নুহা - ২০
মোবাইল অনন্তকাল ধরে যেমন বাজবে না, বৃষ্টিও তেমনি ঝরবে না। এক সময় বৃষ্টি থামলো হঠাৎ করে যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই। তবে যতটুকু সময় বৃষ্টি ঝরেছিলো সেটা ছিলো একটানা এবং তুমুল বর্ষণ। আমার পাজামার অনেকখানিই ভিজে গিয়ে পায়ের সাথে লেপটে আছে হাঁটুর নিচ থেকে, ওড়নার কিছুটা অংশ ভিজে গেছে। শাহীন ভাই চলে যাবার পর, বৃষ্টি থামলে আমিও বাসায় ফেরার জন্য প্রস্তুতি নেই। এ এলাকায় অনেক বাঙালি লোকের বসবাস, দোকানও আছে। কেউ যেমন বাইরে ফুটপাতে ব্যবসা করে আবার কারো কারো নিজস্ব দোকান আছে ফোনের, কারো বা আছে ভ্যারাইটি স্টোর, এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশের মতো মুদি দোকান। তবে এখানে এসব দোকানকে বলে আলিমেন্টারি। এই রকম গা ভেজা অবস্থায় হেঁটে হেঁটে এই এলাকা পার হতে গেলে অনেক বাঙালি লোকের মুখোমুখি হতে হবে। ব্যাপারটা কেমন দেখাবে ভাবতেই অস্বস্তি লাগছে। এই চিরচেনা অস্বস্তিদায়ক বোধ বাংলাদেশ বা ইউরোপ, আমেরিকা বোঝে না, সঠিক সময়ে ঠিকই উচিত আর অনুচিতের মাপকাঠি নিয়ে সামনে চলে আসে। রিকশা পেলে ভালো হতো। টুং টুং আওয়াজ করে রিকশাওয়ালা নিয়ে যেতো আমাকে আমার গন্তব্যে। এই যে এখানে যেমন কাছাকাছি কিছু জায়গা আছে, না সেখানে হেঁটে যাওয়া যেতে ভালো লাগে না আবার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগে! এমন সময় বাংলাদেশের রিকশার খুব অভাব বোধ করি। যানজট মুক্ত এরকম একটা দেশে রিকশা থাকলে ভালো হতো, আমাদের দেশীয় একটা বাহনের প্রচার ঘটতো। খিদে লেগেছে, কিছু খাওয়া দরকার। সামনেই একটা সুপারশপ আছে, ওখান থেকে রুটি, দুধ, ফল, আইস টি এসব কেনা দরকার। কিন্তু এসব ভারী ভারী জিনিস গুলো টেনে নিয়ে বাসায় যাওয়াটাও মুশকিল। বাসের জন্য অপেক্ষা করাও ঝামেলা লাগছে, হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না। মাথা কেমন টলছে। জ্বরের আভাস। ধ্যাত পারবো না এসব কিনতে। বাসায় যা আছে তাইই খাবো। জানতাম তো আমি মোল্লার দৌড় যে মসজিদ পর্যন্ত। বাসায় গিয়ে রান্না করবে, রেজাকে খাওয়াবে তাই খাবার না কেনার জন্য বাহানা, বুঝি না আমি ! হাহাহহাআহা শব্দে নুহার হাসি আমার কানে যন্ত্রণার তৈরি করছে।
ওকে বলি - আরেকবার আমাকে খোঁচালে চড় লাগাবো তোমাকে !
পার্ক থেকে বের হয়ে রাস্তার উল্টো পাশেই একটা পিৎজার দোকান দেখে ওখানে ঢুকলাম। চিংড়ি মাছের পিৎজা নিলাম এক টুকরো পরিমান কেটে আর একটা ফানটা। দোকানের এক কোণায় দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলাম। পিৎজা কেটে ওজন দেয়ার মেশিনে ওজন মেপেই ওরা মূল্য নির্ধারণ করে। চিংড়ি পিৎজা বরাবরই পছন্দ আমার, সাথে লেটুশ পাতা কুঁচি করে কেটে দেয়, সাথে মেয়নেজ , দারুন লাগে খেতে। দোকান থেকে বের হয়ে পাশের লাইব্রেরীর দোকানে একটু ঢু মারি। কাগজ কলম কিনবো। এখানের ডায়েরি আমার তেমন পছন্দ হয় না, নানা ধরণের এ দেশীয় ছবি আর এড দিয়ে ভরা যে কয়েকটা ডায়েরি দেখেছি। একটা খাতা কিনলাম আর কলম। ছোট ছোট শো পিসের মতো কিছু শার্পনার দেখলাম, ডিজাইন করা কিছু পেন্সিল, ফেইরি টেলসের বই, স্টিকার, ম্যাগাজিন দিয়ে দোকানটা ভর্তি। আচ্ছা ঝোঁকের মাথায় খাতা কলম কিনলাম না তো ! নিজের মনের কথা কাউকে বলা তো নিরাপদ মনে হয় না আমার কাছে। ভয় লাগে, কাকে কখন কী বলে ফেঁসে যাই। তবে এখানে মিশিই বা কার সাথে ! একমাত্র শবনম ছাড়া আর কারো সাথে তো অমন ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশাই হয় না, কিন্তু তাই বলে কী শবনমকে সব বলতে পারি ! কী যে চমৎকার শবনমের দাম্পত্য জীবন, সেখানে আমার এই বর্তমানের মানসিক পীড়ন ওকে প্রচণ্ড ভাবে আঘাত করবে, ব্যথিত হবে ও, এমনকি রেজাকে সরাসরি চার্জ করে একটা হুলুস্থুল কাণ্ডও ঘটাতে পারে। ওর জন্য অসম্ভব কিছু না।
বৃষ্টি শেষে আবার গা চিড়চিড়ে ধরণের একটা রোদ উঠেছে। চোখ ব্যথা করছে। সানগ্লাসটা ব্যাগে আছে কিনা মনে করতে পারছি না। ছাতাটা খুলে হাঁটতে থাকি ধীরে ধীরে বাসার দিকে। কোলাহলের জায়গাটা যেখানে বাঙালিদের সমাগমটা বেশি, ঐ জায়গাটা এড়িয়ে একটা নিরিবিলি বিকল্প পথ ধরি বাসায় ফেরার জন্য। ঐ রাস্তাটা আমার খুব ভালো লাগে। এমন না যে ওখানে প্রাকৃতিক শোভা বেশি কিংবা খুব সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর বিশেষ করে নতুন মডেলের বাড়ি ঘর আছে, সেটা নয়। আর এখানে প্রথম প্রথম এসে আমার সব জায়গা, মানুষজনের চেহারা একই রকম লাগতো। আমি ভাবতাম ইউরোপ মানেই আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি ঘর, ঝকঝকে চকচকে রাস্তাঘাট। মজার ব্যাপার রাস্তার পাশের পীত বর্ণের বড় বড় ডাস্টবিন দেখে আমি তো ভেবেছিলাম এগুলো বুঝি পোস্ট বক্স। এখন ভেবেই হাসি পাচ্ছে। পোস্ট বক্স গুলো ছোট ছোট , লাল রঙের বক্স, দেয়ালে ঝোলানো থাকে আবার চাইলে পোস্ট অফিসে গিয়েও টোকেন নিয়ে চিঠি বা জরুরী জিনিস পোস্ট করা যায়। এই রাস্তাটা এতো নিরিবিলি হবার কারণ সম্ভবত মূল সড়ক থেকে এটা কিছুটা ভেতরের দিকে। এখানে বড়সড় একটা গ্যারেজ ছাড়া আর তেমন কিছু নেই শব্দ উৎপাদন করার মতো। দুপুরের ঝিম ধরা রোদে মনে হয় পুরো এলাকাই হাঁপাচ্ছে, ঘাপটি মেরে ছায়া ছায়া জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছে মানুষ গুলো। রোদ পড়ে এলেই আস্তে আস্তে বের হবে সবাই বৈকালিক বা সান্ধ্যভ্রমণে। ঘেউ ঘেউ করে একটা কুকুর ডাকছে কোনো এক বাসার বারান্দা থেকে। অনেকেই আছে নিজের পোষা কুকুর বারান্দায় বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখে সময়ে সময়ে, হয়তো বিকেলে নিয়ে বের হবে বাইরে। ইউরোপিয়ানদের কুকুর প্রীতি একেবারে দেখা মতো। আলাদা ঘর, কুকুরের হাসপাতাল , আলাদা পারসোনাল ডাক্তার, তাদের জন্য সুপারশপে আলাদা একটা অংশই আছে খাবারদাবারের। কুকুরের ডাকটা ঝিম ধরা দুপুরকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে এমন লাগছে। আমি আমাদের বাসার প্রায় কাছাকাছিই চলে এসেছি, ট্রেন যাওয়ার সেই ব্রিজটার কাছে। এখানে ট্রেন লাইনের পাশে বেশ বড় বড় ঘাস গজিয়ে একটা গ্রাম্য আবহ তৈরি করেছে। ট্রেনের ব্রিজটা রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচুতে। ওখান থেকে এই দিনের বেলাতেও কেমন একটা টি টি টি করা ডাক আসছে। র্যাকেট- টেইলড পাখির আওয়াজের মতো তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ । হঠাৎ করে শুনলে কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়, মনে হয় শত শত কাঁচের প্লেট- জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজ হচ্ছে। কানে অনেকক্ষণ লেগে থাকে এ আওয়াজের রেশ। উফফ বাসার সামনের এই উঁচু জায়গাটা পার হবার সময় আমার হাঁফ ধরে যায় ভীষণ, ক্লান্তি লাগে। মাথাটা এমনিতেই বন বন করে ঘুরছে, নাক মুখ দিয়ে গরম হলকা বের হচ্ছে।
গেট খুলে বিল্ডিং কম্পাঊন্ডে ঢুকে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াই। লিফট দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত। দরজা খুলে যে বের হলো তাকে দেখার জন্য এ মুহূর্তে প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের বিল্ডিং এর দুই তলার বারান্দায় দেখা সেই ছেলেটা। মুখে খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি, এলোমেলো চুল আর এক জোড়া বিষণ্ণ চোখ। আমাকে দেখে একটা হাসি হাসি ভঙ্গী করলো কিন্তু পুরোপুরি হাসি বলা যায় না। জানতে চাইলো - তুমি অসুস্থ নাকি ? আমি মুখে কোনও শব্দ করলাম না, মাথা দু দিকে নাড়িয়ে বোঝালাম আমি ঠিক আছি। এই প্রথম এই ছেলেটার সাথে আমার কথা। একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। দেখলাম ছেলেটা লেটার বক্স চেক করে দুইটা চিঠি ঢুকিয়ে নিলো পকেটে। আমাদের লেটার বক্সের চাবি আমার কাছে থাকে না আর এখানে চিঠি পাঠাবার কেউ নেইও। আমিও লেটার বক্সে একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম, গ্লাসের বাইরে দিয়ে দেখলাম একটা চিঠি এসেছে, হয়তো গ্যাস বা অন্য কোনও বিল হবে। সব ফ্ল্যাটের জন্যই একটা করে লেটার বক্স আছে সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো দেয়ালের গা সেঁটে নিচ তলায়, যেখান থেকে আমরা লিফটে উঠি। ছেলেটা চলে যেতে গিয়েও একটু থমকে দাঁড়ালো। আমি ওর দিকে তাকালে আমাকে জানালো - আমি নিনো। তুমি ?
- আমি নুহা। এই বিল্ডিং এর চার তলায় থাকি। আমার কথা শুনে ছেলেটা মিটিমিটি হাসে। আমার অস্বস্তি হতে থাকে ওর হাসি দেখে।
- জানি তো! তুমি এশিয়ান?
আমি মাথা নাড়াই।
- হাহাহা , তুমি কথা কম বলো ?
আমি হেসে ফেলি ওর কথা শুনে। আমি ভীষণ অপ্রস্তুতবোধ করছি এভাবে হঠাৎ করে ওর সাথে কথা হয়ে যাবে, ভাবিনি।
- আচ্ছা নুহা, আজকে আসি তাহলে। আবার দেখা হবে। কথাও।
- চাও নিনো।
আমাকে কী খুবই অসুস্থ দেখাচ্ছে আজকে, দুইজন জিজ্ঞেস করলো আজ। ঘরে ঢুকেই ফ্ল্যাটে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াই নিজেকে দেখার জন্য। চোখ দুইটা ফোলা ফোলা, লালচে আর এলোমেলো চুলে পুরো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। দেখাক গে। বাইরের জামাকাপড় ছাড়া দরকার, সেই সাথে শাওয়ার নেয়াও জরুরী। বাইরে থেকে আসার পরেও শাওয়ার না নিলে আমার কেমন যেন লাগে। ঘরে তো কোনও ওষুধও নেই, হু হু করে মনে হয় জ্বর বাড়ছে, গা কেঁপে কেঁপে উঠছে, শীত শীত লাগছে। এখানে জ্বর ঠাণ্ডা লাগলো আর ফার্মেসি থেকে চট করে ওষুধ কিনে আনলাম সেরকম নয়। প্রেসক্রিপসন ছাড়া সব ওষুধ আবার ফার্মেসি থেকে এভেইলেবল দেয়া হয় না আর কিনতে হলেও অনেক টাকা লাগে। কিন্তু ডাক্তারের প্রেসক্রাইবড ওষুধ হলে অনেক অল্প দামেই পাওয়া যায়। জ্বর আসুক বা নিউমোনিয়া বাঁধুক কোনো ব্যাপার না আমার জন্য, এখন ঘুম দরকার। কপালের দুপাশের রগ টিপটিপ করে লাফাচ্ছে মনে হয়,ব্যথা হচ্ছে। আলমারি থেকে একটা পাতলা চাদর বের করে নেই। হাড়ে হাড়ে মনে হয় শীত ঢুকে গেছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেই, অন্ধকার অন্ধকার হয়ে এলে চোখে একটু আরাম লাগতে থাকে। উফফ আবার মোবাইলটা বাজছে। হাতে নিয়ে দেখি রেজার নাম্বার। ওর লাইনটা বেজে বেজে কেটে যাবার পর আমি মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রাখি। একটা বিতৃষ্ণা কাজ করছে ওর নাম্বারটা দেখে। রাতে বাসায় ফিরলেই ও আমার সাথে কথা বলার একটা বাহানা তৈরি করবে ভালো করেই জানি। এরকম দু নৌকায় পা দিয়ে ভোগ বিলাসিতায় জীবন কাটানো রেজা বা ওর মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব হলেও আমার জন্য সম্ভব না। চাইলেই আমি চট করে বাসা ছেড়ে চলে যেতে পারি না বা বাংলাদেশেও চলে যেতে পারি না। আমাকে স্ট্রাগল করতে হবে, পায়ের নিচে একটা মাটির নাগাল পেতে হবে। হাহহাহা পাথরের দেশে মাটি খুঁজছ তাও আবার রেজার খেয়ে পড়ে ! অবাক করলে নুহা ! হাহহাহহা !
আমি ধমকে উঠি, আবার এসেছ তুমি ? যাও বলছি, মাথায় এমনিতেই যন্ত্রণা হচ্ছে, আর যন্ত্রণা বাড়িও না। আমাকে সে বিয়ে করেছে, এখানে এনেছে, সুতরাং আমার খাওয়া পড়ার দায়িত্বও ওকে নিতে হবে। নিজেকেই নিজে শোনাই আমি।
- আরে বোকা মেয়ে, তুমিও যা ইচ্ছে হয় তাই এমন একটা জীবন বেছে নাও না। সারাদিন একলাই তো থাকো, নিজের মতো করে একটা সঙ্গী খুঁজে নাও না, রেজা যেমন নিয়েছে। হাতের সামনেই আছে এমন মানুষ, শুধু চোখটা খুলে দেখো।
- নুহা !!! চুপ করবে ? আমি চিৎকার করে উঠি শূন্য ঘরে। আমি কেঁদে উঠতে গিয়েও সামলে নেই। আমাকে এমন দিকভ্রষ্ট করতে চায় কেন আমার আরেকটা সত্ত্বা ! তার মানে কী আমার মনের মাঝেও এমন কোনও গোপন আকাঙ্ক্ষা ঘাপটি মেরে ছিলো নাকি রেজার উপরে রাগে, জেদে এমনটা হচ্ছে ! আমি বুঝি না, কিচ্ছু বুঝতে পারি না। মা মনে হয় ঠিকই বলে, আমি ইদানিং নামাজ পড়ি না। আমাকে শয়তান ধোঁকা দিচ্ছে।
- হাহাহহাহা নুহা, তুমি আবার শয়তান ফেরেশতা, পাপ - পুণ্য নিয়ে কবে থেকে মাথা ঘামাও?
আমি নুহার ধোঁকাবাজি কথা আর হাহাহা হাসি আর শুনতে চাই না, কানে মাথায় আরেকটা বালিশ চেপে ধরি। আমার কানে নুহার সেই ভয় ধরানো হাসির প্রতিধ্বনি হতেই থাকে, হতেই থাকি। আমি আরও জোরে চেপে ধরি বালিশটা আমার মুখের উপর। ভালোই তো, আমার আর কিছু করতে হলো না, নিজেই নিজেকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ফেলছ, ভালো ভালো, খুব ভালো করছ নুহা। এ কথায় আমার খেয়াল হয়, আসলেই তো আমি কী করছি এটা ! আমার তো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমি বালিশটা আমার মুখের উপর থেকে সরাই। উঠে গিয়ে টেবিল ফ্যানটা ছেড়ে দেই। কেমন ঘেমে গেছে আমার কপাল, গলা ! পানি পিপাসা হচ্ছে। সাইড টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে এক চুমুক পানি খাই। আমি খাটের মাঝ বরাবর গিয়ে শুয়ে পড়ি, বালিশ ছাড়া। মনে হয় আমার শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। কী কথা বলার জন্য , কাকে বলার জন্য যেন আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমার একটু কথা বলার দরকার। কার সাথে আমার কথা শেয়ার করবো জানি না। আমার চোখ জ্বালা করছে, পানি গড়িয়ে পড়ছে। শরীরটা কিছুক্ষণ পর পর হালকা কেঁপে উঠছে, জ্বরের জন্য নাকি কান্না চেপে রাখার জন্য জানি না। হিহিহিহিহিহিহি ... হিহিহিহিহিহি ! একটা প্রেত হাসির আওয়াজ ঘরময় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নুহা ! যাও বলছি এখান থেকে। ওর যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায় না। হাসতে হাসতে বলে-
- দুঃখের কাহিনী লিখে রাখবে বলেই তো কাগজ কলম কিনে আনলে। বিছানা বালিশ না ভিজিয়ে দুই কলম লিখে ফেলো না যন্ত্রণার কথা ! বোকা মেয়ে !
মাথার ভেতর সারাক্ষণ একজন কথা বলতে থাকলে আমি মনে হয় পাগলই হয়ে যাবো। ইচ্ছে করে নিজের মাথা নিজেই বাড়ি মেরে গুড়িয়ে দেই। মাথার মাঝে বিজবিজ করে প্রতিনিয়তই কথার আওয়াজ আসা, কানে যখন তখন হাসির শব্দ ভেসে আসা - আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটেই। কিসের যেন এক ঘূর্ণি চলছে মাথায়। এরকম ঘূর্ণি নিয়ে যেন কী একটা বই পড়েছিলাম, নামটা যেন কী ! উমমম সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বই ! নামটা যেন কী ! উফফ সময়মত কিচ্ছু মনে পড়ে না। চোখ বন্ধ করে স্মৃতির অতলে ডুব দেই, খুঁজে আনতে হবে নামটা যে করেই হোক। ইয়েসসস মনে পড়েছে - বইয়ের নাম - নীল ঘূর্ণি। আমার তো একটু ঘুমানো দরকার। আল্লাহ আমার চোখে একটু ঘুম দাও, সারা শরীর কী এক অসহ্য ছটফটানিতে ছিঁড়ে পড়ছে কিন্তু ঘুম কেন আসছে না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানার মাঝ থেকে সাইড টেবিলের কাছে যাই, ওখানেই খাতা কলম রাখা আছে। বালিশটা বুকের নিচে রেখে উপুড় হয়ে শুই। কলমটা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকি আমার যন্ত্রণার কোন রঙটা খাতায় আঁকবো, কোন রঙের সাথ একন রঙ মেশাবো। আমার ভাবনারা দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে যায়। আমি কোনও রঙ খুঁজে পাই না আঁকার মতো, আমার তুলিতে কিছু আসে না। মাথায় ঘুরছে বনবন করে একটাই গানের লাইন, আঙুরবালার গান -
" আমি আপন আর পর সবারে চিনেছি, হৃদয়ের বীণা ভাঙিয়া ফেলেছি "
আমি না দেখা সেই আঙুরবালার দুঃখবেদনায় আক্রান্ত হই, শূন্যের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে তার চোখের কোলটা মুছে দিতে চাই। আহা আঙুরবালা !
চলবে