বেশীরভাগ দিনই সকালের শুরুটা হয় থমথমে ভাব নিয়ে।আকাশটা থমথমে ধূসর ভাব নিয়ে, গাছের পাতা থমথমে বাতাসহীন হয়ে, পাড়াটাও একেবারে থমথমে কোলাহল শূন্যতায় ভুগে ভুগে আর এসব নিয়ে আমিও থমথমে হয়ে থাকি।ঐ যে ভূপেন হাজারিকার গানটার মতো -
মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই
জল থৈ থৈ করে কিছু নেই নেই
ভাঙ্গনের যে নেই পারাপার
তুমি আমি সব একাকার।।
যদিও শেষ লাইনটা আমার জন্য নয়। তবুও ভাবতে ভালো লাগে " কেউ আর আমি মিলে মিশে একাকার হচ্ছি"! অর্থহীন প্রলাপ যত!
বলা যায় বিশ্রীভাবেই শুরু হয় কোনো কোনো সকাল, যা একেবারে রাত অবধি গড়ায়। সেদিনগুলোতে আমি চুপচাপ একেবারে নিজের ভেতর ঢুকে পড়ি। জানালা দিয়ে চোখ দুটো জাগিয়ে এক ঠায় বৃষ্টি ঝরা দেখি। বৃষ্টি না ঝরলেও যে বৃষ্টি ঝরা দেখা যায় কী করে শিখেছিলাম সে আর এখন মনে নেই। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে ছুঁই। কখনো কখনো বৃষ্টি কোনও অবয়বে এসে সামনে দাঁড়ায়। হয়ে ওঠে জীবন্ত। জীবন্ত বৃষ্টি! কী অদ্ভুত! সে সময়টায় শরীর জুড়ে বয়ে যায় বৈদ্যুতিক প্রবাহ। কখনো মৃদু বা তীব্র, এক ঝিমঝিমে আবেশ। আমি তখন দেখতে থাকি একেকটা সুদীর্ঘ সকাল, একটা মন্থর দিন কিংবা অন্ধকারের জঠরে ঘাপটি মেরে থাকা নৈঃশব্দ্যের টালমাটাল রাত, বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া প্রগাঢ় কোনো সুখ স্মৃতি।
কোনো কোনো দুপুরে অসময়ের ঘুম ভেঙে দেখি দিনের আলো সন্ধ্যায় গড়িয়েছে। আর সন্ধ্যের দিকে তাকালেই প্রথম যে কথাটা মনে হয় - আজকের সন্ধ্যেটা কেমন হাহাকারময়। যখন আরও ছোট ছিলাম, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রেখেছি, ঐ হাহাকাময় সন্ধ্যেগুলোর সাথে তখন নতুন নতুন পরিচয়। অবশ্য তারুন্য বা কৈশোর, যৌবনের সংজ্ঞা ফ্রেমে আটকে থাকার নয় বা বয়সের সীমারেখায় চিহ্নিত করারও নয়। অচেনা অনুভব, ভীষণ রহস্যময় এক বয়স, অস্থির আমি, টালমাটাল ঘুড়ির মতো। কি জানি পেতে ইচ্ছে করে, বুকের কাছটায় চেপে ধরতে ইচ্ছে দৃশ্যমান কিন্তু আবছা কোনও মূর্তি শূন্যতা দূর করতে। কিন্তু সে বয়সের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পেরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় যেন থেমে পড়তে হয়। আর তখনই দ্বিধা- দ্বন্দ্বেরা পূর্ণ যৌবনবতী স্রোতের মতো খলবলে হাসিতে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে একটা বোধ বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে যায়, নীল-বেগুনি রঙে লিখে রেখে যায় আজকের পর থেকে আমার প্রতিটা সন্ধ্যেই হবে হাহাকারময়। পরাজয় নামক শব্দের সাথে পরিচয় হয় সে বয়সে!
আমি যদিও এতো সহজে কাবু হই না কিন্তু কোনো কোনো সন্ধ্যায় আমি ছাইরঙা মেঘ নিয়ে হাঁটতে থাকি, গলে পড়তে, ঝেড়ে ফেলতে সমস্ত ক্লেদ। তখন আরও কোনও বুকচেরা বাঁশীর সুর শুনতে ইচ্ছে করে। জানি এরকম নাম না জানা আরও অনেক অনেক মানুষ আছে যারা তাদের বুকেও কোনো হাহাকারময় সঙ্গীত লুকিয়ে রেখেছে যা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। সেই সব মন্থর আঁধার রাতগুলোতে আমি আমার কথা ভাবি, আমার ফাঁকা জীবনের কথা ভাবি। কোথায় যেন শুনেছিলাম দেখার মতো চোখ নিয়ে তাকালেই, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় রাংতায় মোড়ানো সুখী হবার সব উপকরণ, ট্যাবলেট আর টনিক। দাম তাদের আকাশছোঁয়া, তাই কেনার সামর্থ্য আমার নেই। আবছা ফুঁয়ে সে সময় তাই উড়িয়ে দিতে হয় একটা নিঃশ্বাস - " তবুও কোনো কোনো দিন তোমায় নিয়ে ঘরে ফিরি।"
যে পথ আমাকে কোথাও নিয়ে যায় না শেষ পর্যন্ত, তবুও কেন সে পথে আমার পা বাড়ানো! বুঝি না কেন সে অমোঘ আকর্ষণ। কেউ কেউ আছে তারা তাদের জীবনের শুরুতেই কারো কারো সাথে কোনো নামহীন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, সে সম্পর্কের দায় বয়ে বেড়ায় আমৃত্যু। একটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু নামহীন সম্পর্ককে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ, তাই না? আমি কী কখনো এমন নামহীন সম্পর্ক বয়ে বেড়িয়েছি, কাউকে কথা দিয়েছিলাম? দিলেও হয়তো সেটা ভুলে গেছি। এরকম বেকার দিনগুলোতেই যতসব এলোমেলো নেই নেই ভাবনা, কথারা ছুটোছুটি করতে থাকে মনের অলিন্দে অলিন্দে। সেই কবে ডায়েরিতে কীসের এক অভিমানে লিখে রেখেছিলাম -
" আমার ইদানীং বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বস্তা বস্তা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমার গভীর চেতনাহীন ঘুম দিতে ইচ্ছে করে প্রায়শই। মারা গেলে কেমন হবে? পরিবারের কেউ কি মন খারাপ করবে? আমার বিছানা, পাশের জানালাটা? পাশের বাড়ির কৃষ্ণচূড়া গাছটা? শুনেছি গাছটা কাটিয়ে ফেলবে, ওখানে নাকি জ্বীনের আছর হয়েছে। হাহাহহা। আচ্ছা, আমার নিজের আমিটার জন্য কী আমার কষ্ট হবে না, যদি আমি মারা যাই? আমি ছাড়া আমার আর কে আছে? কেউ না! কেউ না!!!"
আমি এখন তাই আগুনের জন্য প্রার্থনা করি, প্রার্থনা করি তুমুল ঝড়ের, বনে বনে দাবানল জ্বলে উঠবার জন্য। জীবনের পায়ে পায়ে ঘোরা পঙ্গু নথিমালা হয়তো নিভৃতে জ্বালিয়ে দেবো কোনো গোপন উল্লাসে। পৃথিবীবাসি হয়তো ভেবে নেবে বিষাদহ্রদে জ্বলতে থাকা টিমটিমে লন্ঠনের নিচে কেউ শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু কেউ জানবে না আমি তখনও জাগ্রত।
কী নিবিড় বৃষ্টির দিন আজ! আকাশে মাদল বাজছে থেকে থেকে। তার গভীর কৃষ্ণ চোখের মায়াডাক আমি আর উপেক্ষা করতে পারছি না। এখনই আমাকে ছুটতে হবে...