রাত ২.৩০ বাজে। আমার ঘুম পাচ্ছে না একদমই। পাশে আমার স্ত্রী পুষ্পা শুয়ে আছে। শাড়ি এলোমেলো, হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে সে। ওর ঘুম গভীর, কিন্তু আমি ইনসুমনিয়ার রোগী। তাই অন্যান্য দিন যা করি, আজও তাই করলাম। সিগারেট আর লাইটার ট্রাউজারের পকেটে পুরে চুপিচুপি বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম।
আমাদের দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদটা অনেক সুন্দর। যেমন খোলামেলা, তেমনি মনোমুগ্ধকর। বাসার সামনেই অনেক বড় একটা মাঠ। রাতের বেলা হু হু করে ঠান্ডা বাতাস চলাফেরা করে ছাদে।
সিগারেট ধরিয়ে ছাদের কোনার দিকে পাতা বেতের চেয়ারটাতে একটু আরাম করে যেই বসেছি, তখনই লক্ষ্য করলাম আমি ছাড়াও কে যেন আছে ছাদে। ভালো করে তাকাতে ছাদের দক্ষিণ কিনারায়‚ রেলিংয়ের ধারে একজন মানুষকে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে দেখলাম।
আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল! কে ওটা? মানুষ না অশরীরী কেউ?
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বুকে অনেকখানি সাহস জড়ো করে আমি মানুষটার কাছে গেলাম। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম‚ "ক্ক ক্ক কে? কে ওখানে?"
মানুষটা হেসে বলল- "ভয় পাবেন না। আমি ভূত নই‚ আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি‚ আপনার প্রতিবেশী।"
আমি এবার চিনতে পারলাম-
"আরে বরকত সাহেব! আপনি এত রাতে?"
"ঘুম আসছিল না‚ বসুন গল্প করি।"
সরে আমাকে বসার জন্য জায়গা করে দিলেন তিনি। সরে বসার দরকার ছিল না‚ ছাদে অনেক জায়গা। তারপরও তার করে দেয়া জায়গাটাতেই আমি বসলাম। বসেই বললাম-
"আপনারও আমার মতো ইনসুমনিয়া আছে নাকি?"
"না ভাই‚ আমার ইনসুমনিয়া নেই। আমার বরং ঘুম ভালোই হয়।"
"তাহলে হঠাৎ ছাদে এলেন? ভালো লাগছিল না ঘরে?"
"না‚ তাও না। আমার বাসায় বেশ ভালোই লাগে। আসলে আমার কোন জায়গাতেই খারাপ লাগে না।"
"তাহলে এত রাতে ছাদে এলেন?"
বরকত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন-
"আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আত্মহত্যা করব।"
আমি চমকে উঠে বললাম-"এসব কি বলছেন ভাই?"
বরকত সাহেব যেন থতমত খেয়ে গেলেন আমার প্রশ্নে। বললেন-"কি বলছি?"
"আত্মহত্যার কথা বলছেন!"
"হ্যা তাতে কি? আত্মহত্যা যে কেউ করে না তা তো না। প্রতি মিনিটে দেশের কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছেই‚ কিংবা মারা যাচ্ছেই। কেউ না কেউ জন্ম নিচ্ছেই। আমার আত্মহত্যা এত গুরুত্বপূর্ণ হতে যাবে কেন?"
আমি ভালোই বিস্মিত হলাম। ঠান্ডা মাথার খুনীর কথা শুনেছি‚ কিন্তু ঠান্ডা মাথায় কেউ আত্মহত্যা করে এমনটা শুনিনি।
"প্রতিটা মানুষের জীবনই গুরুত্বপূর্ণ বরকত সাহেব। কিন্তু আপনি আত্মহত্যা করতে চাইছেন কেন? আপনি তো জীবনে খুবই সাকসেসফুল একজন মানুষ‚ কিসের কষ্ট আপনার?"
"আমার কোন কষ্ট নেই।"
"তাহলে কেন আত্মহত্যা করতে চাইছেন?"
"বিষয়টা একটু জটিল। আপনাকে বোঝাতে পারব বলে মনে হয় না।"
"তবুও বলুন।" একজন মানুষ কেন আত্মহত্যা করতে চাইছে‚ এটা সে যদি আরেকজনের কাছে খুলে বলে‚ তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছেটা মরে গেছে। তাই জানতে চাইলাম।
বরকত সাহেব বলতে শুরু করলেন-
"সেদিন আমার বোনের ছেলে সুমন আমায় বলল‚ মামা‚ তুমি জীবনে প্রচন্ড রকমের সফল একজন মানুষ। তুমি নিজের আত্মজীবনী লিখছ না কেন? আমি সুমনের কথা গুরুত্ব সহকারে নিলাম এবং ঠিক করলাম নিজের আত্মজীবনী লিখব। আত্মজীবনী কি করে সুন্দরভাবে লিখতে হয় সেটা জানার জন্য আমি বিখ্যাত মানুষদের আত্মজীবনী সংগ্রহ করে পড়তে লাগলাম। এই যেমন- মহাত্মা গান্ধী‚ চার্লি চ্যাপলিন‚ আব্রাহাম লিংকন ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক হলাম খুব। সেটা হলো‚ সকল বিখ্যাত‚ সফল মানুষের জীবনেই কিছু ব্যর্থতা‚ কিছু অপ্রাপ্তি‚ কিছু কষ্ট লুকিয়ে আছে। সব মানুষই জীবনের কোন না কোন ক্ষেত্রে অনেক সংগ্রাম করেছে‚ কিংবা অনেক কষ্ট পেয়েছে। এমনকি জানতে পারলাম যে আমার সকল বন্ধু‚ সকল সহকর্মীর জীবনেও কোন না কোন বড় কষ্ট কিংবা ব্যর্থতা আছে। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম‚ আমার জীবনে কোন সংগ্রামের গল্প নেই‚ কোন ব্যর্থতার গল্প নেই।
আমি জন্মেছিলাম প্রচন্ড ধনী পরিবারে। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। প্রতিটি পরীক্ষায় অসাধারণ রেজাল্ট করে উতরে গেছি। সার্টিফিকেট আর বাবার জোরে হাই স্যালারির চাকরী পেয়েছি। সুন্দরী বউ পেয়েছি। দু'টো সু-সন্তান পেয়েছি‚ তারা দু'জনেই নম্র-ভদ্র‚ পড়াশোনায় ভালো। কারো জীবনে কোন কষ্ট নেই আমাদের পরিবারে।
বিষয়টা উপলব্ধি করে আমার মনে হলো‚ আমি বেঁচে আছি কেন! আমার বেঁচে থাকার পেছনে তেমন স্বার্থকতা নেই। কারণ মানুষের জীবনে সুখ দুঃখ থাকবে‚ আপস এন্ড ডাউনস থাকবে‚ কষ্ট থাকবে‚ আনন্দ থাকবে। কিন্তু আমার জীবন কেন সরলরেখায় চলছে? এর অবসান হওয়া উচিত!"
"আপনি নিজের কথা ভাবছেন কেন শুধু ভাই? বউ ছেলেমেয়েদের কথা ভাবুন। ওদের আপনাকে দরকার!"
"ঠিক বলেছেন আপনি। আমাকে ওদের দরকার। কিন্তু ওদের জীবনও কিন্তু আমার মতো সরলরেখাতেই চলছে। আমার অকাল মৃত্যু ওদের জীবনে কষ্ট বয়ে আনবে। মানুষের জীবনে কষ্টের প্রয়োজন রয়েছে।"
*** *** ***
আমি পুলিশকে এতটুকু বলার পর থামলাম। ঢক ঢক করে পানি খেলাম এক গ্লাস। পুলিশ অফিসারটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সে জিজ্ঞেস করল‚ "তার মানে আপনি বলতে চাইছেন‚ বরকত সাহেব দশ তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন‚ আপনি তাকে খুন করেননি?"
"না‚ আমি তা বলতে চাইছি না। বরকত সাহেব আত্মহত্যা করেননি‚ আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি।"
"কেন আপনি তা করলেন? তিনি যখন স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করার কথা ভাবছিলেন‚ তখন তাকে খুন করার কি দরকার ছিল?"
"কারণটা হলো‚ বরকত সাহেবের কথা শুনে মনে হলো‚ আমার জীবনও কি বরকত সাহেবের মতো নয়! আমিও কি একজন নিরেট সফল মানুষ নই। আমার জীবনে কি কোন কষ্ট আছে! সংগ্রামের গল্প আছে! ভেবে দেখলাম-নেই! ছাত্রজীবনে যেমন প্রচন্ড মেধাবী ছিলাম‚ কর্মজীবনে তেমন প্রচন্ড সফল‚ বৈবাহিক জীবনে তেমনি প্রচন্ড সুখী। কোথাও এতটুকু আঁচড় নেই। একটা গ্রাফে যদি আমার জীবন আঁকা হয়‚ একটা নিপাট সরলরেখা পাওয়া যাবে। তখন ভাবলাম‚ এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাক। বরকত সাহেব মারা যাক‚ তার দায়ে আমি ফাঁসিতে ঝুলি। অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হোক আমার। জীবনে কিছুটা দুঃখ আসুক।"
"তারপর আপনি ঠান্ডা মাথায় বরকত সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন?"
"হ্যা!"
*** *** ***
আমাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে‚ তখন পুলিশ অফিসারকে দেখলাম গভীর চিন্তায় তার কপাল কুঁচকে আছে। নিজের রিভলবারটার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। আমি মৃদু হেসে জেলের পথে পা বাড়ালাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১:০৫