তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকি হবে পানি নিয়ে। যদিও আমরা নিজেরা তৃতীয় বিশ্বেরই নাগরিক, তবু বিশ্বযুদ্ধ হলে আমাদের কী? আমরা তো বিশ্বের বাইরে। আর আইনস্টাইন বলে গেছেন, চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাটিসোটা দিয়ে, তখন আমাদের একটা ভুমিকা থাকবে, এরই মধ্যে আমরা তার প্রমাণ রেখে চলেছি, দু-আড়াই বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিনগুলোয় রাজপথে আমরা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের মহড়া দিয়েছি, আর চর, হল, হাট বা জমি দখল করতে গিয়ে আমাদের অকুতোভয় যোদ্ধারা প্রায়ই লাঠিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে থাকে। চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে আমরা ভালো করব, যদি আমরা তত দিন বেঁচে থাকি।
কিন্তু বেঁচে থাকব, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ জীবনের অপর নাম পানি, আর আমরা সেই পানি পাব কি না, সেই সন্দেহ এখন ঘোরতর রূপে দেখা দিয়েছে।
কথাটা প্রথম শ্রবণে মেনে নেওয়া তো দুরের কথা, নিজের কানকেই বিশ্বাস করা কঠিন। পানির ওপর ভাসছে এই দেশ। উড়োজাহাজ থেকে যখন পাখি কিংবা পাইলটের চোখে তাকাই এই বদ্বীপের দিকে, তাতে মনে হয়, পুরোটা দেশ আসলে পানির নিচেই ডুবে আছে। তবু, আগামী পাঁচ-সাত বছর পরে এই ঢাকায় আমরা পান করার মতো পানি পাব কি না, এই সন্দেহ ঘোরতর রূপে বিদ্যমান। এখনই ঢাকায় পানির সংকট প্রবল, প্রায়ই অনেক বাড়িতেই পানি থাকে না, দিনের মধ্যে কখনো কখনো হয়তো পানি আসে, সেটা ধরে রাখতে গৃহিণীদের নানা কোশেশ করতে হয়, আর অনেক এলাকা পানির অভাবে কারবালা হয়ে পড়ে। আমরা সংবাদমাধ্যমে এক কলস পানির জন্য দীর্ঘ লাইনের ছবি অনেক দেখেছি। এটাও আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু পানি যে পাঁচ-সাত বছর পরে ঢাকা শহরে পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে, এটা একটা বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী মে দিবসের জনসভায় বলেছেন, পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে সময় লাগবে। কথাটায় সত্যতা আছে। আবার ঢাকা শহরের পানি সমস্যার একটা বড় সহজ আশু সমাধানও আছে। সেটা হলো অব্যাহতভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা।
ঢাকা শহরে ঢাকা ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে, তার বেশির ভাগটা আসে গভীর নলকুপ থেকে। ৫০০-র বেশি গভীর নলকুপ আছে ঢাকা ওয়াসার (৫২৭টার মতো)। এর মধ্যে অনেক নলকুপের বিদ্যুৎ-জেনারেটর নেই। ফলে লোডশেডিং বেশি হলে ওইসব গভীর নলকুপ বন্ধ থাকে। এমনিতেই ঢাকা ওয়াসার মোট পানি সরবরাহ ক্ষমতা ঢাকার মোট পানির চাহিদার তুলনায় কম। তার ওপর যদি দিনের কিছু সময় নলকুপ বন্ধ থাকে, ওই এলাকায় পানিসংকট দেখা দিতে বাধ্য। এ সমস্যার একটা সহজ সমাধানের আশ্বাস আমরা পেয়েছি। তা হলো ওয়াসার গভীর নলকুপে একাধিক বৈদ্যুতিক লাইন রাখা। একটায় লোডশেডিং দেওয়া হলে যেন আরেকটা লাইন চালু করা যায় এবং পানি উত্তোলন অব্যাহত রাখা যায়। এই বুদ্ধিটা ভালো বুদ্ধি। এত দিন কেন এই বুদ্ধি আমাদের মাথায় আসেনি! আরেকটা কাজও করা যেতে পারে। সেটা হলো, যে কয়টা গভীর নলকুপকেন্দ্রে বিদ্যুতের জেনারেটর নেই, সেখানে জেনারেটর স্থাপন করা। এই নিয়ে কথা বলছিলাম আইনুন নিশাতের সঙ্গে। আমার সরাসরি শিক্ষক এই পানি-বিশেষজ্ঞ বললেন, মোটামুটি ১০০ কোটি টাকা লাগতে পারে সব কটা নলকুপের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করতে। ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে এই ১০০ কোটি টাকা সরকারের জন্য খুব কি বেশি টাকা? অবশ্য রোজ নগদ টাকা দিয়ে তেল কিনতে হবে, সেই টাকার কথাও ভাবতে হবে। একটা ফেজে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে আরেকটা ফেজে সংযোগ দেওয়া গেলে খুবই ভালো, কিন্তু কোনো ফেজেই যদি বিদ্যুৎ না থাকে, তখন তো পানিবিহীন দিন যাপন করা যাবে না।
কিন্তু আমাদের চিন্তা বর্তমান নিয়ে নয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে। পাঁচ-সাত বছর পরে ঢাকা শহরের গভীর নলকুপে আমরা আদৌ পানি পাব তো?
শুধু ওয়াসার পাঁচ শতাধিক গভীর নলকুপ নয়, ঢাকা শহরে সহস্রাধিক বেসরকারি গভীর নলকুপ দিয়েও মাটির নিচের পানি তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন প্রতিঘণ্টায় পানি উঠছে আর উঠছে। আর এর ফলে আমাদের ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে ক্রমাগত ও দ্রুত। প্রতিবছর মোটামুটি দুই থেকে তিন মিটার নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। পাঁচ বছর পরে পানির স্তর নেমে যাবে আরো ১৫ মিটার নিচে। যে হারে লোকসংখ্যা বাড়ছে আর বাড়ছে গভীর নলকুপের সংখ্যা, তাতে আরও বেশি নিচেও নামতে পারে। তখন আদৌ গভীর নলকুপেও পানি ওঠানো যাবে তো!
ঢাকার ভুগর্ভস্থ পানির স্তর আমরা ক্রমাগত ফাঁকা করে চলেছি। আমাদের মাটির নিচটা এখন ফাঁপা। তার পরিবেশগত ঝুঁকি কী, ভুমিকম্প হলে পুরো ঢাকা দেবে যাবে কি না, এটা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু পাঁচ-সাত বছর পরে ঢাকা শহরে গভীর নলকুপে আমরা যে পানি পাব কি না, এটা নিয়ে ভাবার সময় এখনই।
ঢাকা শহরের ভুগর্ভস্থ পানির আধারগুলোতে এখন পানি আসছে ঢাকার বাইরে থেকে, ময়মনসিংহ ইত্যাদি এলাকা থেকে, মাটির নিচে পানির স্রোত বয়ে আসছে ওইসব এলাকা থেকে। খাড়াভাবে আসছে না।
সারা দেশে আমরা আমাদের সেচকাজে ও গার্হস্থ্য কাজেও গভীর ও অগভীর নলকুপের ওপর নির্ভর করছি। সারা দেশে লাখ লাখ নলকুপ প্রতিনিয়ত ভুগর্ভস্থ পানি তুলছে কোটি কোটি গ্যালন। তার একটা প্রাথমিক কুফল আমরা পেয়েছি, একটা ধাਆা আমরা খেয়েছি আর্সেনিকদুষণের মাধ্যমে।
এখন ঢাকায় গার্হস্থ্য প্রয়োজনে আর ঢাকার বাইরে সেচকাজের জন্য আমরা যদি আমাদের মাটির নিচের পানির ব্যবহার অব্যাহত রাখি, তাহলে একদিন না একদিন বাংলাদেশে ভুগর্ভস্থ পানির আধারগুলো নিঃশেষিত হয়ে যেতে বাধ্য। অন্য অঞ্চলে হয়তো হাহাকারটা লাগবে ২০ বছর কিংবা আরও পরে, ঢাকায় এই পানির সংকট দেখা দেবে পাঁচ-সাত বছরের মধ্যেই। তখন আমরা কী করব? পানি না পেয়ে মারা যাব?
অথচ বছরের চার-পাঁচ মাস এই দেশ বন্যার পানিতে ডুবে থাকে। কবি কোলরিজের ওই কথাটাই তাই বারবার বলতে হয়−সর্বত্র পানি আর পানি, কিন্তু পান করার মতো এক ফোঁটা পানিও নেই।
এ সমস্যাটা নিয়ে ভাবনা শুরু করতে আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি না করে এখনই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সমাধানের পথে যেতে হবে।
সবচেয়ে বড় সমাধান হলো, মাটির ওপরের পানি ব্যবহার করা। ঢাকার চারদিকেই নদী আছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের উজানে যেখানে নদীতে ঢাকা শহরের বর্জ্য মেশে না, সেখানে পানি শোধনাগার স্থাপন করে ঢাকা শহরের পানির চাহিদা মেটানোর কাজ জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা দরকার। আইনুন নিশাতের প্রতিধ্বনি করে বলি−পানি শোধনাগারগুলোকেও বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার, তাতে পানি সরবরাহ করতেও দুরত্ব কমবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয় বড় জলাধারের মাধ্যমে। বৃষ্টির পানি বা নদীর ভরা মৌসুমের অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে অনেক শহরে। যেমন আছে সিঙ্গাপুরে বা মেলবোর্নে। আমরা যদি আমাদের আশুলিয়ার মতো এলাকাগুলো ভুমিদস্যুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোকে রক্ষা ও উন্নত করতে পারি, তবে সেসব হতে পারে আমাদের পানির বড় উৎস।
বাড়িতে বাড়িতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখলেও বছরের ছয় মাস আমরা সেই পানিতে গার্হস্থ্য প্রয়োজন মেটাতে পারি। তা করা হলেও তো আমাদের ভুগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কম পড়ে। সে ক্ষেত্রে নতুন ভবন নির্মাণের শর্ত হিসেবে ছাদে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা ও ব্যবহার করার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
আরও একটা বিকল্প উপায় হতে পারে, আমাদের শুন্য ভুগর্ভে উল্টো পানি ঢুকিয়ে দেওয়া। ইনফিল্ট্রেশন গ্যালারি নামের একটা পদ্ধতিতে এটা করা হয় কোনো কোনো দেশে। এ পদ্ধতিতে পানি আসে আনুভুমিকভাবে। আরেকটা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। সরাসরি কুপ খনন করে কুপের মধ্যে ফিল্টারের জন্য বালি, পাথরকুচি ইত্যাদি যা যা দিতে হয়, সেসব দিয়ে সরাসরি ভুগর্ভস্থ জলাধারে পানি প্রবেশের ব্যবস্থা করা। তবে প্রতিটা পদ্ধতিরই নেতিবাচক দিক আছে। সেসবও বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতেই হবে। কারখানার বর্জ্য নদীর পানিতে মেশানো বন্ধ করতে হবে অবশ্যই। এ বিষয়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটা কড়াকড়ি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার ধাਆা সামলাতে পরে সেটা শিথিল করা হয়। এটাতে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বুড়িগঙ্গাসহ আমাদের সব নদীকেই বাঁচাতে হবে, দখলমুক্ত করতে হবে, দুষণমুক্ত রাখতে হবে।
আর আমাদের পানির উৎস হিসেবে গভীর নলকুপের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। সেটা শুধু ঢাকা শহরের জন্য নয়, সারা দেশের সেচকাজের জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের ভু-ওপরস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতেই হবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পানি নিয়ে বাধবে, কিন্তু আমরা বাংলাদেশ বন্যার জলেই ডুবি, সেটাই হতে পারে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। আমাদের পানি ধরে রাখতে হবে, সেই পানি বছরের বাকি সময় সেচে, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করতে পারতে হবে।
মুশকিল হলো, আমরা কখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। আমাদের সরকারগুলো সমস্যার সমাধান চায় তাৎক্ষণিক। আর আমাদের ভবিষ্যৎ-ভাবনার দায়িত্ব আমরা দিয়ে রেখেছি আমাদের বিদেশি উন্নয়ন-সহযোগীদের ওপর। তারা তাদের সুবিধামতো, মর্জিমতো, বিদেশাগত পুঁথিগত বিদ্যামতো আমাদের দাওয়াই দেয়। যদি দেয় তো আমরা সেই মতো কিছুদিন চলি।
ঢাকা শহর ১০ বছর পরে কত বড় হবে, কত মানুষ থাকবে এ শহরে, আর তাদের পানি কোত্থেকে কীভাবে আসবে, ২০ বছর পরে কী হবে, তার পরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। ভিশন ২০২১ সালের দিনগুলোয় পানি নিয়েই দেশের ভীষণ করুণ অবস্থা কল্পনা করে আমাদের আঁতকে উঠতেই হচ্ছে।
আরেকটা কথা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আন্দোলনটা থেমে গেল কেন? আর বিকেন্দ্রীকরণের কী হলো? পোশাকশিল্প কারখানার কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে, এর উৎপাদিত পণ্যও যায় বিদেশে। এ কারখানাগুলো তাহলে চট্টগ্রাম বা মংলার যত কাছে হয় ততই কি জ্বালানি-খরচ, মহাসড়কের ভিড়, যানবাহনের সংখ্যা, পরিবেশদুষণ কমে না? আমরা কি বন্দরের কাছে এক বা একাধিক পোশাকশিল্প পল্লী গড়ে তুলতে পারি না? যেখানে কারখানা আকাশের দিকে বেড়ে না উঠে আনুভুমিকভাবে বাড়বে, যেখানে আগুন লাগলে কর্মীরা ঝলসে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না। যে পোশাকশিল্প পল্লী ১৫ লাখ মানুষের ভার থেকে বাঁচাবে ঢাকা শহরকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পানির সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। কথাটা দু-চার দিনের জন্য সত্য, দুই চার মাসের জন্য সত্য নয়। কিন্তু পানির সমস্যার স্থায়ী সমাধানটা সত্যি কঠিন। তা যদি করতে হয়, কাজ শুরু করতে হবে আজই।
আনিসুল হক: কবি, লেখক, সাংবাদিক।