তিথি হাতের মুঠি খুলছে আর বন্ধ করছে, বন্ধ করছে আর খুলছে। সে দ্বিধান্বিত বেশ। যা বলতে চাইছে পল্লবকে, সেটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। আবার না বললেও অপরাধবোধে ভুগছে সে, অদ্ভুত দোটানা।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বেশ! ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে বারান্দায় বসে একটা বই পড়ছে পল্লব। বইয়ের নাম- দা ওলড ম্যান এন্ড দা সী। ভাবলেশহীন মুখে পাতা উলটে যাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার চশমার কাঁচ, অন্যমনস্কভাবে আঙুল দিয়েই সেটা মুছে নিচ্ছে সে।
তিথি পল্লবের পাসে গিয়ে বসে পড়ল। ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসল পল্লব।
“গুড মর্নিং। বেশ সকাল সকাল উঠে পড়েছ তিথি। আরেকটু ঘুমালে পারতে, ছুটির দিন আফটার অল।”
তিথি হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসি পেল না তার। গলাটা ভীষণ শুকনো ঠেকছে, এক গ্লাস পানি পেলে ভালো হতো। পল্লব জিজ্ঞেস করল-
“কি ব্যাপার, তোমাকে এমন নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন তিথি?”
“পল্লব, আই ওয়ন্ট টু কনফেস সামথিং!”
“কনফেস করতে চাও? কি কনফেস করবে?”
“জানি না তুমি রাগ করবে কি না। হয়তো বলা উচিত হচ্ছে না তোমাকে, কিংবা আরও আগেই বলা উচিত ছিল, জানি না উচিত অনুচিত কি! কিন্তু, আমার মনে হচ্ছে, তোমাকে বলতেই হবে!”
পল্লব হাতের বইটা বন্ধ করে সজাগ চোখে তাকাল তিথির দিকে। তারপর মৃদু হেসে বলল-
“যা বলতে চাও, নির্ভয়ে বলে ফেল তিথি। আমি কিছু মনে করব না।”
“হ্যা, জানি তুমি কিছু মনে করবে না। সে ভরসাতেই বলার সাহস পেয়েছি। আগের মতো বদমেজাজি নেই তুমি, ইনকন্সিডারেট নেই। তবুও দ্বিধা হচ্ছে!”
“ঠিকাছে তিথি, তোমার যদি অস্বস্তি হয় তাহলে পরে বলতে পারো, না বললেও অসুবিধা নেই।”
“না না, আমি বলব।”
“আচ্ছা বলো।”
“আসলে ঘটনাটা হচ্ছে, বিয়ের আগে একটা ছেলে আমাকে পছন্দ করত। এক তরফা ছিল ব্যাপারটা, আমি তেমন পাত্তা দিতাম না ছেলেটাকে। ওদিকে বিয়ের পর তুমি আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। সারাক্ষণ কাজ নিয়ে পড়ে থাকো, ঠিক ঠাক সময়ে বাসায় আসো না, ঠিকমতো কথা বলো না, কারণে অকারণে উপেক্ষা করে যাও আমাকে। ঠিক তখন সেই ছেলেটার সাথে আমার দেখা হলো আবার। এখনো বিয়ে করেনি সে। এন্ড………..উই হ্যাভ স্টার্টেড ডেইটিং!”
“হোয়াট?”
“আয়াম সরি, পল্লব। আমি একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাই ওর সাথে, এবং আস্তে আস্তে বুঝতেও পারলাম যে এটা ভুল করছি, প্রতারণা করছি তোমার সাথে। আবার তোমার আচরণও বদলে গেছে গত ক’মাসে। আগের চেয়ে অনেক দায়িত্ববান হয়েছ তুমি, অনেক সৎ হয়েছ, পরিবারের প্রতি সহমর্মী হয়েছ। তাই আমিও ঠিক করলাম, ইট’স হাই টাইম আই স্টপড চিটিং!”
পল্লব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্মিত হেসে বলল- “ইট’স ওকে তিথি। ভুলটা আসলে আমারই। আমিই এতদিন উদাসীন ছিলাম তোমার প্রতি। সরি।”
“না না পল্লব, ভুল ভাবছ। যতোই যা হোক, এভাবে তোমার সাথে প্রতারণা করার অধিকার নেই আমার।”
“যাই হোক, যা হয়েছে, ভুলে যাও তিথি।”
তিথি পাশ ঘেঁষে বসে পল্লবের হাতে হাত রাখল। এই মুহূর্তে বাইরের বৃষ্টি খুব সুন্দর লাগছে তার, পল্লবের হাতটাও উষ্ণ ঠেকছে।
হঠাৎ বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পল্লব বলল-
“আসলে কি জানো তিথি, আমার মনে হয় না তোমার ঐ ছেলেটার সাথে সম্পর্কটা শেষ করে দেয়া উচিত। ছেলেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত তোমার!”
তিথি আকাশ থেকে পড়ল। পল্লব কি এতটাই রেগে গেছে যে প্রচ্ছন্নভাবে তাকে জানাতে হচ্ছে সেটা!
“পল্লব, আমি সত্যিই সরি। আমি আসলে……”
“না না তিথি, তুমি ভুল বুঝছ, আই মিন ইট। তোমার সত্যিই এই নতুন সম্পর্কের ব্যাপারে সিরিয়াস হওয়া উচিত।”
“কেন?”
“কারণ, তোমার তাকে দরকার হবে। আমি বেশিদিন বেঁচে নেই তিথি।”
“মানে? কি হয়েছে তোমার? কোন অসুখ ধরা পড়েছে?” কেঁপে উঠল তিথির কন্ঠ।
“না তিথি, কোন অসুখ ধরা পড়েনি আমার। আসলে আমার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে।”
“কেন এ কথা বলছ পল্লব? বত্রিশও পেরোয়নি তোমার বয়স।”
“জানি। আমি তোমাকে এখন কিছু অদ্ভুত কথা বলব তোমাকে। তুমি কি বিশ্বাস করবে?”
“হ্যা করব। কেন করব না!”
“প্লিজ সিরিয়াসলি নিও আমার কথা। আমি একবিন্দু রসিকতা করতে যাচ্ছি না তোমার সাথে।”
“অবশ্যই সিরিয়াসলি নেব পল্লব। বলো কি কথা!”
“সেটা হলো, আমি আসলে পল্লব নই।”
“হোয়াট?”
“হ্যা, ঠিক শুনেছ। আমি পল্লব নই। আমার নাম আফসার উদ্দিন।”
“কি বলতে চাচ্ছ, খুলে বলো!”
“বলছি। আমি আফসার উদ্দিন। খুলনার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালে। আমার জীবন কেটেছে খুব সাদামাঠা ভাবে। ছাত্র হিসেবে সাধারণ মানের ছিলাম, চাকরী জীবনেও সাধারণ এক সাধারণ কেরানী ছিলাম। আমি বিয়ে করছিলাম এক সাদাসিধে গ্রামের মেয়েকে। দু’টো সন্তান হয়েছিল আমার। সন্তানদের কেউ অসাধারণ মেধা নিয়ে জন্মায়নি। কেউই জীবনে খুব সফল হয়নি। আমার মতোই সাধারণ জীবন কাটিয়েছে ওরাও, হয়তো এখনও কাটাচ্ছে, কি জানি! যাই হোক, ৮২ বছর বয়সে ম্যালেরিয়া হয়ে আমার মৃত্যু হয়। সাদামাঠা জীবনের ঘানি অনেক দূর টেনেছি।
গড়বড়টা শুরু হয় আমার মৃত্যুর পরেই। মৃত্যুর পর চোখ মেলে তাকাতেই দেখি একটা ছিমছাম শহুরে বাসার সাদা চাদর বিছানো বিছানায় শুয়ে আছি আমি। আমার পাশেই একটা ছোট্ট মেয়ে পুতুল নিয়ে খেলছে। রুমের মধ্যে একটা আয়না ছিল। আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখি, আমি এক তাগড়া যুবক। কেঁপে উঠলাম ভয়ে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম-‘কে এটা!’ আমার মস্তিষ্কেই উত্তরটা তৈরি হলো, যেন কিছু পুরনো ফাইল চোখের সামনে চলে এসেছে, এমন ভাবে। আমি বুঝতে পারলাম, আমার নতুন নাম রাজিব। আমি একজন পুলিশ অফিসার। বুঝতে পারলাম যে আমার স্ত্রীর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। যে মেয়েটাকে বিছানায় খেলতে দেখেছি, সে আমার নিজের মেয়ে। বাসায় আমরা ছাড়াও একটা কাজের ছেলে থাকে, তার নাম মতিন। আমাদের বাসা ঢাকার কলাবাগানে। শুধু তাই নয়, রাজিব নামের লোকটার জীবনের যে কোন ঘটনা আমি চাইতেই মস্তিষ্কে পেয়ে যাচ্ছিলাম।
পাঁচ মাস বেঁচে ছিলাম আমি রাজিব হিসেবে, তারপর একদিন হার্ট এটাকে মারা গেলাম। মারা যাবার কিছুক্ষণ চোখ মেলে আবিষ্কার করলাম, আমি বরিশালের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া চাষি।
তিন মাস আমি চাষির জীবন যাপন করেছি, তারপর একদিন মারা গেলাম গাড়ি চাপা পড়ে। সেই থেকে গত তের বছরে আমি অনেক বার মরেছি, নতুন নতুন জীবন পেয়েছি, আবার মরেছি, কোন জীবনই কয়েক মাসের বেশি দীর্ঘ হয়নি। প্রত্যেকবার মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেছি আলাদা ভাবে।
কখনো কখনো চেষ্টা করেছিলাম ফেলে আসা জীবনের মানুষগুলোর পরিবারের সাথে দেখা করার। করেছিলামও, তারা কেউ আমাকে নতুন রূপে চিনতে পারেনি। তিন মাস আগে পল্লব হিসেবে জীবন পাওয়ার আগে, আমি ছিলাম একজন স্কুল শিক্ষক। পল্লব হিসেবেও আমার জীবন খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না! তিথি, তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?”
তিথি হা করে তাকিয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। সে ইতস্তত করে বলল-
“তোমাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই পল্লব! তোমার আজগুবি গল্প কেউই বিশ্বাস করবে না। কিন্তু জানি না কেন, আমি ভীষণ ভাবে টের পাচ্ছি যে তুমি সত্য বলছ। আমি অদ্ভুত, অজানা কোন কারণে তোমাকে বিশ্বাস করেছি।”
“বিশ্বাস যদি করেই থাকো, তাহলে নিজের স্বার্থেই প্লিজ, এই নতুন রিলেশনকে সিরিয়াসলি নাও তিথি।”
“না, সেটা হবে না পল্লব। প্রকৃতি কোন অদ্ভুত খেলা শুরু করেছে তোমার সাথে। আমি এই খেলা সাঙ্গ করে দেব। তুমি কথা দাও পল্লব, তুমি যদি কোন কারণে এবার মারা যাও, তাহলে পরের বার যে জীবন পাবে, যে জীবনই হোক না কেন, কুলি হও, ভিখারি হও, বাসের হেল্পার হও, সত্তর বছরের বুড়ো হও, ষোল বছরের কিশোর হও, ডাজ নট ম্যাটার! তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে। আমার সঙ্গে তোমার বাকী সব ক’টা জীবন কাটাবে, প্লীজ কথা দাও!”
“কথা দিলাম তিথি।”
এর ঠিক এগার দিন পর দুর্ঘটনা বসত বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মারা যায় পল্লব। পল্লব মারা যাবার ঠিক দু’দিন পরে সুন্দরী এক তরুণী আসে তিথির বাসায়। তিথিকে বলে-
“তিথি, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ? আমি তোমার পল্লব! জানতাম, প্রকৃতি আমাদের এক হতে দেবে না। সে জন্যই বোধহয় এবার প্রথম বারের মতো আমি কোন নারীর জীবন পেয়েছি। তুমি ভালো থেকো তিথি। বিদায়!”
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:১৮