somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নুহা-১৯

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নুহা-১৮

মন মেজাজ খারাপ হলে অনেক মানুষই ভাংচুর করে হাতের সামনে কিছু পেলে। এতে নাকি মেজাজ ঠাণ্ডা হয়। আমি যদিও কিছু ভাংচুর করিনি বা মনেও আসেনি এ ধরণের কিছু তবে জোরে শব্দ করে শোবার রুমের দরজাটা লাগিয়ে আসাতে রেজার উপরে ঝাল কিছুটা মেটানো গেলে আমার রাগ কিছুটা কমে। বাংলাদেশে আমাদের প্রতিবেশী শিল্পী আপাদের বাসায় প্রায়ই তার বাবা- মায়ের মাঝে তীব্র ঝগড়াঝাঁটির এক পর্যায়ে তার বাবা-মা সহ ছোট দুই ভাই বোনেরাও তাদের শোকেসের কাঁচের জিনিসপত্র ভাংচুর করতো, সে কথা এখন মনে পড়ে গেলো। তাদের বাসায় একবার দাওয়াতে গিয়ে দেখি সব মেলামাইনের গ্লাস প্লেট। শিল্পী আপার মা আবার হাসতে হাসতে আমার মা'কে বলেছিলেন - " আপনাদের জাফর ভাইয়ের কাজ দেখেন না আপা, টিভিতে মেলামাইনের নতুন প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন দেইখা একগাদা মেলামাইনের থালা বাসন,চামচ, গ্লাস কিনে নিয়ে আসছে।" মানুষ কত অদ্ভুত! আসলে মানুষ না, নারীদের মন কত অদ্ভুত! যার সাথে মনের মিল নেই, রোজ ঝগড়া, প্লেট গ্লাসের ঝনঝনানি যাদের বাড়ি জুড়ে, মহল্লায় এক নামে যাদের চেনে ঝগড়াটে বাড়ি, সেই আন্টিও তার স্বামীর দোষ ঢেকে, নিজে অনেক কিছু সহ্য করে কেমন স্বামীর প্রশংসা করে যায়! জেদ ওঠাতে আমাদের ফ্ল্যাটের সবচেয়ে নিরিবিলি আর কোণার রুমে চলে এসেছি ঠিকই কিন্তু ফ্লোরে শুলে তো শরীর ব্যথা হয়ে যাবে। আর এমনিতেও এ রুমে এলে কেমন অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হয়, ভয় ভয় লাগে। এ রুমে কোনো ফ্যান নেই। গরম লাগছে একটু একটু। ফ্লোরটা ঝাড়ু বা লিকুইড দিয়েও ক্লিন করা হচ্ছে না অনেকদিন। একদিন সময় করে রুমটা পরিষ্কার করতে হবে। এ ঘরে রেজার ইউস করা একটা আলমারি ছাড়া আর কিছুই নেই। পরিষ্কার করতে বেশি ঝামেলা হবে না মনে হচ্ছে। ফ্লোরে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া আপাতত কোনো কাজ নেই। বালিশটা সাথে আনলেও বালিশটা এখন পড়ে আছে আমার পাশেই। উঠে গিয়ে জানালাটা খোলা দরকার রুমের। ভ্যাপসা বাতাসটা বেরিয়ে যেতো তাহলে। কয়টা বাজে কে জানে ! মোবাইলটাও সাথে আনিনি। রোজই আমার সাথে বিরক্তিকর কিছু না কিছু ঘটছে। যদিও আমার নির্দিষ্ট কোনো শিডিউল নেই তবুও এভাবে মনটা রোজ রোজ তেতো হয়ে থাকলে ভালো লাগে না। নাহ্‌ ওঠা দরকার, জানালাটা খুলে দিলে গরম লাগাটা কমবে বোধ হয়। জানালাটা খুলে দিয়ে কিছুক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। এ রুমটা বেশি ব্যবহার হয় না বলে এ রুমের জানালায় কোনো পর্দাও ঝোলাইনি। স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো আর আমি ছাড়া মনে হচ্ছে আর কেউ জেগে নেই এখন। এই আলোটা না জ্বললেই বোধ হয় ভালো ছিলো, আঁধারটা এরকম করে চোখে লাগতো না। দূর থেকে কারো হাসির শব্দ ভেসে আসছে এমন মনে হচ্ছে। হয়তো কেউ লেট নাইট পার্টি শেষে ঘরে ফিরছে। রাত অনেক হয়েছে বলেই দূর থেকেও হাসির শব্দ আমার এখানে পাওয়া যাচ্ছে। কারা আসছে হাসতে হাসতে, কারা ফিরে যাচ্ছে ঘরে, তাদের দেখার জন্য আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। কিছু তো করার নেই আমার তাই অপেক্ষা করি দেখার জন্য সেই জেগে থাকা মানুষদের দেখা পেতে। তিন চারজন ছেলে মেয়ে হাত নেড়ে খুব গল্প করতে করতে যাচ্ছে আমাদের বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে। এরা এতো উচ্চস্বরে হাসে কেন কে জানে!


রেজা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাকে আজ অন্যদিনের মতো ডাকতে আসেনি। আমি কী অপেক্ষা করেছিলাম ও ডাকতে আসবে, সাধাসাধি করবে, মাফ চাইবে? ও অন্যায় করেছে বলেই হয়তো আমার মাঝে অপেক্ষার কোনও ব্যাপার হালকা ভাবে হলেও ছিল, প্রত্যাশা ছিলো স্যরি বলবে। ও সেটা তো করেইনি বরং ঝাঁজ দেখিয়েছে। আমাকে কী না বলে লিয়ানার জন্য সফট হতে, ওর দুঃখে দুঃখী হতে। বোথ আর শেইমলেস স্টুপিড ! এই ঘরটা আমাকে এক মুহূর্তে র জন্য স্বস্তি দিচ্ছে না। রুমের দরজাটা খুলে আমি ফ্রেশ রুমের দিকে যাই। চোখে মুখে পানি দিয়ে এসে আয়নায় ভালোভাবে নিজের চেহারাটা দেখি। আমার চেহারায় কী কামুক ভাব দেখা যাচ্ছে ! চোখ বড় বড় করে, একবার কুঁচকে ছোট করে, পিট পিট করে ঘাড় একবার ডানে কাত করে, একবার বামে কাত করে, সোজা করে অনেকভাবেই দেখার চেষ্টা করি, নিরীক্ষণ চালাই নিজের উপরে। কিছুক্ষুন আগে রেজার সাথে আমি যে কামনা-বাসনার একটা এক্টিং করে এলাম সেটা ভেবেই হাসি পাচ্ছে এখন। আমার কাছ থেকে এ ধরণের আচরন পেতে অভ্যস্ত না বলেই রেজা কেমন অবাক হচ্ছিলো, আমি খেয়াল করেছি। কী মিথ্যুক ও, বলে কি না ঐ মিষ্টি গন্ধওয়ালা পারফিউম নাকি ও সবসময়ই ইউস করে। কালেভদ্রে ও পারফিউম ইউস করে বলেই ওর সুগন্ধী বছর ঘুরলেও ফুরায় না। শবনমের পরামর্শে আমি ব্যাগে বডি স্প্রে রাখি গরমের দিনে তাই বডি স্প্রে আমার বেশিই লাগে। ওর গায়ের সুগন্ধীতেই বেশ বোঝা যাচ্ছিলো ও পারফিউম মহিলাদের, পুরুষরা জেনেশুনে অন্তত কোমল পারফিউম ইউস করবে না। লিয়ানার এসএমএসটা আসাতে আমি রেজার সাথে একটু এক্টিং করেছি ইন্টারকোর্সের ব্যাপারে, দেখতে ও কতটা এক্টিভ আছে। পুরুষ মানুষ সবাই হয়তো এমন না, সবাই হয়তো ঘরেরও খায় না বা তলারও কুড়োয় না। কিন্তু কিছু কিছু পুরুষ মানুষ আছে ঘরে বৌয়ের সাথে সাথে বাইরেও নারীদেহের স্বাদ নেয়। ভালোবাসা ছাড়া কী করে মানুষ পারে শারীরিক ভাবে তৃপ্ত হতে। কই রেজাকে তো একদিনও দেখলাম না ভালোবেসে বেসে আমার শরীরকে জাগিয়ে তুলতে। এসেই হালুম হুলুম করতে করতে নিজের প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে নিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায়। বিয়ের রাত থেকেই দেখছি এমন। পুরুষ মানুষ বা যৌন সম্পর্ক নিয়ে যে জড়তা,প্রাথমিক কৌতূহল, ভয় সবকিছুই আমার কেন যেন মনে হয় আগের মতোই রয়ে গেছে, স্বাভাবিক হতে পারি না এখনো, শরীর অটোমেটিক শক্ত হয়ে আসে আমার। ও যে পেইন আমাকে দিয়েছে, আমার শাড়ি ব্লাউজ লণ্ডভণ্ড করে যে ভয় ও আমার মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো বাসর রাতে সে ভয়, অস্বস্তিটা আমার কাটেনি আজো। আমার ভয়, প্রতিরোধের কাছে পরাজিত হয়ে বাসর রাতে ও কনডম টা খুলে রাখতে রাখতে হিসহিসিয়ে বলে - " বন্ধুরা কাল সকালে শুনলে আমারে পচাইয়া মারবো শালা বউরে লাগাইতে পারলি না কইয়া ।" ধ্যাত শালা বলে সেদিন ও খাট থেকে নেমে গিয়ে ঘরের মাঝে পায়চারী করেছিলো কিছুক্ষণ। প্রথমদিকে ও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলেও মেজাজ খারাপ হওয়াতে ওর অরিজিনাল ভাষাটা সে মুহূর্তে মুখে চলে এসেছিলো। স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা বন্ধুদের বলে ক্রেডিট নেয়ার কী আছে সে বয়সে আমার বোধগম্য ছিলো না, আজো নেই। তবে ব্যাপারটা বেশ পীড়াদায়ক, বিশেষত স্বামীর সেসব বন্ধুদের সামনে পড়ে গেলে বা দেখা সাক্ষাত হলে যে কোনও স্ত্রীর জন্য লজ্জায় কুঁকড়ে যাবার মতো বিষয় একটা। প্রথম প্রথম যে কোনও নারীর জন্য পুরুষ মানুষের ছোঁয়া একটা অন্যরকম ব্যাপার। বাসর রাত বা স্বামী বা পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হলে শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে যে রোমাঞ্চকর অনুভূতি আসার কথা শরীরে, মনে সেটা আমারও ছিলো ভয়াবহভাবে। পুরুষদের মতো নারীদেরও এ অনুভূতিগুলো খুব তীব্র হতে পারে। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাসের বই পড়ে সেসব অনুভূতি যেন দিন দিন তীক্ষ্ণ হচ্ছিলো আমার । একবার নিশাতকে বলেছিলাম সে কথা, শুনেই - ছি ছি তুই এসব ভাবিস ! ইশশ ! লজ্জায় ও যেন মুখ লুকাবার জায়গা পাচ্ছিলো না। নিশাত, আমার কলেজের ফ্রেন্ড। তবে এইচএসসি পরীক্ষা দেবার আগেই সে মরহুম হয়ে গিয়েছিলো। বিয়ের কয়েক মাস পর কলেজে এসে খালি তপুর গল্প শুনতে হতো, তপু ওর প্রবাসী হাসব্যান্ড। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ' কী রে এখন কেমন লাগে , খুব তো আমাকে ছি ছি করেছিলি।' ও লাজুক হেসে বলেছিলো - তুই বুঝবি না রে নুহা ! এ এক অন্য ফিলিংস, তুই কল্পনায় যেমন রোমান্স ভাবিস না তার চেয়েও হাজার গুন বেশি, বুঝলি ? কিন্তু আমার কল্পনায় ভাবা সে ফিলিংস আজো আমার পাওয়া হয়নি। রেজা প্রথম রাতেই যে ভয় আর যে আগ্রাসী রূপ আমাকে দেখিয়ে এসেছে এ যাবতকাল, আমি স্বাভাবিক হতেই পারিনি ওর নিচে পড়ে থাকা ছাড়া। স্বামী বা স্ত্রী কাছে থাকার পরেও যে একজন মানুষ শারীরিক অস্থিরতায় পতিত হতে পারে তার প্রমাণ বোধ হয় আমি। প্রচণ্ড এক জ্বালা সারাক্ষণ আমার শরীর জুড়ে থাকে। রেজা বোঝে না। ও বোঝে সব কিছুতেই শরীরের ব্যাপার টেনে আনতে, তারপর দশ পাঁচ মিনিটের যুদ্ধ, আমার নিঃশ্বাস আটকে পড়ে থাকে। মানসিক ক্ষুধা মিটিয়ে শারীরিক অরগ্যাজমও যে করা সম্ভব সে শুধু বোধ আমার বইতে পড়া অভিজ্ঞতাই হয়ে থাকবে চিরটাকাল। আমার এই মুহূর্তে ভীষণ কষ্ট হতে থাকে, আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে চোখটা জ্বালা করে ওঠে। আমি ক্রমাগত পানির ঝাপটা দিতে থাকে। সারা শরীরে যেন অসহনীয় একটা কামড়ানি ছড়িয়ে পড়ছে প্রতি আঁজলা পানির ঝাপটায়। শারীরিক কষ্টেও যে চোখে পানি চলে আসতে পারে, হুড়মুড়িয়ে কান্না এসে শরীরে কাঁপন তুলতে পারে বিগত কয়টা বছরে শুধু টেরই পেয়েছি, সমাধানের পথ পাইনি। একজন মানুষের আনন্দে বেঁচে থাকার জন্য শারীরিক এবং মানসিক শুশ্রূষার বড্ড প্রয়োজন, এ ভীষণ গভীর এক অনুভব।

চোখ মুখ ধুয়ে আমি রান্নাঘরের পাশের বারান্দায় এসে দাঁড়াই। রাত কত হয়েছে জানি না। বেশ নির্মল একটা বাতাস এসে আমার ভেজা চোখে মুখে পরশ বুলিয়ে গেলো। চুল থেকে ব্যান্ডটা খুলে চুলগুলো পিঠের উপরে ছড়িয়ে দেই। আহ্‌ কী আরাম লাগছে। আমার এ এলাকা থেকে অনেকটা দূরে যে আরেকটা এলাকা দেখা যাচ্ছে জানি না সেটা কোথায়, তবে দূরত্ব অনেকটাই হবে। ওখানের বিভিন্ন বাড়ির প্যাসাজে জ্বলা লাইট কিংবা স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো কেমন ঝিকিমিকি করে জ্বলছে। দূর থেকে এমনই মনে হয় দেখলে। পাহাড়ের কোলে অনেক বাড়ি ঘর, মাঝে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকা নরম আলো আর রাতের অন্ধকার মিলেমিশে একটা অপার্থিব কোনও সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে যেন। একটা ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে যেন আমার মাঝে। রান্নাঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আসি বসার জন্য। এক কাপ চা বানালে মন্দ হতো না বোধ হয়। যাই চুলায় চায়ের জন্য দুধ বসিয়ে আসি। সময়মত নামাতে পারলেই হলো নাহলে এতো রাতে চায়ের সস্প্যান উপচে দুধ পড়লে পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে পুরো বিল্ডিং জুড়ে। তাই কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই চা বানালাম। রান্নাঘরের লাইট জ্বালালাম না রেজার রুমে আলো ঢুকতে পারে ভেবে। চুলার ভ্যাকুয়ামের সাথেই একটা ছোট মতো লাইট আছে,ওটা জ্বালিয়ে কাজ সেরে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসি। গরম গরম চা খাওয়া ঠিক না আর আমি গরম চা খেতেও পারি না। তাই কাপটা বারান্দার রেলিঙে রাখি একটু উত্তাপ কমার জন্য। সড়সড় করে বাতাস হচ্ছে। রাতের এ বাতাসটায় শীতের হালকা গন্ধ আছে। ক'দিন পরেই দিনের দৈর্ঘ্য কমে আসবে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করবে। রোমে এখন পর্যন্ত বা বিগত বেশ কয়েক বছরের তুষারপাতের রেকর্ড শুনিনি। গত শীতে ভেবেছিলাম মামার ওখানে বেড়াতে যাবো। আপন মামা নয় যদিও, আমার মায়ের কাজিন।রোমের বাইরের শহর ব্রেসিয়াতে থাকেন, কিন্তু যাওয়া হয়নি। তার বদলে দেশে গিয়েছিলাম বেড়াতে। ব্রেসিয়া গেলে ছুটি নিয়া তোমার সাথে যাইতে পারতাম কিন্তু বাংলাদেশে অল্প সময়ের লাইগ্যা যাইয়া লাভ নাই। তুমিই যাও, গিয়া থাইক্যা আসো -- এমনটাই বলেছিলো। আমার আর তুষারপাত দেখা হয়নি। দেশের বাইরে শীতের চেয়ে সামারকেই প্রেফার করে বেশীরভাগ মানুষই। কিন্তু শীত সে যত তীব্রই হোক না কেন আমার খুব পছন্দের ঋতু। এই রে চা' টা একেবারে ঠাণ্ডাই হয়ে গেলো কি না কে জানে। আমি কাপটা টেনে নেই, ছোট ছোট চুমুক দেই। চেয়ারে বসে পা ঝোলাতে ঝোলাতে চায়ে চুমুক দিতে ভালো লাগছে বেশ। সাথে একটা গানও মনে পড়ে যাচ্ছে আরতি মুখোপাধ্যায়ের -

" তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়
লজ্জা জড়ানো,ছন্দে কেঁপেছি
ধরা পড়েছিলো হায়য়য়...."


লিরিক ভালমত মনে নেই। এরকমই হবে বোধ হয়। আহা সেদিন গুলো কী আর ফিরে আসবে কখনো? অষ্টাদশ তো পেরিয়ে এসেছি আরও বছর দশেক আগে। হাউ ডাজ টাইম ফ্লাইস ! আমার একটা ফ্রেন্ড ছিলো নাম তন্ময়। ও এতো মজার মানুষ, সবকিছুতেই ছিলো ওর ফান। কখনো আমরা কেউ যদি বলতাম, যায় দিনই ভালো রে। ও সাথে সাথে টেবিল চাপড়ে কিংবা সামনে অন্য কোনও ফ্রেন্ড থাকলে তার পিঠ চাপড়ে গান ধরত -

" আগে কী সোন্দর দিন কাটাইতাম ... অ্যাঅ্যাঅ্যা .. আগে কী সোন্দর দিন কাটাইতাম !" ও গাইতো আর মাথা নাড়তো। সেসব দিনের রিকলিং করতে আসলেই এই মুহূর্তে ভালো লাগছে খুব। আরেক কাপ চা পেতাম এখন ! আহ্‌ জালাল ভাইয়ের দোকানের গরুর দুধের চা যে কী ভালো লাগতো আমাদের ফ্রেন্ডদের কাছে। তন্ময় বলতো - ঐ জালাল শালা তো আফিম, ভাং যা পায় তাই মিশায়, দেখস না এক কাপ খাইলে চার/পাঁচ কাপ না খাইয়া ওঠা যায় না ? খুঁট করে দরজা খোলার একটা শব্দ হতেই আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দরজার দিকে তাকাই। রেজা আবার উঠলো কিনা কে জানে। না রেজা আসেনি, আমাদের বিল্ডিঙের দুই তলার সেই ছেলেটা এসেছে ওদের বারান্দায়। এতো রাতেও ছেলেটা ঘুমাইনি দেখছি। রোজই কী এই ছেলে রাত জাগে নাকি ! লাইটার জ্বালিয়ে একটা সিগারেট গুঁজে দিয়েছে বরাবরের মতো ঠোঁটে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এরকম করে কত কত নিঃসঙ্গ মানুষ বিবিধ কারণেই না রাত জেগে থাকে! ঐ ছেলেটাকে প্রায়ই রাত জাগতে দেখে আমারও মনে হয় ও আমার মতোই নিঃসঙ্গ মানুষ। তাই ওকে দূর থেকে দেখে, কথা না বলেও শুধুমাত্র উপস্থিতি দিয়েও যে আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষের কাছাকাছি পৌঁছানো যায় আমার নিজেকে দিয়ে টের পাচ্ছি। ওকে কেন যেন আপন লাগে কিংবা এমনও হতে পারে রেজার উপেক্ষা, অসততা এসবই যেন আমাকে ঐ নিঃসঙ্গ ছেলেটাকে আমাকে আপন ভাবতে আরও বেশি করে উদ্বুদ্ধ করছিলো। কবিতা পড়তে ইচ্ছে করছে ভীষণ। উমমম ঠিক পড়তে না, কেউ যদি চুলে বিলি কেটে কবিতা শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দিতো। নিজেই হেসে উঠি নিঃশব্দে। আমাকে আবার কে কবিতা শোনাবে, কে চুলে বিলি কেটে দিবে ! মানুষের তো আর কাজকর্ম নেই ! তবুও একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মিছেমিছি। চেয়ারটা টেনে বারান্দার রেলিঙয়ের কাছে নিয়ে যাই, মাথাটা সেখানে রেখে কল্পনায় দেখি কেউ একজন আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। মাথা কাত করে রেলিঙয়ে রাখায় কিছু চুল পড়ে গালের কাছটায় ঢেকে গেছে। সেই কেউ একজন চুলগুলো আস্তে আস্তে সরিয়ে দিলো যেন। কানের পাশে ফিসফিস করে বলে, অতন্দ্রিলা কবিতা শুনবে?

আমি ঘুম ঘুম স্বরে জড়ানো কণ্ঠে বলি, আমি অতন্দ্রিলা না, আমি নুহা। আচ্ছা কে আমায় এতো আদর করে কথা বলছে ! ঐ দুই তলার ছেলেটা কোনোভাবে আমার এখানে চলে আসেনি তো ? ও বাংলায় কথা বলতে পারে জানতাম না তো আগে ! আবার কেউ একজন বলে -

অতন্দ্রিলা, কবিতা শুনবে না ?

আমি জড়ানো গলায় বলি, হুম শুনবো । তার হাত আমার হাতে চেপে ধরি। শোনাও কবিতা । ফিসফিস করে যেন কেউ বলতে থাকে -

অতন্দ্রিলা, ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে বলি,
শোনো, সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায় ---সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি---
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন, আলাদা নিশ্বাসে---
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা---
অতন্দ্রিলা, হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না, দেখি তুমি নেই ||


কার কবিতা এটা? কার? তুমি লিখেছো ? তুমি ? নাহ্‌ ও লিখবে কেন। এটা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা না ? আমাকে কেউ উত্তর দেয় না। আমি উত্তরের অপেক্ষায় থেকে থেকে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি। কেউ একজন আমাকে ভীষণ আলতো করে ছুঁয়ে গেছে যেন, গালের কাছটায় তার হাতের ছোঁয়া লেগে আছে এখনো। বাতাসে চুল উড়ে উড়ে আমার গালের কাছে, চোখে আছড়ে আছড়ে পড়তে থাকি। আমি কিছুক্ষণ আগের চরম বঞ্চনাকে পিছনে ফেলে আকাশে বাতাসে উড়তে থাকি অচেনা এক আনন্দ-অনুভবে।

চলবে
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:৪১
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×