somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবাসেঃ পর্ব ১৪

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব

খাটটি পেয়ে আমার সারাদিন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আগের বাসায় ম্যাট্রেস ছিল। বাসা ছাড়ার সময় বাড়ীয়ালাকে ফেরত দিতে হয়েছে । ম্যাট্রেসগুলোয় উনি ফ্রি থাকতে দিয়েছিলেন। ওটি তার সামার ক্যাম্পিং এ লাগে।

আমেরিকায় ক্যাম্পিং খুব জনপ্রিয় । সামার আসলেই ঘর বাড়ি ফেলে এরা বনে বাদাড়ে চলে যায় । সেখানে কিছুদিন তাঁবু খাটিয়ে থাকে । বন জঙ্গল অসহ্য মনে হলে আবার লোকালয়ে ফিরে আসে।

সুরিয়ার বাসায় এতদিন ওর সোফায় ঘুমিয়েছি । সুরিয়া অবশ্য যেদিন আসি সেদিন আমাকে বলেছিলো , এখানে তুমি খুব আরামে ঘুমাবে । মথু যখন থাকত, মথু ঘরে আর আমি লিভিং রুমে এই সোফাটাতে ঘুমাতাম।

সুরিয়াদের আগের এপার্টমেন্টে; আরও অনেকের সাথে ওরা একটি রুম নিয়ে থাকতো । সুরিয়া বলল, তখন ও নাকি তারা আলাদা ঘুমাতো । মথু উপরে খাটে আর সে নিচে মেঝেতে । আর ও বলল, একি ঘরে থাকলে কি হবে, জানো মথু কিন্তু এখনও আমাকে ছোঁয়নি ।

মথু আসলেই খুব ভদ্র ছেলে ছিল । সুরিয়া ও খুব ভদ্র মেয়ে । আমি কখনই ওদের সম্পর্ক নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি। তবু সুরিয়া আমাকে কেন এত কিছু বলল বুঝলাম না ।

রাতে নাসরিনের সাথে যখন কথা হল । ওকে বললাম , আমরা বাইরে থেকে যা ধারনা করি তা সবসময় ঠিক নয় । সুরিয়া আমাকে আজ সবটা বলেছে । নাসরিন বলল , তাই নাকি ? এসব গল্প সুরিয়া কোনোদিন আমাকে করে না । তোমার মতো গাড়লদেরকেই শুধু করে।

আমি যে সুরিয়ার কথা শতভাগ বিশ্বাস করেছিলাম তা নয় । তবে নাসরিনে আমাকে গাড়ল বলাতে বেশ রাগ হল ।

যাই হোক খাটটি পেয়ে আমি খুব আরাম করে ঘুমুচ্ছিলাম। নিজের একটা খাট , নিজের একটা বিছানা অন্যরকম অনুভুতি কাজ করছিল । দিনের বেলা ল্যাবে গিয়ে কাজ করতাম আর ভাবতাম কখন বাসায় যেয়ে খাটে গড়াগড়ি দেবো ।

এর মাঝে প্রফেসর মনে করিয়ে দিলেন ১৩ই জুলাই ল্যান্ডস্যাট ক্যালিব্রেসন মিটিঙের কথা । স্যু ফলসে, ইরসে হবে মিটিং । ইরস হল আর্থ রিসোর্স অব্জারভেশন সেন্টার। সহজ কথায় স্যাটেলাইট ডাটা যেখানে জমা হয় ।

মিটিংটা ছিল নাসা, আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানের কম্বাইন্ড মিটিং । মিটিং এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা। প্রফেসর বললেন, আমরা সকাল ৬টায় রওনা দেব । ৬টার মধ্যে সবাই যেন চলে আসে । মিটিং এ ব্রেকফাস্ট থাকবে তবে কোন লাঞ্চ দেওয়া হবে না । বাড়ি থেকে খাবার আনতে পার অথবা কিনতে পার। খাবার একটু এক্সপেন্সিভ হতে পারে।

আমি একটু অবাকই হলাম । এত আয়োজন , এত প্রস্তুতি । খাবারই দেবে না ! সে আবার কি রকম মিটিং । আমাদের দেশে মিটিং মানেই তো খাওয়া দাওয়া ।

ঐ দিন ভোরে উঠে লাঞ্চ বানিয়ে ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । এত ভোর, আমার ধারনা ছিল , রাস্তা ঘাট সব ফাঁকা । কিন্তু দেখলাম না ভালই গাড়ি চলছে । সর্টকার্ট করতে আমি ভিতরের রাস্তা দিয়ে গেলাম । ভিতরের রাস্তায় কেউ নেই আর ভোর পাঁচটা, তাই সূর্যের আলোও ততটা ফোটেনি ।

ভিতরের রাস্তায় এক বাড়ি ছিল । তার সামনে একটা ভাঙ্গা গাড়ি । মনে হয় কেউ থাকেনা । একদিন সন্ধ্যায় এক থুত্থুরে বুড়িকে বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতে দেখেছি । বুড়িকে আমার গল্পের সেই ডাইনী বুড়ির মত মনে হয়েছিল ।

আমি জোরে পা চালাচ্ছিলাম। আমার শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি বুড়ি বেরিয়ে এসে আমার ঘাড় মটকে দেবে । ডিপার্টমেন্ট পৌঁছে দেখি পুরো ঘেমে গেছি । কাপড় চোপড় পাল্টে অনেক্ষন ধরে সাজগোজ করলাম ।

৬টা বাজে আমরা রওনা দিয়েছি । আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন প্রফেসর এরন । সাতজন বসা যায় । বেশ বড় গাড়ি । পিছনের সিটে আমি আর মারকট বসলাম । পথে যেতে যেতে অনেক ফসলের মাঠ পড়ল । সূর্যের আলো তখন কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে । খুব চমৎকার লাগছিলো দেখতে । বেশীর ভাগই সব গম , যবের ক্ষেত ।

আমেরিকার ফসল সম্পর্কে গল্প হচ্ছিল। জানলাম ভৌগোলীক কারণে এখানে মসলার চাষ হয় না । এই কারণে আমেরিকান খাবারে মসলা থাকেনা । যেখানে যেটি হয় তাদের তো সেটি খেয়েই অভ্যস্ত হওয়ার কথা । তবে আমেরিকানরাও এখন মসলা খাওয়া শুরু করেছে । প্রধানত মেক্সিকো ও আরও অনেক দেশ থেকে মসলার আমদানি করা হয় ।

এক ঘণ্টা পর আমরা ইরস পৌছালাম । তার আগে আমাদের সিকুরিটি চেক করা হল । ল্যারি নিজেই বলল ,খুবই হাস্যকর এসবের কোন মানে হয় । ইরসে আছেটা কি , টেররিস্টরা কেন আসবে এখানে?

৪/৫ মাস আগে প্রফেসর এরন একবার জিগ্যেস করছিলেন , ডু ইউ নো ওবাইদুল ফ্রম বাংলাদেশ ? এর আগে তিনি আমাদের গার্মেন্টস পুড়ে যাওয়া নিয়ে অনেক গল্প করছিলেন । তখন মনে হয়েছিল, বাহ্ উনি আমার দেশের অনেক খবরই রাখেন । আর বাংলাদেশের ওবাইদুল কাদেরকে তো সবাই চেনেই ।

আমি বললাম, ইয়েস আই নো হিম ভেরি ওয়েল । হি ইজ দা মিনিস্টার অফ আওয়ার কান্ট্রি। তিনি বললেন , ওহ রিয়েলি ! একচুয়ালি হি ওয়াজ মাই স্টুডেন্ট ।

আমার উত্তর শুনে অনেকক্ষণ হাসলেন উনি আর ঘটনাটি আমি ভুলেও গেলাম ।

আমাদের পিছনে আর একটি গাড়ী চেকের জন্য অপেক্ষা করছিল । কিন্তু তাদেরকে আগে যেতে দেওয়া হল। ডক্টর হেল্ডার বললেন গাড়িতে ওবাইদুল আছে । নামটা আমার খুব চেনা মনে হল। কোথায় যেন শুনেছি এ নাম ।

যাই হোক আর কতগুলি চেক পেরিয়ে আমরা ইরসে ঢুকলাম।মিটিং শুরু হওয়ার আগে সবাই খাওয়াদাওয়া করছে। ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে। ব্রেকফাস্ট এত পরিমানে দেওয়া হয়েছে যে লাঞ্চ করার আর দরকার নেই ।

কিন্তু সময় কম আর গপগপ করে খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখলে ভাল দেখায় না । আমি শুধু একটি আপেল নিলাম । মিটিং শুরু হল । চারদিক পিনপতন নীরবতা ।

খুব আস্তে করে আমি আপেলে কামড় দিচ্ছিলাম যাতে আমার আপেলের কামড়ে মিটিঙের কোন অসুবিধা না হয় । কিন্তু সেই আস্তেটাতেই মনে হলো যেন অনেক শব্দ হচ্ছে । পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে যাচ্ছে । নিশ্চিত হতে পাশে বসা সুদীপকে বললাম , দেখোতো আমি আপেল খেলে তুমি কোন কচকচ শব্দ শোনো কিনা । সুদীপ বলল , হুম হাল্কা কচকচ শোনা যাচ্ছে ।

আপেল খাওয়া বাদ দিয়ে আমি মিটিঙে মন দিলাম । আমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল । আমার পরিচয় যখন দিল তার আগ পর্যন্ত আমার ধারনা ছিলনা যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আমার ঘাড়ে চাপানো হয়েছে । বিদেশে প্রফেসররা অবশ্য এভাবেই কথা বলেন । নাউ ইউ আর ইন চার্জ অফ দিস প্রজেক্ট । ইউ আর সাইন্টিস্ট । উই অল আর সাইন্টিস্ট হেয়ার ...। এরকম আরও অনেক কিছু ।

এই অনেক কিছুর কারনে যেটি হয় , যে ছেলেটি মনে মনে ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটছিল । একসময় তার মনে হয়, সত্যিই কি আমি সাইন্টিস্ট না ? চাইলে কি আমিও কিছু করতে পারি না ।

এই কিছু করার জন্য ছেলেটি দিনরাত কাজ করে । কাজ না করে অবশ্য এখানে উপায় ও নেই । ফায়ার করতে এরা ওস্তাদ । তবে ফায়ার এরা ফায়ারিং মুডে করে না । চোখে জল আনার মত করে বলে দেখ আমি তোমাকে এ বছর সাপোর্ট দিতে পারছি না । আসলে আমার সে সুযোগ নেই । ফান্ডের অবস্থা ভাল নয় । আমার খুব খারাপ লাগছে এ জন্য । তোমাকে সাপোর্ট দিতে পারলে এ মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতাম ...।

কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেটি হয়, আসলে সে বড় অঙ্কের ফান্ড পেয়েছে । তোমাকে দিয়ে সে তার আউটকাম পায়নি বলে এই কৌশল ।
তবে খারাপ ভাবে কখনই এরা বলবে না , খারাপ ব্যাবহার করবে না । কারো মনে কষ্ট দেওয়া আমেরিকানদের কাছে প্রচণ্ড অমানবিক ব্যাপার । কিন্তু হৃদয় ভেঙে খান খান করা , পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেওয়া সামান্য ব্যাপার ।

মিটিঙের লোকজনের অধিকাংশই ছিল নাসার ক্যালিব্রেসন সাইন্টিস্ট , ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আর কয়েকজন ইরস ইমপ্লয়ী । আমার চোখ শুধু খুঁজছিল এদের মধ্যে কোন বাংলাদেশি আছে কিনা । হুইল চেয়ারে বসা একজনকে দেখলাম । তাকে আমার বাংলাদেশী মনে হল । ইরস ইমপ্লয়িদের যখন পরিচয় দেওয়া হল । জানলাম তার নাম ওবাইদুল এবং নিশ্চল আমাকে বলল, হি ইজ ফ্রম বাংলাদেশ ।

বাংলাদেশ নামটা শুনে আমার আবেগে আপ্লুত হওয়ার কথা কিন্তু ওবাইদুলকে দেখে ততক্ষণে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি এই ওবাইদুলের কথায় তিনি বলেছিলেন । কিন্তু সেই ওবাইদুল এমন হতে পারে সেটি আমার ধারনার ভীষণ বাইরে ছিল । ওবাইদুল কে আমি এখানে ভাই বলে সম্বোধন করাটা সমীচীন মনে করছি ।

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওবাইদুল ভাইকে দেখছিলাম । মিটিং এর কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না ।

ওবাইদুল ভাইয়ের বর্ণনা কিভাবে দেব ঠিক বুঝতে পারছিনা । এর জন্য সত্যি ক্ষমা চাচ্ছি। ওবাইদুল ভাই একটি হুইল চেয়ারে বসে আছেন, হাত পা নড়াতে পারছেন না । হাতের সাথে একটা শক্ত লাঠির মত বেঁধে রেখেছেন ।সেটা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পাসওয়ার্ড টাইপ করলেন ।

ভাবছিলাম, যদি পাসওয়ার্ড টাইপ করতে এতক্ষন লাগে তাহলে উনি কি করে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করছেন! এত এত কাজ কি করে করছেন ! একজন বলল একটা ভয়েস ট্রান্সলেটর দিয়ে উনি কাজ করেন । তবে ওনার প্রেসেজেন্টেসনের সময় মনে হল , কথা বলতেও ওনার বেশ কষ্ট হচ্ছে ।

মাঝখানে আমাদের ট্রি ব্রেক দেওয়া হল । আমি ওবাইদুল ভায়ের সাথে দেখা করতে গেলাম ।নিজের পরিচয় দিলাম । আমাকে খুব সহজেই তুমি করে বলা শুরু করলেন । একজন বাংলাদেশী পেয়ে উনিও যেন বেশ আনন্দিত । বেশ হেসে হেসে কথা বলছিলেন। চমৎকার করে হাসেন উনি।

আমার ধারনা ছিল ওবাইদুল ভাই নিশ্চয়ই আমার বছর সাত আট বছরের সিনিয়র হবেন । কিন্তু তাঁর ব্যাচ শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হবার অবস্থা । তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন । '৮৯ এর ব্যাচ । কিন্তু তাকে দেখলে সেটি মনে হবার কোন কারন নেই । গৌর বর্ণের মুখ খানায় চমৎকার হাসি যেন তাকে চির তরুন করে রেখেছে ।

এই চির তরুনটি যখন আমার সাথে কথা বলছিলেন । এই দীর্ঘ কথা বলার সময় একবারও ঘাড় নড়াননি । সেটি কোন লজ্জা বা ইচ্ছাকৃত কারনে নয় । ওবাইদুল ভাই ঘাড় নড়াতে পারেন না ।

বছর কয়েক আগে বন্ধুদের সাথে এক আলো ঝলমলে দিনে তিনি ঘুরতে বেরিয়েছিলেন । তখন তাদের গাড়িতে একটা এক্সিডেন্ট হয় । ওবাইদুল ভাই এর বাকি বন্ধুদের তেমন কিছু না হলেও সেই আলো ঝলমলে দিনে তাঁর জীবনে অন্ধকার নেমে আসে । তবে তাঁর নিজ কর্মগুনে সেই অন্ধকার তিনি সরিয়ে ফেলেছেন । তাঁর নির্মল হাসি , উপস্থাপন দেখে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে ।

কলেজে থাকতে আমার এক বন্ধু ছিল ওর নাম প্রিয়াঙ্কা । পরে ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে চলে যায় । আমরা বন্ধুরা একদিন গল্প করছিলাম । এক বন্ধু একটা লোকের গল্প বলছিল, যে অমুক পারে, তমুক পারে তবে ঘাড় নড়াতে পারে না ।

হঠাৎ প্রিয়াংকা চেঁচিয়ে ঊঠলো, তাহলে লোকটা বেঁচে আছে কেমন করে ? আমি বললাম, না বাঁচার কী আছে ?

না লোকটা তো আকাশ দেখতে পারে না , আকাশ না দেখে কেউ বাঁচে থাকে কিভাবে?ওবাইদুল ভাইকে দেখে প্রিয়াংকার কথাটা মনে পড়ে গেলো । আকাশ নিয়েই যার কাজ , সেই কিনা আকাশ দেখতে পারে না ।

লাঞ্চ টাইমে আমি টুনা সালাদ কিনলাম । সবার সামনে বক্স খুলে খাব ভেবে অদ্ভুত লাগছিল । সুদীপ বলল তুমি না খাবার এনেছ ? আমাকে দাও। সুদীপ কে নুডুলস দিয়ে আমি ওবাইদুল ভায়ের কাছে গেলাম ।

দেখলাম তার আমেরিকান সহকর্মীরা তার খাবার এনে দিচ্ছে। খাওয়া শেষে পরিষ্কার করে দিচ্ছে । আর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করছে ।করুণা করে নয় , খুব সম্মানের সাথেই করছে । বুঝলাম আমেরিকান চাকরীর এই এনি টাইম হায়ার এনি টাইম ফায়ার বাজারে ওবাইদুল ভাই খুব গুরুত্বপূর্ণ । নিশ্চয়ই আমেরিকানদের কাছে সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল এতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন কি করে !

শুনেছি ওবাইদুল ভাই স্যু ফলসের একটা বিশেষ ফ্ল্যাটে থাকনে । শারীরিক ভাবে অসুবিধাগ্রস্থ লোকদের জন্য এই ফ্ল্যাট । চব্বিশ ঘণ্টা নার্স থাকে সেখানে । অফিসে আসার সময় এক আমেরিকান সহকর্মী ওনাকে রাইড দেন ।

আমেরিকার প্রতি আমার মাঝে মাঝে খুব রাগ হত । তাদেরকে অমানবিক , নির্দয় , নিষ্ঠুর মনে হত । কিন্তু সেদিন যেন বারবার ওদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞই হচ্ছিলাম ।

মিটিং থেকে ফিরতে আঁটটার মত বেজে গেল । তখনও কটকটা রোদ । ল্যারি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল ।

পরদিন ল্যাবের সাপ্তাহিক মিটিং। ল্যারি আমাকে বলল , তুমি কি প্রতিদিন এত দুর হেঁটে আস ?
- হুম ।
ডক্টর হেলডার বললেন, কেন তোমার গাড়ি নেই ?
- নেই ।
-ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই ?
-নেই ।
সাইকেল আছে ?
-আছে, তবে চালাতে পারি না ।

একটা মানুষ সাইকেল চালাতে পারে না , উনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না । বললেন, তাহলে তুমি তোমার দেশে কি করতে ? সাইকেল চালাতে পার না , গাড়ি চালাতে পার না । পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিতে নাকি সবসময় এখনকার মত হাঁটতে ?

আমি বললাম , না হাঁটতাম না । প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট নিতাম, ওটার নাম রিক্সা । আমাদের দেশের মানুষ তোমাদের মত এত হাটে না।

বুঝিয়ে বললাম, রিক্সা খুব ভাল ট্রান্সপোর্ট । ওটা তোমাকে বাসার সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে । ওটাতে খুব হাওয়া হয় । ওটাতে চড়লে তোমার মন ভাল হয়ে যাবে , কখনও বমি পাবে না। যেহেতু মাত্র দুজন বসা যায় এবং বেশ ঝাঁকুনি হয় তাই তুমি ওটাতে ডেট ও করতে পার । ঝাঁকুনির সুবিধা , তুমি মাঝে মাঝে না চাইতেই অপরপক্ষের ছোঁয়া পাবে ।

- ওহ্ ইট স রোমান্টিক।
- ইয়েস।
- হুম, তবে চিন্তা কর না জান্নাতুন । রায়ান তোমাকে এখন থেকে সাইকেল চালানো শেখাবে।

পরদিন ল্যাব শেষে রায়ান দেখি দাঁড়িয়ে আছে । বলল চল, তোমাকে সাইকেল চালানো শেখাই । বললাম, দেখো এই বুড়ো বয়সে এই শিখে হাত পা ভাংতে চাই না ।

রায়ান হাসতে হাসতে বলল, হাউ ওল্ড আর ইউ ? এক বছর কমিয়ে বললাম । বলল, রিয়েলি? তোমাকে তো অনেক ইয়াং দেখায় ।

রায়ানের মন্তব্যে ভীষণ খুশি হলাম আমি ।

-হুম আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল তুমি কখনও এশিয়ানদের বয়স অনুমান করতে পারবে না ? তাদেরকে আসল বয়সের থেকে অনেক ইয়াং দেখায়।

রায়ানের কথায় খুব রাগ হল আমার ।

এর মধ্যে আমি এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললাম । আমার কিছুটা ভুলে যাওয়া রোগ ছিল । সেদিন চুলায় মুরগী রান্না করব বলে তেল গরম দিলাম । দিয়ে মেঝেতে কি যেন একটা পড়েছিলো , সেটা পরিস্কার করছিলাম । পরিস্কার করতে করতে চুলায় যে কিছু দিয়েছি বেমালুম ভুলে গেলাম ।

আমি যখন ঘষে ঘষে মেজেটা তকতকে করছি , সুরিয়া চিৎকার দিয়ে উঠল ফায়ার ফায়ার । ততক্ষণে ফায়ার এলার্ম বাজতে শুরু করেছে ।

সেদিন তেল একটু বেশিই ঢেলেছিলাম পুরা সপ্তাহের রান্নার জন্য । তেল পুরাটা পুড়ে শেষ না হলে আগুন নিভবে না । তেলের আগুন পানিও দিতে পারছিনা ।কিন্তু বাসা তো কাঠের এর মধ্যে আগুন ধরে যেতে পারে । সুরিয়া বলল , আগে চুলাটা নিভাও । কিন্তু ভয়ে ও বস্তুর কাছে আমি যাচ্ছি না ।

সুরিয়াই চুলা নিভিয়ে গনগনে পাতিলটাকে মেঝেতে রাখল । তখনও দাও দাও করে আগুন জ্বলছে । সুরিয়া একটা চেয়ার নিয়ে গেল ফায়ার এলার্ম খুলতে । কিন্তু কিছুতেই সে পারছিলনা । তখন রাত ১২ টা বাজে । আমাদের ভয় হচ্ছিল ফায়ার ব্রিগেড না চলে আসে ।

আমাদের কলিং বেল ক্রমাগত বাজছে । বুঝতে পারছিলাম না, ফায়ার ব্রিগেডের লোক কিনা । দরজা খুলে দেখি , এপার্টমেন্টের সবাই চলে এসেছে । ভীষণ ফোলা আর উৎকণ্ঠা তাঁদের চোখে । আমেরিকানরা সাধারনত রাত আটটা নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে । আগুন ধরেছে ভেবে তারা কাচা ঘুম ভেঙ্গে ছুটে এসেছে ।

একজন বলল , ডু ইউ হ্যাভ ফায়ার ইন ইওর হোম ?ডু ইউ নিড টু কল ৯১১ ?

আমরা বললাম, কই নাতো , সেরকম কিছু নয়।

বিকট শব্দ করে ফায়ার এলার্ম তখনও বাজছে ।

(চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪৭
৩১টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×