নুহা-১৯
বারান্দায় রেলিঙের কাছ ঘেঁষে মাথা রেখে কখন চোখ লেগে এসেছিলো জানি না। তবে ঘুমেরা তাড়নায় বারবার মাথা ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছিলো, আর এভাবে কী ঘুমানো যায় ! টলমল পায়ে যখন ঘরের দিকে যাই আধো ঘুম আর জাগরণের মাঝে এক পলক দেখেছিলাম আকাশ ফর্সা হবে হবে করছে। রাতে কী আবোলতাবোল ভেবেছি, কীসের কবিতা আওড়েছি কে জানে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম ঘরে ফেরার পর হিসেব নেই। আমার আরেকটা সকালের শুরু। ভালো কী মন্দ ভাবে শুরু হলো কিংবা কেমন যাবে দিন তাও ভাবতে পারছি না এই মুহূর্তে। গা ব্যথা করছে ফ্লোরে শুয়ে। একটা জ্বর জ্বর ভাব ঘুরছে, মাথা, ঘাড় সব ব্যথা ব্যথা করছে। ঘুম ভেঙে ফ্লোরে কিছুক্ষণ বসে থাকি ঝিম ধরে। ফ্রেশ হতে গিয়ে আয়নায় চোখ পড়লে দেখি চোখ একটু লালচে হয়ে আছে। রাত্রি জাগরণের ফল এটা। রাত জেগে থাকার অবসান কবে হবে জানি না। সামনের দিনগুলো যা আসছে তাতে আমি ভালো কিছু দেখছি না নিজের জন্য।
কৌশলী হও নুহা, কৌশলী হতে শিখো।
- হুম শেখা উচিত। এই প্রথম ঐ নুহাটা আমাকে ভালো বুদ্ধি দিলো। ওর গালটা ছুঁয়ে দেই একটু।
- ইউরো তো যেভাবে খুশী সেভাবে উড়িয়েছ এবার একটু সঞ্চয় করো।
আচ্ছা। লক্ষ্মী মেয়ের মতো উত্তর দেই আমি।
- বাংলাদেশ থেকে গতবার আসার সময় একটা একাউন্ট করে এসেছিলে না ব্যাংকে, ওখানে প্রতি মাসে কিছু কিছু টাকা পাঠাও রেজাকে না জানিয়ে
- না জানিয়ে পাঠানো টা তো চুরি করা হয়ে যায়। টাকা যেহেতু ওর। জানিয়ে পাঠালে সমস্যা কী।
- ওকে সমস্যা হলে না জানিয়ে পাঠিয়ো বা কোনও সিস্টেম খুঁজে বের করো। সব কী আমি শিখিয়ে দিবো নাকি
- ঠিক আছে। এখন যাও, আজেবাজে বুদ্ধি দিও না। যাও,আজকে বিরক্ত করবে না একদম। অনেক কাজ করতে হবে
- হুম যাচ্ছি। ও আরেকটা কথা শোনো, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে। অসুস্থ হয়ে গেলে কিন্তু আরও বিপদে পড়ে যাবে
- ধ্যাত কু ডাক ডেকো না তো। পারো খালি ভয় দেখাতে। যাও বিদায় হও এখন। দাঁতটা ব্রাশ তো করতে দিবে নাকি ?
- এই না একটু আগে বলছিলে এই প্রথম তোমাকে ভালো বুদ্ধি দিয়েছি ? আসলে তোমরা মানুষরা একেক সময় একেক কথা বলো।
- আমরা মানুষ হলে তুমি কী ?
- দেবী, মহামানবী ।
- ইশশ ! যাও ফুটো
নুহা ভালো কথাই বলে গেছে, ঠিকমতো খেতে হবে, না হলে ব্রেইন কাজ করবে না। সকালে ঘুম ভেঙে খেতে ভালো না লাগলেও পাউরুটি আর ডিম পোচ করে নেই, এক কাপ চা করে খেতে বসি। আজ কয়েক জায়গায় ফোন দিতে হবে। শাহিন ভাইকে ফোন দিবো, দেখি উনার কাছে কাজকর্মের ব্যাপারে কোনও খবর পাওয়া যায় কিনা কিংবা কেউ ইংরেজি শিখতে চায় কিনা। আমরা যেমন এ দেশের ভাষা শেখার জন্য ভাষা শিক্ষার স্কুলে ক্লাস করি যদিও সেটা অবৈতনিক কিন্তু এ দেশীয়রা ইংরেজি শেখার জন্য ক্লাস করে কিনা বা করলেও যে আমার সেখানে সুযোগ হবে তাও তো জানি না। আসলে কিছুই জানি না কিন্তু কোনও একটা পথ ধরে আগাতে হবে, নিজের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু নিজের আয়ের মাধ্যমেই সেটা করা সম্ভব। রেজা আমাকে টাকা পয়সা জনিত সমস্যায় রাখেনি যদিও কিন্তু ওর মনের ভেতরে আসলে কি কি কাজ করে এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে। সে ঠিক কত টাকা বেতন পায় আমি জানিও না, দেশেও তো আমার শ্বশুর- শাশুড়ি কে সে টাকা পয়সা তেমন পাঠায় না একটা নির্দিষ্ট মাসিক বরাদ্দ ছাড়া। জীবন নিয়ে ওর তেমন প্ল্যানও নাই দেখা যায় । সারাজীবন প্রবাসেই থাকবে এমন একটা ভাব।
আমার প্রবাস জীবন ভালো লাগছে না। পারছি না নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে, ঘরের মানুষটার কারণে। দুপুরের রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। নুহা আজ তোমার রান্না করার দরকার নেই। রোজ রোজ রেঁধে কী করবা ?
- বাজার করেছি রান্না করতে হবে না ! কী বলো এসব
- বাজার করলেই রাঁধতে হয় নাকি ? বোকা মেয়ে ! নাকি রেজা এসে খাবার না পেলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাবে ?
- রেজার ভয়ে রাঁধি কে বললো ? সব সময় ফালতু কথা বলো না তো ! রেজা তো সবসময় বাসায় খায় না । আমাকে তো খেতে হয়। নিজের জন্যই রাঁধি আমি।
- মিথ্যা কথা বলছ কেন ? তুমি যে রেজাকে ভয় পাও না সেটার প্রমাণ পারলে দিও আজকে না রেঁধে।
- আচ্ছা দিবো। আমিও বাইরে থেকে খেয়ে আসবো আজ। আর রাতের জন্য খাবার কিনে আনবো।
- হুম দেখবো তো তোমার দৌড় কোন পর্যন্ত !
উফফ নুহা চুপ করো। চিৎকার দিয়ে উঠি আমি। আমার ভেতরের সত্ত্বাটা ক্রমশ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে কেন এভাবে বুঝি না! অসহ্য লাগে। সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে প্রায়। শাওয়ার নিয়ে বের হওয়া দরকার। রাতের রান্নার কথা ভেবে ফ্রিজ থেকে এক প্যাকেট গরুর মাংসও আর চিংড়ি মাছ বের করেছিলাম বরফ গলবার জন্য। কিন্তু সেগুলো আবার ফ্রিজে তুলে রাখি। নাহ্ আজ আমি রান্না করবো না। গুড গার্ল নুহা । আমি চমকে উঠি শুনে। উফফ তুমি আবার এসেছ ? শাওয়ার নিতে আজ বেশি সময় লাগাই না। গলা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। জ্বর চলে আসলেই ভালো, একটা সাময়িক ঘোরের মাঝে চলে যাবো। কোনও কিছুই আমাকে তখন আর যন্ত্রণা দিতে পারবে না। শাওয়ার সেরে আজ খুব দ্রুতই বের হলাম। ঝটপট রেডি হয়ে গেটে তালা আটকে নিচে নামি। মালিয়ানা যাবো আগে, আমাদের পাশের মহল্লা। হহাহা মহল্লা বলে ফেললাম কী অনায়াসেই। মালিয়ানা আমার পাশের এলাকার নাম। এখানে যে কোনও রাস্তার নামের সাথে via কথাটা যোগ করে। যেমন ভিয়া মালিয়ানা। মালিয়ানা বাস দিয়েও যাওয়া যায়, হেঁটেও যাওয়া যায়। আজকে গিয়ে যদি দেখি বাস আসতে দেরী হচ্ছে হেঁটে হেঁটেই চলে যাবো। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়েও বাসের দেখা পেলাম না। গেট দিয়ে বের হবার সময় গ্যারেজের বদমাইশ হামাদি কে দেখেছিলাম দাঁড়িয়ে থাকতে তেলতেলে হাসি হাসি মুখ নিয়ে। চোখ চোখ পড়ে যাওয়াতে হাসি মুখে সে আমার দিকে তাকিয়ে সালামও দিয়েছিলো " সালুতে " ( salute ) বলে। প্রত্যুত্তরে আমাকেও দিতে হয়েছে। একে দেখলেই কেন যেন আমার রাগ লাগে খুব।
বাস না পেয়ে হেঁটে হেঁটেই যাচ্ছিলাম। ঐ রাস্তায় একটা বার আছে। বাঙালি এক ভদ্রলোক সেখানে কাজ করেন, নাম - রাশেদ। উনার সাথে দেখা হয়ে যাওয়াতে সালাম দিলো। রেজার সাথেই প্রথম এখানে এসেছিলাম একদিন বিকেলে, কফি খেতে।
- কী ভাবী, মালিয়ানা যাচ্ছেন বুঝি ? ভালো আছেন?
- জি। ভালো আছি, আপনি ? আমার প্রশ্ন শুনে উনি একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন --
- যতটুকু ভালো থাকা যায় আর কী। চলে যাচ্ছে সময়।
এখানের বাঙালি মানুষগুলো তাদের দীর্ঘশ্বাসের পিছু এখনো ছাড়াতে পারেনি। দেশ, মা, ভালো জব, স্টে পারমিশন ইত্যাদি অনেক কিছুর অভাব নিয়েই তারা সবাই খুব একটা ভালো নেই এই দেশে। রাশেদ ভাইয়ের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না আমি। উনি আমাকে বারের ভেতরে এসে বসতে বলেন বাইরের রোদ দেখে। এই বারে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম কাজ করতে। তাকে দেখতে না পেয়ে বললাম -
- ঐ মেয়েটা কে দেখছি না যে !
- ভেগেছে।
- মানে ?
উনি আমার এ প্রশ্নের উত্তর দেন না। হাসেন শুধু। আমার দিকে একটা জুসের বোতল বাড়িয়ে দেন। রোদের মাঝে খেতে ভালো লাগবে, খান ভাবী। বার মানেই আগে ভাবতাম মদ বিক্রি করে বুঝি। এখানে এসে এ ধারণাটা বদলেছে। বারে ব্রেক ফাস্ট, চকলেট, মোবাইলে টাকা রিচার্জ, লটারি, গেমস খেলা ইত্যাদি অনেক কিছুই যায়, মানে বেশীর ভাগ বারেই।
ভাবী কী অসুস্থ নাকি ? কেমন যেন দেখা যাচ্ছে আপনাকে।
আমিও হাসি তার কথা শুনে। উত্তর দেই না। তাকে জিজ্ঞেস করি রাশেদ ভাই, আপনাদের বারে কী কাজের ব্যবস্থা করা যাবে ? আমি আসলে কাজ খুঁজছি। আমার কথা শুনে রাশেদ ভাই হাসে শুধু। এমনিতে তাকে দেখে স্বল্পভাষী মনে হয়েছে আমার। উনি আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে কী বোঝেন জানি না, বললেন -
মেয়েদের বারে কাজ করাটা বিশেষ করে বাঙালিদের জন্য কিন্তু বেশ টাফ। আর বেতনও খুব বেশি না। ডেইলি ২০-৩০ টাকা দিবে, তাও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী। আবার শিফটিং ডিউটি। রাতে ডিউটি পড়ে মাঝে মাঝে।
- আমি হার্ড ওয়ার্ক করতে পারব, সেটা সমস্যা না রাশেদ ভাই।
- আমি আসলে ভাবী হার্ড ওয়ার্ক মিন করছি না। আরও ব্যাপার আছে এখানে। তবে আমাদের বারে লোক নিলে আমি জানাবো। আপনি তো প্রায়ই এখান দিয়ে যাতায়াত করেন, দেখেছি আমি। আমি জানাবো, আপনি চাইলে আমার মোবাইল নাম্বার রাখতে পারেন, আপনার নাম্বারও দিতে পারেন। আমি আমার নাম্বার দিয়ে, জুসের বিল চুকিয়ে বার থেকে বের হই।
বাইরে অনেক রোদ হলেও বাতাস আছে। আমার ভেজা চুল ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেছে বাতাসের ছুটোছুটিতে। ব্যাগ থেকে চুলের ব্যান্ড বের করে চুলগুলো বেঁধে নিলেও ছাতা বের করতে ইচ্ছে করে না। রোদে বেশি বেশি করে পুড়ি, জ্বরটাও দ্রুত আসবে। আহা ঢং কতো, তুমি কী ভেবেছ জ্বর এলে রেজা তোমাকে কোলে তুলে নাচবে ?
- ধ্যাত সারাক্ষণ রেজা রেজা করবে না তো। ভাল্লাগে না
ভেতরের নুহাটা সাময়িক চুপ থাকলেও আবার কিছুক্ষণ পর এসে হানা দিবে জানি। শাহীন ভাইকে ফোন দেয়া দরকার। উনার আজ কাজ আছে কি নেই না জেনে এভাবে হুট করে বের হয়ে গেলাম বোকার মতো, ভেবেই তো লজ্জা লাগছে। তবুও ফোন দেই। ফোন পেতেই উনি খোঁচা মেরেই বলেন --
আপনাকে তো চিনলাম না। কে আপনি ? হাসি হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করেন।
- চেনার দরকার নেই। কোথায় আছেন এখন তাই বলেন। আমিও হাসতে হাসতেই বলি। এমন অড টাইমে তাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করলাম কিনা কে জানে !
- বাসাতেই আছি। তবে এখন খেয়েই বের হবো, কামলা দিতে হবে তো। আজকে তিনটা দশটা ডিউটি। বলেন ম্যাডাম কী করতে পারি আপনার জন্য। আর এই অসময়ে বাইরে কী করেন, সংসারী মানুষ আপনি!
- যারা সংসারী না তারা বুঝি বাইরে থাকবে এমনই নিয়ম ! হাহহাহা। আমি আপনাদের এলাকাতেই এসেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনার সাথে একটু দেখা করবো। আমার কথা শুনে এবার শাহীন ভাই একটু সিরিয়াস হয়, কেন ভাবী কোনও সমস্যা হয়েছে। তার গলার উৎকণ্ঠা স্পষ্টতই টের পাই। প্রবাসে একজন বাঙালির জন্য আরেকজন বাঙালির এই উৎকণ্ঠা সত্যিই আমাকে সম্মানিত করে, ভালো লাগার অনুভব দেয়।
- না না শাহীন ভাই, তেমন জরুরী কিছু নয়। আমাকে উনি আর কথা বলতে দেন না, বলেন -
- আপনি রাস্তার ওখানে যে পার্কটা আছে চৌরাস্তার মোড়ে, ওখানে থাকেন। আমি বিশ মিনিট পর আসছি।
ধ্যাত আমিও যে কি না ! উনাকে ফোন দিয়েই বাসা থেকে বের হওয়া দরকার ছিলো। নিশ্চয়ই উনি খেয়ে একটু রেস্ট নিতো। চৌরাস্তার ওখানে যে পার্কটা ওটা সেই স্কুলের সামনেই যেখানে আগে ভাষা শেখার জন্য যেতাম। পার্ক বলতে রাস্তার উপরেই, কোনও গাছপালা জাতীয় কিছু নেই কয়েকটি বেঞ্চ আর বাচ্চাদের কিছু রাইডস ছাড়া। ওখানেই গিয়ে বসলাম । অন্য কয়েকটা বিল্ডিং এর ছায়া পড়েছে বলে এই জায়গাটা একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। স্কুলের দিকে একটু নস্টালজিক নস্টালজিক লাগছে। প্রথম প্রথম এখানে যখন ক্লাস করতে আসতাম, বাঙালি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের মানুষজন এখানে আসতো। সময়টা ক্লাসে খুব আনন্দের ছিলো। দুপুর বলে এ সময়টায় তেমন লোকজন নেই এখানে। আশেপাশে কয়েকটা পিৎজার দোকান আছে, সেখানে কিছুটা ভিড় ছাড়া তেমন লক্ষ্যনীয় কিছু নেই এখন এই মুহূর্তে। মালিয়ানা এলাকার এটাই মনে হয় শেষ প্রান্ত, তাই গাড়ির কোলাহল এখানে বেশ কম। ঐ যে শাহীন ভাই হেলতে দুলতে আসছে। উনার স্বাস্থ্য এতো খারাপ যে আমরা ক্লাসে তাকে ক্ষেপাতাম এই বলে যে উনার তো ছায়াই পড়ে না, ভূত টুত কেউ না তো উনি। মাথার চুলগুলোও উনার বেশ হালকা হয়ে গেছে। বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ হয়ে গেছে , বিয়ে করেন নি। এ কথা জিজ্ঞেস করলে বলে -
- আপনাদের ইতালির সরকার তো আমাকে দেশেই যেতে দেয় না, বিয়েটা আটকে রেখেছে। উনাকে ব্যবস্থা করতে বলেন। আরে ভাই বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করবো কে । এই বছর ঐ বছর করতে করতে আজ প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলো, দেশেই যেতে পারি না কাগজের জন্য। পরে রাগ করলে কিন্তু আর বিয়েই করবো না বলে রাখলাম। উনার কথা শুনলে হাসিই পায়, অনেক মজা করে কথা বললেও উনার গলার স্বরের বেদনাটুকু উনি আড়াল করতে পারেন না।
আমাকে দেখেই শাহীন ভাই যে কথাটা বললেন - আপনারা ভাই মানুষ খারাপ। কত্তদিন পর আপনাকে দেখলাম জানেন মিয়া ? যাই হোক আমাদের ভাইজান রেজা সাহেব কেমন আছেন ?
- আপনি দেখি এখনো আমাকে মিয়া বলার অভ্যাস ছাড়তে পারলেন না । হাহহাহা। হুম আপনাদের ভাই ভালোই আছে।
- কিন্তু আপনি ভালো নাই কেন ? আপনার চেহারা আয়নায় দেখেছেন এর মধ্যে ? চোখের নিচে কালি, একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব চেহারার মধ্যে। আপনার চেহারার লাবন্যও তো হারিয়ে গেছে। সমস্যা কী ভাবী ? এই ভাইটাকে বলে ফেলেন।
- আরে তেমন গুরুতর সমস্যা না। তবে রাতে ঘুম হচ্ছে না । আর একটু জ্বর জ্বর ভাব, এই আর কী !
উনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন এক দৃষ্টিতে। বলেন - সত্যি বলছেন তো ?
আমি হাসি নিঃশব্দে। মাথা নাড়াই। শাহীন ভাই আমাকে বলেন - ভাবী আপনি আগের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছেন। আগে কতো হাসিখুশি ছিলেন। সেই চঞ্চলতাটা নেই। আর এখন আপনি কতো গম্ভীর। স্কুল ছাড়ার পর একটা দিনও ফোন করেন নাই। অথচ আপনি এ এলাকায় প্রায়ই আসেন মার্কেটে, ফোনের দোকানে এসে কার্ড কেনেন সবই খবর পাই, দেখেছিও কয়েকদিন। ডাকিনি কারণ এখানে ব্যাচেলরদের অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়। উনিও হাসেন বলতে বলতে।
- শাহীন ভাই আমাকে কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন ? ঘরে থেকে থেকে আমার কেমন দম বন্ধ লাগে। কিন্তু সারাদিন বাইরে উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরিও ভালো লাগে না। শাহীন ভাইকে দেখে আমার কেমন কান্না কান্না পায়। বাংলাদেশের কথা মনে হয়, আমার ভাইয়ার কথা মনে হয়। আমার কথা শুনে উনি ব্যথিত হন। বলেন -
- আপনার এই গরীব ভাইটার কাছে আপনি এতো দামী আবদার করলেন ভাবী ? ইউরোপে গত কয়েক মাসে কাজের কতো ক্রাইসিস চলছে আপনি মনে হয় খবর রাখেন না। রেজা ভাই তো পার্মানেন্ট জব করে, আরামের চাকরী ! আমরা যে কতটা অনিশ্চিত জীবন কাটাই এখানে বুঝবেন না ভাবী। রোজ রাতে বা কাজ শেষ বাসায় ফেরার পর একটা আতংক কাজ করে, মালিক পর দিন ফোন করে কাজের জন্য যেতে বলবে তো , যদি ভুলে যায় আমাকে ডাকতে ইত্যাদি নানান ভাবনায় দেখেন না মাথার চুল সব পড়ে গেছে। হাহহাহাহা । টেনশন করবেন না, আমার খোঁজে কোনও কাজ যদি থাকে আমি জানাবো । আপনি নিশ্চয়ই বাসাবাড়িতে কাজ করবেন না ইতালিয়ানদের ?
- বাসাবাড়ির কাজ মানে ?
- মেইড হিসাবে কাজ করবেন ? হাহহাহাহা
- কেউ ইংরেজি শিখতে চায় না এখন ?
- আহারে ভাবী আপনি কোন দুনিয়ায় যে থাকেন এখন কে জানে ? নাহ আপনি দেখছি বড্ড ইমোশনাল আছেন এখনো। ক্লাসে কখনো পড়া না পারলে আপনার কতদিন যে চোখ ভিজে উঠতো, লজ্জায় আপনি লাল হয়ে যেতেন এখনো মনে পড়লে আমি হাসি। আচ্ছা আপনার জন্য কাজ খুঁজবো। তবে জিজ্ঞেস করবো না আপনি কেন কাজ খুঁজছেন ? আপনার জায়গায় আমি থাকলে কখনোই কাজ করতে চাইতাম না। কাজ করা অনেক কষ্টের এই দেশে। তবে কিছু কিছু ব্যাচেলর আছে এদেশে মানে বাঙালিদের কথা বলছি ভাবী। তাঁর ইতালিয়ান বৃদ্ধ মহিলাদের বাসায় কাজ করে। কাজ মানে আশা করি বুঝেছেন কী কাজ ?
- না বুঝি নি। কী কাজ ? সত্যিই আমি অবাক হয়ে শাহীন ভাইয়ের দিকে তাকাই।
- পুরো বৃদ্ধও বলা যাবে না। মনে করেন ফিফটি ক্রস করা বিধবা বা ডিভোর্সড মহিলারা আছে না? তারা চাইলেই এদিক সেদিক গিয়ে দৈহিক তৃষ্ণা মিটিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বাসায় একজন কাজের লোক রাখলে সেটা আরও নিরাপদ। বাসার বেতনেই কাজ চলে যায়। আর এ ক্ষেত্রে মহিলাগুলো জানে এশিয়ানরা বিশ্বস্ত, তাছাড়া তারা অভাবীও। বাড়ির কাজ, সেক্স, খাওয়া -পড়া গিফট সবই পাওয়া যায়। আমাদের দেশের অনেক ছেলেই ভাবী এখন এসব কাজ করছে, পরিশ্রম কম। তবে সচরাচর তারা বলবে না তারা কী কাজ করছে। মানিক ভাই কে চিনতেন না স্কুলের? ঐ যে দেখতে খুব সুন্দর, কাজ পাচ্ছিলো না। পরে কীভাবে যেন এক বুড়ির খপ্পরে পড়েছে, বুড়ি তো তাকে এখন বিয়েও করতে চায়, বিনিময়ে দশ বিশ হাজার ইউরো দিতেও রাজি। বুড়িটা আবার একলা, ছেলেমেয়েরা সব ইতালির বাইরে থাকে, খোঁজও নেয় না। মানিক ভাই তো লজ্জায় এখন আমাদের এদিকেই আসেন না, ঐ বুড়ির বাসায় থাকেন। এই হচ্ছে ভাবী ভেতরের খবর। চাকরী টাকা পয়সা নিয়ে এতো টেনশন আর ভাল্লাগে না। কোনদিন শুনবেন কোনও বুড়ি বিয়া কইরা নিজেরে বিকাইয়া দিছি। বলে উনি হাসেন ঠিকই কিন্তু এর আড়ালের বেদনাটা আমি টের পাই।
- হুম নদীর এই পাড় আর ঐ পাড় দুজনেই ভাব সুখ কোথায় গচ্ছিত আছে। হাহহাহা। আপনার কাজের সময় হয়ে এলো। উঠবেন না ?
- যাওয়া দরকার তো। একদিন সময় করে আসেন। স্কুলে যারা আগে পড়াতো , তারা এখনো আছে। ফ্রাঞ্চিস, এলিজা, লোরা ওদের সাথে সন্ধ্যার পর কাজ না থাকলে আমি মাঝে মাঝে আড্ডা দেই। আপনার কথাও ওরা জানতে চায়। একদিন আসেন, রেজা ভাইকেও নিয়ে আইসেন। ভাল্লাগবে।
আমি মাথা নাড়াই। কাজের সময় হয়ে যাওয়াতে শাহীন ভাই চলে যায়। আমার কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই বলেই হয়তো বসে থাকি। হঠাৎ হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝলক টের পাচ্ছি। শীতের ঘ্রাণ পাওয়া যায় এমন বাতাসে। আমার হাতে, মুখে দুই এক ফোঁটা পানি এসে পড়লে মুখটা তুলে আকাশের দিকে তাকাই। আকাশে মেঘ জমেছে অথচ কিছুক্ষণ আগেও কী ভীষণ রোদ ছিলো। বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমশ ঘন হচ্ছে। ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে মাথার উপর মেলে ধরি। কী অদ্ভুত এক দৃশ্য। আমার আশেপাশে কেউ নেই। একা বেঞ্চের এখানে বসে আছি, বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে। বাতাসের ঝাঁপটায় বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার পায়ের কাছটা, শরীরের কয়েক জায়গায়ও ভিজে জামা পেটের কাছে, সাইডে লেপটে গেছে। ভিজে যাক সব কিছু, আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাক। কেমন ঘোরগ্রস্ত লাগছে। মাথায় কবিতা ঘুরছে -
চোখের জলের কোন গল্প শোনাব না । আমি শুধু
অন্যমনস্ক এক গাছ এঁকে যাবো । এঁকে দেব
লোকাল ট্রেন আর তার পেছন পেছন দৌড়ে যাওয়া
সিগন্যালম্যান
তারপরের লাইনগুলো যেন কি ! উফফ তারপরের লাইনগুলো কীভাবে জানবো এখন ! কি যেন ! আমি স্মৃতি হাতড়াতে থাকি। মনে হচ্ছে কবিতার লাইনগুলো মন একরতে না পারলে জীবন আমার বৃথা হয়ে যাবে, ক্লান্তি গুলো আরও বেশি করে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে --
আমার ঠিকানা খুবই ছোট । তুমি সমস্ত নিষেধাজ্ঞা
অমান্য ক'রে
চিঠি দিও, হৃদস্পন্দন পাঠিও
সুবীর সরকারের এই কবিতা সেই কবে পড়েছিলাম কিন্তু এখন এমন আকুল করা হাহাকারে কেন ভেসে যাচ্ছি আমি জানি না। বৃষ্টির বেগ বাড়তে থাকলে আমার মাঝে একটা বিষণ্ণতা ভর করতে থাকে আরও তীব্র ভাবে। মোবাইলে বোধ হয় কোনো ফোন এসেছে। ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে করে না। বাজতে থাকুক মোবাইল অনন্তকাল ধরে।
চলবে