কর্মের ভেদাভেদ যে কেউ মানে না তুমি যেমন জানো, আমিও জানি। তুমি তো একবার আমাকে বলেছিলে, তোমার কাজের জায়গায় আমি চাইলে আমাকেও তুমি কাজের ব্যবস্থা করে দিবে। ম্যানেজারের সাথে তোমার ভালো সম্পর্ক আছে যেহেতু তুমি ব্যবস্থা করো আমার কাজের। আমি এভাবে বাসায় থাকলে একা একা একেবারে পাগল হয়ে যাবো।
- চাইলেই যে কাজ পাওয়া যায় না সেটা তুমি জানো না বোধ হয়। আর কাজ কইরা তুমি কয় টাকা পাইবা, বড়জোর এক হাজার থাইকা বারশো ইউরো? আমি কী প্রতিমাসে তোমারে চার/ পাঁচশো টাকা দেই না? নাইলে আরও কিছু টাকা বাড়াইয়া দিমু। কাজের জায়গায় মাইয়াদের পদে পদে সমস্যা। বুঝবা না তুমি। এখন আসো, ঘুমাই।
- আমি টাকার জন্য কাজ করতে চাই কখন বললাম তোমাকে? টাকাটাই কী সব ?
- হ টাকাটাই সব। এই টাকার লাইগাই তো ইউরোপে আসছি, এখনো বুঝ নাই? আবেগ দিয়া জীবন চলে না নুহা। আবেগ দিয়া সব বিচার কইরো না। বুঝছি তোমারে কোনও জায়গা থাইকা ঘুরাইয়া আনতে হইবো, তাইলে যদি তোমার মাথা ঠাণ্ডা হয়। কাল সকালে আমার কাজে যাইতে হইবো, এখন লাইট নিভাও তো।
- তুমি সরাসরি কথা বলতে পারছ না কেন ? তুমি চাচ্ছো না যে আমি জব করি, এইতো ?
- আরে কী যন্ত্রণা, আমি কখন কইলাম তুমি কাজ করো এইটা আমি চাই না? আমি কইলাম অফিসের কাজকর্ম পাওয়া অনেক টাফ ব্যাপার। অড জব তো বহু আছে। কালকে খুঁজলেই কমপক্ষে দুইটা কাজের খবর তোমারে আমি দিতে পারি। কী করবা?
- অড জব মানে কী? কী ধরণের ?
- বারে, শপিং মলে, পিৎজ্জারিয়াতে,জুতার দোকানে, কসমেটিকসের দোকান , তরকারি বেচতেও পারো। হাহাহহা।
- আচ্ছা তুমি খুঁজে দেখো। আমিও খুঁজবো। আমার এভাবে ঘরে ভালো লাগে না, খুব কষ্ট হয়। আমি কিছু একটা করতে চাই। এভাবে ঘরে বসে থাকাটা ঠিক না। মেয়েদের একটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দরকার আছে।
- আমি আগেও বলছি টাকার জন্য হইলে আমি তোমারে হাত খরচ আরও বাড়াইয়া দিমু। কিন্তু তুমি এইখানে কাজ কইরা টিকতে পারবা না।
- চ্যালেঞ্জ দিচ্ছো নাকি ?
রেজা হাই তুলতে তুলতে বলে, নাহ্ চ্যালেঞ্জ না। বাঙালি মেয়েদের খুব একটা কাজ করতে এখানে দেখি নাই কখনো। ঐ অভিজ্ঞতা দিয়া বললাম আর কী! দেখি তোমার মন ভালো করনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা ।
আমার মন ভালো করা নিয়ে ওকে খুব একটা চিন্তিত মনে হলো না। কাল অফিসে যাইতে হইবো - বলে ও শুয়ে পড়লো। ও শুয়ে পড়ুক আমার সমস্যা নেই কিন্তু আমার মাথা ঠাণ্ডা হবার মতো কোনো লক্ষন আমি দেখলাম না। কেন যে আমি কেঁদে ফেললাম ওরকম ভাবে আর এ কারণেই ও ভেবেই নিয়েছে হয়তো আমি আবেগের কারণে এমন করছি, হঠাৎ ক্ষেপে গেছি, স্বভাবের বাইরে গিয়ে অনেক কথাই বলে ফেলেছি। এখন মনে করতে পারছি, ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো। বলেছিলো অড জবের কথা, এমনকি তরকারী বিক্রি করা ধরণের জবের কথাও বলেছে। ওর শ্লেষসহ হাসির কথা মনে পড়তেই তো মেজাজটা চিড়চিড় করে বেড়ে যাচ্ছে। ও ভাবেটা কী আমাকে। ঘুমাবার আগে দাঁত ব্রাশ করে না শুলে কেমন যেন খারাপ লাগে। চোখে মুখে পানি দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম আমার কী করা উচিত। রেজা কোনো কারণে আমার জব করার ব্যাপার নিয়ে বাহানা করলে আমার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভেবে রাখা দরকার, না হলে দেখা যাবে আমি কিছু বলতে গিয়ে আবার কেঁদে ফেলেছি। বেশ কয়েকবার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। বেসিনের আয়নার দিকে তাকালাম নিজেকে দেখার জন্য। সন্ধ্যায় যখন অনেকটা সময় নিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখেছিলাম আর এই এখনকার আমাকে দেখছি, অনেক তফাৎ এখন। তখনকার ফুরফুরে ভাবটা পুরোপুরিই উধাও । তখন নিজেকেই দেখেছি এক আহ্লাদী মেয়ে হিসেবে কিন্তু এই মুহূর্তের চোখের দৃষ্টিতে কী আমার কিছু দেখা যাচ্ছে? রাগী, প্রত্যয়ী নাকি অন্ধ অভিমানে আচ্ছন্ন কোনো নারী যাকে তার স্বামী বোকাই ভাবে। আমি কী আসলেই বোকা? আমার মাথার তালুটা কেমন গরম হয়ে আছে মনে হচ্ছে। একটু পানি নিয়ে তালুতে দেই, চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল গলিয়ে চুলগুলো হালকা ভিজিয়ে নেই, ঘাড়ে, গলায় পানির ঝাপটা দেই। চুল, ঘাড় বেয়ে পানির কারণে গলায় আর বুকের কাছটায় কামিজটা ভিজে গেছে। যাক ভিজে, বদলাতে ইচ্ছে করছে না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝলক গায়ে লাগাতে। মন এখন অনেকটাই শান্ত, তবে বুঝতে পারছিলাম এটা সাময়িক। বিছানায় রেজার কাছে গিয়ে শুলে আবার একই বিষয় মাথায় ঘুরতে থাকবে। কত রাত হয়েছে বুঝতে পারছি না। ঝিঁঝিঁ ডাকার আওয়াজ পাচ্ছি। এখানেও ঝিঁঝিঁ ডাকে এই ব্যাপারটাতে অবাক হয়েছিলাম প্রথম যেদিন শুনি। যেখানে গাছপালা বেশি সেখানে এরকম ডাকতে শোনা যায় ঝিঁঝিঁদের। আর এখানে যেসব বাড়ি আছে, দ্বিতীয় তলার ভাড়া একটু বেশি কিংবা নিচ তলার কারণ। দ্বিতীয় বা নিচ তলাতে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে গাছ লাগানো থাকে, একটা ইয়ার্ড পাওয়া যায়, দোলনা ঝোলাবার জায়গা থাকে, বিশ্রাম নেবার জন্য কিংবা পারিবারিক পিকনিকের জন্য বেশ প্রশস্ত জায়গা, যাকে বলা যায় এক খণ্ড জমি, মাটির স্পর্শ পাওয়া যায়। এগুলো যদিও বানানো হয় কৃত্রিমভাবে । মাটিতে ঘাসের একটা বেড করে এনে লাগানো। আমাদের বিল্ডিং এর সাথে লাগোয়া যে পাঁচ তলা বাড়িটা, ঐ বাড়ির নিচ তলায় এমন একটা ইয়ার্ড আছে।ওখানে অনেক গাছ। ঝিঁঝিঁর ডাক এখন সেখান থেকেই আসছে। বাংলাদেশে যেরকম পাওয়া যায় রাত গভীর হলে কিংবা বৃষ্টির রাতে থেমে থেমে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনি, এখনো সেরকম শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার তিন তলার প্রতিবেশী একটা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি, তার বারান্দার এক কোণায় সে সিগারেট খাচ্ছে। অন্ধকারে ছোট একটা বিন্দুর মতো তার সিগারেটের উজ্জ্বল আগুনটা দেখতে পাচ্ছি। ছেলেটাকে প্রায়ই দেখি আসা যাওয়ার পথে, কখনো লিফটে ওঠার সময় কিংবা কখনো বারান্দায়। ছেলেটার সম্পর্কে চাইলে অনেক কিছুই ভাবা যেতে পারে। সে নিঃসঙ্গ কিনা সে ভাবার বিষয়, তার সাথে কখনো কোনও বন্ধু বা পরিবারের মানুষজন দেখিনি। এমনকি এ বারান্দায় সে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। রান্নাঘর এসে যখন রান্না করে তখনও আশেপাশে কাউকে দেখিনি। উদ্ভট অনেক ভাবনাই ছেলেটাকে নিয়ে মনের মাঝে কাজ করে। মাঝে মাঝে তার সাথে চোখাচোখি হয়েছে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে গভীর বিষাদের ছায়া। হুম তোমার যত ঢং সুলভ ভাবনা ! তুমি বেশি জানো, ছেলেটা একা কিনা? চক্ষু বিশারদ হয়ে গেছো নাকি নুহা? ঢং খালি। নিজের ভেতরের মানুষটার এরকম হঠাৎ করে ধমকে ওঠায় আমার হাসি পেয়ে যায়।
ছেলেটা কত রাত পর্যন্ত এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে, সিগারেট খাবে। সিগারেটের গন্ধে আমার মাথা ধরে যায়। তবুও দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়। কিসের এক অস্থিরতায় আমার ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। ছেলেটা আসলে দাঁড়িয়ে নেই, একটা টেবিল আছে ছোট, বারান্দার এক কোণায় রাখা, সেখানে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে মরিচ, সবজি, আলু, পেঁয়াজ এসব কোনও প্লাস্টিকের ঝুরিতে ভরে টেবিলে রেখে দেয়। সবজি বারান্দায় রেখে অনেকেই দেখি খায়। বারান্দার খোলা আলো বাতাসে সবজি অনেকটা ভালো থাকে ফ্রিজে থাকার চেয়ে। ছেলেটার বয়স কত হবে অনুমান করা শক্ত। আমি অন্তত কারো বয়স অনুমান করতে পারি না। তবুও ভাবা যেতে পারে বয়স সাতাশ থেকে ত্রিশের মধ্যে হবে। এ বয়সের ছেলেরা অনেক হাসিখুশি থাকে, বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে ঘোরে। ছেলেটার মুখে হাসি হাসি ভাব আমি একদিনও দেখিনি। ছেলেটা আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। ঠোঁটের কাছে লাইটার এনে যখন সিগারেট ধরালো, সেই আলোতে ওর চেহারার কিছু অংশ স্পষ্ট হলো। অনুভূতিহীন, কঠোর একটা মুখ। আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা কী ঠিক হচ্ছে বা ছেলেটা বিরক্ত হচ্ছে? আশ্চর্য নুহা, তুমি তোমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়েছ, ছেলেটাকে তো বিরক্ত করছো না। এতো এডভান্স চিন্তা করো কেন, তাও যেটার দরকার নেই সেটা নিয়ে? মনের আরেকটা অংশ আমাকে এমনটাই বলে। আসলেই তো, আমি তো ছেলেটাকে বিরক্ত করছি না। তবুও মনের সংশয় যায় না। আর এভাবে একটানা দাঁড়িয়ে থাকতেও ক্লান্তি লাগছে, একটু বসে দেয়ালে হেলান দিতে ইচ্ছে করছে। রাত কত হয়েছে কে জানে। রেজার ঘুম ভাঙবে না যদিও কিংবা ঘুমের মাঝে আলগোছে যদি টেরও পায় আমি নেই ও উঠে আসবে না খুঁজতে। আমার স্বভাবের কিছু অংশ ও জেনে গেছে হয়তো ভালমত খেয়াল না করেও। ছেলেটার ফোনে কেউ বোধ হয় ফোন করেছে। ফোনটা সাইলেন্ট করা, আলো জ্বলছে শুধু। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাম্বারটা দেখে আবার সে পাশে রেখে দিলো। নাহ্, এবার ঘরে যাই। ঘুম না এলেও চেষ্টা করা দরকার ঘুমাবার জন্য। সকালে শবনমের সাথে হাসপাতালে যেতে হবে। আবার কী সমস্যা হলো ওর কে জানে! এই মেয়েটার শরীরে এতো এতো অসুখ বাসা বেঁধে আছে যে ভাবলেই খারাপ লাগে। এতো চমৎকার একজন মানুষ, নামাজি, কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার বা খারাপ চিন্তাও করতে দেখিনি, শ্বশুর বাড়িতে এতো গঞ্জনা শুনেও কখনো ও তাদের সম্বন্ধে খারাপ কথা আমার কাছেও বলেনি , ওর এতো ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও। আল্লাহ যে ওকে কোন পরীক্ষায় ফেলেছে কে জানে।
শোবার ঘরে এসে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দেই যাতে শব্দ না হয়। বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে এক চুমুক পানি খাই। সারাদিনে রাতেও আমি এক লিটার পানি শেষ করতে পারি না। আমি বুঝি পানি আমার কমই পান করা হয়। কবে না আমারও আবার হাসপাতালে দৌড়াতে হয় কে জানে। বিছানার পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখিই রাত প্রায় তিনটা। সারাদিনে রাতে মোবাইলটাও ধরে দেখিনি বাইরে বের হবার সময় ব্যাগে মোবাইল ঢোকানো আর বাসায় এসে ব্যাগ থেকে নামিয়ে রাখা ছাড়া। তিনটা এসএমএস আর চারটা মিসকল উঠে আছে। নিশ্চয়ই মোবাইল কোম্পানির এডভারটাইজমেন্ট! আমার সিমটা Wind কোম্পানির। একই অপারেটরে কল করলে দুইশো মিনিট ফ্রী আর আছে আনলিমিটেড এসএমএস এক মাসে। ইচ্ছে করছে না কে মেসেজ পাঠালো দেখতে। কাল দেখলেই হবে। এখন বিছানায় শুলেই যদি ঘুম চলে আসতো তাহলে ভালো হতো। সকালে উঠতে আর আলসেমী লাগতো না। আমি মোবাইলে সকাল আটটায় এলার্ম দিয়ে রাখি। শবনমের ওখানে যেতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগে যদি সময়মত বাস চলে আসে। আশা করছি সময়মত পৌঁছাতে পারবো। বরাবরের মতোই ঘুমাবার সময় কোলবালিশের অভাব অনুভব করি বলে মাথার বালিশটা বুকে জড়িয়ে নেই। ঘুম না আসা যে কত কষ্টের যারা ভুক্তভুগি তারাই ভালো জানেন। শরীরের ভেতরে অসহনীয় একটা কামড়ানি অনুভূত হয় আমার। হাত, পায়ের মাসল, কোমর সারা শরীরে। অসহ্য লাগে,মনে হয় শরীরের এই যন্ত্রণায় মারা যাবো, পাগল পাগল লাগে। বারবার বিছানা থেকে উঠে বসলে, হাঁটাহাঁটি করলে রেজার সমস্যা হবে। এপাশ ওপাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এক পর্যায়ে চুপ করেই শুয়ে থাকি। সারা বাড়িতে, এমনকি বাইরের এখন আর গাড়ি চলাচলের শব্দ নেই। পিনপতন নীরবতার মাঝে একমাত্র আমার নিঃশ্বাসের শব্দই পাওয়া যাবে হয়তো কান পাতলে। এখন কী আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করেই রাখবো। উফ্ আল্লাহ আমার চোখে ঘুম দাও, একটু ঘুম দাও। চাইলেই আমি পারি পাশের রুমে গিয়ে বই পড়তে, গান শুনতে কিংবা অনলাইনে ব্রাউজ করতে। কিন্তু এটা তো কোনো সমাধান না। ঘুম না এলেও চুপচাপ নিঃসাড়ে বিছানায় পড়ে থাকা ক্লান্তিহীন চোখে, এ যে কী যন্ত্রণার। সকালে উঠলে সারা শরীর অবসন্ন লাগে। রাত না জেগে একেবারে ঘড়ি ধরে নিয়ম মেনে বিছানায় গিয়েছি, দুপুরে না ঘুমিয়েও দেখেছি , ঘরের কাজ কর্ম করেছি তাও যদি ঘুমের নিয়মানুবর্তিতা আসতো বুঝতাম, তাও আসে না। রেজা এসব শুনলেই বলে, আরে এমনি এমনি কী আর ঘুম আসবো! তোমার ঘুমের ওষুধ তো আমার কাছে।
চলবে