somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নুহা- ১৮

০১ লা অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নুহা-১৭

- তুই তোকারি করি আর যাই-ই করি তোমার মূল সমস্যা কোথায় বের করতে পেরেছ ?

- মূল সমস্যা মানে ? আমার দ্বিধা-বিভক্ত কণ্ঠস্বরে নুহা হেসে ওঠে হা হা হা শব্দে। বলে -

- তোমার মাথাটা গেছে একেবারেই । আচ্ছা আমাকে বলো দেখি তোমার আসলে চাওয়াটা কী ? নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও, অর্থনৈতিক মুক্তি বলো আর যাইই বলো তোমার সময় ভালো কাটুক, তোমার শিক্ষা জীবনের সার্থকতা আসুক ব্ল্যা ব্ল্যা এইসব নাকি লিয়ানার সাথে রেজার লুকোচুরি সম্পর্ক ? কোনটা তোমাকে বেশি পীড়া দিচ্ছে আমাকে বলো তো নুহা ?

নুহার কথা শুনে আমি আমার অকারণ মাথা ব্যথা থেকে ভারমুক্ত হবার চেষ্টা করি। আমার তো এমনটাই কথা ছিলো রেজার সাথে, ও আমার জবের ব্যাপারে খোঁজ খবর করবে, আমি নিজেও খুঁজবো হোক সেটা অড জব। মাঝখান থেকে লিয়ানার প্রসঙ্গটা কী করে যে ঢুকে গেলো যা অনেক আগে আমি ভুলে যেতে চেষ্টা করেছিলাম আর আমিও এসব নিয়ে ভেতরে ভেতরে অস্থিরতায় ভুগলাম ! আচ্ছা আমি কী পারি না একেবারেই নিরাসক্ত হয়ে যেতে? একেবারে সব ব্যাপারে? অ্যাজ লাইক অ্যা রোবট ! হুহ্‌ পারলে তো ভালোই হতো। রাতের রান্নার ব্যবস্থা করা দরকার। খিদে পেয়েছে। আজ ইচ্ছে করছে না ভাত রান্না করতে। পাস্তা রান্না করা যায় অবশ্য। 'পাস্তা আলে অলিও' খুব ঝামেলাহীন ভাবে দ্রুত রান্না করা যায় এমন একটা খাবার। পাস্তা অবশ্য কিনলেই হয় না, কেনার আগে প্যাকেটের গায়ে দেখা নেয়া উচিত এটা সিদ্ধ হতে কত সময় লাগে। চিকন আর মোটা, মাঝারি ধরণের পাস্তা সবই আছে। মাঝে মাঝে আমি অবশ্য কাঁচা মরিচ দু টুকরো করে পাস্তায় দিয়ে নেই ঝাল ঝাল ফ্লেভার পেতে। আমি চুলায় দুজনের জন্য পাস্তার পানি বসিয়ে দেই গরম হবার জন্য। আর রসুন কুঁচিয়ে নেই একটু, দুটো কাঁচা মরিচ সাথে। পানি গরম হতে হতে ফ্রেশ হয়ে আসি। বারবার ঠিক করি অসময়ে আর ঘুমাবো না তবুও রোজ কিছু না কিছু অনিয়ম হয়ে যায়। ধ্যাত। মেজাজ টা এখনো খিচড়ে আছে। হাত মুখ ধুয়ে এসে পাস্তা রান্নায় মন দেই। অবশ্য বেশি সময় লাগে না এটা রান্না করতে। পাস্তাটা সিদ্ধ হয়ে গেলে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে পানি ঝরাতে ঢেলে দেই। ফ্রাইপ্যানে অলিভ অয়েল দিয়ে গরম হতে একটু সময় নেই, তারপর রসুন দিয়ে একটু ভেজে নিয়ে সিদ্ধ করা পাস্তাটা মিশিয়ে নেই। একটু নেড়েচেড়ে সাথে কাঁচামরিচ ফালিটাও দিয়ে দেই আর ব্যাসিলিকা পাতাও দেই। যদিও ব্যাসিলিকা পাতা দিলে রসুনের ফ্লেভার ঢাকা পড়ে যায় আর এ পাস্তায় এটা দেয়ও না। এই ব্যাসিলিকা পাতাটা আমাদের দেশের পুদিনা পাতার মতো, তবে ঘ্রাণ পুদিনা পাতার মতো অতটা তীব্র লাগে না আমার কাছে। গরম গরম না খেলে পাস্তা খাওয়ার মজাই টের পাওয়া যায় না। তবে আরেকটা পাস্তা আছে " পাস্তা ফ্রেদ্দো " ওটা খেতেই হয় ঠাণ্ডা করে। রেজার জন্য অপেক্ষা করবো কিনা ভাবছি নাকি ফোন দিয়ে দেখবো কোথায় আছে এখন। রাত প্রায় দশটা বাজে। উপস ফোন তো বাসায় আজ, ও নিয়ে যায়নি। ওর বান্ধবী ওকে আর কয়বার খুঁজলো পরে আর দেখিনি। হয়তো রেজা ফোন করে জানিয়েও দিয়েছে আজ ওর মোবাইল ওর সাথে নেই। তবে আমি বলছি না এরকমটাই হয়েছে, অনুমান করছি মাত্র। আমি খেতে বসি। ইশ একটা কোক পেলে ভালো হতো। রেজার জন্য হট পটে কিছুটা পাস্তা আলাদা করে রাখি অবশ্য।

আজ ওকে জিজ্ঞেস করতেই হবে আমার জবের ব্যাপার নিয়ে কিছু ভেবেছে কিনা। না ভাবলে আমি আমার মতো ট্রাই করবো। সোনিয়াকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করাও যেতে পারে এই ব্যাপার। সোনিয়া হচ্ছে আমার এক ইতালিয়ান ফ্রেন্ড। ভাষা শেখার স্কুলে যখন আমি পড়তাম, ও আমাদের শিক্ষক ছিলো। এরপর ওর সাথে আমার বেশ ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমদিকে ওর সাথে আমার কথাবার্তা চলতো ইংরেজিতে, বিশেষ করে ও যে ইংরেজিটা বুঝতো না খাতায় লিখে লিখে ওকে বোঝাতে হতো। তবে সেটা ছিলো স্কুলের বাইরের সম্পর্ক। ওর সাথে আমি তখন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম, তবে দূরে কোথাও না,কাছাকাছিই থাকতাম আমার চেনা দূরত্বের মাঝে। মাঝে মাঝে ওর বয় ফ্রেন্ড জর্জো আমাদের সাথে যোগ দিতো। জর্জো দারুন হ্যান্ডসাম একজন ছেলে এবং খুব ভালো ইংরেজি বুঝে। সচরাচর ইতালিয়ানরা নিজের ভাষাটাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়া সত্ত্বেও। জর্জো ব্লকবাস্টারে কাজ করে, সেখান থেকে প্রায়ই আমি মুভি নিয়ে আসি। কিন্তু তখনও জানতাম না ও সোনিয়ার বয় ফ্রেন্ড। ওদের দুজনের সম্পর্কটা চমৎকার এবং অনেক বছরের। বিয়ে করবে কিনা একে অপরকে, জিজ্ঞেস করলে সোনিয়া বলতো , আমরা তো এখনো অনেক ইয়াং। আরও কয়েক বছর যাক! এমনিতে সোনিয়াকে ফোন করা হয় না, শেষবার শুনেছিলাম ও নতুন একটা জব পেয়েছে। সারাদিনই ব্যস্ততায় যায়। জব বলতে বেবি সিটিং এর জব। ওকে আগামীকালই ফোন দিবো ভাবি। ব্লকবাস্টারে গেলে জর্জোকেও বলবো আমার জবের ব্যাপারে হেল্প করতে। এভাবে আর কতদিন ঘরে বসে বসে চর্বি মজুদ করতে হবে। এমন একটা দেশ কোথায় কোথায় যে জব খুঁজতে হবে কে জানে। অনলাইনে বসে জবের জন্য ঠিক কোন সেক্টরে ট্রাই করবো তাও তো বুঝি না। দেখি আগামীকাল সেই স্কুলেও যাবো যেখানে ইতালিয়ান ভাষা শেখার জন্য কিছুদিন গিয়েছিলাম। একবার শাহীন ভাই বলেছিলো একজনকে ইংরেজি পড়াবার জন্য। আমি তেমন একটা আগ্রহ দেখাইনি সে সময়। শাহীন ভাই এখানেই থাকেন মালিয়ানা তে। ইতালিতে অবৈধ পথে এসেছেন দেশের ভালো জব ছেড়ে । এখন দিন রাত নিজেকেই শাপ শাপান্ত করেন নিজে। নিজের স্বার্থের জন্য কারো সাথে যোগাযোগ করাটা আমার কাছে কেমন যেন লাগে, নিজেকে লোভী লোভী, স্বার্থপর লাগে। কিন্তু কী করবো আমি ! আমার যে এভাবে ঘরে থাকতে আর ভালো লাগছে না।

ইশশ ঢং ! আমার যে এভাবে ঘরে এভাবে পড়ে পড়ে মরতে ইচ্ছে করছে না। ঢং করো কেন এতো নুহা ! টেলিভিশন , মঞ্চে কখনো অভিনয় করেছিলে নাকি কিংবা শখে একবার দুইবার স্কুলের কোনও প্রোগ্রামে ?- বলে খিল খিল করে হাসতে থাকে আরেক নুহা। হাসি শেষ হলে আমার দিকে তাকায়, রেগে রেগে বলে --তুমি কী এমন খারাপ আছো আমাকে বলো দেখি ? খেতে পাচ্ছো না, জামাকাপড় পাচ্ছো না, স্বামীর আদর -সোহাগ পাচ্ছো না এমন ? পানিতে পড়ে গেছো নাকি ? কিছুক্ষণ পর পর যে ফিচফিচ করে কাঁদো ?

- আজব তো ! কাঁদলাম কোথায়? খাওয়া-পরা, জামাকাপড়, আদর সোহাগই কী সব নাকি একজন নারীর জীবনে ?

- ইশশ ভারী আমার নারীবাদীরে ! তো আর কী চাও শুনি ?

- তুমি বুঝবে না। যাও তো এখন

- কেন আমি আর তুমি কী আলাদা নাকি ? আমিও তো নারী বলো আমাকে

- বিরক্ত করো না তো, যাও এখান থেকে।

- আগেও বলেছি তোমার আসল রাগ কোথায় ? লিয়ানা নাকি তোমার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, নিজের উপর কনফিডেন্ট হতে করতে পারছো না কোনটা ?

- আমার সময় কাটছে না এইভাবে। এইভাবে দেশের বাইরে একা একা থাকতে ভালো লাগছে না সবাইকে ছেড়ে। বিয়ের পরে একজন নারীর জন্য তার স্বামীই সব কিছু না। তার একটা আলাদা জগত থাকতে হয়, একটা উদ্দেশ্য থাকতে হয় জীবনের

- তুমি কী একাই এমন জীবন কাটাচ্ছ নাকি ? এখানে তো আরও অনেক বাঙালি বৌ আছে তাদের স্বামীর সাথে? কই তাদের মাঝে তো এমন হাহাকার দেখি না ! তারা খাওয়া-পরা পাচ্ছে, বিদেশি পাসপোর্ট পেয়েছে, গয়না বানায়, দেশে আসে যায় , বেড়ায়, দাওয়াত খায়, দুইজন বাচ্চা থাকার পরেও চার/পাঁচটা করে বাচ্চা নিচ্ছে বেতনভাতা বিভিন্ন সুবিধার জন্য, পান খায়, দল বেঁধে পিকনিকে যায়, সেসব দেখেও শিখো না কেন ? তুমি কোন জমিদারের কন্যা আর জমিদারের বৌ যে তোমার এতো চাহিদা? সুখে থাকতে ভূতে কিলাচ্ছে নাকি ?

- তুমি দেখি আমার মায়ের মতো কথা বলছো ! যাও ভাগো এখান থেকে।

- সময় কাটাবার বিকল্প কী হতে পারে সেটা ভাবো বোকা মেয়ে

- ধ্যাত সময় নাই অসময় নাই এভাবে পিছু পিছু ঘুরো না তো। যাও এখন

সময় কাটাবার বিকল্প আমার কাছে এই মুহূর্তে আর কিছুই ভাবতে পারছি না জবের বিকল্প হিসেবে। মনে মনে স্থির করি আজ রেজা ফিরলেই ওকে ধরতে হবে এ ব্যাপারে, ও হয়তো ধরেই নিয়েছে আমি শুধুমাত্র খেয়ালের বশে ওকে জবের ব্যাপারে বলেছি। খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে চলে আসি। রেজার কাজের জায়গায় একটা ফোন দেয়া দরকার, ও বের হয়েছে কি না জানার জন্য, যেহেতু বলেছিলো সন্ধ্যায় চলে আসবে। এমনও হতে পারে আজ হঠাৎ দুই শিফটের কাজ পড়ে গেছে। ফোন দিতেই আজ ফোন রিসিভ করলো ওর কলিগ জুলিয়েট, চমৎকার হাসিখুশি এক মেয়ে। কুশল বিনিময় শেষে যখন রেজার কথা জানতে চাইলাম, বললো - ওকে তো লাঞ্চের পর দেখিনি আমি। আমি তাৎক্ষণিক কী বলবো বুঝতে পারি না। তুমি এসো একদিন, গল্প করা যাবে - ফোন রাখার আগে জুলিয়েট বললো আমাকে। আমিও জানালাম - অবশ্যই আসবো। বনা নত্তে ( শুভ রাত্রি )। আসলে বুঝতে পারছি না রেজার সমস্যা কী, ও এভাবে কাজ শেষে কোথায় যায়! এই যে আমি ফোন দিয়ে খোঁজ নিলাম হয়তো এটা নিয়েও রাগ দেখাবে যে আমি যখন তখন ফোন করে ওর ইমেজ খারাপ করে দিচ্ছি কলিগদের কাছে। অনেক পারসোনাল কাজ থাকতে পারে, যা ছুটির দিনে করা যায় না। তাই মাঝে মাঝে মিথ্যে বলে কাজের জায়গা থেকে ছুটি নিতে হয় - এমন যুক্তিই রেজা দেখায় কিন্তু কী সেই কাজ তার ব্যাপারে সে জানাতে আগ্রহী না। আচ্ছা সব বিবাহিত পুরুষরাই কী এমন? কই আলী ভাইকে তো দেখি শবনমের সাথে সবই শেয়ার করে, আমার বাবাকেও দেখেছি সব শেয়ার করতে মায়ের সাথে। সব শেয়ার বলতে সাংসারিক ব্যাপারকেই বোঝাচ্ছি। বিয়ের পরেও যে মানুষের নিজস্বতা ফুরিয়ে যায় না সেটা আমি বুঝি। তবে কেন এই লুকোচুরি। যতবার আমি আমার নিজেকে রেজার জন্য প্রস্তুত করতে চাই, ওর কাছে এগিয়ে যেতে নিজেকে মেলে ধরবো বলে চিন্তা করি, ও আমাকে ততবারই অজান্তে বা জেনেশুনে নির্দয় ভাবে ধাক্কা দেয়। রেজা এমন কেন ! তার মানে নুহা স্বীকার করলে, তুমি নিজেকে এতদিন পর্যন্ত রেজার কাছে তুলে ধরো নি ? হাহহহাহাহা !

- উফফফ আবার এসেছ তুমি! এখান থেকে যাও বলছি

শোবার ঘরের সাথের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। বাইরে গাড়ি চলাচল কমে গেছে। এখানে রাত জাগা লোকের সংখ্যা বোধ হয় কম। বেশীরভাগ বিল্ডিং এর ফ্ল্যাটেরই লাইট নেভানো দেখছি। এমনও হতে পারে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের দিকেও তারা মনোযোগী, অহেতুক কোনো অপচয় তারা করে না। আমাদের বিল্ডিং এর অপজিটের যে বাড়িটা তার দুই তলায় একটা ফ্যামিলি থাকে। বাবা-মা-তাদের দুই ছেলে। মাঝে মাঝে তারা এখানে আড্ডা দেয়, চা-কফি হয়তো খায়। খুব প্রাণবন্ত সে ফ্যামিলিটা। ছেলে দুটোর মা সারাক্ষণই দেখি কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত। কখনো কখনো ভেজা কাপড় ছড়িয়ে দিতে বারান্দায় আসে। খুব যত্ন নিয়ে নিয়ে কাপড় ঝেড়ে ঝেড়ে পানি ছাড়ায়, ক্লিপ আটকে দেয়। একদিন দুপুরের কথা। আমি এমনিতেই গিয়েছিলাম বারান্দায়। দেখলাম সে মহিলাকে একটা ফ্রকের মতো জামা পরা, বয়স যদিও আন্দাজ করতে পারি না, চল্লিশ/ পঞ্চাশ হবে হয়তো। চুলের রঙটা আমাদের ভাষায় সাদা হলেও ওদের ভাষায় ' বিয়াংকা', অনেকে আছে ইচ্ছে করেই কালো চুলে রঙ করে সাদা বানায়। এই বিয়াংকা আবার ধবধবে সাদা নয়, বলা যায় প্রিন্সেস ডায়েনার মতো চুলের রঙ। সে মহিলাও বারান্দায় এমনি দাঁড়িয়ে ছিলো, হয়তো কোনও কাজ শেষ করে মাত্রই বারান্দায় এসেছে এমন। হঠাৎ আমার চোখে চোখ পড়াতে সে ফিক করে হেসে দিলো, দূর থেকেই বললো - চাও, সিনোরিনা। আমিও প্রত্যুত্তরে তাকে ' চাও' বললাম। এই ' চাও' দিয়ে স্বাগতম এবং বিদায় দুটোই বুঝায় এখানে। মধ্যবয়সী এই মহিলাকে দেখতে আমার ভালোই লাগে। তার স্বামীর চোখে পড়ার মতো একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেশ পুরুষ্টু কাঁচাপাকা গোঁফ, মাথা ভর্তি চুল। ছেলে দুটোর বয়স ত্রিশের মধ্যেই হবে। তাদের ভেতরের রুম থেকে আলো এসে পড়ায় দেখা যাচ্ছে সে বাড়ির বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আবছা একটা মূর্তির মতো দেখা যাচ্ছে। আমার এ বারান্দার চাইনিজ কমলা গাছটায় শেষ পানি দিয়েছিলাম কবে মনে করতে চেষ্টা করি। পানি দেয়া দরকার। এখানে তো আমি রাত ছাড়া পানিই দিতে পারবো না, এক ফোঁটা পানি নিচে পড়লে কিয়ারার মা দৌড়ে আসবে। আচ্ছা কিয়ারার মা'র খোঁজ নিতে পারলে ভালো হতো। মহিলা প্রেগন্যান্ট, এর মাঝেই কোনো বাবু-টাবু হলো কিনা কে জানে। আমি তো ওদের ফোন নাম্বার জানি না, ম্যাকের নাম্বারও না। দেখি এর মাঝে ম্যাকের সাথে দেখা হলে খোঁজ নিবে। মানুষ এ যুগে এতো কমার্শিয়াল, এভাবে খোঁজ খবর জানতে চাইলে মাইন্ড করে কিনা কে জানে। যদিও ম্যাককে অতটা কাটখোট্টা মনে হয়নি। আমাদের ফ্ল্যাটের মেইন গেট খোলা শব্দ পাই। হয়তো রেজা এসেছে। আসুক, এসে খুঁজুক আমাকে। এখন আমি বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে থাকবো।

তুমি বারান্দায় নাকি নুহা ? রেজার গলার আওয়াজ পাই।
ঘরে ঢুকতেই একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগে। পারফিউমের গন্ধ। আমি গন্ধের উৎস খোঁজার জন্য ঘরের এদিক সেদিক তাকাই। উফফ অনেক টায়ার্ড লাগতাছে। এক গ্লাস পানি দিবা? রেজা ওর জামাকাপড় চেঞ্জ করার জন্য ওয়ারড্রবের দিকে যায়। ট্রাউজার বের করে। আচ্ছা তুমি ফ্রেশরুমের দিকে যাও, হাত মুখ ধুয়ে আসো। আমি তোমার খাবার রেডি করি, বলি আমি। কিন্তু ও উত্তর না দিয়ে প্যান্ট খোলে ঘরের ভেতরেই। কী আজব বলি আমি। এসব কী রেজা!

- আরে তুমি আমিই তো। একবারে গোসল করুম, হাত মুখ ধোয়ার চেয়ে গোসলই ভালো। দাঁড়াও আসতাছি। ওর গায়ে শুধুমাত্র একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। খুব সাবলীলভাবে ও হেঁটে ফ্রেশরুমের দিকে আগায়। আমি রান্না ঘরে যেতে নিবো এই সময় একটা এসএমএস আসে রেজার ফোনে। ফোন হাত এনিয়ে দেখি লিওনার মেসেজ -

" আশা করি এতক্ষনে বাড়ি পৌঁছে গেছো। সুন্দর একটা বিকেল উপহার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। বনা নত্তে আমোরে "।

আমার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে এসএমএস টা দেখে। আমি রান্না ঘরে যাই ওর খাবার আনতে। কিন্তু খাবার নিয়ে ঘরে আসতে আসতেই দেখি ও গোসল সেরে বের হয়েছে। এতো দ্রুত গোসল সারে কীভাবে ও, অবাক লাগে। আমার হাতে পাস্তার প্লেট দেখে বলে - কী আনছো ? পাস্তা নাকি? না খাইলে হয় না ? আমি কিছু বলি না ওকে। ওর সামনে এনে রেখে দেই।

- খাইয়া আসছি, পেটটা ভরা । বলে ও ওর পেটের উপর হাত বুলায়

- কোথায় খেয়ে আসছো ? ওর দিকে তাকিয়ে বলি আমি

- কোথায় আবার ! সবসময় যেখানে খাই ! যাই শুইয়া পড়ি। সকালে কাজ আছে। ওর ভঙ্গী দেখে হাসি আমি মনে মনে। সে কী পার্ট রে বাবা !

- এতো তাড়াতাড়িই শোবে ? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, ভাবলাম আজ রাত জাগবো। আমার কণ্ঠের তারল্যে রেজা আমার দিকে তাকায়। চাহনিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বলে -

- তোমার জন্য রাত জাগা তো নিত্য দিনের ব্যাপার। এইটা আবার নতুন কী! দেখি লাইট নিভাও।

- তুমি আজকাল বেশ স্মার্ট হয়ে গেছো দেখি। ঝাড়ি মেরে কথা বলতে শিখেছো। বলতে বলতে আমি বিছানায় ওর দিকে এগিয়ে যাই। আমাকে আগাতে দেখে ও একটু অবাকই হয়। আমি ওর খুব কাছাকাছি গিয়ে আধো শোয়া হয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখি। গলার আর বুকের গন্ধ শুকতে শুকতে বলি - এ পারফিউম কবে কিনলে?

- সবসময় তো এইটাই দেই গায়ে। নাক বন্ধ নাকি তোমার ? ও একটু দূরে সরে গিয়ে বসে বিছানার। দূরে যাও কেন, কাছে আসো - বলে আমি রেজাকে টেনে আমার কাছে আনতে চাই।

- আহ নুহা কী করো? মাত্র কাজের থিকা আসলাম, এইসব ভালো লাগতাছে না।

- তাই ? আমার তো অনেক ইচ্ছে করছে আজ। আমি মনে মনে হাসি ওর বেকায়দা দেখে। কত মিথ্যুক ও, কাজ থেকে বেরিয়েছে বলছে। ওর কাম ভাব কোন পর্যায়ে আছে নাকি নেতিয়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে সেটাই দেখা দরকার। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরেও গলা উঁচিয়ে কথা বলে নির্লজ্জের মতো, ফাঁপর মারে। আজ ওর খবর আছে। আমি ওর গলার কাছটায় মুখ রাখি। বলি- তুমি কবে থেকে মেয়েদের পারফিউম ইউস করা শুরু করলে রেজা। তুমি কী বলতে চাও ? আমি দুনিয়ার মাইয়া মানুষের সাথে আছিলাম নাকি এতক্ষণ?

- উফফ এতো কথা বলো কেন ! দাঁড়াও লাইট টা অফ করে আসি। আমি বিছানা থেকে নেমে লাইট অফ করতে যেতে চাইলে রেজা আমার হাত ধরে থামায়। বলে - আজ ছাইড়া দাও, আমি আইজ পারুম না। এতো কাজ করছি সারাদিন অনেক ক্লান্ত লাগতাছে। আমি হেসে উঠলাম শব্দ করে। বললাম - লিয়ানাকে জানাও তুমি বাসায় ফিরেছো। আমার কথা শুনে ঝট করে রেজা বিছানায় উঠে বসে বলে -

- একদিন মোবাইল টা ভুলে রাইখা গেছি আর তুমি আমার মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছো। এইটা ঠিক না। আমি কী তোমার মোবাইল ঘাঁটি ?

- হাহাহহা ঘাঁটতে চাইলে ঘেঁটে দেখো। সমস্যা নেই।

- তুমি আসলে কী চাও আমারে বলবা নুহা ? রোজ বাসায় ফিরলে প্যানপ্যান করো, ভাল্লাগে না শুনতে। আমি অবাক হই ওর মিথ্যাচারে। আমি রোজ প্যানপ্যান করি ? নাহ আমাকে এখন মাথা গরম করলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখা জরুরী। কিন্তু এভাবে অপবাদ চাপিয়ে দেয়া সহ্যও করতে পারি না বলে ওকে বলি -

- আসলে রেজা প্যানপ্যানের সংজ্ঞা কী তুমি জানো না। তবে তুমি কী চাও, ঠিক কোন ব্যাপারটা আমার কাছে আশা করো সেটা আমাকে বলো।

- শান্তিতে থাকতে চাই।

- আচ্ছা আমার জবের ব্যাপারে খোঁজ নিবে বলেছিলে, কী করলে

- ওইটা নিয়া কথা বলতেই তো গেছিলাম লিয়ানার কাছে। ওর কথা শুনে আমি বেশ জোরেই বলি - স্টপ ইট প্লিজ। আর কত মিথ্যে বলবে ! প্লিজ

- ও বলছে কাজের ব্যবস্থা কইরা দিবো তোমার জন্য। কই কৃতজ্ঞ থাকবা ঐ মাইয়াটার প্রতি সেইটা না কইরা খালি পারো প্যানপ্যান করতে। আমি কিছু না বলে কঠিন দৃষ্টিতে রেজার দিকে তাকিয়ে থাকি। ও কী গর্ধভ না আর কিছু ! আমার কঠিন দৃষ্টি দেখে ও আরও বলে - ওর বয় ফ্রেন্ডের সাথে ওর ঝামেলা চলতাছে বুঝলা। দুঃখী একটা মাইয়া। রেজার কথা শুনতে শুনতে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। কত নির্লজ্জ ভাবে ও একটার পর একটা মিথ্যে বলে যাচ্ছে। এসবের প্রতি আমার আর কোনও ইন্টারেস্ট নেই ও কী বুঝতে পারছে না? আমি উঠে গিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে আসি। বিছানায় শুয়ে পড়ি। ও একটু পর আমার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কায়, বলে -

- নুহা, রাগ করছো ?

কতটা বিবেকহীন হলে পরে ও আমাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারে ভাবি আমি। আমি হাতটা সরিয়ে দেই। ও আবার বলে - আমি কইলাম তো তোমার কাজের ব্যবস্থা কইরা দিমু। অন্তত তোমার যাতে একলা একলা বোর হইতে না হয় আমি দেখুম ব্যাপারটা। তাও তুমি চিল্লায়ও না।

- আরে ধুর আমি চিল্লালাম কখন? আমাকে ঝট করে বিছানায় উঠে বসতে দেখে রেজা চুপ হয়ে যায়। তুমি তোমার রাস্তায় চলো রেজা, লিয়ানা কেন আরও দশ জনের সাথে ওঠাবসা করো, তাদের পারফিউম গায়ে মেখে ঘোর আমার কোনও সমস্যা আর হবে না আজকের পর থেকে। আর আমার জবের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নিতে পারবো। প্লিজ আর কথা বলবে না, ঘুমাও এখন।

- ইউরোপে আইসা হাত্তির পাঁচ পাও দেইখ্যা ফালাইছো নাকি !
ওর খোঁচা মারা কথা শুনে আমার গা চিড়চিড় করে ওঠে রাগে। এ ঘরে থাকলেই ওর অর্থহীন কথা বার্তা শুনতে হবে। আমি একটা বালিশ বগলদাবা করে একেবারে কোণার রুমের দিকে হাঁটা ধরি। আমার ঐ রুমটায় থাকতে অনেক ভয় ভয় লাগবে, তবুও এ রুমে আজকে আর শোবো না, অন্তত আজকে তো নয়ই। ওকে শুধুমাত্র টেস্ট করার জন্য কিছুক্ষণ আগে ওর গায়ের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে নাটকটা করলাম, না হলে বোঝা যেতো না আজ সে লিয়ানার সাথে একটা ইন্টিমেট সম্পর্ক করে এসেছে।
- হ যাও, দেখুম নে কতক্ষণ থাকতে পারো একলা ঐ রুমে - যেতে যেতে রেজার এই কথাটাও কানে আসে। আমি আবার পেছন ফিরে এসে শোবার ঘরের দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দেই। দরজা লাগাবার শব্দে রাতের নীরবতা খান খান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের ফ্ল্যাটে।

চলবে
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্টে যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×