১।
সাব্বির বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরেই চেস্টা করছে সামনের ভিউ থেকে থিমেটিক কিছু খুঁজে বের করতে। এজন্য বারান্দার এমাথা ওমাথায়ও কয়েকবার চক্কর দিয়েছে।কিন্তু কুয়াশা ঘেরা একটা সকালের বাইরে আর কিছুই এর মাঝে খুঁজে পেলো না। শহরের হাইরাইজ বিল্ডিং এর ফাঁকে ফাঁকে আদৌ কোনো সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে কিনা তাও ভাববার মত বিষয়। আজ অনেকদিন পর সাব্বিরের একটু লেখার মুড এসেছিলো মানে গতকাল রাতে। রাতে ঘুম ভাঙার পর থেকেই ভেতরটা ছটফট করছিল কিছু লেখার জন্য। একাকী কামরার নির্জনতা নিয়ে এর আগেও দুইটা লেখা ও লিখেছিল।একটা গল্প আরেকটা মুক্তগদ্যের ঢঙে। এটা মনে পড়াতে ও তাই ভাবছিলো এখন যেহেতু শীতকাল তাহলে শীত বা কুয়াশাচ্ছন্ন থীম নিয়ে কোনো কিছু লিখবে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে, জানালার কাঁচে কুয়াশার উপর সূর্যের আলোর চিকচিক করে ওঠা দেখে কোনো ব্যক্তির মাঝে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জেগে উঠেছে এইরকম টাইপ কিছুর চিন্তা এসেছিলো। যদিও পাবলিক এতো ম্যারম্যারে লেখা খাবে না কিন্তু কিছু একটা লিখে হাতের আড় ভাঙাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর জন্য। লিখবে কোত্থেকে শালার সূর্যই তো উঠে নাই।ধুর আর এদিকে রাতটাও নির্ঘুম গেলো। ফাহিম যদিও বলে -
বন্ধু তুমি লেখক হয়ে এমন ধরণের গালাগালি কর,সেটা কি ঠিক ?
ক্যানরে ভাই আমি লেখক দেইখা কি মানুষ না? আর শালা কোনো গালির পর্যায়ে পড়ে কে বলছে তোমারে ?
পাবলিক কোন লেখা খায় আর কোন লেখা খায় না এসব নিয়ে বিস্তর তর্ক করেছিলো একবার ফাহিমের সাথে। ফাহিম ওর লেখক বন্ধু। পরিচয়টা ব্লগ থেকে ফেসবুক হয়ে ব্যক্তিজীবন পর্যন্তই গড়িয়েছে। সাব্বিরের লেখালেখির শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও এখন ও ট্র্যাক বদলেছে। গল্প না কবিতা না প্রবন্ধ কোনটায় লেখক পরিচিতি বাড়ে এ নিয়েও ওদের দুজনের মাঝে প্রায়ই তর্ক হয়। সেবার তো সাব্বিরের কথা শুনে ফাহিম কয়েকদিন কথাও বলেনি ওর সাথে। সাব্বির যখন বলেছিলো -
আরে মিয়া বাংলাদেশে কি কবির অভাব আছে? ঘাটে ঘাটে কবিদের আনাগোনা। ব্লগগুলা ঘুইরা দেখছ ? মিনিটে মিনিটে কবিতা প্রসব করতাছে। দুই লাইন ফুল, লতা আর নারী নিয়া লেখলেই কবি হওন যায় ? সাব্বিরের কথা শুনে ফাহিমের চেহারাটা কেমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলো।
তোমার কি মনে হয় কবিতা লেখা খুব সহজ ব্যাপার? তুমিও তো লিখছ কবিতা কিন্তু তুমি কি তৃপ্ত হচ্ছো? ফাহিমের কথা শুনলে গা জ্বলে যায়। ব্যাটা বেশি আঁতেল আর জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ধরে কথা বলে। কিন্তু এ কথাও ঠিক কবিতা লেখা সহজ কাজ না। কিন্তু সে কথা স্বীকার করলে তো আর মানসম্মান থাকে না। তাই অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই সাব্বির উত্তর দিয়েছিলো -
ধুর ধুর আমি চাইলেই পারি অমন অনেক কবিতা লিখতে। কিন্তু আমার আসলে কবি হবার ইচ্ছাই নাই। আর বাংলাদেশে অনেক অ-কবি ,কবির ছড়াছড়ি। ভাবতেছি গল্পকার হইয়া যাবো। কি বলো তুমি ?
সে তোমার যা ইচ্ছা হও কিন্তু এটা মনে রেখো কবিরা কিন্তু চাইলে ভালো গল্পকারও হতে পারে। তুমি চ্যালেঞ্জ করলে তোমাকে গল্প লিখেও দেখাতে পারি।
না চ্যালেঞ্জ করতেছি না কিন্তু দরকার কি গণহারে কবিদের স্রোতে গা ভাসানের? তুমিও গল্পকার হইয়া যাও। লাইনে আসো। ফাহিমকে যখন এ কথাটা ও বলেছিলো তখন সরল মনেই বলেছিলো কিন্তু সত্যি সত্যি যখন ফাহিম গল্প লেখা শুরু করলো, সাব্বিরের মনে খুব সূক্ষ্মভাবে একটা ঈর্ষার ব্যাপার কাজ করতে শুরু করে। শুধু তাই না ফাহিমের সাথে ও আগে প্রায়ই বিভিন্ন গল্পের প্লট নিয়েও আলোচনা করতো কিন্তু সেসব নিয়ে যখন ফাহিম লেখা শুরু করলো রীতিমতো সাব্বিরের মাথা রাগে দপদপিয়ে ওঠে। আকার ইঙ্গিতে ফাহিমকে কয়েকবার অন্যদের রেফারেন্সে বলেছেও থীম চুরি নিয়ে ফেসবুকে বা ব্লগে বিভিন্ন গ্রুপের দলাদলি বা সিন্ডিকেটের ঘটনা। কিন্তু ব্যাটা বহুত পিছলা। সাব্বিরের কথা শুনে উত্তর দিয়েছে -
একই থীম নিয়ে তুমি চারজনকে লিখতে দাও। দেখবে চার ধরণের লেখা প্রোডাক্ট করেছে তারা। সে হিসাবে তুমি কাউকেই পুরোপুরি থীম চুরির দায়ে অভিযুক্ত করতে পারো না বন্ধু।
তাই বলে ফাহিম সাব্বিরের বলা গল্পের প্লটগুলো নিয়ে এভাবে গল্প সাজিয়ে লিখে ফেলবে এটা ও মেনে নিতে পারে না। অবশ্য গল্প গুলো অনেকদিন আলোর মুখ দেখেনি, দেখার সম্ভাবনাও ছিলো না। কিন্তু তাই বলে ও সেগুলো কেন লিখবে এ অভিযোগও ফাহিমকে করতে পারে না বলে ওর ভেতরটা চোরা দহনে ওকে দগ্ধ করতে থাকে। তাই ফাহিমের লেখা ভালো হলেও সাব্বির যেন অনেকটা ইচ্ছে করেই বলে -
ধুর মিয়া কি লিখছো এইটা ? আমার থীম নিয়া লেখছো একবার আমারে জিগাইয়া নিবানা আমি এইটার ফিনিশিং নিয়া কি ভাবছিলাম? ভালো মতো ভাইব্যা লেখো। এমনে লেখলে পাবলিক কিন্তু তোমার লেখা খাইবো না আগেই কইলাম।
তোমার আর আমার ফিনিশিং যে একরকম হবে না এটা তো বোঝাই যায়। আমি পাবলিককে খাওয়াবার জন্য লিখি না আগেও বলেছি। আমি আমার নিজের আনন্দের জন্য লিখি। আমি সস্তা বাজারি লেখক হতে চাই না, অনেকদিন পাঠকের মনের মধ্যে থাকতে চাই।
ফাহিমের কথা শুনলে সাব্বিরের ইচ্ছ করে শালার ঘাড়ে দুইটা ঘা লাগাতে। শালা একটা বাটপার। ওর ইচ্ছে করে বলতে - তোর যদি বাজারি লেখক হইতে মনে নাইই চায় তাইলে তুই পত্রিকা, লিটল ম্যাগগুলিতে লেখা পাঠাস ক্যান? ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে অইগুলিরে পাবলিক কইরা রাখস ক্যান? অনলি মী দিয়া রাখ। শালার মুখে একটা আর কামে প্রকাশ করে আরেকটা। বাটপার কোনহাঙ্কার। কিন্তু সেসব আর ওর বলা হয়ে ওঠে না।
শোনো বন্ধু, তোমার লেখা গল্প পড়লে ক্যান জানি মনে হয় তুমি কবিতাই লিখতাছ। পুরা গল্প জুইরা ভালোবাসার প্যানপ্যানানি। এর চেয়ে ভালো তুমি কবিতাই লেখো। তোমার অরিজিন ওইটাই।
ভালোবাসার গল্প বা কবিতা আমি তেমন লিখিনি সাব্বির।
ওই হইলো আর কি। লেখা জুইড়া যদি দুঃখ কষ্ট আর অভিমানের ছড়াছড়ি থাকে ওই লেখা তো পোতাইয়া গেলো, বুঝলা না? মানুষের জীবনে এমনেই অনেক ঝুটঝামেলা লাইগ্যা থাকে। মানুষ চায় অ্যাকশন, একটু অন্যরকম লেখা।
ওর কথা শুনে ফাহিম হাসে। ওর হাসিতে তাচ্ছিল্য লেগে আছে এমন মনে হয় সাব্বিরের। ও বলে -
অ্যাকশন আর অন্যরকমের জন্য বুঝি গালাগালি করে লেখা লিখতে হবে, সাইকোপ্যাথিক লেখা লিখতে হবে আর অশ্লীলতা ঢুকাতে হবে, এমনটাই বলতে চাও? এসব আমিও পারি লিখতে। ইচ্ছে হয় না বলে লিখি না। নিজস্ব একটা ট্র্যান্ড আনতে চাই লেখায়। বরং এক কাজ করো। তুমি জাস্ট চার লাইন একটা কবিতা লিখে দেখাও আমাকে।
কি ভালোবাসার কবিতা? অনেকটা ঠেস মেরেই সাব্বির জিজ্ঞেস করে।
ভালোবাসা, যুদ্ধ, সেক্স যা ইচ্ছা লেখো। তোমার জন্য ওপেন ফিল্ড দিলাম।
হাহ্ কবিতা লেখা ব্যাপার না। ওকে লিখা দেখাবো নে তোমারে। বিশ পঞ্চাশটা কবিতা পড়লে চার/পাঁচটা কবিতা লেখা ব্যাপার নাকি! মনে মনে এসব ভাবলেও সাব্বির কবিতা লিখতে বেশি সময় নেয়নি। বিছানায় যাওয়ার আগে কয়েকটা বই নিয়ে চোখ বুলালে তো এমনিতেই কবিতা লেখার ভাব আসে। একবার ভেবেছিলো অনেকদিন কোনো কবিতার বই কেনা হয় না, আজিজ মার্কেটে গিয়ে ঢুঁ মারার চিন্তাও করেছিলো। কিন্তু ফাহিমের চ্যালেঞ্জের জন্য রিকশা ভাড়া আর টাকা খরচ করে বই কেনার চিন্তা উড়িয়ে দিয়ে অনলাইনের বিভিন্ন কবিতার পেইজ থেকে কিছু আনকমন কবিতা বেছে প্রিন্ট করে দুই একবার চোখ বুলিয়েছিলো। আজকাল কি সব যে কবিতা পোলাপান লেখে! পড়লে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অনেক ভেবেচিন্তে ও কয়েক লাইন কবিতা লিখেও ফেলে -
স্তব্ধ রজনী জানে নিদ্রাবিহীন রাতের নিদারুণ আর্তি,
তামসে জোনাকির আক্ষেপ!
তাই কোনো সান্ত্বনা নয়, সান্ত্বনা নয় - বরং
তোমার–আমার প্রার্থনায় বাজুক অজস্র সুরের বাজনা।
কিন্তু বাজনা শব্দটা ওকে ঠিক স্বস্তি দেয় না। উল্টো মাথায় ক্রমাগত ঢাক ঢোলের আওয়াজ তুলে ওকে অস্থির অবস্থায় ফেলে দেয়। এর বিকল্প কিছু ওর ভাবনায় আসে না বলে ও ঠিক করে ফাহিমকেও এমন এক টপিক দিবে যাতে ও সেটা লিখতে না পারে।
২।
আজকাল ফাহিমের মেজাজটা খুব খিচড়ে থাকে। সাব্বিরের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে এমন লাগাটা বেড়েছে। যে অফিসে কাজ করে সেখানে নিজের পারফর্মেন্সের কারণে টুপটাপ কয়টা প্রোমোশন পেয়ে নিজের এখন আলাদা একটা রুম থাকায় লেখালেখি নিয়ে চিন্তাভাবনার সময়ও খানিকটা পায়। এটা নিয়ে ওর বৌ সামিরা অবশ্য অবাকই হয়। আইটি সেক্টরের লোক হয়ে এতো সাহিত্যপ্রীতি কীভাবে সম্ভব তারউপর অফিসে বসে সাহিত্যচর্চা! যখন সাব্বিরের সাথে পরিচয় হয়েছিলো তখন বুঝতে পারেনি ছেলেটা ভেতরে ভেতরে এতো রাফ আর গোয়ার ধরণের। কিছু একটা আকর্ষণ সাব্বিরের চরিত্রে ঠিকই আছে যে কারণে এখনো ফাহিম সম্পর্কটা ওর সাথে ধরে রেখেছে কিন্তু মাঝে মাঝে ওই ছেলে এতো এক্সট্রিম লেভেলের মুখ খারাপ করে ইচ্ছে করে থাপড়িয়ে ওর নাক-নকশা বদলে দেয়। এক নাম্বারের গবেট একটা। ফাহিমের যে কোনো লেখা পড়লে অকারণেই সেসব নিয়ে তর্ক করা তো আছেই, কোনোদিন প্রশংসাও করতে চায় না। অবশ্য ফাহিম জোর করে যখন গল্প লেখিয়ের কাতারে নাম লেখালো তখন থেকেই সাব্বিরের এসব বদমায়েশির শুরু। ফাহিমও কম ঘাগু, আগে যেসব টপিক নিয়ে সাব্বির গল্প লিখতে গিয়ে আটকে যেতো কিংবা পরামর্শ করতো কোন টপিক নিয়ে লিখলে ভালো হয়, সাব্বিরকে শাস্তি দেয়ার জন্য ও নিজেই সেসব থীম নিয়ে অসামাপ্ত লেখাগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো। ফাহিম ঠিকই টের পায় সাব্বির ঈর্ষা করে এসব নিয়ে কিন্তু ভদ্রতার কারণে বলতে পারে না। ওর মনের না-বলা ভাব দেখে ফাহিম ভেতরে ভেতরে খুব আনন্দ বোধ করে।
কিন্তু ওই শালাটা পুরোই একটা খচ্চর মনে মনে ভাবে ফাহিম। গল্প লেখার শুরুর দিকে আগে প্রায়ই ফাহিমকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে এমন এমন সব টপিক দিত লেখার জন্য যে ওর পুরো মাথাই ফাঁকা হয়ে যেতো সেসব প্লট সাজাতে গিয়ে। এতো ফুটানি করে যেহেতু ও সাব্বিরকে বলেছিলো গল্প লেখা কোনো বিষয় না, তাই ওর চ্যালেঞ্জ রাখতে না পারলে একটা মানসম্মানের ব্যাপার। সারাক্ষণই ওর মাথায় অক্ষরেরা নাচানাচি করে। হারামজাদাটা কয়দিন আগে একটা থীম দিয়েছিলো -
মনে করো একটা গ্রামের গল্প এটা। একদিন সকালে উঠে গ্রামবাসী দেখলো যে ওই গ্রামে আর একটা গাছও নেই। গ্রামবাসীদের মনের বিস্ময় ভাবটা যেমন ফুটাইয়া তুলবা সেই সাথে কারা কারা এইসব কাজের সাথে যুক্ত এইসব নিয়া একটা গল্প লেখবা। খালি লেখার উদ্দেশ্যেই লেখবা বা বর্ণনা করতাছো ব্যাপারটা এমন জানি না হয়। প্রতিটা লাইনের সাথে সাথে পাঠক জানি সেইসব ভিজুয়ালাইজ করে অমন কইরা লেখবা, বুঝছো দোস্তো ?
এহ্ আমারে বুঝাইতে আসছে ভিজুয়ালাইজ নিয়া। ওর কাছে আমার শিখতে হবে এখন ভিজুয়ালাইজ কীভাবে করে! মনে মনে ফাহিম যতই তর্জন গর্জন করুকনা কেন ওর মাথায় কিন্তু সেই থীম ঘুরতেই থাকে একটা গ্রামের সব গাছ কেটে উজার করে ফেলা হয়েছে এবং ঘুরে ঘুরে সেই থীম ওর মাথায় উঁকি মেরে যায়। ও শহরে বড় হওয়া মানুষ, এই ধরণের থীম নিয়ে লেখা কি সহজ কাজ! ইচ্ছে করেই হারামিটা এমন থীম দিয়েছে যাতে ও লিখতে গিয়ে হিমশিম খায়। কিন্তু এতো সহজে ফাহিম হাল ছেড়ে দেয়ার মানুষ না। ওর শ্বশুর বাড়ির দিকের এক আত্মীয়র বাড়িতে এই কারণে ঘুরতেও গিয়েছিলো। জায়গাটা ঢাকা ছাড়িয়ে খুব বেশি দূরে না; নরসিংদীর মনোহরদীতে। এর আগে একবার বেড়াতে গিয়ে ভালোই গাছগাছালি চোখে পড়েছিলো সেখানে। শ্যালক সম্পর্কের একজনকে নিয়ে বিকেলে বাজারের দিকে ঘুরতেও বের হয়েছিলো। উদ্দেশ্য এখানের মানুষের জনের চিন্তাভাবনা কেমন সেসব জানা বা গল্পোছলে নিজের কাজটা সেরে নেয়া। একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বেশ আরাম করে চায়ের কাপে যেই না চুমুক দিয়েছে অমন সময় আরেকজন হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে ওর শ্যালককে জানালো -
জামিল ভাই, গন্ডগোল লাগছে। তাড়াতাড়ি বাড়িত যান। চরখিরাঠির মাইনসেরা দাও আর বল্লম নিয়া এনই আইতাছে।সাহেব বাড়ির বাগান দাও দিয়া কোবাইয়া কিছু রাখছে না চাই!
ঘটনা যেটুকু বোঝা গেলো দুই এলাকার মানুষজন ব্যক্তিগত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে বাড়ি ঘর, বাগান, গাছপালা কুপিয়েছে, দুই একটা লাশও ফেলেছে। যে এলাকার মানুষ গাছপালা নিজেরাই কেটে সাফ করে দিতে পারে সেখানে ওর গল্পের প্লটে গ্রামবাসীদের বিস্ময় যে ফুটে উঠবে না সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। পরে একটা মারমুখী গ্রাম্য অ্যাকশনের গল্প ও লিখেছিল এদিক সেদিক করে। চোরাকারবারিদের এক্টিভিটিস কেমন হতে পারে ব্লগে, পত্রিকায় সার্চ করে পড়ে নিয়ে তারপর একটা গল্প দাঁড় করাতে পেরেছিলো। কিন্তু চোখে দেখে লেখা এক জিনিষ আর না দেখে কল্পনা মিশিয়ে লিখা আরেক ব্যাপার। এই কথা শুনে জ্ঞানী মদনা সাব্বির বলেছিলো -
আরে মিয়া যেইটা কোনোদিন দেখো নাই সেইটা নিয়া লেখাটাই তো তোমার লেখক হিসাবে ক্রেডিট বইলা গণ্য হইবো। সব কিছু এতো দেইখা লেখতে চাও ক্যান? গল্প লেখন যে সোজা না বুঝতাছো এইবার?
হারামজাদাটার পাকামি কথা শুনলে থাপড়াতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ফাহিম উত্তর দিয়েছিলো -
যে ব্যাপারটা নিয়ে অভিজ্ঞতা আছে সেটা নিয়ে লিখলে লেখায় অনুভব গাঢ় হয়।
হ, এতো গাঢ় অনুভূতির দরকার নাই। পরে আঠা ছুটানো যাইবো না। বলে খ্যাক খ্যাক করে অশ্লীল ইঙ্গিত দেয়। মাঝে মাঝে এই ছেলেটা এতো বিশ্রী ভঙ্গীতে কথা বলে খুব বিরক্ত লাগে। কিন্তু শুরু থেকে এই পর্যন্ত ফাহিম সাব্বিরসহ লেখালেখির জগতে একটা ভদ্রতা বজায় রেখেই চলেছে। সাব্বিরের মন ভরা এতো হিংসার ব্যাপারটা টের ও আগেই পেয়েছিলো কিন্তু কনফার্ম হবার জন্য ও মাঝে মাঝে ওর লেখার খসরা ওকে দিয়ে বলেছে -
পড়ে দেখো তো দোস্তো। ভুল বা অসঙ্গতি চোখে পড়লে জানিও। ফাহিম জেনে বুঝেই মাঝে মাঝে ভুল লেখা দিয়েছে। কিন্তু সাব্বির ভুল ধরিয়ে দেয়া দূরের কথা ভালো মন্দ কিছুই বলেনি। সামনে বইমেলা আসছে। খুব মন দিয়ে লেখালেখি করতে হবে আর নতুন নতুন কিছু গল্প নামাতে হবে। মিনিমাম একটা ছয় বা আট ফর্মার বই বের এবার না করলেই না মনে মনে ভাবে ফাহিম। মোটামুটি কয়েকটা প্রকাশনিতে কথা বলে খোঁজ নিয়েছে কেমন খরচ পড়তে পারে। এর মাঝে " হলুদ ফুল লাল ফুল" প্রকাশনি থেকেই বই প্রকাশ করবে বলে ভেবেছে। ঝকঝকে প্রচ্ছদ না ম্যাট করাবে একবার ভেবেছিলো সাব্বিরের সাথে আলোচনা করবে কিন্তু বইমেলার প্রসঙ্গ আসাতে সাব্বির বলেছিলো -
এই যে সারি সারি লেখক,অ-লেখক দিয়া সাহিত্যের জগতটা ভইরা গেছে, টেকা হইলেই বই বাইর কইরা ফালায়। নিজের বাপ-দাদার নাম থুইয়া ছদ্ম নামে বই প্রকাশ করে। সবাই কি আর বনফুল, নীললোহিত হইতে পারে! হেহ্...
ফাহিমের মনে হয় কথাটা ওকে উদ্দেশ্য করেই সাব্বির যেন বললো। ফাহিম " তীরন্দাজ " এই ছদ্মনামে লেখে আর সে নাম নিয়ে বহুদিন সাব্বির ওকে শুনিয়েছে ওর নাম শুনলে কারো বোঝার উপায় নেই ও পুরুষ না মহিলা। লেখকের আবার পুরুষ মহিলা কি এটা বলাতেও সাব্বিরের যুক্তির অভাব নেই। বলে -
আরে মিয়া পুরুষ হইয়া তুমি যে লেখা লিখতে পারবা, নারী হইয়া কি পারবা অমন কইরা লিখতে? আমাগো দেশেই তো দেখো না নারীদের লেখা নিয়া কতো বদনাম, ফতোয়া আরো কতো কি!
নারীদের লেখার সীমাবদ্ধতা, স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি নিয়ে ফাহিমের ইচ্ছে হয়েছিলো সাব্বিরকে কিছু বলতে কিন্তু ওর এই সবজান্তা ভাবটার জন্য ও ইচ্ছে করেই এবারের বইমেলায় ওর বই প্রকাশের খবরটা সাব্বিরের কাছে চেপে যায়। ওর গল্পের বইয়ের নাম নিয়ে সাব্বিরের সাথে একটু আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো মনে হলেও নানা ভাবনায় আর সেটা হয়ে ওঠে না।
৩।
অনেকদিন পর দেখা হইলো দোস্তো, না ? বলো কেমন আছো ?
সাব্বিরের উষ্ণ সম্বোধনটা ফাহিমও উপভোগ করে। জিন্স আর ফতুয়ার উপর সাব্বির একটা কালো আর ধূসর রঙের চাদর জড়িয়েছে। জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখাতে ঠোঁটে ও সিগারেট চেপে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারছে না। এর মাঝে কয়েকবার সাব্বিরের গায়ের চাদরের দিকে চোখ পড়েছে। বুঝতে পারছে না একই চাদরে এক জায়গায় কালো আবার আরেক পিঠে ধূসর কেন। জিজ্ঞেস করলেই তো লেকচার ঝাড়বে। এর চেয়ে চারুকলার পাশ ঘেঁসে চুপচাপ হাঁটতেই ফাহিমের ভালো লাগছে। আর কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যে নামবে। ঐ মুহূর্তটা বেশ লাগে ওর। ততক্ষণে সাব্বির বললো -
এইটারে বলে টুইন শাল। আজিজে পাইবা। কালা হইলো রঙের রাজা, এইটা কখনো ভাবছো ?
হুম
অনেক গভীর বোধের ব্যাপার আছে এই কালা রঙের মাঝে। তুমি তো আগে কবিতা কুবিতা লেখতা, তুমি ভালো বুঝবা। ওইখানে ঝাঁপ দিলে তোমার মইধ্যে আরো রঙের উদয় হইবো কিন্তু সেসব রঙে গভীরতা পাইবা না। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো দোস্তো? আমি নিজেই একটা কালা রঙের আধার। আমার ভিত্রে অনেক কথা, অনেক বিশাল এই ব্যপ্তি কিন্তু কতটুকুই আর প্রকাশ করতে পারি কও! পকেট থেকে হাত বের করে সিগারেটে লম্বা এক টানে শেষ করে রাস্তার ধারে ফেলে দেয়। চলো ছবির হাটের ঐহানে যাই। হাট না থাকুক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তো আর হারায় যায় নাই। চা খাই আর কথা কই ,চলো । সল্লু মামার দোকানের চা বহুতদিন খাই না। বলতে বলতে ওরা ভেতরে ঢুকে কিছুদূর সামনে এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ে।
তা দোস্তো, এহন তুমি সময় কাটাইতাছো কেমনে? আজকাল তোমারে ব্লগে বা ফেসবুকে ল্যাদাইতে দেখি না যে!
ল্যাদানো শব্দটাই যথেষ্ট এই সুন্দর সময়টাকে নষ্ট করার জন্য। আমাকে কি তুমি ইয়ে ভাবো ? লেখালেখি আর ল্যাদানো দুইটা কি এক ব্যাপার ?
ফাহিমের কথা সাব্বির তেমন গায়ে লাগায় না। বলে -
আমিও আজকাল কম ল্যাদাই। ভাল্লাগে না লেখালেখি করতে। মনে হয় রাইটার্স ব্লকে ধরছে।
এবার বইমেলায় কোনো বই বের করবে না ? ফাহিমের খুব ইচ্ছে করে সাব্বিরকে ওর বইয়ের কথা বলতে। একবার ভাবে ওর " অন্ধকারের গান " বইয়ের নামটা ওকে বলতে, প্রচ্ছদের ডিজাইনটাও দেখাতে ইচ্ছে করছিলো। আমারো লেখালেখি এখন ভালো লাগে না বুঝলে? লিখতে বসলেই মনে হয় কী হবে লিখে, এর মানে কি এসব। তোমারও কি এমন লাগে সাব্বির? যদিও খুব নিরাসক্ত গলায় এসব ফাহিম বলে যায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে কুটকুট করে ও হাসে। গত আড়াই মাসে ও মোট পনেরোটা গল্প লিখেছে। কেটেছেঁটে শেষ পর্যন্ত আটটা গল্প দিয়ে বই বের করবে এবারের মেলায়। গায়ের দামটা কমিশন বাদ দেয়ার পরে একটু বেশি মনে হলেও পাঠককে আনকোরা গল্প উপহার দিতে পারবে ভাবলেই ওর ভেতরটা ঝলমল করে ওঠে।
ঠিকই বলছো দোস্তো। আমার ভিত্রেও একই ভাবনা কাজ করে। যা করি সবই অর্থহীন লাগে মানে এই লেখালেখির কথা কইতাছি। আর চাকরি লইয়া একটা অনিশ্চিত অবস্থার মইধ্যে দিয়া যাইতাছি ইদানিং জানোই তো! আমার মন টিকে না কোনো অফিসে বেশিদিন। মনে করো একটা লেখার ফিলিংস আইলেই দেহি কাজকাম আইসা হাজির হয়। অফিসের বসেরা যদি জানতো একজন উদীয়মান লেখকের একটা লেখা প্রসবের আগেই তারে গলাটিপ্যা মাইরা ফালায় এইভাবে কাজের হুকুম দিয়া তহন আর কি মন মেজাজ ঠিক থাকে কও! এই লিগ্যা দিছি চাকরি ছাইড়া। সাব্বির খুব ভাব নিয়া কথা বললেও ও ভাবে ' কি দরকার অফিসে নিজের ফায়ার হওনের খবর আঁতেলটারে জানানের!'
ওদিকে ফাহিমও ভাবে ' এহ্ অফিস জানি লেখালেখির স্কুল। কাম থুইয়া ব্যাটা লেখস, তোরে তো ফায়ার করন দরকার!' কিন্তু ফাহিম শুধু ছোট করে বলে - হুম!
হঠাৎ করে ওদের মাঝে নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। সাব্বির ওর পায়ের চটি জোরাতে ঘ্যাসঘ্যাস করে শব্দ তুলে ঝুরোঝুরো মাটি জড়ো করার মতো ছেলেমানুষি খেলায় মেতে ওঠে। সাব্বিরের ইচ্ছে করে ওর মোবাইলে এবারের বইমেলায় বের হতে যাওয়া প্রচ্ছদটা ওকে দেখাতে। গত কয়েকমাসে ও নিজেও বেশ কিছু গল্প লিখেছে। এর মাঝে সাইকোলজিক্যাল কিছু মার মার কাট কাট টাইপ গল্প। কিন্তু ইচ্ছে করেই ফেসবুক আর ব্লগে নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন ও যেমন দেয়নি তেমনি ফাহিমকেও কিছু জানায়নি। বরং নিরুৎসাহিতই করেছে বেশি এই বলে যে -
হুদাই বই বাইর করনের দরকার কি। মাইনসের আর খাইয়া কাম নাই প্রতিষ্ঠিত লেখকগো বই থুইয়া আমাগো বই ক্যান পাবলিক কিনবো! ফাহিম মদনাটাও বলেছে - হুম ঠিকই বলেছো! কিন্তু ওর ভেতরটা খুব হাঁসফাঁস লাগে নিজের বইয়ের খবরটা জানাতে না পেরে তাই স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকতে না পেরে ফাহিমকে বলে -
চলো দোস্তো, এইবার উঠি। মশা কামড়াইতাছে। সাব্বিরের বাসা হাতিরপুল। তাই ভাবে বাসায় যাবার আগে একবার আজিজে প্রকাশকের দোকানে ঢুঁ মেরে খোঁজখবর নিয়ে যাবে। আর বেশিদিন বাকি নেই বইমেলার, নিজের বইটা হাতে পাবার জন্য যেন ওর তর সইছে না। বই বিক্রি করে ধারদেনা করে না হয় বন্ধুবান্ধবের টাকা শোধ করা যাবে এই ভাবনায় ডুবে থাকে বলে খুব বেশি দুশ্চিন্তাও যেন কাজ করে না ওর মাঝে! কিন্তু তার আগে এই মদনটাকে কাটানো দরকার। বলা তো যায় না আবার শাহবাগে প্রকাশকের মুখোমুখি না হয়ে যায়! তাই ঠিক করে ফাহিমকে কায়দা করে সরিয়ে দিয়ে হলুদ ফুল লাল ফুল প্রকাশনীর দোকানে ও নিজেই যাবে।
ওদিকে ফাহিমও ভাবে সাব্বিরকে কীভাবে এড়িয়ে প্রকাশকের ওখানে যাবে ও বুঝতে পারে না। এখন যদি সাব্বিরও বলে চলো দোস্তো একসাথে হাঁটি কিংবা পাঠক সমাবেশ, প্রথমায় চলো ঢুঁ মেরে আসি, তখন ওকে না করবে কি করে ও ভেবে পায় না।
তবুও একসাথে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আজিজ মার্কেটের কাছে চলে আসলে ওরা আরো ধীরগতিতে এগোতে থাকে। দুজনের বুকের ভেতরেই মনে হয় ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। হয়তো দুজনেই ভাবে বইমেলার আগে যদি প্রকাশ পেয়েই যায় ওদের বই বের হচ্ছে না হয় বলবে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই কেউ কাউকে বলেনি। তবুও অস্বস্তি যেন ওদের পিছু ছাড়ে না। হঠাৎ করে কে যেন রাস্তার ওপাশ থেকে জোরেশোরেই ডাক দেয় 'সাব্বির ভাই... আরে ভাই দাঁড়ান...' ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে হলুদ ফুল লাল ফুল প্রকাশনীর শামস ভাই রাস্তা পার হয়ে ওদের দিকেই আসছেন।
যাক দুজনকে একসাথেই পেয়ে গেলাম! কি রে ভাই দুই দিন ধরে ফোন দিচ্ছি, ফোনটা ধরেন না ব্যাকও করেন না! খুব ব্যাড হ্যাবিট এটা। মোটামুটি বিরক্তির সুরেই শামস ভাই সাব্বিরকে বলেন। আপনার বই তো প্রেসে চলে গেছে। বাকি চার হাজার টাকাটা তো দিলেন না ভাই! আর ফাহিম ভাই আপনি তো আপনার প্রচ্ছদের ইলাস্ট্রেটর কপিটা এখনো মেইল করলেন না! সময় কমরে ভাই, সময় কম! যা দেওয়ার তাড়াতাড়ি দেন!
কেন যেন ফাহিম আর সাব্বিরের মনে হতে থাকে সময়টা এক জায়গায় এসে স্থির হয়ে গিয়েছে। ওদের দেখলে মনে হবে হঠাৎ করেই ওদের মাথার ওপর দিয়ে একটা বোমারু বিমান প্রচণ্ড শব্দ তুলে ঐ জায়গাটা কোনো অতলস্পর্শী নিস্তব্ধতায় ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। একই সাথে ওরা যেন দৃষ্টিভ্রম অথবা শ্রুতিভ্রমে পড়ে যায় কিংবা প্রাণ থেকেও তারা একে অপরের দিকে নিষ্প্রাণ নিদ্রার মতো তাকিয়ে রয়।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:১৪