রুদ্র রাজিব তার প্রকাশক মাহমুদ সাহেবের সাথে চেচাচ্ছেন ফোনে।
-.....জ্বী মাহমুদ ভাই, আমি লেখাটা শেষ করে এনেছি প্রায়। এখন আপনি বার বার ফোন দিলে আমি কি করে কন্সেন্ট্রেট করব?...কি? নাহ! আমি সত্যিই লিখছি ভাই। আমি বলেছি লেখাটা কাল পরশুর মধ্যে পাবেন, সত্যিই পাবেন। দয়া করে এই ক’দিনের মধ্যে ফোন দেবেন না।
রেহনুমা এক কাপ কফি নিয়ে রাজিবের পাশে বসল। কিছুটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে তাকে।
- তুমি সত্যিই নতুন উপন্যাসটা প্রায় শেষ করেছ?
-আরে নাহ! কিসের কি!! লেখা শেষ করতে হলে তো শুরু করতে হবে। আমি এখনো শুরুই করিনি। বার বার লিখছি, কয়েক পাতা লিখে কেটে দিচ্ছি। কোন প্লট নিয়েই কয়েক পৃষ্ঠার বেশি এগোতে পারছি না। এমন কখনো হয়নি আগে। মনে হচ্ছে, আমার লেখার ক্ষমতা ফুরিয়ে এসেছে। অথচ প্রকাশক বলছে, বইয়ের প্রচ্ছদও নাকি তৈরি। লেখার কোন নামগন্ধ নেই, উপন্যাসের নামও ঠিক হয়নি, ওদিকে বইয়ের প্রচ্ছদ রেডি করে ফেলছে।
- আমার মনে হচ্ছে, তুমি রাইটার’স ব্লকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ!
-রাইটার’স ব্লক! এসব ঢংয়ের কথা। আজকালকার উঠতি লেখকরা, নতুন নতুন পুঁচকে লেখকরা যখন প্লট খুঁজে পায় না, তখন ঢং করে বলে, তারা রাইটার’স ব্লকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। লিখতে শেখেনি, ব্লক শুরু হয়েছে। শব্দটা শুনলেও আজকাল মেজাজ বিগড়ে যায়।
- হুম! কফি খাও। বেশি স্ট্রেস নিও না। আমার মনে হয় আজ রাতটা লেখালেখি বাদ দিয়ে অন্য কিছু করো। আশা করি কাল সব ঠিক হয়ে যাবে!!
-অন্য কিছু? অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল সে। কিছুটা লজ্জিত এবং বিব্রত দেখাল রেহনুমাকে।
- না মানে বলছিলাম, একটা মুভি দেখো, কিংবা বই পড়ো, অথবা ঘুমাও। লেখালেখি ভুলে থাকো কিছুক্ষণ। কোন জিনিসে মনোযোগ ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে সেটা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকা।
রাজিব মাথা দোলাল।
-ঠিক বলেছ তুমি। আমি একটু হেটে আসি বাইরে থেকে।
পাঞ্জাবীর উপর চাদর জড়িয়ে, ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে উঠে দাড়াল সে। দরজার দিকে গেল।
- এ কি! এত রাতে বাইরে যাবে? ১২ টার বেশি বাজে এখন!
-চিন্তা করো না, বেশি দূরে যাব না।
- কোথায় যাবে?
-বেইলি রোডে। রমিজ মিয়ার দোকানে বসব, চা সিগারেট খাব। দেখি মাথা খোলে কি না!
*** *** ***
রাস্তাটা প্রায় নির্জন। একটা সিগারেট ধরিয়ে আস্তে আস্তে হাটছে রুদ্র। একজন দীর্ঘদেহী মানুষ তার পেছন পেছন আসতে লাগল। থমকে দাড়িয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল রাজিব।
-কিছু বলবেন?
- আপনি বিখ্যাত লেখক রুদ্র রাজিব নন?
-হ্যা, আমি রুদ্র রাজিব।
- খুব ভালো লাগল আপনাকে সামনাসামনি দেখতে পেয়ে। আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান স্যার।
-আচ্ছা!
বলেই রাজিব হাটতে লাগল আবার। তার পাশে তাল মিলিয়ে হাটতে লাগল ভদ্রলোক।
- স্যার, আপনি সত্যিই খুব ভালো লেখেন, অসাধারণ লেখেন।
-আমার কোন লেখা পড়েছেন আপনি?
- আপনার রৌদ্রছায়া উপন্যাসটা পড়েছিলাম আমি।
-আর?
- আর পড়িনি।
-একটা বই পড়েই ফ্যান হয়ে গেলেন?
- কি করব স্যার বলুন! আমি তো ছাপার অক্ষর ভালোমতো পড়তে শিখিনি এখনো। শিখে ফেললে আরও কিছু বই পড়ব।
-মানে? আপনি ছাপার অক্ষর না শিখেই কি করে পড়লেন আমার বই?
- লম্বা গল্প স্যার!
-বেশি লম্বা?
- না, তা ঠিক না। আসলে গল্পটা খুবই ছোট। আমি জন্মান্ধ ছিলাম। কিছুদিন আগে একটা মানব উন্নয়ন মূলক সংস্থার কল্যানে, এবং একজন মহৎ ব্যক্তির মরনোত্তর চক্ষুদানের ফলে আমি দেখতে শিখেছি। আমি অন্ধ ছিলাম যখন, তখন ব্রেইল হরফে পড়তে শিখেছিলাম। অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়তাম। আপনার শুধু একটা বইয়েরই ব্রেইল সংস্করণ বেরিয়েছিল। সেটা পড়েছি।
রাজিব হাটতে হাটতেই খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করল লোকটাকে।
-নাম কি আপনার ভাই?
- আমার নাম আবীর।
-আবীর ভাই, আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুবই ভালো লাগল। আমি প্রথম একজন অন্ধ ভক্তের সঙ্গে পরিচিত হলাম, যে কি না আক্ষরিক অর্থেই আমার “অন্ধ-ভক্ত”। ব্রেইল পদ্ধতিতে আমার একটা বই বেরিয়েছিল বটে, কিন্তু বইটা অন্ধ পাঠকদের কাছে কেমন লেগেছে সেটা জানা হয়নি। সত্যিই খুব ভালো লাগল আপনাকে দেখে।
- আমারও খুব ভালো লাগছে স্যার। এত রাতে বাইরে হাঁটছেন কেন? প্রায়ই কি রাত বিরেতে হাটাহাটি করে থাকেন?
-না, প্রায়ই করি না। আজ করছি। আসলে বইমেলা চলে এসেছে, অথচ এখনও লিখিনি কিছু। লেখা বেরোচ্ছে না হাত দিয়ে। রাইটার’স ব্লক না ছাই, সেটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি!
- আমি স্যার আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
-আপনি?
- হ্যা স্যার। ব্রেইলে যে অনেক বই পড়েছিলাম, এমন নয়। কিন্তু কিছু চিন্তা ভাবনা আছে আমার। এখনো কোন সাহিত্যিক এই চিন্তাগুলো প্রকাশ করেননি।
-তাই? কেমন চিন্তা ভাবনা?
- একটু জটিল চিন্তা স্যার। যেমন ধরুন, আপনি চোখ বন্ধ করে স্পর্শ করে করে যদি আমার হাতটা ধরেন, আপনি কি বুঝতে পারবেন যে এটা আমার হাত, পা নয়, কিংবা একটা বই নয়, কিংবা একটা ফুটবল নয়।
-নিশ্চয়ই পারব। খুবই সহজ কাজ।
- চোখ বন্ধ করে যখন আপনি আমার হাত ধরবেন, যখন হাতের আকৃতি অনুভব করবেন, তখন কি আপনার মনে হাতের একটা ছবি ভেসে উঠবে না?
-তা তো উঠবেই।
- কিন্তু স্যার, আমরা যারা জন্মান্ধ, যারা কখনো কোন ছবি দেখিনি, আলো দেখিনি, তাদের কাছে আকার-আকৃতির সংজ্ঞা কি? আকার-আকৃতি, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা এগুলোকে আপনি কল্পনা করেন ছবির মতোন করে, মানসপটে দৃশ্য তৈরির সাহায্য; কিন্তু আমরা যারা জন্মান্ধ, তারা কেমন করে সেটা কল্পনা করি, সেটা অনুমান করতে পারেন? আমাদের কল্পনায় তো দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিষয়গুলো নেই। তাহলে আমাদের কল্পনা কি রকম হতে পারে? কোন কিছুকে শূন্য দিয়ে ভাগ দিলে যা আসে, তা অসংজ্ঞায়িত, তার কোন সংজ্ঞা নেই। সেটা আমাদের কল্পনার বাইরের কিছু বিষয়। অন্ধদের কল্পনায় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আকার, আকার, আকৃতির যে প্রকৃতি, সেটাকে কি সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব?
রাজিব বেশ বিস্মিত হলো।
-আপনি একদম ঠিক বলেছেন আবীর। চমৎকার বলেছেন। এ বিষয়টা নিয়ে কখনো ভাবিনি। আলো-বিহীন আকার আকৃতির কল্পনা কেমন, সেটা একজন দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে কখনো জানা সম্ভব নয়। একটা বিজ্ঞানের উদাহরণ দেই। যেমন, সময়ের দ্বিতীয় মাত্রাকে বিজ্ঞান পঞ্চম মাত্রা বলে থাকে। আমরা ত্রিমাত্রিক প্রাণীরা কখনো অনুভব করতে পারব না পঞ্চম মাত্রা কেমন হতে পারে। যা কিছু আমাদের কল্পনায় নেই, তা আমরা অনুভব করতে পারি না। একজন জন্মান্ধ মানুষ যেমন কখনো আলো কিংবা রঙ অনুভব করতে পারবে না, তেমনি একজন দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষও কখনো অন্ধদের অবয়ব জ্ঞান, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ইত্যাদি মাত্রাজনিত জ্ঞান ইত্যাদি অনুভব করতে পারবে না।
- জ্বী, সেটাই। এখন যদি একটা উপন্যাস লিখতে বলা হয় আপনাকে, যেখানে একজন অন্ধ মানুষের দিন যাপনের গল্প থাকবে, তার আবেগের গল্প থাকবে, কল্পনার গল্প থাকবে, আপনি লিখতে পারবেন?
-নাহ, পারব না। যদি লিখিও, সেটা হবে অবাস্তব গল্প। সেখানে শুধু কল্পনা থাকবে, আর কিছু নয়। অভিজ্ঞতাহীন কল্পনা নিয়ে কোন গল্প লেখা সম্ভব নয়। আমি লিখতে চাই-ও না।
- তাহলে এমন গল্প কে লিখতে পারবে?
-আপনি। একমাত্র আপনার মতো কেউ, যে জন্মান্ধ ছিল, তারপর চোখের দৃষ্টি পেয়েছে। এই দুই জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই সবচেয়ে ভালো লিখতে পারবে।
আবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
- হ্যা, আমি। কিংবা আমার মতো কেউ। আসলে আমি এমন একটা উপন্যাস লিখেছিও। কিন্তু আমার ভাষাজ্ঞান খুব-ই খারাপ। আমি চাই আপনি এটা নতুন করে লিখুন।
পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে সেটা রাজিবকে দিল সে।
-এখানে আছে উপন্যাসটি। আমি চাই এটা আপনি আপনার মতো করে লিখুন, আপনার নামেই ছাপান।
রাজিব সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখল আবীরকে।
-আপনি পেনড্রাইভটা সাথে নিয়ে ঘুরছেন কেন? আপনি কি জানতেন আমার সঙ্গে আপনার দেখা হবে?
হ্যা, জানতাম। আসলে আমি আপনাকে ফলো করছি বেশ কয়েকদিন ধরে। হয়তো লক্ষ্য করেননি। আজ সুযোগ পেয়ে কথাটা বললাম।
-কেন ফলো করছিলেন? শুধু উপন্যাসটা লেখানোর জন্য? তাও আমার নামে?
- হ্যা, উপন্যাসটা লেখা খুব জরুরী। জানেন, অন্ধদের কল্পনা অনেক সুন্দর। পৃথিবীটাকে আমি যেভাবে কল্পনা করতাম অন্ধ থাকার সময়, বাস্তবে তার মিল পাইনি। অন্ধকারের অবয়ব, অন্ধকারের পৃথিবীও যে কত সুন্দর হতে পারে, সেটা স্বাভাবিক মানুষ কখনোই জানতে পারবে না। যদি একজন ভালো সাহিত্যিক কোন কারণে অন্ধ হয়ে যেত, তাহলে সে এসব নিয়ে লিখতে পারত। যদি একজন ভালো চিত্রশিল্পী কিংবা সংগীতশিল্পী অন্ধ হয়ে যেত, তাহলে তারাও অন্য রকম কিছু শিল্প কর্ম তৈরি করে যেতে পারত। অন্ধকারে জন্মানো শিল্প সাহিত্যের সন্ধান পেত পৃথিবীর মানুষ।
ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে এলো রাজিব। মনে মনে ভাবল- সাইকো চরিত্র নাকি! শিল্পী-কবি-লেখকদের ধরে ধরে অন্ধ করে দিতে চায়? যাতে অন্ধদের জগৎ নিয়ে তারা লিখতে পারে?
-দেখুন, আমি আপনার হয়ে কোন উপন্যাস লিখতে চাই না। রাইটার’স ব্লকে ভুগছি বলে গল্প পাবার জন্য ভিখারি হয়ে যাইনি। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল খুব। বিদায়।
- আপনি কি ভয় পাচ্ছেন আমাকে স্যার? আমাকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি চাই, আপনি আমার উপন্যাসটা পড়েন, যদি ভালো না লাগে, লিখবেন না। কোন অসুবিধে নেই। পেনড্রাইভটা রাখুন স্যার।
কাঁপা হাতে পেনড্রাইভটা নিল সে। নিয়েই হন হন করে হাটা শুরু করল। আবীর তার পিছু নিল না। স্থির দাড়িয়ে রইল।
*** *** ***
নিজের বাসায় ফিরেছে রাজিব। রেহনুমাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল সে। রেহনুমা বেশ অবাক হলো শুনে।
- লোকটা সত্যিই অদ্ভুত।
-লোকটা আমাকে ফলো করছিল। কথাবার্তাও তেমন সুবিধের ঠেকেনি। মনে হচ্ছে, কোথাও একটা সমস্যা আছে।
- আমারও সেটাই মনে হচ্ছে। পেনড্রাইভে আসলেই কোন উপন্যাস আছে কি না দেখেছ?
-না এখনো দেখিনি, দেখছি দাঁড়াও।
রাজিব পেন ড্রাউভটা লাগালো ল্যাপটপে। সেখানে আসলেই একটা ওয়ার্ড ফাইল দেখতে পেল। সেটা ওপেন করল রাজিব। কয়েক শো পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস। শুরুতেই বড় বড় করে কিছু কথা লেখা। সেটা পড়ে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল রাজিবের।
- কি হলো? কি লেখা ওখানে?
- পড়ে দেখো।
রেহনুমা পড়তে লাগল জোরে জোরে।
স্যার, আপনি কি জানেন ভাবছেন এই উপন্যাস লেখাটা এত জরুরী কেন? কারণটা বেশ ভয়ংকর। আমি আসলে জন্মান্ধ ছিলাম না। আমি জন্মের সময় স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন, সুস্থ-স্বাভাবিক একটি শিশু ছিলাম। আমার বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত লেখক। নাম বললে চিনবেন। নাম বলছি না। আমার বাবা চেয়েছিলেন, অন্ধদের জীবন নিয়ে, কল্পনা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলেন, এই ধরনের উপন্যাস লেখাটা এত সহজ নয়। তিনি অন্ধ নন, অন্ধদের জগৎ কেমন সেটা তিনি জানেন না। ডাক্তাররা বলে, আমার বাবা মানসিক রোগী ছিলেন, সাইকোপ্যাথ ছিলেন। একদিন তিনি চিমটা দিয়ে খুঁচে নিজেই নিজের চোখের মনি দু’টো নষ্ট করে ফেলেন। অন্ধ হয়ে যান তিনি। ঠিক করলেন, এবার লিখবেন উপন্যাসটা। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন যে অন্ধ হয়েও তেমন লাভ হয়নি। তার মস্তিষ্কে আলোর, দৃশ্যের, অবয়বের স্মৃতি ছিল। জন্মান্ধের কল্পনা কেমন সেটা জানতে হলে একজন জন্মান্ধকেই এই উপন্যাসটা লিখতে হবে। তিনি বিয়ে করেন। সন্তান নেন এবং জন্মের সময়ই নিজের সন্তানকে নিজে অন্ধ করে দেন, যাতে করে ছেলেটা বেড়ে ওঠে এমন একটা উপন্যাস লিখতে পারে। আমিই সেই সন্তান। আমি ব্রেইলে প্রচুর বই পড়েছি। আমার বাবা আমাকে অনেক কিছু পড়িয়েছেন, শিখিয়েছেন এবং মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছেন কেন তিনি এমন করলেন। বাবার উপর আমার মোটেও রাগ হয়নি। আমার মনে হয়েছিল, বাবা খুবই নিবেদিত প্রাণ, মহৎ একজন লেখক। যাই হোক, আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন এই গল্পটা লেখা আমার জন্য এত জরুরী কেন! আমি পুরো জীবন কাটিয়েছি শুধুই উপন্যাসটা লেখার জন্য। অনুগ্রহ করে উপন্যাসটা নিজের মতো করে, নিজের আবেগ দিয়ে লিখবেন।
পড়া শেষ হতে রাজিব-রেহনুমা দু’জন দু’জনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
*** *** ***
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বিছানা হাতড়ে রাজিবকে পেল না রেহনুমা। হয়তো তারাতারি উঠে লিখতে বসেছে। হাই তুলে রান্নাঘরের দিকে গেল সে। চিনি আর কফির কৌটো খুঁজে নিয়ে কফি বানাতে লাগল। স্টাডি রুম থেকে টাইপ করার শব্দ পেল সে। রাজিব হয়তো উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেছে। একটু কান পেতে শুনতেই কেমন অদ্ভুত লাগল শব্দটা। টাইপিংয়ের শব্দটা কেমন এলোমেলো। থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে। দ্রুত হেটে সে স্টাডিরুমে চলে এলো। এসেই বিস্ময়ের ধাক্কায় মুখ হা হয়ে গেল তার। রাজিব টাইপ করছে, তার চোখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চোখের মনি দু’টো আর নেই, তুলে নেয়া হয়েছে কিছু একটা দিয়ে। রাজিব নির্বিকার মুখে টাইপ করে চলেছে।
- রাজিব, এসব কি?
- আমি নিজেকে নিজে অন্ধ করেছি রেহনুমা।
- কেন?
- আমি সারারাত জেগে উপন্যাসটা পড়লাম রেহনুমা। এমন অসাধারণ-সুন্দর গল্প, অবিশ্বাস্য কল্পনা আমি কখনো পড়িনি। এই উপন্যাসটা আমাকে অমর করে দেবে। এই উপন্যাস লিখতে গেলে আমাকে সত্যিকার অন্ধত্বের অনুভূতি নিয়েই লিখতে হবে। একজন মানুষ তার পুরো জীবন অন্ধ হয়ে থেকেছে এই উপন্যাসের জন্য, তার আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা বুঝে লিখতে হলে আমাকেও অন্ধ হতে হবে রেহনুমা!
রেহনুমা আর ভাবতে পারল না কিছু! তার পা দুটো দুর্বল হয়ে এলো। জ্ঞান হারাল সে।