শীতের দাপট দেখে এলোমেলো লেখা আর আটকে রাখতে পারলাম না। হাত পা পুরা জমে যাচ্ছে। শীতের দাপট দেখে মনে হল স্কুল কলেজ গুলাতে গরমের ছুটির পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য শীতকালীন ছুটিও থাকা উচিত। অন্তত পোলাপান গুলা আরামে থাকুক। আর আমরা যারা কামলা খাটি তারা বুঝি, আহারে!! কি কষ্ট সকালে অফিস এর জন্য বের হওয়া। প্রায়ই ভাবি ইশ!!!আজ যদি না যাওয়া লাগতো। কিন্তু, তা তো আর হয় না। অফিস এর বস তো গণ্ডার শ্রেণীর প্রাণী, শীত কাহাকে বলে তা তো তিনি বুঝেনই না।
যাই হোক আমার বিবাহ অতি দ্রুত হয়েছে বলে আমি নিজেও বুঝতে পারি নি যে বিয়ে করছি। যাকে বিয়ে করেছি তাকে তো বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। বরং যখন তার কথা বলা হয়েছিলো তখন ভেবেছিলাম, নাহ!! এই দুর্মূল্যের বাজারে যেখানে সব ভালো ছেলে সুন্দরী, রূপবতী মেয়ে খুঁজে হয়রান, সেখানে আমার মতো সাধারণ মেয়েকে পছন্দ করার কিছু নাই। এক কথায় আমি ধরেই নিয়েছিলাম এই ছেলে আমার মত সাধারণ কন্যা কে বিবাহ করবেন না। কারন আজকাল সবাই বাইরের সুন্দর নিয়েই মাথা ঘামায়। মনের সৌন্দর্য খোঁজার মত সময় কারো নাই।
যথারীতি আমি ভুলতে বসেছিলাম তার কথা। হঠাৎ একদিন কথা নাই বার্তা নাই একরকম ঝড়ের মতোই আমাকে বলা হল ছেলে মেয়েকে দেখতে চায়, তাও আবার এখনি। আরে কি যন্ত্রণা!! আমি ভাবলাম, এই শীতের বিকেলে ঘুমাচ্ছি এটাই তো ভালো। জানি গেলে আমাকে পছন্দ করবে না। শুধু শুধু নিজের এবং তার দুইজনের ই সময় নষ্ট হবে। আমার ব্যাপক তোড়জোড় করে আমাকে নিয়ে গেলো কেএফসি তে পাত্র দেখাতে।
আমি অলস ভঙ্গি এবং ফুরফুরে মেজাজে গেলাম। যাকে দেখতে গেলাম তিনি তখন সেখানে ছিলেন না। হয়তো কোথাও হাঁটতে গিয়েছিলেন। জানতে পারলাম পাত্র এবং পাত্রের মা দুইজন আছেন। আমাদের ঘটক আমাকে বলল, শোন!! তুমি মাইয়া অনেক কথা কউ মুই জানি। তয় পোলার সামনে বেশী কথা কইও না। পোলায় তোমারে অনেক কিছু জিগাইবে, কিন্তু তুমি চুপ থাকবা। পোলায় কইলাম অনেক চালাক। আমি থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, পোলায় যদি চালাক হয়, আমি কি গাধা??? আর আমি কেন চুপ থাকবো?? আমার যা বলার আমি তাই বলবো। তাতে যদি তার বিবাহ করার ইচ্ছা হয় তো হবে, নয়তো হবে না। এই কথা শুনে ঘটক বেচারা ব্যাপক আকারে মর্মাহত হইলেন এবং তিনি ধরিয়া নিলেন এই মাইয়ারে এইখানে বিয়া দেয়া যাইবে না।
বেশ কিছুক্ষন পরে দূর থেকে দেখলাম একজন অস্থির ব্যাক্তি অতি দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে আমাদের টেবিলের দিকে। দেখে কিছু বোঝার আগেই সে অতি হাস্যজ্জল চেহারা নিয়ে সবার সাথে কথা বলা শুরু করলো। অবশেষে তিনি যখন আমার দিকে নজর দেয়ার সময় পেলেন আমি ভাবলাম কি না কি গুরু গম্ভীর আলোচনা শুরু করবে কে জানে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, আপনি এফেয়ার করেন নাই কেন??? আমি প্রশ্ন শুনে কিছুটা হতবাক হলেও ব্যাপক মজা পেলাম। কারন আমার ধারনা ছিল না কেউ কনে দেখতে এসে এই প্রশ্ন করতে পারে। সে যাই হোক, উত্তর দেবার আগে আমি আমার স্বভাব সুলভ হাসি থামাতে পারলাম না। হাসার পরে মনে হল, ধুর!! এটা কি হল। তারা আসছে মেয়ে দেখতে। এখন থাকতে হবে শান্ত আর আমি কিনা বত্রিশ দাঁত বের করে হেসে ফেললাম। যাই হোক বললাম, যে আসলে হয়ে উঠে নি। উত্তরে সে বলল, তার অনেক ইচ্ছা ছিল কিন্তু হয় নি।
এর পরে টুকটাক অনেক কথাই হল। এক পর্যায় তিনি আমার রাশি কি তাও জানতে চাইলেন। কারন তিনি রাশি পড়তে মজা পান। আমিও মজা পাই কিন্তু বিশ্বাস করি না। কথাবার্তায় জানা গেলো আমার আর তার রাশিতে কোন মিল নাই। পুরাই বিপরীত। আমি আবারো ভেবে নিলাম যাহ্!! এইখানে আর কিছু হবে না। আমি দূর থেকে দেখছিলাম আমাদের ঘটক সাহেব তার দাঁত গুলো সব মেলে দিয়ে ব্যাপক আগ্রহে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম তিনি ব্যাপক খুশি। আমি ছেলেকে বললাম, দেখুন আপনি যদি বিয়ে করতে চান তাও জানাবেন আর যদি না চান, আমাকে ভালো না লাগে তাও জানাবেন। এবং দ্রুত জানাবেন। নয়তো আমার বাপ মা চিন্তায় মাথা নষ্ট করে ফেলবে এবং আমার রাতের ঘুম হারাম হবে।এর মাঝেই জানলাম যে তার অনেক ইচ্ছা কোন বিশেষ তারিখে বিয়ে করার। সামনে একটা বিশেষ তারিখ আছে ১২/১২/১২। যদি পছন্দ হয় তো সে এই তারিখে বিয়ে করবে। আমি মনে মনে ভাবলাম, কয় কি!! মুখের কথা নাকি। বললাম আর হইলো। ১২ তারিখ তো ১৫ দিন পরেই। এতো সোজা নাকি বিয়ে করা। যদিও তার ইচ্ছাটা ভালো লেগেছিল অনেক।
সংক্ষিপ্ত আলাপ চারিতা শেষে আমাদের যাবার সময় হয়ে গেলো। সবাই বিদায় নিলো। আমি ভাবলাম যাবার সময় অন্তত সে আমাকে বলে যাবে, কিন্তু সে হনহন করে চলে গেলো। আমি আবার ভেবে নিলাম যে নাহ!! কিছুই হবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার ছিল কিছু হোক বা না হোক মানুষ টা কে প্রথম দেখে এবং কথা বলে বেশ ভালো লেগেছে। অনেক সহজ আর সাধারণ। অহেতুক ভাব নিয়ে থাকে না। যা বলার সহজে বলে ফেলে। সবচাইতে ভালো ব্যাপার তার হাসি টা ভালো লেগেছে। যেন দুষ্ট কোন শিশু হাসছে। দেখে অনেক মায়া হয়। এসব ভেবে কিঞ্চিত মন খারাপও হয়ে গেলো। মনে হল, আরে যদি এর সাথে বিয়ে হত তবে হাসতে পারতাম। কিন্তু এই ছেলে আমাকে কেন পছন্দ করবে। এর তো অনেক ভালো কোন মেয়ের সাথে বিয়ে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছিলাম এর মাঝেই ঘটক এসে অলিম্পিক জয়ের হাসি দিয়ে বলল, দেখসেন আমি পাত্র দেখাইতে নিয়ে আসছি। আপনি তো ভাবসিলেন আমি ধান্দাবাজ। হুদাই কথা কই। আমি অতি কষ্টে হাসি আটকে রাখতে গিয়েও পারলাম না।
যাই হোক পরীক্ষা পর্ব শেষ করে ঘরে ফিরতেই আব্বু জিজ্ঞেস করলো কেমন দেখলা? আমি বললাম, দেখার চাইতে বুঝলাম বেশী। যা বুঝলাম ভালো বুঝলাম। কিন্তু বুঝলেই তো হবে না। তার ভালো না লাগলে কি আর কিছু সম্ভব নাকি। অতএব, স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়ে চলো সবাই বাইরে খেতে যাই। বলে রাখা ভালো, সেদিন আমার আব্বুর জন্মদিন ছিল। সবাই গেলাম রাতে খেতে। খাবার মাঝখানে বুঝলাম আব্বু আর আম্মু অনেক চিন্তায় আছেন কি বলবে ছেলে পক্ষ সেটা নিয়ে। আমি পাত্তা না দিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলাম। কারন আমি ধরেই নিয়েছি নেগেটিভ কিছুই বলবে। হঠাৎ দেখলাম আমার বাপ-মা ব্যাপক আবেগ নিয়ে মোনাজাত শুরু করলো। ভাবলাম এ আবার কোন নাটক এর দৃশ্য। বুঝলাম আমাদের কাঙ্খিত ঘটকের ফোন এসেছে এবং তিনি বলেছেন ছেলের তো মেয়ে পছন্দ হয়েছে( যদিও পরে জানলাম ছেলে তো ওই রাতে ঘটক কে কিছু বলেই নাই। আমাদের ঘটক স্বপ্নে দেখে জানিয়েছে মনে হয়।)
মুখে না বলিলেও মনে মনে ব্যাপক খুশি হইলাম এবং ভয় পাওয়া শুরু করলাম। কারন বিয়ে মানেই তো ছেলের একার পছন্দ নয়। সাথে লতাপাতা-খালবিল ও ত্থাকে। পরিবারের সবার পছন্দ না হলে তো আর বিয়ে হবে না। অতএব আবার হতাশ!! আমি শুধু এতটুকু বললাম, যে দেখেন আমি জানি বিয়ে করতে গেলে সবার পছন্দের দরকার আছে। তবে সবচাইতে জরুরী হল যে বিয়ে করবে তার পছন্দ। আর সে যদি মনে করে যে আমাকে বিয়ে করলে সে ভালো থাকবে, তখন বাকি সবাইকে রাজি করানো কোন ব্যাপার না। আমি জানি একজন মানুষ সবার একসাথে পছন্দ হবার কথা না। কারো ভালো লাগবে, কারো খারাপ লাগবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং যেটাই করবেন তাড়াতাড়ি ভাববেন। এর পরে জানলাম আবার আমাকে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে। এবার পরিবারের সামনে পরীক্ষা দেবার পালা। এই পরিক্ষায় যাবার আগে অনেক ভয় ছিল। তবে এই পুরো সময় এ আমাকে অনেক সাহস দিয়েছেন আমার স্বামী। তার সাহস এর জন্যই কখনো ভয় পাইনি।
আমি সেদিন তাকে বললাম, দেখুন যা পরীক্ষা দেবার দিয়েছি। আপনি যা বলার আজ ই বলবেন। সে আমাকে বলল, অবশ্যই। আজ রাতেই আপনাকে হ্যা বা না জানাবো।
এর পরে সারাটা দিন যে কি করে গেলো বুঝলাম না। অনেক ভয়, অনেক সংশয় নিয়ে কাটালাম। প্রতি মুহূর্তে ভয় কাজ করছিলো। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এলো রাত ১১টার দিকে। জানতে পারলাম সব ঠিক আছে এবং ১২ তারিখ বিয়ে হবে। হঠাৎ মনে হল আরে ১২ তারিখ তো আর মাত্র ৪ দিন পরেই। মজা করতেসে নাকি আমার সাথে। নিজেকে বিশ্বাস করাতে অনেক সময় লেগেছিল। ঘোর লেগেছিল। ঘোর কাটাতে অনেক সময় লাগলো।
দেখতে দেখতে এলো সেই দিন। অনেক ভয়ভীতির অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তার সাথেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো। আমি জানি না সে আমার মাঝে কি দেখেছে, কি পেয়েছে। তবে তার মাঝে আমি একটা সরল আর সুন্দর মনের মানুষ দেখতে পেয়েছি। যার সাথে অনেক কথা বলা যায়, অনেক গল্প করা যায়, যার মুখের হাসি দেখতে ভালো লাগে। অদ্ভুত সে অনুভূতি!! বলে বোঝানোর নয়। আমি কখনো তাকে বুঝাতে পারবো না। সবকিছু হয়তো বুঝাতেও নেই। কিছু ব্যাপার অজানা থাকাই ভালো। সর্বোপরি আমি খুশি একজন ভালো মানুষকে আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়ে। সারাজীবন যেন সে এভাবেই থাকে আমার সাথে শুধু এটুকুই কাম্য।
অনেক লম্বা গল্প করে ফেললাম। সবাই বিরক্ত হয়ে গরম চোখে তাকাচ্ছেন বুঝতেই পারছি। শান্ত হয়ে যান। একটা হাসি দেন মন ভালো হয়ে যাবে
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৫